গর্ভপাত ও রাষ্ট্রীয় অনুশাসন

  • 23 June, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 411 view(s)
  • লিখেছেন : মোনালিসা পাত্র
গর্ভধারণ ও গর্ভপাত একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে আলোচ্য একটি বিষয়, কারণ দুজন মানুষ যখন সন্তানধারণের মত সিধান্ত নেন তার পিছনে সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক এবং শারীরিক নানান বিষয় ন্যস্ত থাকে। এই আইনটি বস্তুতই সারা বিশ্বের মুক্তমনা মানুষদের বিশেষভাবে চিন্তিত করেছে। আমেরিকা গর্ভপাতের অধিকার খর্ব করে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মহিলাদের অবদমিত করার ঐতিহাসিক প্রথাকেই এক ধাপ এগিয়ে দিল। 

সালটা ১৯৭৩, টেক্সাসের এক তরুণী তৃতীয়বার গর্ভবতী হওয়ায় গর্ভপাত করতে চেয়ে  আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন এবং আদালত তরুণীর স্বপক্ষে রায়দান করে। যদিও ততদিনে আবেদনকারী তরুণী তৃতীয়বার মা হয়েছেন। তদাপী এই আইন এক দীর্ঘ অচলায়তনকে ভাঙতে সক্ষম হয়েছিল। অর্ধদশক পেরিয়ে সেই একই আদালত মহিলাদের গর্ভপাতের অধিকারকে নিষিদ্ধ করল ও একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে রাষ্ট্রের অধিকারকে কায়েম করল। গর্ভধারণ ও গর্ভপাত একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে আলোচ্য একটি বিষয় কারণ দুজন মানুষ যখন সন্তানধারণের মত সিধান্ত নেন তার পিছনে সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক এবং শারীরিক নানান বিষয় ন্যস্ত থাকে। এই আইনটি বস্তুতই সারা বিশ্বের মুক্তমনা মানুষদের বিশেষভাবে চিন্তিত করেছে। আমি এপ্রসঙ্গে গর্ভপাত বিষয়টি নিয়ে যে সামাজিক নির্মাণগুলি আছে সেগুলি নিয়ে আলোচনা করার মাধ্যমে এই আইনটির মারাত্মক কয়েকটি সামাজিক প্রক্ষেপের বিষয়ে আলোচনা করছি।

প্রথমতঃ নারী শরীরের ওপর অধিকার কায়েম করা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম উপপাদ্য এবং সেখানে নারী শরীরকে মাতৃত্বের মাধ্যম হিসেবে দেখা হয় এবং তাতে নারী অর্থাৎ যিনি আদতে সন্তানধারণ করবেন তার ইচ্ছে প্রায়শই অবহেলিত বা সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করা হয়। নারীর শরীরের ওপর অধিকার তার সঙ্গী পুরুষের, এটাই প্রচলিত সামাজিক নির্মাণ এবং নারীরাও সেই বিশ্বাস নিয়ে চলেন তাই গর্ভধারণও হয় সেই সমাজ ও পরিবারকেন্দ্রিক। কিন্ত এপ্রসঙ্গে যে বিষয়গুলি অনুচ্চারিত সেগুলি হল গর্ভধারণের জন্য একজন নারীকে তার শরীরের বিভিন্ন পরিবর্তন, সামাজিক স্থিতির পরিবর্তন মেনে নিতে হয়। তাই এক্ষেত্রে কেবল শারীরিক ভাবে নয় মানসিকভাবে তৈরি হওয়াটাও বিশেষভাবে জরুরি, কারণ জন্ম দেওয়াই শেষ নয় বরং শুরু বলা যেতে পারে। বাকি জীবন এবং তার পর এক দীর্ঘ পথ-সেখানে মানসিক ভাবে কাঙ্ক্ষিত সন্তানই কাম্য। গর্ভপাত এক্ষেত্রে নারীদের একান্ত ব্যক্তিক সিধান্ত, সঙ্গীর মতামত এখানে গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়ই তবে অন্তিম নির্ণায়ক নয়, কারণ মাতৃত্ব নারীর দেহকেন্দ্রিক একটি প্রক্রিয়া যার সিদ্ধান্ত তার নিজের হওয়াটাই কাম্য। নারী শরীরের ওপর কার অধিকার, এপ্রসঙ্গের আলোচনায় এতদিন তার সঙ্গী, পরিবার, সমাজ ইত্যাদির ভূমিকা আলোচিত হত। কিন্ত এখন এই আলোচনায় রাষ্ট্রও একটি ক্ষমতার অবস্থান কায়েম করল। নারীর স্বীয় শরীরের ওপর অধিকার কায়েম করার লড়াই দীর্ঘমেয়াদি এবং বিভিন্ন সামাজিক নির্মাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। নারী ক্ষমতায়নের লড়াইয়ে নারীর শরীরের ওপর অধিকার আদায় করার জন্য নারীবাদীদের দীর্ঘ আন্দোলন রয়েছে যদিও এপ্রসঙ্গে আমাদের দেশের আইন মহিলাদের সিধান্তের ওপরই গুরত্ব দিয়েছেন গর্ভপাতের বিষয়টি নিয়ে। তবে আইন থাকা ও তার প্রয়োগ করার পরিসর থাকার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে।

দ্বিতীয়তঃ গর্ভপাতের কারণ হিসেবে গর্ভধারণের নানান দিকগুলি আলোচনা করা প্রাসঙ্গিক। একজন নারী সর্বদা স্বেচ্ছায় মা হন এমনটা নয়, বিবাহ পূর্ববর্তী সম্পর্কে কেউ মা হতে পারেন, আসাবধানতার জন্যও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতেও অনেকে মা হতে পারেন, বিবাহ পরবর্তী সময়ে সামাজিক চাপে, পারিবারিক চাপে এবং অনেক সময় সঙ্গীর ইচ্ছা পূরণেও অনেকে মা হন, বৈবাহিক ধর্ষণও এক্ষেত্রে মাতৃত্বের কারণ হতে পারে। এই সকল পরিস্থিতিতে একজন নারী মনে করতেই পারেন যে তিনি মানসিক ভাবে সন্তানের জন্ম দিতে প্রস্তুত নন। সেক্ষেত্রে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ তাকে বাধা দিতে পারে, পরিবার তাকে আটকাতে পারে কিন্তু আইন তাকে সেই স্বাধিকার প্রয়োগ করার স্বাধীনতা দিয়েছিল এতদিন। কিন্তু আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সেই অধিকার খর্ব করার মাধ্যমে ব্যক্তিগত পরিসরেও রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রয়োগকে সুনিশ্চিত করে। এপ্রসঙ্গে মাতৃত্বকে একটি পবিত্র প্রতিষ্ঠান হিসাবে কায়েম করতে চাওয়ার সামাজিক নির্মাণটিকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

তৃতীয়তঃ বিবাহ পূর্ববর্তী গর্ভধারণ সামাজিক ভাবে স্বীকৃত নয় এবং বহু তরুণী ও নারী নানান সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় লাঞ্ছনার স্বীকার হন একক আবিবাহিত মাতৃত্বের যাপনকে বেছে নিলে। এক্ষেত্রে কেবল মা নয়, সন্তানকেও এই সামাজিক দায়ভার বহন করে চলতে হয় আজীবন, যা মা ও সন্তানের সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে। এইধরনের মাতৃত্বে অর্থনৈতিক দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাই এমতাবস্থায় সমস্ত সামাজিক, পারিপার্শ্বিক এবং সর্বোপরি মানসিক দ্বন্দ্ব পেরিয়ে যদি কোন নারী গর্ভপাতের সিদ্বান্ত্ব নেন তা তার একান্ত ব্যক্তিগত। সেখানে রাষ্ট্রের অধিকার কায়েম নিন্দনীয় কেবল নয় স্বাধীন চিন্তাধারার মানুষের জন্য দুঃসহও বটে। এক্ষেত্রে একটি বিষয় অবশ্যই চিন্তার যে, গর্ভপাত যদি আইন দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয় তবে বেপথে গর্ভপাত হবে এবং তাতে মৃত্যুহার বাড়বে বই কমবে না। এক্ষেত্রেও নারীকেই ভোগ করতে হবে তার যাবতীয় অনুষঙ্গ। আমাদের দেশে গর্ভপাতের অধিকার নারীর ওপর ন্যস্ত থাকা সত্বেও এবিষয়ে সচেতনতা এবং সহযোগিতা দুইয়ে যথেষ্ট ঘাটতি দেখা যায়।

চতুর্থতঃ গর্ভপাতের সঙ্গে একপ্রকার নীতি পুলিশি এবং পাপ পুন্যের হিসেব জুড়ে দেওয়া হয় যা নারী স্বাধীনতাকে খর্ব করার পাশাপাশি নারী শরীরের ওপর সমাজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে এবং বহু মহিলাও মনে করেন গর্ভপাত পাপ এবং এ একপ্রকার হত্যা। তাই গর্ভপাতের অধিকার কায়েম করার পাশাপাশি সামাজিক নির্মাণগুলির গোড়ায় পৌঁছানো দরকার ও সেগুলিকে যুক্তি দিয়ে বিবেচনা করার পরিসর তৈরি করা দরকার। আমেরিকার এই আইন পুনরায় আমাদের অর্ধশতক পিছিয়ে দিল এবং প্রান্তিক শ্রেণীর মহিলাদের যথা যৌনকর্মী, প্রতিবন্ধী এবং মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলাদের এক চরম সংকটের মুখে নিমজ্জিত করল।

নারীবাদী আন্দোলনের একটি অন্যতম স্তম্ভ হল নারীর শরীরের ওপর নিজের অধিকার কায়েম করা। পাশ্চাত্যের প্রভাব আমাদের ওপর অসীম, তাই খাপ পঞ্চায়েত ও নীতিপুলিশির দেশে এহেন সুবিধেজনক নিয়ম বলবৎ হওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। আমেরিকার মহিলাদের গর্ভপাতের অধিকার খর্ব করে নারীদের ক্ষমতায়ন ও সমতার লড়াইকে অনেক ধাপ পিছিয়ে দিল। রাষ্ট্র তার ক্ষমতার প্রয়োগ করে বলা ভালো বলপূর্বক প্রয়োগ করে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মহিলাদের অবদমিত করার ঐতিহাসিক প্রথাকেই এক ধাপ এগিয়ে দিল। 

পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ২৪ আগস্ট ২০২২ 

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

ছবি : সংগৃহীত

 

0 Comments

Post Comment