- 20 June, 2023
- 0 Comment(s)
- 1149 view(s)
- লিখেছেন : বাইজিদ হোসেন
- “হে মানব জাতি! তোমাদের রবকে ভয় করো। তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একটি প্রাণ থেকে। আর সেই একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন তার জোড়া। তারপর তাদের দু’জনার থেকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। ” -সুরা আন নিসা, রুকু ১ (আল কোরান)
এই পৃথিবীর সৃষ্টিরহস্য নিয়ে মানুষের কৌতূহল চিরদিনের। প্রাচীন কালের মানুষ যেমন ভেবেছে বা যেমন দেখেছে সেইমতো তারা সৃষ্টি রহস্যকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে। ইসলামের অনুসারীরা জানেন যে আল্লাহ পাক ‘কুন’ শব্দের দ্বারা ছয় দিনের মধ্যে সমস্ত বিশ্ব–ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছিলেন। সৃষ্টির ঊষালগ্নে আদমকে এবং তার সঙ্গিনী হাওয়াকে সৃষ্টি করেছিলেন। এসব তিনি করেছিলেন আদম–হাওয়ার ইবাদত লাভে তৃপ্ত হওয়ার জন্য। ফরিস্তাগণ আল্লাহ পাকের এই কাজ খুশি মনে মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা যুক্তি খাড়া করেছিলেন যে, তাঁরাই তো দিনরাত আল্লাহ পাকের সিজদা ইবাদত করে চলেছেন, তাহলে আদমের কি প্রয়োজন? তাই তাঁরা মাটির তৈরি আদমকে সিজদা করতে রাজি ছিলেন না। তখন আল্লাহতায়ালা তাঁদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি যা জানি তোমরা তা জান না।’ যদিও আল্লাহতায়ালার নির্দেশে শেষ পর্যন্ত সবাই মিলে সিজদা করলেন কিন্তু প্রধান ফরিস্তা আজাজিল কোনমতেই আদমকে সিজদা করতে রাজি হলেন না। ফলে তাকে বিদ্রোহী হিসাবে ঘোষণা করা হল এবং স্বর্গ থেকে বিতাড়ন করা হল। জ্বীন এবং ফরিস্তা আগুনের দ্বারা তৈরি। তাই আজাজিল ফরিস্তা আল্লাহ পাকের বিরোধিতায় অনড় থাকলেন। এই আজাজিল ফরিস্তা শয়তান হিসাবে চিহ্নিত হলেন।
এখান থেকে শুরু হল ভাল–মন্দ, কু আর সু–এর লড়াই। শয়তানের প্ররোচনায় পা দিয়ে আল্লাহের নির্দেশ অমান্য করায় আদম–হাওয়া জান্নাতের সুখ থেকে বঞ্চিত হলেন এবং তাঁরা মর্ত্যলোকে পতিত হলেন।
এরপর এই পৃথিবীর মনুষ্যজাতির উদ্ভব ও বিকাশের সুদীর্ঘ ইতিহাস। ডারউইনের বিবর্তনবাদ এবং জ্বীনতত্ত্বের গবেষণা মানব সমাজের উদ্ভব ও বিকাশের যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছে তা পৃথিবীর প্রায় সমস্ত ধর্মীয় ব্যাখ্যার বিপরীত। এর আলোচনা অন্যত্র হবে। আমরা সরাসরি প্রাসঙ্গিক বিষয়ে দৃষ্টিপাত করব।
আরবের ঊষর মরুভূমির কোলে ইসলামের শেষ নবী হজরত মোহাম্মদ জন্ম নিলেন ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যান করে আল্লাহতায়ালার স্বর্গীয় বাণী লাভ করেন এবং ইসলাম ধর্মের প্রচার শুরু করেন।
ইসলামের মূল স্তম্ভ হল কোরান। এই কোরানে ৩০টি ‘পারা’ বা অধ্যায় আছে। যার মধ্যে সুরা আন নিসা অন্যতম। এই সুরায় আল্লাহ পাক ইসলামিয় দৃষ্টিভঙ্গীতে পারিবারিক জীবনে অন্যান্য আনুসাঙ্গিক বিষয়ের সাথে বিষয় সম্পত্তির বণ্টন–ভাগ–বাঁটোয়ারা পদ্ধতির বিধান বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। দেখা যাক সেখানে ঠিক কী বলা হয়েছে।
যে যে বিধানগুলি কোরান অনুমোদন করেছে সেগুলি কী এবং ১৪০০ বছর পরে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে সেই বিধানগুলির কার্যকারিতা বা সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই আইনের ভূমিকা কেমন হতে পারে তা একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক।
মনে রাখা দরকার যে, আজ থেকে ১৪০০ বছর আগের আরবভুমি যে সামাজিক নিয়মের অধীনে ছিল, যে আইন চালু ছিল, প্রয়োজন মতো তার পরিবর্তন করে হজরত মোহাম্মদ যে বৈপ্লবিক কর্মসাধন করেছিলেন তা যুগান্তকারী হিসাবে গণ্য হয়েছে। কিন্তু সমাজ–অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান–বিজ্ঞানের যে জোয়ার এসেছে, সমাজ–বিজ্ঞান যে নতুন দিশা দেখিয়েছে, ইন্টারনেটের দৌলতে সমগ্র বিশ্ব মানুষের হাতের তালুতে বন্দি হয়েছে এবং জ্ঞান–জগতের বিস্তার মানুষকে নিত্য নতুন প্রয়োজনের সামনে দাঁড় করিয়েছে, জাগতিক এবং মহাজাগতিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে এবং হবে, এটাই বাস্তব। সমাজ এগোবে আর চিন্তা এক জায়গায় বদ্ধ অবস্থায় আবর্তিত হবে এটা অবাস্তব। এটা হতে পারে না।
এই সুরায় অনাথদের প্রতি অন্যায় করা থেকে মানুষকে বিরত থাকার কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে। ‘এতিমদের (অনাথ) মাল–সম্পত্তি তাদের নিকট ফিরিয়ে দাও, ভাল মাল মন্দ মালের সঙ্গে বদল কোরো না। আর তাদের মাল তোমাদের মালের সাথে মিলিয়ে হজম করে ফেলো না। এ অত্যন্ত বড় গুণাহ।’ (সুরা আন নিশা, রুকু ১, অনুচ্ছেদ ২)
এই একবিংশ শতাব্দীতে নারী–পুরুষের বিভেদ লজ্জাজনক অসভ্যতা বলে মনে করা হয়। তৎকালীন আরব সমাজে মেয়েদের যে করুণ অবস্থা ছিল তা সর্বজনবিদিত। হজরত মোহাম্মদ সেখান থেকে নারী সমাজকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। একথা মানতেই হবে। তখন মেয়েদের মানুষ বলে করা হত না। তাই অধিকারহীন মেয়েদের যতটুকু অধিকার কোরানের নির্দেশক্রমে দেওয়া হয়েছিল তা রীতিমত বৈপ্লবিক। সুরা আন নিসায় বলা হল: ‘তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন: পুরুষদের অংশ দুজন মেয়ের সমান।’ ‘আর যদি একটি মেয়ে ওয়ারিশ হয়, তাহলে পরিত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধেক তার’। আর এক জায়গায় (রুকু ২৪, আয়াত ১৭৬) বল হয়েছে: ‘লোকেরা তোমার কাছে কালালা (নিঃসন্তান মৃত ব্যক্তি) সম্পর্কে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করে। বল: আল্লাহ তোমাদেরকে ফতোয়া দিচ্ছেন: কোনো ব্যক্তি যদি সন্তানহীন অবস্থায় মারা যায় এবং সেই বোন তার সম্পত্তি হতে অর্ধেক অংশ পাবে। আর বোন যদি সন্তানহীন অবস্থায় মারা যায় তবে ভাই তার পুর্ণ উত্তরাধিকারী হবে।’
অর্থাৎ প্রচারে যতই সমানাধিকারের কথা বলা হোক না কেন ইসলামি বিধানে নারী–পুরুষের সমান অধিকার দেওয়া হয়নি। সে সময়ে একটা অমানবিক এবং অমর্যাদাকর অবস্থা থেকে নারী সমাজকে কিছুটা সম্মানজনক অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছিল।
ধরেই নেওয়া হয়েছে নারী পুরুষের উপর নির্ভরশীল, পুরুষের মুখাপেক্ষী হয়ে আছে এবং চিরকাল তাই থাকবে। তাই বাবার সম্পত্তিতে তার ভাগ পুত্রের তুলনায় অর্ধেক। কিন্তু সময় তো থেমে নেই। আধুনিক সমাজে নারী শিক্ষা লাভ করে স্বাবলম্বী হয়েছে, নিজে রোজগার করে সংসার প্রতিপালনে সক্ষম। এমন অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে যেখানে স্ত্রী স্বামীর তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন এবং তার রোজগার ও সামাজিক গুরুত্ব স্বামীর তুলানায় অধিক। তাহলে ১৪০০ বছর আগের সম্পত্তি বণ্টনের এই নিয়ম কি এখনও বলবৎ থাকবে নাকি তার পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে? এই প্রশ্নের জবাব কী?
এখানে আরও একটি গুরুতর সমস্যার উল্লেখ প্রয়োজন। একটু উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে। একজন বিবাহিত পুত্র, তার বাবা–মা–স্ত্রী এবং এক পুত্রসন্তান নিয়ে সুখের সংসার। একদিন মাঠে কাজ করার সময় বিষাক্ত সাপের ছোবলে সেই উপার্জনশীল পুত্র মারা গেল। এবার শ্বশুরের সংসারে ওই বিধবার এবং তার সন্তানের ইসলামি আইনে কী অবস্থা দাঁড়াবে অনেকেই হয়ত জানেন না। ওই অনাথ নাবালক তার দাদুর সম্পত্তির কোনো অংশীদার হতে পারবে না এবং সেই বিধবা স্ত্রীও কোনো সম্পত্তি পাবে না। রাতারাতি তারা পথের ভিখারী হয়ে যাবে। এই আইনের মানবিক দিক কী আছে বা সামাজিক কোন কল্যাণ সাধিত হবে তা হয়ত হাদিসবেত্তাগণ বাতলে দিতে পারবেন। কিন্তু ওই অভাগী এবং পিতৃহারা সন্তানের যে কোনো উপকার হবে না তা বলাই বাহুল্য।
কবি নজরুল ইসলাম তার ‘নারী’ কবিতায় লিখেছেন:
‘সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ–রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা কিছু মহান–সৃষ্টি চিরকল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’।
নারীদের জন্য যে বিবিধ বিশেষণ এই সমাজ দিয়েছে তা লক্ষ্যণীয়—‘কুলটা’, ‘অসতী’, ‘কুলত্যাগিনী’, ‘স্বামীখাকি’, ‘পুত্রখাকি’, ‘বেশরম’, ‘বেহায়া’, ‘ডাইনি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। যে নারীর গর্ভ থেকে মানব, মহামানব সবার জন্ম তারা কেমন করে অবলীলায় মাতৃত্বের ঋণ ভুলে পুরুষ–শাসিত সমাজের প্রতিভূ হয়ে উঠেছেন তা এক দীর্ঘ ইতিহাস।
সুরা আল মায়েদা, রুকু ১৪, আয়াত ১০৪–এ বর্ণিত হয়েছে: ‘আর যখন তাদেরকে বলা হয় আল্লাহর অবতীর্ণ আইন ও বিধানের দিকে এসো ও কবুল কর এবং পয়গম্বরের দিকে এসো (ও তাকে মেনে চলো), তখন তারা জবাব দেয় যে, আমাদের জন্য তো সেই পথ ও পন্থাই যথেষ্ট যা অবলম্বন করে আমাদের বাপ–দাদারা চলে গেছে। কিন্তু এই বাপ–দাদারা কিছু জানলেও এবং সঠিক পথ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকলেও কি করে তারা তাদের অন্ধ অনুসরণ করে চলতে থাকবে?’
এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ যেটি আমাদের উপলব্ধি করতে হবে তা হল ‘অতীতের অন্ধ অনুসরণ থেকে বিরত থাকতে হবে।’ এই দৃষ্টিভঙ্গি চিরকালীন সত্য এবং সমাজ প্রগতির পথপ্রদর্শক। কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে যে নতুন চাহিদা এবং এগিয়ে চলার জন্য নতুন দিকনির্দেশ প্রয়োজন হয় তা পরিবর্তিত অবস্থায় আমাদের অন্বেষণ করতে হয় এবং সব যুগে তাই করতে হবে। অন্যথায় পুরাতন পথনির্দেশ আমাদের পিছনের দিকে টেনে ধরবে, আমরা সামনে এগোতে পারবো না। আমরা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বো।
এই দেশের ক্রিমিনাল কোর্ট মুসলিম জনগোষ্ঠী মেনে চলেন। কিন্তু সিভিল কোর্ট মানার ক্ষেত্রে অনেক বিতর্ক দেখা দেয়। ইসলামি আইনে চুরির শাস্তি হাত কেটে ফেলা। জ্বেনার শাস্তি হত্যা করা। আমরা কি সেই দাবি করছি না তো? তাহলে সম্পত্তির অধিকারের ক্ষেত্রে নারী–পুরুষের সমান অধিকার মানতে পারছি না কেন? শুধুমাত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের প্রতি বঞ্চনা কি চলতে দেওয়া যায়?
এটা প্রমানিত যে, চিরন্তন সত্য, চিরকালীন সত্য, শাশ্বত সত্য—এই ধারণাগুলি ভুল। সত্য আপেক্ষিক, সত্য সমকালীন এবং বিশেষ। সমস্ত কিছু পরিবর্তনের সাথে সাথে এক যুগে যা সত্য বলে স্বীকৃতি লাভ করেছিল সেই ধারণা একসময় প্রাসঙ্গিকতা হারায়। এই কথাটি অনুধাবন করতে না পারলে আমরা মিথ্যার গোলক ধাঁধায় ঘুরে মরব। অগ্রগতি বলে শুধুই মরীচিকার পিছনে ছুটতে থাকব এবং শেষ পর্যন্ত নিজের ভাগ্যকে দোষ দিয়ে কপাল চাপড়াতে থাকব।
কবি নজরুল ইসলাম দুঃখ করে বলেছিলেন:
‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে
আমরা তখন বসে,
বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজছি
ফেকাহ হাদিস চষে।’
ছবি: প্রতীকী
লেখক : শিক্ষক ও সমাজকর্মী
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ১৪ মে, ২০২০
0 Comments
Post Comment