‘‌স্বাধীন মানুষ’‌ হওয়া মেয়েদের জন্য ব্রাত্য-ই! 

  • 20 May, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 2377 view(s)
  • লিখেছেন : সরিতা আহমেদ
কিছুদিন আগেই পেরিয়েছে মাতৃদিবস। সোশাল মিডিয়া ভেসে গেছে মায়ের বন্দনায়। মায়ের আত্মত্যাগ, সহ্যশক্তি ইত্যাদি নিয়ে গুচ্ছের শব্দ খরচ হয়েছে। প্রতিটি মা-দিবস এলে বোনের জন্মদিন এলে ছেলেরা ন্যাকাবোকা শব্দ খরচ করে ছবি দেয়। ব্যস, 'মেয়েছেলের' প্রতি এর চেয়ে বেশি দরদ কিসে! দুই ছেলের বিধবা মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে করার ইচ্ছেকে তাই মেনে নিতে না পেরে তার সোনার টুকরো ভাই পিস্তল বের করে দু রাউন্ড গুলি চালিয়ে দিল।

‘‌‘‌মেয়েটির দোষ ছিল দেড় বছরের বৈধব্যের পরে সে একজনকে জীবনসাথী হিসেবে পেতে চেয়েছিল। দুই ছেলের বিধবা মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে করার ইচ্ছেকে মেনে নিতে না পেরে তার সোনার টুকরো ভাই পিস্তল বের করে দু রাউন্ড গুলি চালিয়ে দিল। বুকে পিঠে গুলি খেয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে প্রতিবছর পরিবারের মঙ্গলকামনায় ব্রত করা, ভাইকে ফোঁটা দেওয়া, রাখি বাঁধা সেই ‘‌নির্লজ্জ’‌ দিদি।’‌’‌ দুর্গাপুর সুভাষপল্লীর ঘটনা। 

কিছুদিন আগেই পেরিয়েছে মাতৃদিবস। সোশাল মিডিয়া ভেসে গেছে মায়ের বন্দনায়। মায়ের আত্মত্যাগ, সহ্যশক্তি ইত্যাদি নিয়ে গুচ্ছের শব্দ খরচ হয়েছে। 
প্রতিটি রাখি, ভাইফোঁটা, জামাইষষ্ঠী, শিবরাত্রী অথবা করওয়াচৌথ এলে মেয়েরা নিয়ম করে ছেলেদের আয়ুরক্ষায় নিরম্বু উপবাস, ত্যাগ, ব্রত পালনে আত্মক্ষয় করে গুচ্ছেক পদ রাঁধে আর ভাবে আমাদের সেফটি-সিকিউরিটি এবার গ্যারেন্টেড বাঁধা। 
প্রতিটি মা-দিবস এলে বোনের জন্মদিন এলে ছেলেরা ন্যাকাবোকা শব্দ খরচ করে কোবতে সাঁটায়, ছবি দেয়। ব্যস, 'মেয়েছেলের' প্রতি এর চেয়ে বেশি দরদ কিসে!

যত দিন যাচ্ছে তত ‘‌মা-দিদি-স্ত্রী’‌ — শব্দগুলো ছেলেদের কাছে ‘‌হকের মাল বা নিজের সম্পত্তি’‌ নামে মগজে সেঁটে যাচ্ছে। মায়ের কাজ জন্ম দেওয়া, লালনপালন করা, রান্নাবান্না করা আর মুখ বুজে সন্তানের যাবতীয় খাতিরযত্ন করা। ছোটবেলায় দিদির কাজ ভাইকে রক্ষা করা, আর বোনের কাজ দাদার লেজুড়বৃত্তি করা। 
স্থান-কাল-ক্ষেত্রবিশেষে কখনো নারীর উপর দেবত্ব আরোপ করে মহিমান্বিত করা হয়, কখনো আবার ডাইনি শয়তানী অপয়া শব্দযোগে বদনামও করা হয়। লক্ষনীয় এইসব বদখত বিশেষণ কোনওভাবেই ম্যাসকুলাইন জেন্ডারে প্রযোজ্য হয় না। ডিক্সনারিতেই নেই। ক্লাইম্যাক্স আর এন্টিক্লাইম্যাক্সের মাঝামাঝি কোনো স্থানে মেয়েদের ঠাঁই নেই। তাকে সতী অথবা সীতা হতেই হবে। নয় মন্থরা। কী কাব্যে কী বাস্তবে, সর্বত্র নারীর জন্য অতিমানবী আর অমানুষীর চ্যালেঞ্জ থাকবে। 
দোষেগুণে সাধারণ ‘‌স্বাধীন মানুষ’‌ হওয়াটা যেন মেয়েদের জন্য চিরকালই ব্রাত্য! 
কারণ সাধারণদের নিয়ে কোনো মুখরোচক গল্প হয় না। কিন্তু মেয়েদের চরিত্র নিয়ে পাড়া থেকে পার্লামেন্ট অবধি মুখরোচক রগড় হবে না, সমাজ এমন ধৃষ্টতা দেখায় কেমনে!

নারী ‘‌মা’‌ হওয়ায় জীবনের বড় সার্থকতা খুঁজে পায়, বিয়ে না হলে ‘‌একলা জীবন বয়ে বেড়াবার’‌ জন্য নিজেরই কোনও খুঁত খুঁটিয়ে বের করে, অভিশপ্ত বলে আত্মগ্লানিতে ভোগে, একঘরে হয়ে গুটিয়ে যায়।
অন্যদিকে ছেলেদের ‘‌পিতা’‌ হওয়ায় বা ‘‌স্বামী’‌ হওয়ায় আলাদা করে সার্থকতা খোঁজার দরকার পড়ে না কারণ তারা ‘‌‘‌বাঁকা হোক তবু সোনার আঙটি’‌’‌র জাত। তবে তাদের একটা অলিখিত কিন্তু মারাত্মক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আপনা হতেই কাঁধে এসে পড়ে ‘‌‘‌বদচলন মেয়েছেলেকে টাইট দেওয়া’‌’‌। সে তার সম্পর্কে যেই হোক বা না হোক। উল্টো দায়িত্বটা কিন্তু মেয়েদের জন্য কদাপি আরোপিত নয়। —এই হচ্ছে আমাদের সামাজিক জ্ঞান যা আদিকাল থেকেই পরিবার পরিবেশের মাধ্যমে ছেলেমেয়েরা শিখেছে। 

তাই তো মায়ের কিম্বা দিদি কিম্বা বোনের বৈধব্য নিয়ে মড়াকান্না, শোককাব্য লেখা ছেলে, ভাইয়েরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না তাদের নতুন প্রেম, নতুন জীবন। কারণ সেটি তাদের শিক্ষামতে ‘‌‘‌বদচলন অওরাতে’‌’‌র লক্ষণ।

স্বামীর মৃত্যুর পরে স্ত্রীর বেঁচে থাকাটা আমাদের সমাজে ‘‌‘‌আহা-উহু’‌’‌ দুঃখবিলাস। সমাজ আমাদের মজ্জায় ঢুকিয়েছে ধর্ম-জাতপাত নির্বিশেষে বৈধব্য জিনিসটা নারীর জন্য শাস্তি, অভিশাপ। স্ত্রীহারা পুরুষের জন্য অবশ্য তা স্বস্তির, সহানুভূতির।
সুতরাং স্বামী মরলে স্ত্রীজীবন বৃথা,পতিত, অর্থহীন। কৃচ্ছসাধন করে দিনাতিপাত করাই বিধান। সবাই তখন বয়ষ্কা মহিলার বৈধব্য যন্ত্রণার ‘‌গতি লাগাতে’‌ প্রার্থনা করে ‘‌‘‌হরি দিন তো গেল, পার কর ওনারে’‌’‌।
অথচ একজন স্বামীহারা স্ত্রী যদি পরনির্ভরশীল না হন তবে দিব্যি নিজের ছন্দে জীবন চালাতে পারেন, তোফা বাঁচতে পারেন নিজের পছন্দগুলোকে লালন করে। এটা যতই যুক্তিযুক্ত হোক, বাস্তবে এমনটা হয় না। আর কালেভদ্রে যদি হয়ও তবে এরকমভাবে ইচ্ছেমতো বাঁচা মহিলাকে শুনতে হয়  চরিত্রহননকারী অশ্লীল কটূবাক্য।

একটা লোকের মৃত্যু তার সঙ্গীনীকেও নাড়িয়ে দেয়।— ‘‌আহা, উনি না হয় কিছুদিন আগেই গেলেন, তোমারও ডাক আসবে। এত প্রেমময় দাম্পত্য ছিল— বেশিদিন বিচ্ছেদ ঈশ্বরেরও সইবে না দেখ।’‌ সান্ত্বনা চালাচালি হয় মেসেজে। স্বামীহারা মহিলার জন্য এগুলোই ‘‌স্বাভাবিক’‌ সামাজিক বার্তা।

—‘‌‘‌মাত্র ৭দিনের বিচ্ছেদ। তমুকের পথেই অমৃতলোকে গমন ওমুকের’‌’‌ — কিছুদিন আগেই বিখ্যাত সাহিত্যিকজায়ার প্রয়াণে এরকম শিরোনাম ছেপেছিল নামজাদা সংবাদপত্র। আচ্ছা, উল্টোটা হলে কি এমন শিরোনাম দেখতে পেতাম?— একেবারেই না। মৃত স্ত্রীর পথে জ্যান্ত স্বামী হাঁটবেন— এ কী অলুক্ষুণে ভাবনা!! অসামাজিক অন্যায় চিন্তা। 

মনে মনে আমাদের সোনার টুকরো পুত্র-ভ্রাতা-ভাগ্না-জামাই সবাই ওই দুর্গাপুরের ববিতার ভাই আরজুর মতই। 

আধুনিক যুগেও সচেতন মুখোশে মানববাদী, লিঙ্গসাম্যের বিপ্লব করা  ‘‌মুখেন মারিতং জগৎ’‌ ছেলেরা চেতন-অবচেতনে হয়ে ওঠে দিদি-বোন-স্ত্রী-মায়ের কর্তা। 
বাড়ির ছোট-বড় সব মেয়েরই ‘‌‘‌চোখে জল, মুখে হাসি’‌’‌, ‘‌‘‌সর্বংসহা’‌’‌ ভাবমূর্তিটুকুই অক্ষুণ্ণ রাখতে চায় তারা। 
কাব্য গদ্য কবিতা সাহিত্য নাটক সিনেমা সবেতেই এই চড়া দাগের দুঃখবিলাস হিট হয়। অন্যথায় আজও সেসব বাতিল, ফ্লপ, রিজেক্টেড মাল।

বিদ্যাসাগর-রামমোহন কে ছিলেন, কী করেছিলেন সেসব ইতিহাস। বাস্তবটা হল সর্বক্ষণ আমাদের চারপাশে সতীদাহের আগুন ধিকিধিকি জ্বলে। অদৃশ্য নয় একেবারেই। আমরা ইচ্ছেকৃত চোখ বন্ধ করে থাকি বলেই দেখতে পাই না৷ 
অথবা দেখতে চাই না। 

হ্যাঁ দেখতে, দেখাতে চাই না বলেই তো আরেকটি খবরে চোখ আটকে রসিক হলদে দাঁত বের করে খড়কিকাঠি চিবুই। 
জিম্বাবুয়ের হারারে শহরের এক প্রাক্তন সেনাকর্মী মিসহেক নয়নডোরা যিনি ৬৬ বছর বয়সে ১৬টি স্ত্রী ও ১৫১ টি সন্তান নিয়ে নিদারুণ ফ্যামিলি প্ল্যানিং করছেন। 
সেই মনুষ্যেতরটির বাইট ‘‌‘‌বহুগামীতার এই প্রজেক্ট শুরু করেছিলাম ১৯৮৩-‌তে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চালিয়ে যেতে চাই। বেশি বয়সী থেকে অল্প বয়সী সব স্ত্রীকে যৌনসুখে খুশি রাখাই বর্তমানে আমার জীবিকা। টার্গেট ১০০ জন স্ত্রী ও ১০০০ টি সন্তান।’‌’ ছাপা হয়েছে ‘‌অক্লান্ত সেনানী’‌ শিরোনামে। হ্যাঁ বাংলারই নামজাদা সংবাদপত্রে।

সমাজ পুরুষদের ঠিক কী চেহারায় দেখতে অথবা দেখাতে চায়— তা প্রতিদিন বুঝিয়ে দিচ্ছে এরকম গণমাধ্যম, সমাজদর্পন।

ওই যে বললাম, সতী অথবা সীতা হওয়ার অগ্নিপরীক্ষার আগুনটা আজও  জ্বলছেই। সচেতনভাবে নিজেদের চোখ-কান বন্ধ রাখছি বলে, যুগ যুগ ধরে পাওয়া বিশেষণ— শক্তিময়ী দেবী-দুঃখবতী রমনী-সহনশীলা লৌহমানবী ইত্যাদি অতিমানবিক মোটাদাগের সেন্টিমেন্টাল জোব্বায় শরীর-মনকে আবৃত করে ফেলছি বলেই সেই আঁচ টের পাচ্ছি না।

‘‌অনার কিলিং’‌ কি ভিনদেশ থেকে উড়ে আসা হালফিলের আমদানি নাকি মশাই!
ও তো আমাদের শতবর্ষ ব্যাপী চলা ‘‌আপুন কা মাল, আপুন সামহালেগা’‌ কালচার। যাকে প্রতিনিয়ত জল-সার যুগিয়ে আমরাই মহীরূহ করে তুলেছি। সেটা ভুলে কেবল তাত্ত্বিক বিপ্লব মাড়ালে চলবে?

পুনঃপ্রকাশ।  প্রথম প্রকাশ ১৯মে  ২০২২ 

ছবি :‌ সংগৃহীত
লেখক :‌ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক

0 Comments

Post Comment