- 17 October, 2021
- 0 Comment(s)
- 459 view(s)
- লিখেছেন : ময়ূরীকা মুখোপাধ্যায়
এই লেখাটা যখন থেকেই লিখবো লিখবো করছি, তখন থেকেই এই প্রবাদটা কেমন যেন ঘুরে ফিরে আসছে। আসলে বাণিজ্য আর লক্ষ্মী, এই যুগলের সম্পর্ক সুপ্রাচীনকাল থেকে প্রদর্শিত, এবং প্রতিষ্ঠিত হলেও বহুলাংশে স্বীকৃত হয়তো নয়। তা সে যাই হয়ে থাকুক না কেন, শুরুতেই লেখকের পক্ষ থেকে বরং একটি ছোট্ট বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দিয়ে দেওয়াই ভালো যে, “কোনো প্রাচীন প্রবাদের তত্ত্বগত সারবত্তা প্রমাণ করা লেখকের উদ্দেশ্য নহে।” কিছুদিন আগে টেলিভিশনের সৌজন্যে একটি বিখ্যাত মিষ্টির এক মজার ইতিহাস জানতে পারলাম। কোনও এক সময়ে, কোনও এক মিষ্টি ব্যবসায়ী তথা ময়রা, তাঁর কন্যা সন্তানটির হাতে কিছুক্ষণের জন্য তাঁর দোকানটির দায়ভার দিয়ে যান। তাঁর সেই কন্যা সন্তানটি তখন নেহাতই খেলার ছলে, পাক করা ছানাকে লম্বা লম্বা করে গড়ে তেলে ছেড়ে দেয় ভাজার জন্য। এরপর বাবার বকুনির হাত থেকে বাঁচার জন্য সেই ভেজে রাখা ছানার আকারগুলোকে সে তাড়াতাড়ি রসে ফেলে দেয়।কিন্তু এতকিছু করেও অভিজ্ঞ ময়রার চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। ব্যবসার ক্ষতি আটকাতে, কিছুটা বাধ্য হয়েই সে সেই অজানা মিষ্টিগুলোকে বিক্রি করতে বসে। কিন্তু শাপে কিছুটা বরই হয়। আশ্চর্যজনক ভাবে ক্রেতাদের সেই মিষ্টি মুহূর্তেই মন জয় করে নেয়। উৎসাহী হয়ে তাঁরা সেই মিষ্টির নাম জানতে চাইলে ময়রা ভদ্রলোক বেশি সাত-পাঁচ না ভেবে, তাঁর মেয়ের নামটাই বলে দেন সটান। এখন এখানে দুটো প্রশ্ন আসে, সেই মিষ্টির নাম কি ? আর যিনি সেই মিষ্টির কারিগর, তিনিই বা কে ? উত্তর একটাই ‘নিখুঁতি’। মিষ্টি নিখুঁতিকে আর তারপর ফিরে তাকাতে হয়নি। যদিও ময়রার সেই ছোট্ট কন্যাসন্তান ‘নিখুঁতি’র খবর আমরা রাখিনি, তা সত্ত্বেও ব্যবসার ব্যাকরণে এই নামকরণের ক্ষেত্রে ‘ফেস-ভ্যালু’, ‘ব্র্যান্ডিং’, ‘মার্কেটিং’ এই সমস্ত শব্দদের ঠাঁই পেতেও কিন্তু বিশেষ অসুবিধে হয়নি, আর এই সমস্ত শব্দগুচ্ছদেরই আজ আমরা একটু নাড়িয়ে-চাড়িয়ে দেখবো।
সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৬১ সালে গোটা দেশে ১ থেকে ৬ বছর বয়সী প্রতি এক হাজার পুত্রসন্তানপিছু কন্যা সন্তানের সংখ্যাটা ছিল ৯৭৬। ৫০ বছর পরে ২০১১ সালে এই সংখ্যাটা কমে হয় ৯১৯। ১৯৬১ সালে এ রাজ্যে ১ থেকে ৬ বছর বয়সী প্রতি এক হাজার পুত্র সন্তানপিছু কন্যা সন্তানের সংখ্যা ছিল ১০০৮। আর ৫০ বছর পরে ২০১১ সালে এই সংখ্যাটা কমে হয় ৯৫৬। এখন মনে হতেই পারে হঠাৎ করে এই সংখ্যা-পরিসংখ্যানের কিই বা প্রয়োজনীয়তা আছে? বা উপরোক্ত ‘ব্র্যান্ডিং’, ‘মার্কেটিং’ ইত্যাদি ইত্যাদির সঙ্গেই বা এর কি সম্পর্ক? ঠিক এই দুটোকেই যুক্ত করে আজকে আমরা কয়েনের উল্টো পিঠটাতে একটু নজর ঘোরানোর চেষ্টা করবো। যে ভারতবর্ষে কন্যাসন্তানদের পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্য সভা-সমিতির আয়োজন করতে হয়, কানে কামড়ে সচেতনতা প্রচার করতে হয়, সেই ভারতবর্ষেই বিখ্যাত কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের ‘মুখ’ হিসেবে উঠে এসেছে বেশ কিছু নারী অবয়ব। পোশাকি ভাষায় যার নাম ‘ম্যাসকট’। আজকের আলোচনায় তাঁরাই আলোচ্য। আর তাঁদের উল্লেখযোগ্য হওয়ার মূলে যে সবসময় কোনো নিবিড় ইতিহাস জুড়ে আছে তা নয়। বরঞ্চ কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেগুলি নিছকই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু তাও ওই কন্যাসন্তান সংক্রান্ত সংখ্যা-পরিসংখ্যানের পাশে যদি সেই ‘ফিমেল ম্যাসকট’-দের ফেলা হয়, এবং তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা যায়, তাহলে নিশ্চিত ভাবে সেই সমস্ত ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
সালটা ১৯২৯, ভারতবর্ষে তখন সদর্পে ইংরেজ রাজত্ব চলছে। ব্রিটিশরাজত্বে জর্জরিত ভারতবাসী ‘ক্যান্ডি’, ‘বিস্কিট্’-এর কথা শুনলেও, তাদের চেখে দেখার কোনো অধিকার ছিল না। এমতবস্থায়, মোহনলাল দয়াল চৌহান নামে এক যুবক রীতিমতো একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটিয়ে ফেললেন। ইংরেজদের মুখাপেক্ষী না হয়ে ভারতবাসীকে লজেন্স আর বিস্কুটের স্বাদ দিতে, নিজেই জার্মানী থেকে পড়াশোনা করে এসে বানিয়ে ফেললেন অরেঞ্জ ক্যান্ডি আর গ্লুকোজ বিস্কুট। শুরু হল ‘পার্লে’-র জয়যাত্রা, আর কালক্রমে সেই ‘গ্লুকোজ’ শব্দই কাটছাঁট হয়ে দাঁড়ালো ‘জি’ তে। সৃষ্টি হল ‘পার্লে-জি’-র। আর পার্লে-জি বললেই অবধারিতভাবে চোখে ভাসে প্যাকেটের এক কোণের সেই ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটির ছবি। তাঁর পরিচয় নিয়ে অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা ঘুরে বেড়ালেও তার সমস্তটাই আদপে গুজব। আদপে এটি, ১৯৬০-এর দিকে মগনলাল দাহিয়া নামে এক শিল্পীরই তৈরি করা নিছকই এক সৃষ্টি। প্যাকেটের বিস্কুটের সঙ্গে, যার জনপ্রিয়তা সমানুপাতিক হারে আজও ক্রমবর্ধমান।
মতামত ব্যক্তিগত হলেও সব চরিত্র কিন্তু মোটেই কাল্পনিক নয়। আশি-নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়কে যদি কেউ শব্দ দিয়ে মনে রাখেন, তাহলে তাদের কাছে দূরদর্শনে সম্প্রচারিত হওয়া মহাভারত আর তার মাঝে সম্প্রচারিত হওয়া, একটি বিশেষ বিজ্ঞাপন বিরতির শীর্ষ সঙ্গীত নিঃসন্দেহে কানে লেগে থাকবে। শুধু তাই নয়, হলফ করে বলতে পারি এখনও অনেক বাড়িতে সেই বিশেষ প্রোডাক্টটি নিয়মিত ব্যবহৃত হয়। কি সেই বিজ্ঞাপন ? আর কিই বা সেই প্রোডাক্ট? উত্তর হিসেবে সেই শীর্ষ সঙ্গীতটির দু-এক লাইন উদ্ধৃত করতেই পারি,
“দুধ সি সফেদি নিরমা সে আয়ি, রঙ্গিন্ কাপড়া ভি খিল খিল যায়ি …”
আজ্ঞে ঠিকই ধরেছেন। ব্যবসায়িক দিক থেকে, বা দামের দিক থেকে ওঠা-পড়া থাকলেও বছরের পর বছর প্যাকেটের সেই সাদা ফ্রক পরিহিত বাচ্চা মেয়েটি সমানভাবে জনপ্রিয়তার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে।
গুজরাটের বাসিন্দা কার্সানভাই পটেল ছিলেন গুজরাট সরকারের খনিজ ও ভূতত্ত্ব বিভাগে কর্মরত। ‘নিরমা ডিটারজেন্ট পাউডার’ তাঁরই মস্তিস্ক প্রসূত। কিন্তু ‘নিরমা’ এই বিশেষ নামটির পিছনে একটি গল্প থাকলেও সেটা সত্যি। এই কার্সানভাই পাটেলের একমাত্র কন্যা ছিলেন নিরুপমা পাটেল। কার্সানভাই তখন চেষ্টা করছেন নিজের সমস্ত অভিজ্ঞতা, পড়াশোনাকে একসাথে জুড়ে সস্তার একটি ডিটারজেন্ট পাউডার প্রস্তুত করতে। সফলও হয়েছেন অনেকাংশে। বাড়িতে বাড়িতে সাইকেলে করে বিক্রি করছেন সেই নাম না জানা ওয়াশিং পাউডার। ঠিক সেই সময়, খুবই কম বয়সে কার্সানভাইের একমাত্র আদরের কন্যা নিরুপমার দুর্ভাগ্যজনক ভাবে একটি অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়। ভেঙে পড়েন কার্সানভাই। পণ করেন, তাঁর মেয়েকে আজীবন বাঁচিয়ে রাখবেন তাঁরই আবিষ্কারের মাধ্যমে। বাড়িতে নিরুপমার আদরের নাম ‘নিরমা’ দিয়েই নামকরণ হয়, সেই নতুন ডিটারজেন্ট পাউডারটির। আর প্যাকেটে কিংবা বিজ্ঞাপন বিরতিতে ‘ব্র্যান্ড ম্যাসকট’ হিসেবে ঠাঁই পেয়ে যায় সাদা ফ্রক পরিহিত নিরুপমার আসল ছবি। ভারতবাসীর ঘরে ঘরে আজীবন অমর হয়ে থাকলো ‘নিরমা’, এইভাবেই।
ঝরঝরে ধোঁয়া ওঠা ভাত, মুচমুচে ভাজা পেঁয়াজ, শুকনো লঙ্কা দিয়ে মাখা আলুসেদ্ধ। আর সাথে এক কোণে উঁকি মারছে ফুটফুটে একখানা হাঁসের (!) ডিম। এই সবকিছুর সঙ্গে একটু মাখন হলেই …
আর এই মাখন বলতেই মনে পড়ে, “আসলি মাখ্খান দেশ কা মাখ্খান” – আমুল বাটারের কথা। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, ভারতবর্ষের এ হেন কোনো প্রান্ত নেই যেখানে আমুল বাটার চাখা হয়নি। আমুলের পত্তন ভারতবর্ষের দুগ্ধ শিল্পের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। যে ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল, ১৯৪৬ সালে ত্রিভুবনদাস পটেল এবং ভার্গিস কুরিয়েন-এর হাত ধরে। কালক্রমে আমুলের উড়ান জারি থাকলেও, ১৯৬৬ সাল নাগাদ প্রোডাক্টটিকে ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার তথা ‘ব্র্যান্ডিং’-এর প্রয়োজনীয়তা তারা অনুভব করলো। প্রাথমিকভাবে তাঁদের লক্ষ্য ছিল এমনভাবে সেই কাজটি করার যাতে করে বাড়ির গৃহিণীরা সহজেই তার প্রতি আকৃষ্ট হন। সেই কারণেই আমুলের ব্রান্ড ম্যাসকট হিসেবে নির্বাচিত হল একটি বাচ্চা মেয়ে। আর এই মোক্ষম কাজটি করার দায়ভার বর্তালো মুম্বাই এর একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার ওপর। ইউস্টেস ফার্নান্ডেজ নামের এক চিত্র-পরিচালকের হাত ধরেই পৃথিবীর আলো দেখল ‘আমুল-গার্ল’। যার পরনে রইলো লাল-সাদা ববি প্রিন্টের ফ্রক, মাথার চুল কাল্পনিক ভাবে কিছুটা নীলচে, মুখ-চোখের লোভনীয় দৃষ্টি আর হাতে সেই অমোঘ জুটি পাঁউরুটি আর মাখন। আমার আপনার ভাতের শুরুতে মাখন থাকুক বা না থাকুক, সেই শুরুর দিন থেকেই কিন্তু আমুল-গার্লের জনপ্রিয়তা শীর্ষে থেকেছে।
আর ইদানীংকালে এই বিজ্ঞাপনের সঙ্গে যখন নারীরা চরিত্র হিসেবে জুড়ে যায় তখন মুখ ঢাকা তো দূরস্ত, মুখ লোকাবারও উপায় থাকে না। প্রাসঙ্গিকের বদলে বাড়াবাড়ি রকমে (আদিমতম উপায়ে) নারীদেহকে আর্কষণীয় করে তোলার প্রবণতাই সেখানে বেশি পরিলক্ষিত হয়। তবে শুরুতেই বলা হয়েছে কয়েনের উল্টো পিঠে চোখ রাখলে দেখা যাবে, সেখানে রয়েছে নিখাদ কল্পনা আর ঘটনার সংমিশ্রণে তৈরি হওয়া বেশ কিছু শিল্পের নিদর্শন। যেখানে দিনের শেষে কোথাও না কোথাও গিয়ে মিশে থাকে ভালোলাগা, স্মৃতিমেদুরতা, শৈশব। নারীত্ব সেখানে কেবলই পণ্যে পরিণত হয়নি। তাই দৃশ্যদূষণের কোনও সম্ভাবনা বা আশঙ্কাও থাকেনি। পরিশেষে তাই এই আবেদনটুকুই বোধহয় রয়ে যায় যে, এ যুগ বিজ্ঞাপনের হলেও, আমরা যেন বিজ্ঞাপন-সর্বস্ব না হয়ে উঠি। বাস্তব আর বিজ্ঞাপনের মাঝের সূক্ষ্ম বিভাজনটুকু যেন বিকৃত না হয়, বরং স্বাভাবিক নিয়মেই তা সুন্দর হয়ে উঠুক, স্বাভাবিক হয়ে উঠুক, নান্দনিক হয়ে উঠুক।
0 Comments
Post Comment