‌সাবিত্রীর লড়াই

  • 03 January, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 968 view(s)
  • লিখেছেন : জ্যোৎস্না রহমান 
৩ জানুয়ারি ১৮৩১ সালে মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলার নয়গাঁও গ্রামে সাবিত্রীবাঈ ফুলের জন্ম। দলিত আন্দোলনের ইতিহাসে সাবিত্রীবাঈ ফুলের অবদানের কথা জুড়ে দেওয়া হয় জ্যোতিবারাও ফুলের অবদানের সঙ্গে। জ্যোতি-‌সাবিত্রী পরস্পরের পরিপূরক একথা যেমন ঠিক পাশাপাশি কাজের নিরিখে সাবিত্রীকে নিয়েই ইতিহাস লেখা হতে পারে যেখানে জ্যোতির প্রেরণা ও সাহায্য অবশ্যই থাকবে। জন্মদিনে সাবিত্রীবাঈ ফুলেকে বিশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লড়াই কথাটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে  জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে। কেউ নিজের বাঁচার জন্য আবার কেউ অন্যকে বাঁচাতে লড়াই করে যাচ্ছে। বেশিরভাগ নারীর জীবন মানেই লড়াই, কিন্তু এমন একজন নারীর কথা বলতে চাই, যিনি লড়াই করেছেন নারীর শিক্ষা নিয়ে। এর জন্য তাঁকে তাঁরই নির্মিত স্কুলে যেতে হত ব্যাগে আর একটি শাড়ি নিয়ে। কারণ, অসহায় মেয়েদের শিক্ষিত করার অপরাধে স্কুলে যাওয়ার পথে তার গায়ে কাদা ও পাথর ছোঁড়া হত। কিন্তু তিনি একটুও দমেননি, উল্টে বলতেন— ‘‌তোমাদের কাছে যা গোবর, কাদা, পাথর আমার কাছে সেটা ফুল।’‌ উদার মনের এই নারী আর কেউ নন, তিনি সাবিত্রীবাঈ ফুলে। তিনি আর তাঁর স্বামী জ্যোতিবারাও ফুলে দলিত আর মুসলিম মেয়েদের জন্য স্কুল খুলেছিলেন, যেটা ছিল সেই সময়ে সবথেকে বড়ো অপরাধ। সে সময় বলতে  ১৮৪৮ সালের কথা বলছি, যখন মুসলিম মেয়েদের পড়াশুনা করাটা ছিল অপরাধ। আর বিদ্যালয়ে কোন মেয়ের শিক্ষকতা করতে যাওয়াটা ছিল আরও বড় অপরাধ।  এমন একটা সময়ে পা রেখে তিনি মাথা উঁচু করে নারী শিক্ষার জন্য লড়াই করে গেছেন।  

এছাড়াও ব্রাহ্মণ বিধবাদের মধ্যে যাঁরা গর্ভবতী হয়ে লোক-‌লাজের ভয়ে নিজের সন্তানকে গলাটিপে হত্যা করতেন— তিনি সেই সন্তানদের প্রাণ রক্ষার তাগিদে অনেক ব্রাহ্মণ বিধবাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁর আশ্রমে।

প্লেগ মহামারীর সময় মানুষকে অসহায় ভাবে মরতে দেখেছেন সাবিত্রী। চুপ করে বসে থাকতে পারেননি। ছোঁয়াচে রোগকে তোয়াক্কা না করে রোগীদের নিয়ে যেতেন তাঁর ছেলে ডাক্তার যশোবন্তের ক্লিনিকে। যার ফলে ওই রোগ বাসা বাঁধল তাঁর দেহে। তিনি সব লড়াইয়ের অবসান ঘটিয়ে মারা গেলেন ১৮৯৭ সালের ১০ই মার্চ। যার দুইদিন আগে ৮ই মার্চ-‌কে নারী দিবস হিসাবে উদযাপন করা হয়। 

কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, দলিত আন্দোলনের ইতিহাসে সাবিত্রীবাঈ ফুলের অবদানের কথা জুড়ে দেওয়া হয় জ্যোতিবারাও ফুলের অবদানের সঙ্গে। জ্যোতি-‌সাবিত্রী পরস্পরের পরিপূরক একথা যেমন ঠিক পাশাপাশি কাজের নিরিখে সাবিত্রীকে নিয়েই ইতিহাস লেখা হতে পারে যেখানে জ্যোতির প্রেরণা ও সাহায্য অবশ্যই থাকবে।

সাবিত্রীবাঈ যেমন নারী শিক্ষা নিয়ে বাইরে লড়াই করেছেন তেমনি অনেক নারী আছেন যাঁরা অন্তরালে থেকে নিজের শিক্ষা নিয়ে লড়াই করছেন। সমাজের অলিতেগলিতে এমন অনেক নারীর লড়াইয়ের কাহিনী লুকিয়ে আছে। বহু মেয়ের ছোট থেকে স্বপ্ন পড়াশুনা শেষ করে স্বাবলম্বী হওয়ার। কিন্তু সেই স্বপ্নকে পায়ে মাড়িয়ে ঘাড় ধরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শ্বশুর বাড়ি। কারণ সমাজের নিয়ম, বাবা মায়ের একমাত্র কর্তব্য ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা আর মেয়েকে সৎ পাত্রস্থ করা।  

এ দেশের মেয়েদের একমাত্র ভবিতব্য বিয়ে করে সন্তান জন্ম দেওয়া আর পড়ে পড়ে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার সহ্য করা। ফলে ছোট থেকে তাদের মানসিকতায় গেঁথে যায় বিয়ের স্বপ্ন। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রমী মেয়ে চায় স্বাবলম্বী হতে। তাদেরকেই লড়াই করে স্বপ্ন পূরণ করতে হয়। কিন্তু যতই এগোও না কেন বিয়ে অবশ্যই করতে হবে আর বিয়ে মানেই আত্মবিসর্জন। এমন অনেক নারীকে দেখেছি বিয়ের পর সংসারের কথা ভেবে, স্বামী, সন্তানের কষ্টের কথা ভেবে চাকরি ছেড়ে দিতে।  তারপর শুরু হয় তার জীবনের লড়াই। কারণ যাদের কথা ভেবে সে চাকরি ছাড়ে তাদের কাছে হাত পাততে হয় নিজের প্রয়োজন মেটাতে এবং বারংবার অপমানিত হতে হয়। 

আসলে নারীদের শুধু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সঙ্গে নয় লড়াইটা নিজের সঙ্গেও করতে হবে। পরিবর্তন করতে হবে নিজের মানসিকতার। একটা নারী যখন শাশুড়ি বা মা হবে তখন তার বৌমা বা মেয়েকে গতানুগতিক সমাজের নিয়মসৃষ্ট পথ না দেখিয়ে নিজসৃষ্ট পথ চিনিয়ে দিতে হবে। আসলে ভিক্ষা নয় স্বোপার্জিত অধিকারই পারবে নারীকে মানুষ হিসেবে চেনাতে। সময় লাগবে, কিন্তু লড়াই যদি সঠিক পদ্ধতি মেনে এগিয়ে যায় নারীর জয় নিশ্চিত।‌

পুনঃপ্রকাশ

লেখক : প্রাবন্ধিক

0 Comments

Post Comment