- 25 December, 2020
- 0 Comment(s)
- 767 view(s)
- লিখেছেন : কুমকুম চট্টোপাধ্যায়
শীত পড়ি পড়ি এমন এক ভোরবেলায় উত্তরাদি চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। লেখাপড়ার প্রতি অসীম আগ্রহ, গাছপালার প্রতি একান্ত ভালোবাসা, ছোট্ট কেতকীর বেড়ে ওঠা নিয়ে স্বপ্ন, বেথুন কলেজের লাইব্রেরিতে আর একবার গিয়ে বসার আগ্রহ--এমন আরও কত ইচ্ছে, ভালোলাগা আর ভালোবাসার বন্ধনকে এক মুহূর্তে ছিন্ন করে দিয়ে নীরবে পাড়ি জমালেন সেই নির্দিষ্ট অথচ অচেনা পথে। পিছনে পড়ে রইল তাঁর কর্মময় জীবন, তাঁর অনেক আশা-নিরাশার ইতিহাসকে বুকে করে। কতশত মানুষের মনের সিন্ধুকে জমা করে গেলেন অজস্র স্মৃতির মণিমুক্তো। সেই সম্পদই বাঁচিয়ে রাখে--বাঁচিয়ে রাখবে অনন্ত পথের পথিক উত্তরা চক্রবর্তীকে।
অধ্যাপক, লেখক, গবেষক
উত্তরাদি ভালো ছাত্র ছিলেন। সেন্ট জনস্ ডায়সেশন স্কুলে পড়ার কারণে ইংরাজিতে খুব ভালো দখল ছিল। আবার ওঁর কথা অনুযায়ী ওই স্কুলে বাংলাটাও খুব ভালো শেখানো হত। তাই উত্তরাদি বাংলা ভাষাতেও রীতিমতো দক্ষ ছিলেন। সেই সঙ্গে ওঁর অসম্ভব সাহিত্যপ্রীতি ছিল। উনি ছিলেন ইতিহাসের ছাত্রী, আর আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের। দু-জনেরই নিজ নিজ বিষয়ের পাশাপাশি অদম্য সাহিত্যপিপাসা ছিল। কাছাকাছি আসার এটা ছিল একটা মস্ত বড়ো কারণ। অসুস্থ শরীরেও উত্তরাদি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে কথা বলতেন। রাত বেড়ে যেত। ছাড়তে চাইতেন না কিছুতেই। সেই সময় তাঁর তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তির পরিচয় পেয়ে আমি চমৎকৃত হতাম।
উত্তরাদি ছিলেন একাধারে শিক্ষক, লেখক এবং গবেষক। শিক্ষক উত্তরাদিকে চিনেছি ছাত্রীদের কাছ থেকে। বেথুন কলেজের ছাত্রীদের ইউসি ম্যাডামকে নিয়ে খুবই গর্ব ছিল। এক প্রতিষ্ঠিত ছাত্রীর কথায় জানতে পেরেছিলাম যে যারা ভবিষ্যতে গবেষণা করেছে উত্তরাদির অধ্যাপনায় তারা খুবই উপকৃত হয়েছে। আর একজন ছাত্রী বলেছিল যে উত্তরাদি ওদের স্বাধীনভাবে ভাবতে শিখিয়েছিলেন। আমি নিজে উত্তরাদির সাক্ষাৎ ছাত্রী না হলেও শিখেছি অনেক কিছু। আর্কাইভস্-এ গিয়ে পড়ার অভ্যাসটা উনি আমার মধ্যে তৈরি করে দিয়েছিলেন। বই সম্পাদনার অনেক খুঁটিনাটি আমি শিখেছি ওঁর কাছে। অবসর সময়ে আমার না-পড়া ভালো ভালো বই সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
উত্তরাদি ছিলেন একজন সফল প্রাবন্ধিক। অনেক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখেছেন। বেথুন বিদ্যায়তন, কলকাতার পুরোনো ইতিহাস, নারীশিক্ষা, মুসলিম নারীশিক্ষা ও তাদের ক্ষমতায়ন নিয়ে তাঁর বহু প্রকাশিত প্রবন্ধ আছে। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রবন্ধ আমি পড়েছি। এখন সব হয়তো সঠিক উল্লেখ করতে পারবো না। যে কটা লেখা আমার কাছে আছে তা উল্লেখ করে উত্তরাদির কত বিবিধ বিষয়ে পড়ার আগ্রহ ছিল তা বোঝাবার সামান্য চেষ্টা করেছি।
বেথুন কলেজের ১২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে যে স্যুভেনির প্রকাশিত হয়েছিল উত্তরাদির সম্পাদনায় সেটি বেথুন কলেজ বিষয়ে একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। সেখানে উত্তরাদি ‘বেথুনের মাঠ : ইতিহাসের সাক্ষী’ নামে একটি অসাধারণ গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ওই উপলক্ষেই বেথুন কলেজ থেকে প্রকাশিত দুটি মূল্যবান বই ‘In the Footsteps of Chandramukhi’ এবং ‘Women’s Education and Politics of Gender’ সম্পাদনা করেন উত্তরাদি, আর একজন বেথুন কলেজেরই অধ্যাপিকা বাণীমঞ্জরী দাসের সঙ্গে। দুটি বই খুবই জনপ্রিয় হয়। প্রথম বইটি নিঃশেষিত হয়ে যাওয়ার দরুণ কলেজ কর্তৃপক্ষ পুনর্বার বইটি প্রকাশের উদ্যোগ নেন। এখানে বেথুন কলেজের দু-জন প্রাক্তন অধ্যক্ষ Anne Louise Janau এবং Gertrude Marian Wright-কে নিয়ে খুব তথ্যসম্বলিত ও বিশ্লেষণমূলক দুটি প্রবন্ধ লেখেন। উত্তরাদির অভিজ্ঞতা ও পারদর্শিতার কথা চিন্তা করে দ্বিতীয়বার বইটি প্রকাশ করার সময় সম্পাদনার দায়িত্ব উত্তরাদিকেই দেওয়া হয়। বাণীমঞ্জরীদি রাজি না হওয়ার জন্য তাঁর জায়গায় আর একজন সম্পাদক হিসাবে আমাকে নিযুক্ত করা হয়। এই সময়কালে উত্তরাদির সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। আর এই সময়েই তাঁর গুরুতর অসুস্থতা ধরা পড়ে। কিন্তু সেই অসুস্থতাকে উপেক্ষা করে তিনি যে অনলস ও অখণ্ড মনোযোগে কাজটি সমাপ্ত করেন, তা আমাকে বিস্মিত করেছিল। তবুও প্রচুর চেষ্টা ও পরিশ্রমের পরেও যেটুকু ভুলত্রুটি থেকে গিয়েছিল তার জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। সপ্তাহে তিন দিন ধরে ডায়ালিসিস করিয়ে খুব অসুস্থ শরীরেও তিনি অপরিসীম ভালোবাসা ও উৎসাহ নিয়ে কাজটি করেছিলেন। এই পরিসরে আমি গবেষক, সম্পাদক ও লেখক উত্তরাদির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ উত্তরাদিকেও চিনতে শিখেছিলাম খুব কাছ থেকে। প্রতি মুহূর্তে ওঁর আন্তরিক স্নেহ আমাকে অভিষিক্ত করেছে। সেসব কথা মনে করলেই আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়।
বেথুন স্কুলের সঙ্গে উত্তরাদি কোনোদিন যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু ১৯৯৯ সালে বেথুন স্কুলের দেড়শো বছর পূর্তি উপলক্ষে বেথুন স্কুল প্রাক্তনী সমিতি একটি স্যুভেনির ছাড়াও তিনটি বই প্রকাশ করেছিল। তার মধ্যে প্রথম বইটিতে উত্তরাদির লেখা ‘নারীশিক্ষা ও সচেতনতা : ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে’ নামে একটি মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। এই লেখাটির মাধ্যমে বেথুন স্কুলের সঙ্গে উত্তরাদির একটি অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুনের জন্মসাল ও তারিখ খুঁজে বের করা ওঁর একটি বিশেষ অবদান। কারণ তার আগে পর্যন্ত বেথুন সাহেবের জন্মদিনটি অন্ধকারেই থেকে গিয়েছিল। বেথুন সাহেবের জন্মদিন ১২ জুলাই, ১৯০১ এই তথ্যটি উনি খুঁজে বের করার পর থেকে ওই দিনটি বেথুন স্কুল প্রাক্তনী সমিতির বেথুন স্মরণ ও পুনর্মিলন উৎসবের দিন হিসাবে চিহ্নিত ও পালিত হয়। এটি নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ লেখার মধ্যে মীরাতুন নাহার সম্পাদিত ‘দোলনচাঁপা’ পত্রিকার ষষ্ঠ বর্ষ , দ্বাদশ সংখ্যায় (জুন, ২০১৯) প্রকাশিত ‘এক অনন্য ব্যক্তিত্ব একটি সাহিত্য পত্রিকা ও একটি চিরকালীন মূল্যবান গ্রন্থ’ সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রেক্ষিতে লেখকের মুন্সিয়ানাকে তুলে ধরে।
‘পথচারী ঐতিহাসিক যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত’ উত্তরা চক্রবর্তীর লেখা একটি মূল্যবান বই। ব্রিটিশ আমলে যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত আঞ্চলিক ও জনজাতির ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে যে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন, সেখানে আলো ফেলে লেখক আমাদের বিশেষ কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। আমার কাছে বইটি আরও বেশি মূল্যবান কারণ বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরেই একদিন উত্তরাদি নিজের বাড়িতে বসে বইটি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। প্রথম পাতায় লিখে দিয়েছিলেন--“কুমকুমকে, স্নেহভাজনীয়াসু ছোট ভগিনীটিকে, উত্তরাদি, ২৬. ০৪. ২০১৮।" ওঁর সম্পাদিত আরও গুরুত্বপূর্ণ দুটি বই--এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত স্মারক গ্রন্থ Time Past and Time Present, 225 years of Asiatic Society এবং পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ থেকে প্রকাশিত ‘অশীন দাশগুপ্ত স্মারক বক্তৃতা সংগ্রহ : ইতিহাসের উপকূলে’।
অধ্যয়ন, অধ্যাপনা ও গবেষণার পাশাপাশি উত্তরাদির সাংগঠনিক ক্ষমতার স্বাক্ষর রয়েছে বেথুন কলেজের বিভিন্ন জায়গায়। বেথুন কলেজের ১২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে যে বর্ষব্যাপী অনুষ্ঠান চলেছিল সেখানে Bethune College Post-Centenary Silver Jubilee Celebration Committee-র যুগ্ম সম্পাদকের একজন হিসাবে গুরু দায়িত্ব পালন করেছিলেন উত্তরাদি। তা ছাড়া কলেজের আন্তঃশ্রেণি প্রতিযোগিতা অথবা কলেজ ফেস্ট ‘আলাপ’-এ বিতর্ক (Debate) প্রতিযোগিতায় ছাত্রীদের তৈরি করে দিতেন উনি। ২০০৩ সালে প্রথম বছর ফেস্ট-এর কথা তখনকার ছাত্রীরা এখনও খুব আবেগাপ্লুত হয়ে মনে করে। সেখানে উত্তরাদির খুবই ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। তা ছাড়া বেথুনের মাঠ খোঁড়াখুড়ির সময় যেসব পুরোনো ইট, পোড়ামাটির মূর্তি, বাসন, ঘট, ফলক, প্রদীপ ইত্যাদি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উঠে এসেছিল সেই ব্যাপারেও আমি ওঁর সক্রিয় উৎসাহ ও মনোযোগ লক্ষ্য করেছিলাম।
অন্তরঙ্গ উত্তরাদি
আমি নতুন ফ্ল্যাটে আসার পরে উত্তরাদি একদিন এসেছিলেন আমার কাছে। সেদিন আমার আরও কয়েকজন সহকর্মীর উপস্থিতিতে শীতের সুন্দর সন্ধ্যাটি জমে উঠেছিল। আমার জন্য উত্তরাদি খুব সুন্দর একটা শিফন জর্জেট শাড়ি এনেছিলেন। আমি জানি না কেন আমার প্রতি অতিরিক্ত প্রীতিবশত আমি যা করি তাতেই উনি খুশি হতেন। সেদিন আমার আয়োজন আর অভ্যর্থনার প্রশংসা করেছিলেন বারবার। আমার গলায় গান শুনতে খুব পছন্দ করতেন। আমার গাওয়া ওঁর প্রিয় গান ছিল ‘এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে’। একবার কলেজ পিকনিকে গিয়ে আমি এই গানটি গেয়েছিলাম। ওঁর এত ভালো লেগেছিল যে উনি প্রায়ই সে কথা বলতেন। শরতের এক সুন্দর দিনে আমাদের এক সহকর্মী সুমিতা মিত্র-র (বর্তমানে প্রয়াত) নতুন বাড়িতে গৃহপ্রবেশের দিন আমরা সব অধ্যাপিকারা আমন্ত্রিত ছিলাম। সেই আনন্দ-উৎসবে উনি আমার কাছে ‘হৃদয়ে ছিল জেগে’ গানটি শুনতে চেয়েছিলেন। তাঁর এই চাওয়ার মধ্যে এক গভীর অনুভব লুকিয়ে থাকত। আমার স্বরচিত কবিতাপাঠ বা আবৃত্তিও বার বার শুনতে ভালোবাসতেন। সবসময়ই যে ভালো হত এমনটা নয়। কিন্তু উনি ভালো বলে বলে বোধহয় আমার আত্মবিশ্বাস বাড়াবার চেষ্টা করতেন। অনেক উপহার দিয়েছেন আমাকে। জয় গোস্বামীর কবিতার বই থেকে শুরু করে আমেরিকা থেকে আনা বইয়ের ব্যাগ, বাংলাদেশের শাড়ি সবই আজ তাঁর স্নেহ-ভালোবাসার স্বাক্ষর বহন করে রয়ে গেছে আমার কাছে।
বেথুন কলেজের ১২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০৮ সালে Celebration and Chronicles : Bethune College 125 years প্রকাশিত হয়েছিল আমার ও অধ্যাপিকা সোনালি চক্রবর্তী সম্পাদনায়। এই বইটিতেও বেথুন কলেজ সম্পর্কে উত্তরাদির দুটি খুব মূল্যবান লেখা বেরিয়েছিল—The Archives at Bethune College এবং Looking back at a different History : Finding of Antiquities and Archaeological Excavations at Bethune College। অবসরপ্রাপ্ত উত্তরাদি তখন উপদেষ্টা হিসেবে আমাদের খুবই সহযোগিতা করেছিলেন। সেই সময় আমি কাজের সূত্রে একদিন ওঁর বাড়ি গিয়েছিলাম বিকেলবেলা। আমাকে নিজের হাতে লুচি ভেজে খাওয়াবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন উনি। সেই সময় অসতর্কতাবশত রান্নাঘরে আগুন ধরে যায়। আমরা তখন বসবার ঘরে বসে কথা বলছি। উত্তরাদি ময়দা মাখছেন কথা বলতে বলতে। হঠাৎ রান্নাঘর থেকে একটা আওয়াজ শুনতে পেয়ে আমরা দৌড়ে গিয়ে দেখি জ্বলন্ত গ্যাস, তার উপর বসানো তেলের কড়াই সেখান থেকে চিমনি ধরে গিয়ে আগুন ছাদ ছুঁয়ে ফেলেছে। মেন সুইচটা অফ করে জল ঢেলে অনেক কষ্টে আগুন নেভানো হল। সেই আগুনের হলকা উত্তরাদির কপালে ও চুলে এসে লেগেছিল। রান্নাঘর তখন এক ভয়ংকর চেহারা নিয়েছে। তখনও উত্তরাদি আমাকে বলে চলেছেন, “কুমকুম তোমার মাথা খুব ঠান্ডা আর খুব উপস্থিত বুদ্ধি”। আমি বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করি। সবসময় হয়তো পারিনা। কিন্তু ওইরকম একটা পরিস্থিতিতে এই কথা শুনে আমি বোধহয় অবাক হতেও ভুলে গিয়েছিলাম। তারপর যা ঘটলো তাকে ম্যাজিক বললেও কম বলা হয়। একটু সামলে নিয়ে উত্তরাদি পাশের ফ্ল্যাটে চলে গেলেন আমার জন্য লুচি ভাজতে। আমার কোনো আপত্তিকে গ্রাহ্যই করলেন না। এটা আমার একটা অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। তারপর বিস্তর খরচ করে রান্নাঘর সারানো হয়েছিল। ঘটনার সময় সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন উত্তরাদির পিসিমা ঝরনা গোরলে।
বই সম্পাদনার কাজে আমি প্রায়ই যেতাম ওঁর বাড়ি। যেদিনই যেতাম সেদিনই সামনের French Loaf-এর দোকান থেকে কেক-প্যাটিস আনিয়ে রাখতেন। সঙ্গে সুভাষদা মস্ত বড়ো কাপে করে চা এনে দিতেন। কোনো দিন সুভাষদা না থাকলে উত্তরাদিই উঠে চা করতেন। বারণ করলেও শুনতেন না। তখন অসুস্থতার কারণে উনি বাইরের খাবার তো খেতেনই না, উপরন্ত জল মেপে খেতে হয় বলে চা খাওয়াও চলতো না। আমার দারুণ অস্বস্তি হত ওঁর সামনে বসে খেতে। কিন্তু ওঁর জোড়াজুড়ির কাছে আমি পরাজিত হতাম।
উত্তরাদির একতলা ফ্ল্যাটের ভিতরের বারান্দার কাছে একটা ছোটো বাগান আছে। সেখানে কয়েকটা বড়ো বড়ো গাছও আছে। বাগানটা ওঁর খুব প্রিয় ছিল। সেখানকার একটা ইজি চেয়ারে বসে বই পড়া ছিল একটা দারুণ আনন্দের ব্যাপার।
আমরা দু-জন গল্প করে অনেকটা সময় কাটাতাম। সাহিত্য ছাড়াও বেড়ানো, সিনেমা, নাটক, গান সব কিছু নিয়েই আলোচনা হত। সেই আলোচনা আমাকে সমৃদ্ধ করতো। গত মার্চ মাস থেকে করোনা আবহে আর দেখা করা যেত না। ফোনেই প্রচুর সময় ধরে কথা হত। উনি কথা বলে ক্লান্ত হয়ে যেতে পারেন মনে করে আমি অনেক সময় হোয়াটস্অ্যাপে কথা বলতাম। ফোনের কথোপকথন রেকর্ড করে রাখা হয়নি। কিন্তু হোয়াটস্অ্যাপে দীর্ঘদিনের মেসেজ থেকে গেছে। সেই রেখে যাওয়া কথারা কী জীবন্ত! কত সুখের কথা, দুঃখের কথা, ভালোবাসার কথা, কত ছবি-গান-কবিতায় জমজমাট হয়ে আছে হোয়াটস্অ্যাপ। পেছনে যেতে যেতে চোখ আটকে গেল এক জায়গায়--May 3, 2020। উত্তরাদির লেখা একটি কবিতা, তার নাম নেই কোনো।
দৃশ্যপট বদলে যায়, এ শহর নিমেষে উধাও
অবিশ্রাম ঘুঘুর ডাকে।
কৈশোরের স্মৃতি ভেসে আসে, শৈশবও। ধূ ধূ
রোদে জ্বলা প্রান্তরের বট
ছায়া কাঁপে ঘুঘুর থেকে থেকে ডাকা।
জলচৌকির ওপর বই
আঙুলে বর্ণ চিনে চিনে
শব্দ, অক্ষরমালা কি যাদুতে
বাক্য তৈরি হয়
মনে গেঁথে থাকে ছবি লেখা--
“বেলা বাড়ে, হু হু হাওয়া বয়
মালি কুয়ো থেকে জল তোলে”--
অবিনশ্বর ঘুঘু ডাকে
সহজ পাঠের খোলা পাতা
উত্তরাদি : পড়ে দেখে বলো।
কুমকুম : অপূর্ব। খুব সুন্দর হয়েছে। আরও কবিতা চাই।
উত্তরাদি : Thank you Kumkum। তোমার প্রশংসা আমার পরম প্রাপ্তি।
আমার কাছে এই কবিতাটিই পরম প্রাপ্তি। জানি না উনি আর কোনো কবিতা লিখে গেছেন কি না।
শেষের কথা
দীর্ঘদিন ধরে সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালিসিস নিতে নিতে উত্তরাদির শরীর ক্রমশই দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল। তার উপর কোভিড ১৯ সংক্রমণ হয়ে দুর্দশা আরও বাড়লো। সেই করোনা হাসপাতালে থাকাকালীনও মাঝে মাঝেই আমার সঙ্গে ফোনে অল্পস্বল্প কথা হত। তখন বুঝতাম কথা বলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে উত্তরাদির। আমি শেষ ফোন করেছিলাম ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যেবেলা। উনি বললেন, “আমি আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলছি। হয়ে গেলে তোমাকে ফোন করবো”। কিন্তু সে রাতে আর ফোন করেননি। বুঝতে পারলাম কথা বলে ক্লান্ত হয়ে গেছেন। পরের দিন বেশ সকালের দিকে ফোন করলেন। আগের রাতে ফোন করতে পারেননি বলে মন খারাপ করছিলেন। আমি ওঁকে বুঝিয়ে বললাম যে ওঁর এখন বেশি কথা না বলাই ভালো। আমি দু-দিন বাদে ফোন করব। দু-দিন বাদে ভোরবেলায় উনি চলে গেলেন সবার অলক্ষ্যে। আমার সেদিন ফোন করার কথা ছিল। সেটা আর করা হল না। দু-জনেরই দু-জনকে অনেক কথা বলা বাকি রয়ে গেল। সেসব কথা আর কোনোদিনই বলা হবে না।
লেখক : অধ্যাপক, গবেষক
0 Comments
Post Comment