- 16 May, 2020
- 0 Comment(s)
- 859 view(s)
- লিখেছেন : মীরা কাজী
এক মাসের ওপর হতে চলল, অতিমারী “কোরোনা ভাইরাস”-এর সংক্রমণ রুখতে সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। ট্রেন, বাস, দোকান-বাজার, অফিস-আদালত সব বন্ধ। সবাই গৃহবন্দী। রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্রের পাতা জুড়ে কেবলই এই মারণ ব্যাধি সংক্রান্ত খবর। আক্রান্তের হার ক্রমশ বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যূর হার। চিকিৎসার জন্য বহু মানুষকে কোয়রান্টিন সেন্টারে রাখা হচ্ছে। ডাক্তার, নার্সরাও রেহাই পাচ্ছেন না। আচমকা এই বিপর্যয়ে আপামর জনসাধারণ হতচকিত, ভয়ার্ত।
ঊর্মিমালাদের এই ছোট্ট মফস্বল শহরটিতেও বিপর্যয়ের ঢেউ আছড়ে পড়েছে। গৃহবন্দী মানুষজন আতঙ্কিত। প্রথম দিকে ঊর্মিমালাও খুব ভয় পেয়েছিল। কাজের বৌ খুকুরানীকে তখনই সবেতন ছুটি দিয়েছিল সে। খুকুরানী আরো চারটে বাড়িতে কাজ করে। না জানি কোথা থেকে কী হয়? এই সিধান্তটি অবশ্য পরিমলের সঙ্গে পরামর্শ করেই নিয়েছিল ঊর্মিমালা। পরিমলের সাথে পরামর্শ না করে কোনো কাজ করতে পারে না সে। কেন পারে না তার সঠিক ব্যাখ্যা তার নিজের কাছেও নেই। পরিমল যে খুব বদরাগী, ঊর্মিমালার ওপর চোটপাট করে তাও নয়। পরিমলের বিনা অনুমতিতে কোনো কিছু করে সে শান্তি পায় না। তার মনের ভিতরে একটা অতৃপ্তি কাজ করে।
কয়েকদিন থেকে লকডাউন ব্যাপারটি ঊর্মিমালার কেমন যেন গা-সওয়া লাগছে। এই সময়টিকে সে উপভোগ করতে শুরু করেছে। খুকুরানীকে ছুটি দেবার কারণে যেমন তার কাজ বেড়েছে, অন্যদিকে তেমনি লকডাউনে কিছু বাড়তি সুবিধেও হয়েছে তার। এসোজন, বসোজন নেই, তাদের জন্য চা জল খাবার বানানোর ঝামেলা থেকে রেহাই মিলেছে। সেই সঙ্গে পরনিন্দা, পরচর্চা শুনে কান পচাতে হচ্ছে না। পরিমল এখন সপ্তাহে একদিন বাজার যায়। সারা সপ্তাহ সেগুলো হিসেব করে খরচ করতে হয়। তাই রান্নাটাও সংক্ষিপ্ত হয়েছে। ঊর্মিমালা এমনিতেই অন্তর্মূখী মানুষ। বেশি লোকজন হৈ-হল্লা তার অপছন্দ। লকডাউন ব্যাপারটা এখন তার বেশ লাগছে। মোবাইলে মনের মত গান শুনছে। অনেকদিন আগের পড়া বইগুলো আবার পড়ে নিচ্ছে।
ঊর্মিমালাদের পাড়ার কিছু সহৃদয় মানুষ চাঁদা তুলে দুস্থ প্রতিবেশীদের মধ্যে চাল, ডা্ল, আলু, হাত ধোওয়ার সাবান এসব বিতরন করছে। পরিমলও সেই দলে আছে। এই ধরনের কাজে পরিমলকে বরাবরই উৎসাহ দেয় ঊর্মিমালা। এবারও তার ব্যাতিক্রম হয় না। স্বামীর জন্য মনে মনে গর্ব অনুভব করে সে। ঘর থেকে বের হবার প্রয়োজন হয় না ঊর্মিমালার। তবে মাঝে মাঝে বাড়ির সামনে রাস্তাটা দেখতে ইচ্ছে হয়। মুখে মাস্ক পড়ে সদর দরজাটা খুলতেই কালো পিচঢালা রাস্তাটা চোখে পড়ে ঊর্মিমালার। লোকজনের ব্যস্ততা, যানবাহনের দাপাদাপি বিহীন রাস্তাটা আকাশের নীচে শরীর এলিয়ে দিয়ে পড়ে আছে। গাছপালা, বাড়িঘরের ছায়া তার শরীর জুড়ে নক্সী-কাঁথার মত বিছিয়ে আছে। দুটি ঘুঘু আলতো পা ফেলে ফেলে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেই নক্সী-কাঁথায় আরো একটি নক্সা হয়ে। আচ্ছা! রাস্তাটা কি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে? এমন নিরুপদ্রব সময়কাল তার জীবনে তো আসেনি কখনও। পাশের বাড়ির ললিতা তাকে দেখতে পেয়ে কিছুটা এগিয়ে আসে। তারপর সঙ্কুচিত হয়ে বলে, “বৌদি! তোমার সাথে একটু দরকার ছিল”!
কি বলবি বল না? ভাবনার অন্তরাল ছেড়ে বেরিয়ে আসে ঊর্মিমালা।
তোমার ঠাকুরজামাই এর কাজ নাই। আজ এক মাসের ওপর হাত পা গুটিয়ে ঘরে বসে আছে। আমারও তাই। কাজের বাড়িগুলোতে সবাই ছুটি দিয়েছে। পুরো মাসের মাইনেটাও দেয়নি। কেউ কেউ আবার বলেছে, পুজোর আগে আর কাজে নিতে পারবে না। কি নক ডাউন হল! এখন আমরা কোথায় যাই?
রেশনে ফ্রিতে চাল, আটা দিচ্ছে তো? আমাদের পাড়াতেও চাঁদা তুলে তো বার দুই চাল ডাল দিলে। তুই পাস নি?
সব পেয়েছি বৌদি! কিন্তু ওতে আর কদিন? পাঁচ-পাঁচটা পেট? কি করে চলবে? সেই ভাবনায় — তাই তোমার ঠাকুরজামাই বললে, যদি কিছু টাকা ধার হিসেবে —বলতে বলতে মাস্ক পরা নাক-মুখের ওপর জেগে থাকা চোখ দুটি আঁচলে মুছে নেয় ললিতা।
ললিতার কথাকটি ঊর্মিমালার মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকে। কিছুতেই কোনো কাজে মন বসাতে পারে না সে। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয় তার। এত কাছে থেকেও এই দুর্দিনে ললিতার খবর নেওয়া হয়নি! সমস্ত দোকান বন্ধ হলেও পরিমলের মুদিখানার দোকান খোলা। লকডাউনে ভালই বেচা কেনা হচ্ছে। বাড়ী ফিরতে দুপুর গড়িয়ে যায়। খেতে বসে পরিমলের কাছে ললিতার কথাটা পাড়ে ঊর্মিমালা। পরিমল বলে, “আমরা দু দু বার চাল ডাল দিয়েছি। দরকার হলে আবার দিতে হবে। ওসব নিয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে। ওসব নিয়ে ভাবার প্রচুর লোক আছে”। পরিমলের কথাগুলো বড় বেসুরো বাজে ঊর্মিমালার কানে।
আমাকে কিছু টাকা দিও। সাহায্য হিসেবে ললিতাকে দোবো। ও বড় কষ্টে আছে। আমি ওকে কথা দিয়েছি।
তোমার সবেতেই বাড়াবাড়ি। আমাকে না শুধিয়ে কথা দিতে গেলে কেন? পাড়ার ত্রান তহবিলে আমাকে আর্থিক সাহায্য করতে হচ্ছে। পাড়ায় থাকতে গেলে এগুলো করতেই হবে। তোমার আবার আলাদা করে --- আমার কি টাকার গাছ আছে? রোজগার করনি তো কোনদিন? সারাজীবন শুধু পরের টাকায় পোদ্দারি করে গেলে। আমি একটা টাকাও দিতে পারব না। ঝাঁঝের সঙ্গে বলে পরিমল।
কিন্তু আমি যে কথা দিয়েছি তার কি হবে? আহত স্বরে বলে ঊর্মিমালা।
তার আমি কি জানি? তোমার নিজস্ব কিছু থাকলে দাওগে যাও! আমকে এ ব্যাপারে একটা কথাও বলবে না। খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়ে পরিমল।
ঊর্মিমালা স্থানুর মত বসে থাকে এঁটো থালার সামনে। চতুর্দিকে তাকিয়ে তার “নিজস্ব কিছু”কে আপ্রান খুঁজতে থাকে সে। বাসনকোসন, আসবাবপত্র সমেত পুরো বাড়িতে কোত্থাও সেটিকে খুঁজে পায় না। টাকা জমানোর অভ্যাস ঊর্মিমালার কোনকালে নেই। যখন যা প্রয়োজন এতকাল পরিমলের থেকে চেয়ে নিয়েছে। এই চাওয়ার মধ্যে কোনো হীনমন্যতা স্থান পায়নি ঊর্মিমালার মনে। আজ পরিমলের কথাগুলি তার মনের বন্ধ একটি কুঠুরি খুলে দিয়েছে। সেখানে উঁকি দিয়ে মর্যাদা, আত্মসন্মানের ছিটেফোঁটাও দেখতে পায় না ঊর্মিমালা। এই সংসারে তার স্থান খুকুরানীর চেয়ে অধিক কিছু বলে মনে হয় না। তাকের ওপর একটি লক্ষীর ভাঁড়। সেটিতে জমানো টাকা ক’টিও হিসেব মত পরিমলের। ইতস্তত করে ভাঁড়টি তুলে, ললিতার বাড়ী গিয়ে সেটি তার হাতে দিয়ে ঊর্মিমালা বলে, “এর বেশি আর পারলাম না রে?”
“এই আমার অনেক বৌদি!” কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ে ললিতা।
লকডাউন একদিন উঠে যাবে। ক্ষয়ক্ষতি সামলে পৃথিবী তার গতিময়তা ফিরে পাবে। ললিতার বর আবার কাজে যাবে, তার সংসারে ছন্দ ফিরে আসবে। কিন্তু ঊর্মিমালার মনের লক ডাউন উঠবে কি? সে কি পারবে, পুরোনো ছন্দে ফিরতে আর কোনভাবে? এলোমেলো পা ফেলে ফিরে আসে ঊর্মিমালা।
ছবি: কমপিউটার গ্রাফিস্ক
লেখক সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি একজন সমাজকর্মী
0 Comments
Post Comment