আসুক তোর বাবা আজকে

  • 04 December, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1438 view(s)
  • লিখেছেন : রোশন কুমার
পুরো একটা প্রজন্ম মাকে নিয়ে ট্রোল পেজ করে কাটিয়ে দিল। মায়ের জন্য মাতৃ দিবসে কেক আর অন্যদিন ‘‌চুপ করো তো’‌— এর পরিবর্তন সন্তানদের যেমন করতে হবে, তার থেকেও বেশি মায়েদের করতে হবে।

পাঠক বাঙালি না হলে এই শিরোনাম বোঝা একটু মুশকিল। তবে এটা অন্য কোনো ভাষায় অনুবাদ করলে সেই ভাবটা থাকবে না।

শিরোনামের উক্তি ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি এই ধরনের কথা বা কমন ফ্রেজ আছে। যেমন ‘‌তুমি চুপ করো তো’‌, ‘‌কি করো কি সারাদিন’‌, ‘‌আমি ওসব বুঝি না, তোমার দাদা কে বলো, ও ওসব দেখে’‌। এই তালিকার শেষ নেই। এবার ব্যাপারটা হল, এগুলোতে কমনটা কী? উত্তর ‘‌মা’‌।

কী? মাকে নিয়ে এসব আলোচনা পরিচিত ঠিক মাতৃদিবস টাইপ শোনায় না, তাই না?

একদমই ঠিক। তবে, এই বাক্য বা উক্তিগুলোর সাংঘাতিক কুপ্রভাব আছে।

১. সন্তানের বেড়ে ওঠা ও তার চরিত্র গঠনে।

২. মায়ের ইমেজ বা in general.‌

মা কনসেপ্টটাকে সন্তানেরা কীভাবে দেখবে তার উপরেও।

ঘটনা হল, এইসব উক্তির, সব যে মা নিজে ছাড়া অন্য কেউ করছেন, একদমই তা নয়। যেমন এই ধরুন শিরোনামটাই দেখা যাক। আমরা সবাই নিজের মায়ের কাছে না হলেও বন্ধুর মাকে বলতে শুনেছি, ‘‌আসুক আজকে তোর বাবা!’‌

এখন ধরে নিচ্ছি এই উক্তির সঙ্গে আপনি খুব বেশি পরিচিত নন। একটা কনটেক্সটের জন্য বলছি। এই বাক্যটি কিছু মা স্কুল থেকে ফেরার সময়, সাঁতার, আঁকার স্কুল, নাচের স্কুল ইত্যাদি থেকে সন্তানকে নিয়ে ফেরার সময়— সেদিনের তার সন্তানের কী কী কমতি ছিল সেগুলো বিচার করার সময় বলেন।

এবার তাহলে আসা যাক, ‘‌কেন’‌? এই প্রশ্নে। কেন মায়েরা এই কথা বলবেন? সব থেকে আবশ্যিক হল— মা বকবেন, মারবেনও, তবে জিম্মাদারি অথবা সন্তানের বিরুদ্ধে আঁকার স্যারের বা নাচের আন্টির নালিশের পরিপ্রেক্ষিতে কী করতে হবে সেই সিদ্ধান্তটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মায়েরা নেবেন না।

প্রশ্নটা এখানেই—কেন নেবেন না? কেন বাবা আসার পরেই ‘‌তোর আজ কী হয়!’‌ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন? এই প্রশ্নের উত্তর মূলত সবারই জানা। বাবা গৃহস্থের মুখ্য। ভালো হলে, ফার্স্ট হলে, মেডেল পেলে, সন্তান বাবার। বিগড়ে গেলে, নেশা-‌ভাং করলে অথবা ‘‌মাথাটায় কিছু না ঢুকলে—সন্তানের এই না পারাগুলোই পুরোটা এসে পড়ে মায়ের ঘাড়ে। ‘‌সারাটা দিন কি কর? এখানেই এসে যায় এই দ্বিতীয় উক্তিটি। এই উক্তির বক্তা কে এটা বুঝতে কারও অসুবিধা নেই।

এবার আসা যাক মূল বিষয়ে। মাকে বলা অথবা মায়ের বলা এই উক্তিগুলির প্রথম প্রভাবের দিকে।

১. যখনই মা বলছে ‘‌বাবাকে জিজ্ঞেস কর’, ‘‌বাবা বাড়ি আসুক তোর হবে’‌, সঙ্গে সঙ্গে সন্তান দুটো জিনিস শিখছে। এক, মায়ের ক্ষমতা সীমিত, মা বকবে কিন্তু বাবাই সিদ্ধান্ত নেবে। দুই, এর আরেকটা সুদূর প্রসারী প্রভাব হবে, সেই সন্তানের নিজে বাবা/মা অথবা সঙ্গীর প্রতি ব্যবহারে।

এই সম্পর্কিত আমার একটি ব্যক্তিগত খুব অদ্ভুত অভিজ্ঞতা আছে। তখন আমি পড়ি ক্লাস সিক্স কিংবা সেভেনে। পরীক্ষা দিতে ঢুকবো, স্কুলের সামনে এক বন্ধুর মা তাকে বলছেন ‘‌বাবাকে বলব? এসব করছিস?’‌ পরীক্ষা শেষ হলে বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, বন্ধু আই ব্রাও প্লাক করতে গিয়েছিল, আরেক বন্ধুর সঙ্গে, বাড়িতে না জানিয়ে। আমার মাথায় এলো দুটো প্রশ্ন।

১.‌ ওর মা ওকে অদ্ভুত একটা ব্ল্যাকমেল টাইপের বকছিল কেন? দুই, বাবাকে না জানানোর অপশনও নিশ্চয়ই আছে। বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, হ্যাঁ আলবাত আছে। আর করবে না কথা দিয়েছে। মায়ের সঙ্গেই পার্লারে যাবে। এর থেকে আমি কী উপলব্ধি করলাম?

কোনও শাস্তির ভয় হল?, এরকম একা একা যারতার সঙ্গে চলে গেলে কী কী হতে পারে, তা জানল মেয়েটি? না। শুধুই একটা জিনিস ওর মাথায় গেঁথে গেছে। ‘‌বাবা যতক্ষণ না জানছে, অপরাধ নয়’‌। এই বন্ধুই আরো ক বছর পরে একদিন বলেছিল ‘‌তুই বুঝবি না রে, তোর মাকে তো কাউকে কৈফিয়ত দিত হয় না।’‌

কারণ, প্রথমত বাবা বেঁচে নেই, দ্বিতীয়ত, মা চাকরি করেন।

যদিও এখানে খুব বড় উল্লেক্ষ্য একটা ব্যাপার, চাকরি করেও, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থেকেও, অনেক মা ‘‌টাকা পয়সার দিক ওর বাবাই দেখে’‌ বলছেন। অন্য দিকে এর আগের প্রজন্মগুলিতে চাকরিরত মায়ের সংখ্যা খুব লক্ষ্যনীয় না হলেও তাদের সন্তানদের কাছে ‘‌চুপ কর’‌ অথবা ‘‌তোর বাবা আসুক’‌ বলতে হয়নি। তাহলে ব্যাপারটা মা এদের নিজেদের অথরিটি অথবা এজেন্সি রাখার উপরই নির্ভর করছে বলেই মনে হচ্ছে।

২. এই ধরনের কথা মা নিজে অথবা মাকে কেউ বলছেন, এটা চলতে থাকলে, সন্তানের আরও একটা প্রভাবও পড়ছে। সন্তান শিখছে, মায়েদের এগুলো শুনতে হয়। মায়েদের ‘‌চুপ করতো’‌ বলা যায়। মা নিজে সিদ্ধান্ত নেন না, শাস্তি দেন না। বাবার উপর নির্ভর করেন। আমি আমার মাকে কোনোদিন এধরনের কিছু বলার সাহস পাইনি। আমার বিশ্বাস সেটা মা তৈরি হতে দেননি, কারণ তার মাও তাকে এই ধারণা তৈরি হতে দেননি। বড় হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করেছি, মা ছোট ছেলেমেয়েরা মাকে ‘‌তুমি কিছু বোঝ না, চুপ করতো’‌ বলে কেন? মা বলেছিলেন, এর দায় মা-‌বাবা, শিক্ষক, সমাজ সবার।

আরো বড়ো হয়ে এগুলো বুঝলাম। একদিন এরকমই একজন ‘‌সারাটাদিন কী করো, কী পারো বলোতো’‌‌ শোনা কাকিমা মাকে বললেন, ‘‌তুমি তো একটা কাজ করো, রোজগার করো তোমার মেয়ে এগুলো তোমাকে বলে না।’‌

তাই বলে এই মুহূর্তে আজ সব মায়েদের ন’টা-পাঁচটা বাইরের কাজে যোগ দিতে হবে, এই  সমস্যার সমাধান করতে? হ্যাঁ কি না জানি না। এটা সম্ভব না তা জানি।

পুরো একটা প্রজন্ম মাকে নিয়ে ট্রোল পেজ করে কাটিয়ে দিল। মায়ের জন্য মাতৃ দিবসে কেক আর অন্যদিন ‘‌চুপ করো তো’‌— এর পরিবর্তন সন্তানদের যেমন করতে হবে, তার থেকেও বেশি আমার মনে হয় আগামীর বা এখনকার মায়েদের করতে হবে। না হলে যতই মহিলারা অন্যসব দিকে সমান যোগ্য হন না কেন, যতদিন মা কে ‘‌চুপ’‌ করানো অথবা মায়েরও ‘‌বাবা আসুক’‌ বলা বন্ধ হচ্ছে, ততদিন আরও অনেক প্রজন্ম অন্ধকারে থেকে যাবে। কারণ এখনও মায়েরাই সন্তানদের তৈরি করেন, আগামীতেও অনেকদিন হয়ত করবেন।

প্রতীকী ছবি

লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী

 পুনঃপ্রকাশ, প্রথম প্রকাশ ১৩ জুন ২০২০

 

0 Comments

Post Comment