- 29 January, 2022
- 0 Comment(s)
- 429 view(s)
- লিখেছেন : মলয় তেওয়ারী
দেশজুড়ে প্রতিরোধী জাগরণে মেয়েরা সামনের সারিতে। সাত বছর আগে বেখৌফ আজাদীর আন্দোলনে যে আত্মঘোষণা জারি হয়েছিল তা থেমে যায়নি। হিন্দুত্ব রাষ্ট্রবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে নির্ভয় আত্মবিশ্বাস ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়েছে, প্রবল শক্তি নিয়ে উৎসারিত হয়ে ওলোটপালট করে দিচ্ছে স্বভাবসিদ্ধ ধ্যানধারণাকে; ঘোষণা দিয়েছে: “মেয়েরা ধ্বংস করবে হিন্দুরাষ্ট্র”। ক্যাম্পাস থেকে চলতি বাস, রাজপথ থেকে ময়দান— মেয়েরা চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে, পথ দেখাচ্ছে, মত বানাচ্ছে, মানুষ জাগাচ্ছে।
২০১৯-এর ১৫ ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার সামনে আঙুল উঁচিয়ে রুখে দাঁড়াতে দেখা গেল একজনকে। কলকাতায় যাদবপুর এইটবিতে বিজেপির ভরাট সভায় বিদ্বেষপূর্ণ ভাষণ কানে যেতেই পথচলতি একা একজন তৎক্ষণাৎ স্টেজের পাশে গিয়ে সরাসরি ধিক্কার জানাতে শুরু করলেন। দিল্লির লাজপৎ নগরে অমিত শাহর মবমিছিলের সামনে দেখা গেল নিজের নিজের বাসাবাড়ির ব্যালকনি থেকে বিরোধিতার ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে আছেন দুজন। কলকাতার বাঘাযতীন এলাকায় প্রচারশেষে আরএসএসের গুন্ডা বাহিনীর আক্রমণের মুখে রুখে দাঁড়িয়ে একজন হামলাকারীকে ধরে তুলে দেওয়া হল পুলিশের হাতে। প্রতিরোধে এঁরা সকলেই বিভিন্ন বয়সী মেয়ে। জেএনইউ ক্যাম্পাসে আক্রান্ত ও রুখে দাঁড়ানো ছাত্রীদের পাশে পেশাগত স্বার্থ নস্যাৎ করে ছুটে আসেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী। কলকাতা থেকে দিল্লি, প্রত্যক্ষ প্রতিরোধে দৃঢ়তার একক মাত্রা যুক্ত করলেন যাঁরা তাঁরা সকলেই নারী। দেখতে দেখতে শাহিনবাগ গড়ে উঠল। শাহিনবাগ ছড়িয়ে পড়ল কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে, এলাহাবাদের মনসুর আলি পার্কে, গয়ার শান্তি বাগে— দেশের চল্লিশটিরও বেশি শহরে। নব্বই বছরের বৃদ্ধা থেকে শুরু করে কোলের শিশু— চার প্রজন্ম সামিল। ছাত্রী, অ্যাক্টিভিস্ট, শিক্ষিকা, বিভিন্ন পেশাজীবি মহিলা, গৃহবধূ, মা-ঠাকুমা-দিদিমা— বিজেপি-আরএসএসের বিধ্বংসী এজেন্ডার গ্রাস থেকে ভারতের সংবিধান ও ভারতের গণতন্ত্রকে বাঁচানোর লড়ায়ে সামনের সারিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েরা গভীরতর বিস্তারে নতুন গণতন্ত্রের পরিসর রচনা করছে সন্তর্পনে।
সাবিত্রী ফুলে, ফতিমা শেখ, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ফুলো মুর্মু বা ঝানো মুর্মুদের নামে জয়ধ্বনি আগে এভাবে শোনা যায়নি কখনও। কলকাতায় এই প্রথম মেয়েরা মেয়েদের ডেকেছিল শহীদ মিনারে জমায়েত হয়ে আরএসএস কার্যালয় অভিমুখে অভিযানে। বেশ কয়েকশ মেয়ে দীর্ঘ মিছিল করে কেশব ভবনের সামনে গিয়ে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসে হিন্দুত্ব-রাষ্ট্রবাদীদের। এইটবি, বাঘাযতীন, বিক্রমগড়ে — বিজেপির প্রতিটি হামলার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ ও পরবর্তী কর্মসূচির মূল উদ্যোক্তা থেকেছে মেয়েরা। তেমনই আবার ধর্মতলা নিউ মার্কেটে সন্ধ্যার ব্যস্ত রাস্তায় হঠাৎ করে শতাধিক মেয়ে নেচে নিলেন, গেয়ে নিলেন—আজাদী। পথ চলতি মানুষের মাঝখান থেকে হঠাৎ করে একত্রিত হয়ে নিজেদের নৃত্যরত শরীরের ছন্দের তালে তালে তাঁরা চিৎকার করে বলছিলেন, “তুমিই ধর্ষক... আর ধর্ষক, ওই পুলিশ। আর আদালত। এই দেশ। ব্রাহ্মণ্যবাদী। ধর্মান্ধ। মৌলবাদী। হোমোফোবিক। ট্রান্সফোবিক। ফ্যাসিবাদী। হিন্দুরাষ্ট্র। মোদী সরকার।” তাঁদের পরনের বিবিধ পোশাকে লেখা ছিল, “ইউপি পুলিশ গো ব্যাক”, “শাড়ি কপড় খুলব না, কাগজ দেখাব না”, “সিএএ, এনআরসি, এনপিআর, টিজিএ মানছি না”। টিজিএ বা ট্রান্স জেন্ডার অ্যাক্টে রূপান্তরকামী প্রমাণ করতে যৌনাঙ্গ পরীক্ষা করার বিধান আর এনআরসিতে নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্য বাপ-ঠাকুদ্দার ঠিকুজিকুষ্ঠি বের করা— এই দুইয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বাভাবিকভাবে মিলে যায়। ধর্ষণ ও যৌন হিংসা কেবল ব্যক্তিপরিসরে সংঘটিত অপরাধ নয়, বরং রাষ্ট্রব্যবস্থার ধচন সেই অপরাধের অন্যতম ভিত্তি রচনা করে, পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে ওঠে ধর্ষণ ও যৌন হিংসা। এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে থেকেই এই বার্তা ছড়িয়ে দেয় মেয়েদের হঠাৎ-প্রতিবাদ।
মিছিল ও সমাবেশের চরিত্র বদলে যায় বিপুল সংখ্যক মহিলার অংশগ্রহণে। শয়ে শয়ে ছাত্রী রাজপথের প্রতিটি মিছিলে বা গণ সমাবেশের ভেতরে সকলের লিডার হয়ে উঠছে। সকলের সম্ভ্রম অর্জন করে নিচ্ছে তাঁদের আন্তরিক শ্লোগান ও বক্তব্য। তাঁদের শ্লোগানগুলি শত্রু পক্ষের বিরুদ্ধে নিস্ফল আক্রোশ প্রকাশে সীমাবদ্ধ নাই। বরং তা উপস্থিত সকলের আত্মসমীক্ষা আর প্রতিজ্ঞায় উত্তরিত হচ্ছে। ফৈজ আহমেদ ফৈজ যেমন তাঁর “হম দেখেঙ্গে” কবিতায় আল্লাহর দরবারে শেষ বিচারের চির অধরা স্বপ্নকে জনতার দরবারে বৈপ্লবিক উত্থানের আশু সম্ভাবনার সাথে একাত্ম করে তোলেন, তেমনই, নাগরিকত্ব আইন সংক্রান্ত আশু লক্ষ্যের গভীরে “নারীমুক্তি সবার মুক্তি” বার্তা জাগিয়ে তুলছে মেয়েরা।
ভারতে নারীমুক্তি আন্দোলনের নির্ধারক প্রস্থানবিন্দু হল ঘর/বাহির, আধ্যাত্মিক/জাগতিক, ব্যক্তিগত/রাজনৈতিক দ্বি-বিভাজনের লছমণরেখাকে চ্যালেঞ্জ জানানো; সমাজে প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গনির্দিষ্ট ভূমিকাভাগকে ক্রমাগত অতিক্রম করে চলা। অগ্রণী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির খোলামেলা পরিবেশে মেয়েরা ভারী সংখ্যায় পৌঁছে যাওয়ার পর, দিল্লিতে পড়তে আসা এক ছাত্রীর ওপর হিংস্র বলাৎকারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে, একাডেমিক চর্চার গণ্ডি পেরিয়ে গণ আন্দোলনের ময়দানে মূর্ত হয়ে ওঠে পিতৃতান্ত্রিক দ্বি-বিভাজনকে চ্যালেঞ্জ জানানোর স্পর্ধা। কিন্তু তখনও পর্যন্ত তা ছিল মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের অভিব্যক্তি। বর্তমান আলোড়নে তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছেন সেইসব মহিলারা যাঁদের এতদিন ইতিহাসের ওপারের অদৃশ্য এক জগতের অভিব্যক্তিহীন বাসিন্দা হিসেবেই ভাবা হয়েছে।
নিজেদের অভিব্যক্তি জাহির করা, পোষাক ভাষা বা আচরণের লিঙ্গ নির্ধারিত ভূমিকা ভেঙে ফেলা সেইসব ক্রুদ্ধ মেয়েরা এসে দাঁড়ায় লছমনরেখার ভেতর থেকে দলে দলে উঠে আসা “মা-বোন”-দের পাশে। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া শাহিনবাগে অথবা পার্ক সার্কাস ময়দানে। পরস্পরকে দেখেন তাঁরা। উড়নচন্ডি লক্ষ্মীছাড়া এবং সাধ্বি সংসারব্রতীদের পরস্পরের সাথে এভাবে বোধহয় আগে কখনও দেখা হয়নি। এতদিন একে অপরকে অবিশ্বাস আর করুণার চোখে দেখে এসেছে তারা। সংসার ধারণ করে থাকা মায়েরা আশঙ্কা ও সন্দেহে দূর থেকে দেখেছেন সীমানা পেরনো মেয়েদের, ভয় পেয়েছেন— সংসার বুঝি টলে যায়। সংসার টলে যাওয়ার ভয়েই, নিজের সন্তানসন্ততিদের ভবিষ্যৎ টলে যাওয়ার আশঙ্কাতেই এখন রাজপথে এসে তাঁরা দেখছেন তাঁদের সংসারগুলো বিশ্বসংসার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। আর দেখছেন, তাঁরা যদি নিজ নিজ পরিবারের ধাত্রী হন তাহলে সীমা অতিক্রম করা ওই ক্ষিপ্ত বিদ্রোহী মেয়েগুলো আসলে জগতের ধাত্রী। মেয়েদের মুখে— হ্যাঁ বলার আজাদী, না বলার আজাদী, বিয়ে করার আজাদী, না করার আজাদী, সাথি বাছার আজাদী, না বাছার আজাদী— শ্লোগান আর তেমন সমস্যাজনক ঠেকছে না মায়েদের কানে, সোৎসাহে গলা মেলাতে শুরু করছেন তাঁরা।
উল্টোদিকে, নির্ভয় স্বাধীনতার আন্দোলনে পোড় খাওয়া মেয়েরা আবিষ্কার করছে, এতদিন যাদের পরিবারবদ্ধ দশাকে করুণার চোখে দেখেছিল তারা, সেইসব নারীদের বুকে একই আজাদীর স্বপ্ন, একই বিদ্রোহের স্পর্ধা খেলা করে। বহু যুগের ওপার থেকে উঠে এসে ঠাকুমা-দিদিমা-রা প্রেস মিটে, বিবৃতিতে, ভাষণে নব প্রজন্মের মনের কথা বলতে শুরু করেছে। পুরুষতন্ত্রের দৈনন্দিন অন্যায়ে ক্ষিপ্ত বিরক্ত বিদ্রোহীরা যেন এখানে এসে পৌরুষের আস্ফালনের বিপরীতে এক স্নিগ্ধ স্থিতিশীল ও দৃঢ় প্রতিরোধের ভাষা ও শক্তির সন্ধান পাচ্ছে। তাঁদের কথা ছড়িয়ে পড়ছে। শাহিনবাগে ধরনায় বসা ৪৩ বছর বয়সী গৃহবধূ নুসরত আসরা বলেন, “স্বামী প্রথমে বাধা দিলেও এখন বুঝছে কেন আমি এখানে পড়ে থেকে লড়ছি। আমি কোনকিছুকে ভয় পাচ্ছি না। আমি পুলিশের ভয়, লাঠি খাওয়ার ভয় পাচ্ছি না। আমি শুধু আজাদীর জন্য এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। আমরা কোনও ঈশ্বর আল্লা বা কোনও রাজনৈতিক দলের হয়ে লড়ছি না, আমরা আমাদের অধিকারের জন্য লড়ছি। আর, আমি আমার ১২ বছর বয়সী মেয়েকেও প্রতিদিন এখানে নিয়ে আসছি রুখে দাঁড়িয়ে নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করা শেখাতে”।
উচ্ছেদের জ্বালা সব মেয়েই বোঝে। নারী পরিযায়ী, বাপের ঘর থেকে উচ্ছেদ হয়ে শ্বশুরঘর করতে যেতে হয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয় হোক বা রাজনৈতিক বিপর্যয়— ছিন্নমূল পরিবারের দুর্ভোগ মেয়েদেরই পোহাতে হয় সবচেয়ে বেশি। ঘরেবাইরে প্রতিকুল পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করে এগোতে এগোতেও প্রতি মুহুর্তে বাদ পড়ার বিপদে থাকতে হয়। তাই বহু মানুষকে রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে বাদ দেওয়ার মেগা প্রজেক্টের বিরুদ্ধে মেয়েরা স্বভাবতই সংবেদনশীল। আরও গভীরে রয়েছে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র তথা পিতৃতন্ত্রকে রুখে দেওয়ার যুগসঞ্চিত অদম্য আকাঙ্খা। কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বিজেপি-আরএসএস হিন্দুত্বের এজেন্ডা যত এগিয়ে নিয়ে গেছে তত প্রকট হয়েছে নারীবিরোধী হিংস্র পৌরুষের নির্মাণ। নারীসমাজ তাই সর্বস্ব নিয়ে রুখে দাঁড়িয়ে নতুন গণতন্ত্রের পরিসর নির্মাণ করতে নেমেছে।
সৌজন্য দেশব্রতী বিশেষ সংখ্যা, জানুয়ারি ২০২০।
লেখক : সমাজকর্মী
ছবি : সৌজন্য ইন্টারনেট
0 Comments
Post Comment