বিশ্ব রজঃস্রাব পরিচ্ছন্নতা দিবস

  • 28 May, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 733 view(s)
  • লিখেছেন : সরিতা আহমেদ
২৮ মে ওয়ার্ল্ড মেন্সট্রুয়াল হাইজিন ডে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলায় দাঁড়ায় ‘‌বিশ্ব রজঃস্রাব পরিচ্ছন্নতা দিবস।’‌ এক্ষেত্রে ‘হাইজিন’‌ শব্দটি শুধু বাইরের নয়, মানসিক বিষয়ও। যেকোনও নাক সিঁটকানো ব্যাপার, স্টিগমা বিরোধী দিবস পালনের যথেষ্ট প্রয়োজন আছে এই অন্ধবিশ্বাস পোড়া দুনিয়ায়। Cocoon মুভিটা দেখেছি। বয়ঃসন্ধির মেয়ের সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্লট। গল্প কিছুই নেই প্রায়। তবে পিরিয়ড নিয়ে বার্তা আছে। স্টিগমায় কীভাবে আচ্ছন্ন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সেটাও আছে।

২৮ শে মে ওয়ার্ল্ড মেন্সট্রুয়াল হাইজিন ডে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলায় দাঁড়ায় ‘‌বিশ্ব রজঃস্রাব পরিচ্ছন্নতা দিবস।’‌ এক্ষেত্রে ‘হাইজিন’‌ শব্দটি শুধু বাইরের নয়, মানসিক বিষয়ও। যেকোনও নাক সিঁটকানো ব্যাপার, স্টিগমা বিরোধী দিবস পালনের যথেষ্ট প্রয়োজন আছে এই অন্ধবিশ্বাস-পোড়া দুনিয়ায়। Cocoon মুভিটা দেখেছি। বয়ঃসন্ধির মেয়ের সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্লট। গল্প কিছুই নেই প্রায়। তবে পিরিয়ড নিয়ে বার্তা আছে। স্টিগমায় কীভাবে আচ্ছন্ন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সেটাও আছে।
 
এই নিয়েই আমার মেয়েবেলার ঘটনা মনে পড়ে গেল। তখন ক্লাস সিক্স। আমাদের স্কুল জীবনে দুটো উপায় ছিল ক্লাসরুম থেকে বাইরে যাওয়ার। আঙুল তুলে (নাহ্‌, লিঙ্গনির্বিশেষে কড়ি আঙুল দেখানো নয়)  মিসকে বলা —
১ নাম্বার পেয়েছে (ছোট বাইরে পেয়েছে) যাব মিস? 
অথবা
২ নাম্বার পেয়েছে (বড় বাইরে পেয়েছে) যাব মিস?
এই বড় বাইরে বা পটি করতে যাওয়ার পরে ছোটদের হামেশাই জামাকাপড় নোংরা হয়ে যেত। ফলে স্কুল থেকে এক সেট নতুন ড্রেস দিয়ে (পুরনোটা একটা প্যাকেটে ভরে) তাকে বাড়ি পাঠানো হত। পরের দিন সেই মেয়ে আবার স্কুল ড্রেসে ক্লাসে আসত ও তারও পরের দিন স্কুল থেকে পাঠানো ড্রেসটি ফেরত দিত।
জলটল খাওয়াটাওয়া ক্লাসের ভেতরের ব্যাপার। তা, সেদিন দেখি টিফিনের আগেই সৌমিতা কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল হুট করে। ওর ব্যাগ প্রায় আঁচল চাপা দিয়ে একজন আয়ামাসী টেনে নিয়ে গেল। এতটাই ফিসফিসিয়ে এবং ধামাচাপা দিয়ে ব্যাপারখানা কয়েক মিনিটের মধ্যে হল যে আমরা প্রায় কেউই কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। অনেকে বলল, পেট খারাপ তো, প্যান্টে ২ নাম্বার করে ফেলেছে। নাক টেনে কিন্তু  কোনও দুর্গন্ধ পেলাম না। 

কিছুদিন বাদে স্মিতার ক্ষেত্রেও এক ব্যাপার। হুট করে ক্লাসের বাইরে চলে যাওয়া তারপর কাঁদতে কাঁদতে ব্যাগ নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যাওয়া। একেবারে বেপাত্তা। তবে ওর ক্ষেত্রে আরেকটা বিষ্ময়কর ব্যাপার ঘটল। ও বেরোনোর পর পরেই আমাদের বলা হল ক্লাস থেকে বেরিয়ে ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে মাঠে চলে যেতে। ক্লাস ওখানেই হবে। কী ব্যাপার? আজ নাকি শান্তিনিকেতনের স্টাইলে ফাঁকা মাঠে ক্লাস হবে। কারণ ক্লাসরুম ঝ্যাঁটানো হচ্ছে। কী হয়েছে? অনেক কষ্টে জানা গিয়েছিল স্মিতার হেব্বি পেট ব্যথা তাই বাড়ি পাঠানো। তা ঝাঁটপাট দেওয়া কেন? কেউ বলল, ওর নাকি এপেন্ডিক্স ফেটে যাচ্ছিল, তাই বিস্তর রক্তফক্ত বেরিয়েছে। খুব ইনফেকশন। সেইজন্য বেঞ্চ মেঝে সব পরিষ্কার হচ্ছে। আমি ভয়ানক ভয় পেয়েছিলাম। এরকম দুমদাম করে বোমবাস্টিং ভাবে শরীরের ভেতরও ফেটেফুটে রক্তারক্তি কাণ্ড হয়!! তাও ভরা ক্লাসে!

এসব বেশ হরর ব্যাপার। আর আমি অত্যন্ত ছিঁচকাদুনি মেয়ে। কারণ আমি পেটে থাকাকালীন মা নাকি শুধু লেবুই খেত। তাই আমার চোখে লেবুর রসের ঘাটতি নেই —এরকমটা মাসিরা হামেশাই বলত। মাকে জানালাম। খুব গম্ভীর হয়ে মা বলেছিল, ‘শোনো, এরপর থেকে বাথরুমে গেলে ভাল করে খেয়াল করবে। প্যান্টে কোনও লাল দাগ দেখলে আয়ামাসিদের বলে বাড়ি চলে আসবে।’‌
কী ছাতা বলল বুঝলাম না। খামোকা লাল দাগ দেখব কেন? তারপর আবার ভয় লাগল। আমারও কি এপেন্ডিক্স ফেটে যাওয়ার টাইম হচ্ছে! মুশকিল হল, চাইলেই ওরকম হুট করে স্কুল থেকে বাড়ি আসা যায় না। স্কুল বাস না এলে সবাইকে না নিয়ে গেলে আমি একা কীভাবে বাড়ি ফিরব? পাব্লিক বাসে চাপতে গেলে স্টুডেন্টদের ৫০ পয়সা ভাড়া লাগে। (যাতে দুটো কুলফি আইস্ক্রিম হয়ে যায়, যাকগে!) এদিকে আমার মাতারানী কস্মিনকালেও আমার হাতে  এক পয়সা ঠেকান না, নইলে বদসঙ্গে পড়ে আমি নাকি আলুকাবলি, ফুচকা, আইস্ক্রিম ইত্যাদি যাবতীয় যেসব জিনিস দারোয়ানের টয়লেটের জল দিয়ে নাকি তৈরি হয় বলে মিথ— সেগুলো কিনে খেয়ে ভয়ানক রোগ বাঁধাবো! কিন্তু এপেন্ডিক্স ফাটার আগে কি এসব যুক্তি মানবে? সমস্যাটি মাথায় নিয়েই স্কুলে যাওয়াআসা চলল।

পিরিয়ড বস্তুটি আমার কাছে ‘শরীর খারাপ’‌ নামেই এসেছিল ক্লাস সেভেনে। আমি যদিও রক্ত দেখলেই ভয়ে নীল হয়ে যাই কিন্তু মেন্সট্রুয়াল রক্তকে কেন জানিনা প্রথম বারেও ভয় লাগেনি, বরং অবাক হয়েছিলাম এটা ভেবে যে আমারও পেটের ভেতর কিছু ফাটল কিন্তু যন্ত্রণা টের পেলাম না! পরে জানলাম সব মেয়ের কাছেই সেটা ভয়ংকর রকমের ‘শরীর খারাপ’‌ হয়েই আসে।

আরও পরে বড়বেলায় কোথায় যেন আর্টিকেল পড়লাম, নেপালের ছাউপাদি প্রথার কথা। নেপালের পশ্চিম এলাকায় ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন একটি গ্রাম ঢাংগাদি। এখানকার বাড়িগুলো মাটি ও খড় দিয়ে তৈরি। এখানকার গ্রামগুলোর প্রায় সব পরিবারই ছাউপাদি প্রথা পালন করে। পিরিয়ড বা ‘‌মাসিক’‌ শুরু হলে চার থেকে ৬ দিন তাদের বাড়ি থেকে দূরে একটি ঘরে রাখা হয়। যেন একরকম সাময়িক নির্বাসন। একই কাপড় পরে চারদিন ধরে কাটাতে হয়। ওই সময় কোনও পুরুষকে স্পর্শ করা যাবে না এবং বিশেষ কিছু খাবার খেতেও বারণ। এরপর ৬ষ্ঠ কিংবা ৭ম দিনে গরুর মূত্র দিয়ে গায়ে ছিটিয়ে তাদের ঘরে তোলা হয়। এতে ‘অপবিত্রতা’‌ দূর হল বলে মনে করেন স্থানীয়রা। এটির বিরুদ্ধে অনেকবার নারী অধিকার আন্দোলন, প্রশাসনিক আইন ফাইন হলেও রমরমিয়ে এই কুপ্রথা আজও চলছে। স্টিগমার মহিমা! 

যাইহোক, আমার কথায় আসি। বাঙালি মেয়েদের ‘শরীর খারাপ’‌ ভয়ানক লজ্জার জিনিস বলে শিক্ষা দেওয়া হত, হয়ও। জীবনবিজ্ঞান দিদিমণি বা স্যার যদিও এরকম টার্ম ক্লাসে বলতেন না। তবু আমাদের সবাইকে ব্যাপারটা বুঝে যেতে হত যখন ভরা ক্লাসে রজঃস্রাব চ্যাপ্টারে ছেলের দল চোখ মটকে, ব্যাপক হৈচৈ করে উঠত—
— ‘কী করে ওভাবে রক্ত ঝরে স্যার?’‌ 
— ‘কোথা দিয়ে রক্ত পড়ে, ম্যাম?’‌
— ‘বদগন্ধ যুক্ত রক্ত মানে কী স্যার?’‌ (মনে আছে এটার উত্তরে একজন স্যার গলা খাঁকড়ে জানিয়েছিলেন, ‘এইজন্য মেয়েদেরকে এই বিষয়টা শরীর খারাপ বলতে হয়’‌। এবং তারপর থেকে কোনও মেয়ে জ্বর হয়ে স্কুল কামাই করলেও ছেলেরা বুঝত ওর নির্ঘাৎ বদরক্ত বেরিয়েছে!) 
— ‘প্রতিদিন ওরকম রক্ত পড়লে মেয়েরা বাঁচতে পারবে স্যার?’‌
তখন একরাশ লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে বসে চাইতাম হে ধরনী দ্বিখণ্ডিত হও, আমরা সীতা অথবা সতী হই।

এখন তবু স্কুলে পিরিয়ড নিয়ে P&G company থেকে শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। এনিমেশন করে বোঝানো হয় বাচ্চাদের। তাও স্রেফ মেয়েদের৷ ছেলেরা যথারীতি জানলা দিয়ে উঁকি মেরে টিপ্পনী কাটে নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি অমোঘ টানে। উচিত দু পক্ষের সমান সুযোগ। নইলে পুঁথিগত বিদ্যে অর্জন হবে, চাকরিবাকরি মোটা মাইনে হবে, তবে মেয়েদের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া নিয়ে ফিসফিসানি বন্ধ হবে না। স্বাভাবিক প্রক্রিয়া আর শরীর খারাপের ফারাক জানতে জীবন পার হয়ে যাবে তবু অন্ধবিশ্বাসের মেঘ কাটবে না। 

নাহ, জ্ঞান দিচ্ছি না। বলতে চাইছি, স্কুলশিক্ষায় বিনা ট্রেনিং দিয়ে জীবনশৈলী নামের গাল ভরা সাব্জেক্ট চালু করে লাভ কিছু হয় না। ওর চেয়ে স্রেফ বিজ্ঞান ক্লাসে সঠিক টার্মকে সঠিক ভাবে বোঝানোই আমাদের শারীরবৃত্তীয় অনেক পড়াকে কুয়াশামুক্ত করতে পারবে। নইলে কোয়েডুকেশানের লক্ষ্যটা কক্ষপথ বিচ্যুত হয়। আর মেয়েরা সারাজীবন শেখে: স্কার্টটা  সোয়েটার দিয়ে ঢেকেঢুকে চলতে হয়, পাছে তার ‘শরীর খারাপ’‌ লোকচক্ষুতে ধরা না পড়ে যায়। এই স্টিগমাগুলো ভাঙার সময় অনেক আগেই এসেছে। আমরা ঘুমাচ্ছিলাম বলে জাগতে পারিনি। তা সে নেপালের গ্রাম হোক বা কলকাতার ঝাঁ-চকচকে ফ্ল্যাট। 

২৮শে মে মেন্সট্রুয়াল হাইজিন ডে হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে  আরেকবার উস্কে দিল ঘুমভাঙানিয়ার সুর।

পুনঃপ্রকাশ

লেখক :‌ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক

ছবি  : সংগৃহীত
‌‌

0 Comments

Post Comment