- 20 December, 2020
- 0 Comment(s)
- 643 view(s)
- লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
একটা সরু রাস্তা এঁকেবেঁকে চলা ঘোলাটে কালো নদীর মতো। প্রতিদিন এর ওপর দিয়ে অনেক যানবাহনই চলে যায় এঁকেবেঁকে। রাস্তার বাঁকের কাছে একটা ছোটো একতলা পাকাবাড়ি। বাড়ির বারান্দায় বসে মন্দিরা রাস্তার ওপর চলমান গাড়িগুলোকে দেখে চলেছে একমনে। দরজার কাছে কড়া নাড়ছে সেকেন্ড সেমেস্টারের পরীক্ষা। এখনও চলছে অনলাইনে এস. এম. ম্যাডামের ক্লাস। মন্দিরা বেশিরভাগ দিনই ওঁনার ক্লাস করতে পারেনা। আসলে ক্লাস করার কোনো উপায় থাকে না। বাড়িতে সন্তানদের জন্য বরাদ্দ স্মার্টফোন কেবলমাত্র একটি। সেখানেই যত সমস্যা। যেদিন দাদার ক্লাস থাকে না সেদিনই কেবল ক্লাসে জয়েন করার সৌভাগ্য জোটে মন্দিরার কপালে। বন্ধুদের থেকে সব নোট অনেক সময় পাওয়াও যায় না। ইচ্ছা থাকলেও এর কোনো সমাধান মন্দিরার জানা নেই। তার সাথে মাথার মধ্যে ভিড় করে আসে আরও অনেক প্রশ্ন অনেক চাপ। কোনো টিউশন নেয়নি মন্দিরা। ম্যাডামরা কলেজে যা পড়ান তা শুনে আর রেফারেন্স বই দেখেই তার চলে যায়। এখন প্রফেসররা হয়তো আগত সেমেস্টারের বিষয়ে সমস্ত কিছু আলোচনা করছেন-- কতটা সিলেবাস থাকবে, উত্তর কীভাবে লিখতে হবে, কবে পরীক্ষা.....সমস্ত কিছু। সিলেবাসের পাতা উল্টালে মন্দিরা দেখতে পায় প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি চ্যাপটারের পড়া তার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকছে। দাদার ক্লাস থাকার কারণে ঐ ক্লাসগুলি তার করা হয়নি। বন্ধুদের থেকে কিছু কিছু নোটস্ জোগাড় করতে পারলেও এখন বসে বসে সেসব বোঝাবে কে? দাদা ঘরে ঢুকলো হাতে ফোন নিয়ে, 'বোন, দেখ রুমেলা মনে হয় তোকে ফোন করছে।'
ফোনটা দাদার থেকে নিয়ে ধরতে ধরতেই কেটে গেল। মন্দিরা আবার কল ব্যাক করলো রুমেলাকে।
--'হ্যালো রুমেলা।'
--'হ্যাঁ কি রে কোথায় ছিলিস এতক্ষণ, ফোন ধরছিলিস না কেন?'
--'না আসলে দাদার ক্লাস চলছিল তো তাই।'
--'ওঃ তাই বল, আমি তোকে সাতবার ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আর দেখছি প্রতিবারই তুই ফোনটা কেটে দিচ্ছিস।'
--'বল্ কি বলবি।'
--'ঐ বলছি তুই আজ ক্লাস করেছিস রে এস. এম. ম্যামের, আজ কি লেখালেন আমাকে একটু দিতে পারবি? নেটটা ফুরিয়ে গেছিলো বলে ক্লাস করতে পারিনি।'
--'আমিও করতে পারিনিরে দাদার ক্লাস চলছিল।'
--'হা ভগবান! তুই কবে আর ক্লাস করবি? দেখ ম্যাডাম আজ সব সাজেশন দিয়ে দিলেন হয়তো।'
--'আরে বললাম না তোকে আমার নিজের স্মার্টফোন নেই। দাদার ক্লাস ছিল তাই করতে পারলাম না আজকের ক্লাসটা।'
--'উফ্! তুই বিদ্রোহ করতে পারলি না, আন্দোলন করতে পারলি না— আমাকে ক্লাস করতে দিতেই হবে।'
--'বাবার কাছে ঝাড় খাবো।'
--'ঝাড় খাবি মানে? নিজের দাবি তৈরী করতে শেখ— আমার স্মার্টফোন চাই, স্মার্টফোন দিন....'
--'তুই চুপ করতো। ওসব করে কোনো লাভ নেই।'
--'কেন?'
--'কেন আবার তুই বিদ্রোহ ক জনের বিরুদ্ধে করবি? বাবা-দাদার বিরুদ্ধে চলে গেলে মা ও আবার বিরুদ্ধপক্ষে গিয়ে যোগ দেবে আর আমি মাকে কষ্ট দিতে চাই না। ওভাবে হয়না রুমা, সবার আগে পরিবর্তন করা উচিৎ নিজের মানসিকতা। সমস্যাকে গোড়া থেকে নির্মূল করা উচিৎ। মন বদলালে মানুষ বদলাবে, বদলাবে দৃষ্টিকোণও। যাক্ ছাড় এসব কথা শোন্ বলছি তুই যদি লেখাটা কারোর থেকে জোগাড় করতে পারিস আমাকে একটু দিস না রে।'
--'দেবো কিন্তু তোর ফোনে তোর দাদার ফোনে নয়। আগে নিজের ফোন কেন্ তারপর।'
--'কি করে কিনবো, তুই টাকা দিবি?' বলে সামান্য হাসার চেষ্টা করলো মন্দিরা।
মুখ বাঁকানোর ভঙ্গিতে রুমেলা বললো, 'আহ্! জীবনে কত সাধ নিজের টাকায় কেনো তুমি।'
--'টাকা নাই আমার কাছে, ঐ আট মাস আগে পর্যন্ত অটো ভাড়া থেকে কিছু কিছু বাঁচিয়ে ৭০০ টাকা মতো খুচরো জোগাড় হয়েছে, কিন্তু তা দিয়ে কচু স্মার্টফোন কেনা যাবে।'
রুমেলা হাহা করে হেসে উঠলো।
মন্দিরা চটে গিয়ে বললো, 'হাসো আরো হাসো তুমি।' বলে রুমেলা আর কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে দিল। একদিকে পরীক্ষার টেনশনে মাথা খেয়ে নিচ্ছে, অন্যদিকে রুমেলার এই শুষ্ক পরিহাস তার মোটেই সহ্য হলো না। কলেজের অ্যাটেন্ডেসের ব্যাপারটাও তাকে বড়ই ভাবাচ্ছে। মন্দিরা বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে থাকে। যত চিন্তা করে মনটা ততই অস্থির হয়ে ওঠে। পরীক্ষাও স্নিগ্ধ গতিতে দ্রুত লয়ে এগিয়ে আসছে। মন্দিরার মনে হতে থাকে তার জীবনের প্রত্যেকটা ইচ্ছা যেন আজও অপূর্ণ। ছোটোবেলা থেকেই মা-বাবার সমস্ত আদরটুকুর ওপর অধিকার জমিয়ে নিয়েছে ওর দাদা। কোন জাদুবলে তা অজ্ঞাত। সে জন্মদিনের উপহার থেকে শুরু করে পুজোর জামা পর্যন্ত সমস্ত কিছুতেই মন্দিরা কেবল এঁটোকাঁটায় কুড়িয়ে গেছে এতদিন ধরে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার ডাক্তার হওয়ার সেই অপূর্ণ ইচ্ছা। যেটা সে পূরণ করতে চেয়েছে বাল্যে পুতুল খেলে, কৈশোরে স্বপ্নের মায়াজাল বুনে, কিন্তু যৌবনের প্রথম অধ্যায়ে এসেই তাকে ভব সংসারের জলে চুবিয়ে দিতে হয়েছে। মন্দিরার বাবার ধারণা ছিল যে মেয়ে অত কাটাছেঁড়া ডাক্তারিতে করতে পারবে না, মেয়ে যে রক্ত দেখলেই ভিড়মি খায় তা একটা আস্ত জ্যান্ত ব্যাঙকে তালুতে তুলে পেট চিড়বে কেমন করে?
দাদার ধারণা— বারো ক্লাসে সায়েন্স গ্রুপে নম্বর তো তেমন ভালো কিছু ছিলো না। শুধু বায়োলজিতে ভালো পেলে হবে? কেমিষ্ট্রিতে বোন প্রচুর কাঁচা, অত চাপ ও নিতে পারবে না।
মায়ের ধারণা— যেটা নিয়ে ও বেশি দূর এগোতে পারবে না সেটা ওর ঘাড়ে চাপিয়ে বেকার টাকা নষ্ট করার কোনো মানে হয়না। এর থেকে ও বরং আর্টস্ নিয়েই পড়ুক। ওর দাদাও নয় কিছু কিছু পড়াশোনা ওকে দেখিয়ে দিতে পারবে।
ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে মন্দিরা। সূর্য আকাশের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়তেই শীত নেমে এলো মাথার ওপর। কাঠের জানলার ফাঁকা দিয়ে বাইরের ঠান্ডা হাওয়া মন্দ গতিতে ঘরে প্রবেশ করছে। মন্দিরা গায়ে হালকা একটা চাদর মুড়ি দিয়ে টেবিলে কিছু বইখাতা নিয়ে বসলো। ইররেগুলার অনলাইন ক্লাস করার ফল এখন সে ভুগছে। এ পরীক্ষাটাতে তার ভালোভাবে উতরে যাওয়ার চান্স খুবই কম। বাবা বলেছে কোনো সাবজেক্টে যদি সাপ্লি পায় তবে পরের সেমে কলেজে ভর্তির ফি আর দেবেনা। বিয়ে দিয়ে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করবে ঘর থেকে। হাতের ব্যাথার জায়গাটায় টনটন করছে। সকালে ঘর মুছতে গিয়ে হাতে একটা টান ধরেছিল মন্দিরার। সেটাতেই এখন যন্ত্রণাটা বেড়ে গেছে। শীতে শটকার ব্যাথা খুবই কষ্টদায়ক। পড়ায় মন বসছে না। একবার যদি ক্লাসে ম্যামের সাথে যোগাযোগ করতে পারতো। ওর বন্ধুরা হয়তো ভাবছে মন্দিরা ইচ্ছা করে ক্লাস করে না। রাতে খাওয়ার পর বাসনগুলো ধুয়ে শোবার ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করলো মন্দিরা। হাতে মুঠোভর্তি ঘুমের ওষুধ। বাবার ওষুধের সমস্ত ফাইল খরচ করে দুপুরেই জোগাড় করে রেখেছিল সে। টেবিলের ওপর এনে রেখেছে জলভর্তি বোতল। বাইরের হিমেল হাওয়ার স্পর্শে জানলার কাঠের পাল্লাগুলো থরথর করে কাঁপছে। চারিদিক নিঝুম। শীতের মেঘমুক্ত আকাশের বুকে টিমটিমে উজ্জ্বল তারাগুলি নিশ্চল। নিস্পন্দ স্ট্রিটলাইটগুলো ক্লান্ত হয়ে ঘাড় নীচু করে একটানা আলো ফেলছে কালো রাস্তার কঠিন বুকে। মন্দিরা প্রথমে এক ঢোক জল খেল। তারপর কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল ওষুধগুলোর দিকে। হঠাৎই ফোন বেজে উঠলো। ঘরের ভেতরেই বাজছে। মন্দিরার পড়ার টেবিলের ওপর থেকে। চমকে উঠলো মন্দিরা। ফোনটা কানে চেপে ধরলো, 'বল'
--'হ্যালো মন্দিরা আমি রুমেলা বলছি।'
নাকের থেকে গড়িয়ে আসা জলটা একটু টেনে নিয়ে মন্দিরা বললো, 'বল'।
মন্দিরা ফোনের ওপার থেকে শুনতে পেল রুমেলার ফ্যাঁচফ্যাঁচানি কান্নার আওয়াজ। মন্দিরা জিজ্ঞেস করলো, 'কি রে রুমা কাঁদছিস কেন?'
--'মন্দিরা আমাদের বুঝি আর কোনোদিন দেখা হবে না।'
--'কেন রে? এই তো দিব্বি ছিলিস, এখন আবার কি হলো?'
--'আমি আর বাঁচতে চাই না।'
রুমেলা অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে। মন্দিরা ঘাবড়ে গিয়ে বললো, 'কেন রে কি হয়েছে সেটা বলবি তো।'
--'পাঁচ দিন আগে আমার নেট ব্যালান্স শেষ হয়ে গিয়েছিল, বাবা এখনো পর্যন্ত রিচার্জ করে দিচ্ছে না।'
--'কেন?'
রুমেলা রেগে গিয়ে বললো, 'জানিনা।'
--'মানে?'
--'আমি সুইসাইড অ্যাটেম্পট করতে যাচ্ছি। খুব ইচ্ছা ছিল কোনোদিন যদি এমন সিচুয়েশন আসে তাহলে ফেসবুক লাইভ করে সুইসাইড করবো। আমার সে সাধও পূরণ হলো না রে! তাই অগত্যা তোকেই ফোন করে জানাচ্ছি।'
মন্দিরা মাথা চাপড়ে বললো, 'তোর কি মাথা খারাপ? এই কথাগুলো কি সিরিয়াসলি বলছিস নাকি এখনো ফাজলামো মারছিস?'
--'ইয়ার্কি করছি না রে সিরিয়াসলি বলছি, আমার হাতে এখনো পিলসগুলো আছে।'
মন্দিরা একবার নিজের হাতের ট্যাবলেট গুলোর দিকে তাকালো, 'তো তুই রিচার্জ করে নিচ্ছিস না কেন?'
--'আমার কাছেও টাকা নাই।'
--'তুই যে বলছিলিস বিদ্রোহ করতে।'
--'বিদ্রোহ করেও কোনো লাভ নাই, নেট তো আর কেউ ভরে দেবেনা।'
একটু জোরে শ্বাস নিয়ে মন্দিরা হাতের মুঠোটাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরলো, 'পিলসগুলো হাত থেকে ফ্যাল।'
--'না ফেলতে পারবো না। এত ডিপ্রেশন আর সহ্য হয় না। আমি সাপ্লিওয়ালা হয়ে বেঁচে থাকতে পারবো না। আমার একটা প্রেজটিজ বলে জিনিস তো আছে নাকি?
--'থাম্ তুই আর রাখ তোর প্রেজটিজ। দু'চারটে ক্লাস না করলে কেউ সাপ্লি পেয়ে যায় না।'
--'ওরম্ মনে হয়, আমি ভীষণ জেদি জানিস তো, যেটা একবার করবো বলে ঠিক করি সেটা করেই ছাড়ি।'
--'সাপ্লি পেলে দু'জনে একসাথেই পাবো তাতে চিন্তা কি? তোর সাথে আমিও আছি। দেখ্ আমার সিচুয়েশনটাই দেখ্ আমিও তো ক্লাস করতে পারছি না প্রতিদিন কিন্তু আমি এখনো বেঁচে আছি। আর বেঁচে থাকবোও। মরতে চাই না আমি।'
কথাগুলো বলতে গিয়ে গলাটা ধরে এল মন্দিরার। স্বরনালির মধ্যে দিয়ে মনের ভিতর জমে থাকা কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে উঠে এসে আটকে দিলো শেষের বাকি কথাগুলোকে। চোখ দিয়ে টসটস করে জল গাল বেয়ে নেমে যাচ্ছে। সামনের সবকিছু যেন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে মন্দিরার। মন্দিরাকে চুপ থাকতে দেখে রুমেলা আবার জিজ্ঞেস করলো, 'হ্যালো'
--'তোর মতো মরে যাবো না আমি। এই সব চিন্তাভাবনা ছাড় রুমা, মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখ আমার মতো। আমরা, হ্যাঁ আমরা সবাই একসাথে আছি। একটা বিরাট পরিবর্তন আনতে পারবো আমরাই। যদি তেমন হয় তবে বিদ্রোহও করবো আমরা। তবে নিজের অধিকার কখনো ছাড়বো না।'
ফোনটা কেটে মন্দিরা ঘরের দরজা খুলে দিয়ে দ্রুত বাইরে চলে গেল। বাথরুমের কোমোডে ফেলে দিলো হাতের ট্যাবলেটগুলিকে।
লেখক: :ছাত্রী, গল্পলেখক
ছবি: প্রতীকী
0 Comments
Post Comment