দাহ

  • 12 October, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 616 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
মরিয়মরা পালাচ্ছে। মরিয়মদেরকে পালাতে হয়। তাদের বাড়বাড়ন্তকে সমাজ ভালো চোখে দেখে না। একথা মরিয়ম (অথবা মন্দিরাদের মতো একেকজন) নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছে। হাইওয়ের উপরে কয়েকটা আলো জ্বলছে। কয়েকটা টয়োটার হেডলাইট। উপরে কয়েকটা অবয়ব। মাথায় কাপড় ঢাকা। কয়েকটা বিসদৃশ নল উঁচিয়ে রয়েছে তাদের পিঠ থেকে। মরিয়ম নিজের গাড়িটাকে থামিয়ে দিতে বলল। তারপর ? আফগানিস্তানের মহিলা বিচারকদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উপরে ছোটগল্পের আঙ্গিকে এ যেন এক নিবিষ্ট অন্বেষণ।

... এখন সবসময় ওর মধ্যে একটা পোড়া, জ্বালা-ধরানো অনুভূতি হতে থাকে। কিছু একটা যেন পুড়ছে। বেশ অনেকক্ষণ ধরে পুড়ছে। গন্ধটা ওর নাকে এসে লাগে ...

বেশ, পুড়ুক। সমস্ত পুড়ুক।

এইটুকুই

(১)

মন্দিরার শরীরটা আবার ছ্যাঁৎ করে উঠল। আবারও মেসেজ ঢুকেছে। মোবাইলের চড়া আলোটা ঘরের আবছা অন্ধকারকে হঠাৎ এক লহমাতে চুরমার করে দিয়ে ঝলমলিয়ে ফুটে উঠল। মন্দিরা চোখের উপরে হাত রাখল। শুয়ে থাকা অবস্থাতেই ভ্রু কুঁচকিয়ে আড়চোখে দেখে নিতে চাইল নম্বরটাকে। তার আগেই আলো নিভে গেছে। কিন্তু কোনও নাম ফুটে ওঠেনি। অচেনা নম্বর। মন্দিরার ব্লক লিস্ট এবারে সন্দেহাতীত ভাবেই উপচিয়ে পড়বে। তার মোবাইলে যত না পরিচিত মানুষদের নাম সেভ করা রয়েছে, তার চেয়েও অনেক লম্বা বোধহয় তার ‘ব্লকড’ তালিকাতে থাকা মানুষদের পরিসংখ্যান। কিন্তু মন্দিরাদের কোনও উপায় নেই। একবার সমাজে ‘লেবেলড’ হয়ে গেলে পরে মন্দিরার মতো মেয়েদের ফোন অথবা অন্যান্য সমস্ত সামাজিক মাধ্যমের ইনবক্সগুলো এমন সমস্ত মেসেজ আর প্রস্তাবে উপচিয়ে ভরে ওঠে, ব্লক লিস্টের তালিকাকে দীর্ঘায়িত করা ছাড়া তাদের আর তখন কোনও উপায় থাকে না। মন্দিরা কলকাতা পুলিশের তরফে সাহসিকতার জন্য পুরষ্কৃত হয়েছিল। সেই ঘটনার পরে দু’বছরও কাটেনি। এখনও মন্দিরা চোখ বুজলেই সেই সন্ধ্যেটাকে স্পষ্ট মনে করতে পারে। শহরজুড়ে বৃষ্টি হয়েছিল সেদিন।

দিল্লি চলে আসার পর মন্দিরা ভেবেছিল এবারে নিজের ফোন নম্বরটাকে পাকাপাকি ভাবে বদলে নিতে পারলে আর বোধহয় শয়তানগুলো জ্বালাতে পারবে না। কিন্তু কোথায় কি! এসব মামলায় কতদিনই বা আর আসামীদের জেল খাটতে হয়। তার উপরে আবার যদি আসামীদের পিতৃপরিচয়েরও একটা প্রভাব সেক্ষেত্রে কাজ করে, তবে তো সোনায় সোহাগা। মন্দিরা তবুও এসব আজেবাজে জিনিসকে যতটা সম্ভব পাত্তা না দিয়ে থাকতে চেষ্টা করে। কলকাতায় মা যতদিন একা ছিলেন ততদিন অবধি ভয়টা একটু বেশি ছিল। গত জুনে মা চলে গেলেন। মন্দিরা ঝাড়া হাত পা হয়ে দিল্লিতে চলে এল। অনেকদিন ধরেই এই এনজিওটার হয়ে তার কাজ করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এই মেসেজগুলো সত্যিই বড় অস্বস্তিকর। মেসেজটা খুলে মন্দিরা দেখল ভুল বানানে, ইংরেজী হরফে লেখা রয়েছে, “সবকিছুকে নজর রাখছি!” ... বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ।

মন্দিরার অরওয়েলের উপন্যাসটাকে মনে পড়ে গেল। অবশ্য এই মেসেজ যার কাছ থেকে এসেছে, শুধু সে কেন - তার গোটা পরিবারেরও কেউ কোনদিন অরওয়েল, কীপলিং অথবা আর এল স্টিভেনসনকেও উলটিয়ে দেখেছে বলে মনে হয় না। মন্দিরা বিরক্ত হয়ে ফোনটাকে সুইচ অফ করে দিল। আজ বেশ ধকল গেছে কাজের। মন্দিরা চোখ বোজে। মনটাকে শান্ত করতে চেষ্টা করে। কানের কাছে তবুও ফিসফিস করে খুব চেনা গলায় কে যেন একটা বলে চলে, বিকৃত উচ্চারণে, “সবকিছুকে নজর রাখছি!”

“বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ!”

(২)

দরজায় ওরা ঢেরা কেটে দিয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকে পড়ে আসা সেই মর্জিনা-আবদাল্লার চিরকালীন আখ্যানের মতোই। মরিয়ম চোখ বুজে শুতে চেষ্টা করে। গতকাল আমেরিকাতে নতুন প্রেসিডেন্ট শপথ নিয়েছেন। তিনিও আফগানিস্তান থেকে জোরকদমে সেনা সরিয়ে নেওয়ার পক্ষপাতী বলে শোনা যাচ্ছে। এদিকে মরিয়ম বেশ কিছুদিন ধরেই এটাও লক্ষ্য করছে যে, ইদানীং যেন তার এজলাসে গুরুত্বপূর্ণ মামলার সংখ্যা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হচ্ছে। সিনিয়র বিচারপতি ইবাদত খানসাহেবকে জিজ্ঞাসা করেও সে কোনও সদুত্তর পায়নি। জালালাবাদের এই বিচারালয়ে মরিয়ম ছাড়াও আরও একজন মহিলা বিচারক ছিলেন। তিনিও হঠাৎ কোনও কারণ ছাড়াই গত ডিসেম্বরে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে আমেরিকার ভিসার জন্য আবেদন করেছেন। তাঁর ভিসাও বোধহয় খুব শিগগিরই এ্যাপ্রুভড হয়ে যাবে বলে শোনা যাচ্ছে। মরিয়ম তার কম্পিউটারে বসে খালেদ হোসেইনির ‘থাউজ্যান্ড স্প্লেনডিড সান’ বইটার পুরনো পিডিএফটাকে উলটিয়ে পালটিয়ে দেখছিল। বড় কষ্ট করে কেনা বইটাকে হারিয়ে ফেলার পরপরই, আরও কষ্টে সে অন্তত এই পিডিএফটাকে জোগাড় করতে পেরেছে। গল্পের মরিয়মকে তার বড় ভালো লাগে, বড় কাছের বলে মনে হয়। হেরাত, পঞ্জশির, পাগমান, হিন্দুকুশ – এই নামগুলোকে ফিসফিস করে সে নিজের মনের ভিতরে উচ্চারণ করে। এই তার স্বদেশ। এই দেশ ছেড়ে আর কোনও দেশে পাড়ি দেওয়ার তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। কিন্তু, ওরা তার বাড়ির দরজাতে চকখড়ি দিয়ে ঢেরা কেটে দিয়ে গেছে। যদিও সুলেমান এখনও জেল থেকে ছাড়া পায়নি, আইন অনুযায়ী আরও অন্তত বিশবছর তার জেলখাটার মেয়াদ বাকি পড়ে রয়েছে। কিন্তু মোল্লা বরাদর আর প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই কর্তাদের হম্বিতম্বি, বক্তব্যকে আজকাল আর এতটুকুও ভালো ঠেকছে না কারোর। মরিয়ম কি জালালাবাদ থেকে কাবুলে চলে যাওয়ার চেষ্টা করবে ?

(৩)

নয়াদিল্লিতে ভোগল আর জংপুরার মাঝামাঝি একটা ছোট্ট বৌদ্ধ মন্দির আছে। এই জায়গাটা মোটামুটি নিরিবিলি, একেবারে শুনশান নয় তাই বলে। মোটামুটি মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির বাস। একপাশে বাবাজি’র রুটি-তড়কার দোকান। সপ্তাহের বেশিরভাগ দিনেই মন্দিরা এই বাবাজি’র দোকান থেকেই ডিনারটা সেরে নেয়। বাবাজি’র দোকানে একটি ছেলে আছে। নাম লক্ষণ। দেশের বাড়ি মেদিনীপুর। দিদিকে সে খুবই যত্ন করে। কোনও কোনও দিন বেশি রাত হলে তাকে সাবধান করে দেয়। এ বাপু দিল্লি, বড় কঠিন ঠাঁই। লক্ষণের কাছ থেকেই মন্দিরা জেনেছিল দু’চারজন অচেনা ছেলেছোকরাকে সে নাকি আজকাল এই চত্বরে ঘুরপাক খেতে দেখেছে। এমনকী একটি ছেলে নাকি লক্ষণকে এসেও মন্দিরার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিল। আজ রাত্রে খাওয়ার সময়েই মন্দিরাকে লক্ষণ আবার সেই কথা বলছিল। লোকগুলো নাকি আজও এসেছিল। ওদের মধ্যে একজন নাকি বাঙালী। বেশ পয়সাওলা চেহারা। বর্ণনা শুনেই মন্দিরা ছেলেটাকে চিনতে পারল। “বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ!”

দু’বছর আগেকার সেই বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যেয়, অন্ধকার শহরে ভকভক করে মদের গন্ধ বেরুনো মুখ, পরণের সালওয়ার-কামিজের উপর বিশেষ বিশেষ জায়গাতে চেপে বসতে চাওয়া মুষ্টিবদ্ধ দুখানি হাত – শতচেষ্টা করলেও কি সেই মুখ, সেই নোংরা হাত, গলার চকচকে সোনার চেন, হাতের বালাটাকে ভুলতে পারবে মন্দিরা? এমএলএ বাবার দাপটে সেই মুখ তখন এলাকার ত্রাস হয়ে উঠেছিল। সঠিক জায়গাতে লাথি চালিয়েছিল মন্দিরা। তারপর দৌড়েছিল থানার দিকটাতেই, ভিজতে ভিজতে, সপসপে অবস্থায়। নেহাত মন্দিরারও কলেজসূত্রে অল্পবিস্তর পরিচিতি ছিল। সিআর থেকে শুরু করে আরও সব দাদা-দিদিদেরকে ফোন করায় সরাসরি মিডিয়া হাউজগুলোতে খবর চলে গিয়েছিল। কিন্তু পরের কিছুদিনেই মন্দিরা বুঝতে পেরেছিল দীর্ঘমেয়াদে এই সমস্ত লোকেদের বিরুদ্ধে একার জোরে লড়াই করা চলে না। তাই বলে সেই মুখ যে ওকে দেড়হাজার কিলোমিটার দূরত্বের দিল্লিতেও তাড়া করে বেড়াবে, মন্দিরা আশঙ্কা করতে পারেনি। এই জংপুরা আর ভোগল এলাকাতেও!

মনে মনে মন্দিরা ভেবে রেখেছিল পরদিন সকাল হলেই এখানকার অফিসে ওর টিমলিড, এনজিওতে সবার প্রিয় মিঠিদি ওরফে মিঠি শ্রীবাস্তবকে সবটা খুলে বলবে। দরকার হলে লোকাল থানাতেও একটা এফআইআর করে রাখবে। সাবধানের মার নেই। মন্দিরা তার জীবন দিয়ে এটাকে উপলব্ধি করেছে। নইলে ওদের সিআরকেও ঘটনার ঠিক তিনমাসের মাথায় কলেজের সামনেটায় বড় রাস্তার উপরে স্কুটার এ্যাক্সিডেন্টে পড়তে হয় ? মন্দিরা এতসব ভাবতে ভাবতেই জোরকদমে পা চালিয়েছিল। কিন্তু,

মন্দিরার ভিজতে ভালো লাগে। সেদিনের সেই বৃষ্টিভেজা সন্ধেরাতের আবহতে ভিজতে ভিজতেই যে তার টিউশন থেকে বাড়ি ফিরতে  দেরি হয়েছিল সে কথা অনেকেই পরে আন্দাজ করেছিল। কিন্তু দিল্লিতে এই অমাবস্যার রাত্তিরে আকাশের কোথাও এতটুকুও মেঘ ছিল না। এতটুকুও বৃষ্টি পড়েনি। বাইকটা চুপিসাড়ে মন্দিরার পিছন পিছনই এগিয়ে এসেছিল। দোকানের পিছনে লক্ষণ তখন সারাদিনকার বাসন মাজতে ব্যস্ত ছিল বলেই হয়তো বা লক্ষ্য করেনি। সমস্ত মুখ, শরীর, বুকের উপরে অনেকটা জায়গা সপসপে হয়ে ভিজে গিয়েছিল মন্দিরার। প্রায় একলিটারের একটা বোতল। নাকের উপরে যখন সেই ঝাঁঝাঁলোগন্ধী তরলের প্রথম ছোঁয়াটা তার লেগেছিল, মন্দিরা প্রথমেই চোখটাকে বুজিয়ে ফেলেছিল। শহরজুড়ে সে বৃষ্টি নামার প্রতীক্ষা করেছিল তখন। চোখটুকুকে সে কোনোমতে বাঁচাতে চেষ্টা করেছিল। অনেকখানি জায়গা জুড়ে তখন – আগুন জ্বলে উঠেছিল হঠাৎ।

(৪)

ডানকার্ক। ডিজিটাল ডানকার্ক।

একনাগাড়ে মরিয়মের মোবাইলে মেসেজ ঢুকছিল। আমেরিকানদের জন্য অন্তত মোবাইল ইন্টারনেটের কিছু পরিষেবাকে এখনও তারা ব্যবহার করতে পারছে। আগস্ট, ২০২১এর পর থেকে তো কার্যত গোটা দেশেই সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। মরিয়ম এখন রাতবেরাতেও উঠে গিয়ে দু’চারবারে সদর দরজাটাকে দেখে আসে। কান পেতে শুনতে চেষ্টা করে কোথাও কোনও বেয়াড়া শব্দ হল কিনা। জেল ভেঙে সক্কলে পালিয়েছে। এমনকি সুলেমান আর সুলেমানের বন্ধুরাও। নিজের বউ থাকা সত্ত্বেও পাড়ার আরেকটি মেয়েকে ভালো লেগেছিল বলে তুলে এনে তাকে ধর্ষণ করেছিল সুলেমান। নিজের বউ প্রতিবাদ করায় তাকে সবক শেখাতে তুলে দিয়েছিল ওর বন্ধুদের জিম্মাতে। সুলেমান-সহ আরও তিনজনকে পঁচিশ বছরের সাজার মেয়াদ শুনিয়েছিল মরিয়ম। ওর দরজাতে আজকাল প্রত্যেক রাত্তিরেই কারা যেন ঢেরা কেটে দিয়ে যাচ্ছে। লায়লাদিদি আমেরিকাতে পৌঁছেছেন। লায়লাদিদিরাই আরও কয়েকজন মিলে আমেরিকাতে বসে সেখানকার বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এখন চেষ্টা করে যাচ্ছেন মরিয়মদেরকে আফগানিস্তান থেকে বের করে আনতে। মরিয়মের নাকি ভিসা তৈরি হয়ে গেছে। আজ রাত্তিরে একটা জিপ আসবে। মরিয়মকে সেই জিপ কাবুল পৌঁছে দেবে। কোনোমতে একবার আমেরিকান দূতাবাসে পৌঁছতে পারলেই মরিয়ম নিশ্চিন্ত। মোবাইলের মেসেজে শেষমুহূর্ত অবধি মরিয়মের কি কি বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিত সেগুলোকেই পাখিপড়ার মতো করে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন লায়লা শেখ। আরও অন্যান্য দেশীবিদেশী মানুষেরাও মেসেজ করছিলেন। ওদের, অর্থাৎ কিনা আফগানিস্তানে কর্মরত মহিলা বিচারপতি-সহ অন্যান্য পেশাদার মহিলাদের সেই দেশ থেকে উদ্ধার করতে অনেক কটা অনলাইন দল তৈরি করে ফেলা হয়েছে। হোয়াটস্যাপ, ইনস্টাগ্রাম থেকে শুরু করে ট্যুইটারে, ফেসবুকে। মরিয়মকে লায়লাদিদি বলেছেন, এটাকে নাকি আমেরিকাতে বলা হচ্ছে ডিজিটাল ডানকার্ক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই ঐতিহাসিক উদ্ধার-অভিযানের কথা স্মরণে রেখে। মরিয়ম ঠোঁট টিপে হাসতে চেষ্টা করে। এই দেশ ছেড়ে, এই শহর ছেড়ে আর কোথাওই যে তার যেতে ইচ্ছে করে না।

(৫)

কাবুল থেকে জালালাবাদ। জালালাবাদ থেকে কাবুল। আট নম্বর জাতীয় সড়ক, বা কাবুল-জালালাবাদ হাইওয়ে। আশ্চর্য সুন্দর এক যাত্রাপথ। ছোটবেলা থেকেই কত না বার এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করেছে মরিয়ম। এই রাস্তাতেই পড়বে টং-এ ঘরু গিরিখাত। পশ্চিমে হিন্দুকুশ থেকে উৎপত্তি হয়ে সুন্দরী কাবুল নদী, কাবুল শহরের পাশ দিয়ে এসে আরও পূর্বে জালালাবাদের দিকে এগিয়েছে। আরও পূর্বে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে আটক প্রদেশের কাছে সেই নদী সিন্ধুতে গিয়ে মিশেছে। জালালাবাদ থেকে কাবুল যেতে গেলে এই টং-এ ঘরু গিরিপথের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। দুপাশে খাড়াই পাহাড়। সুউচ্চ, সুতীক্ষ্ণ একেকটা পাথরের দেওয়াল। আর এ্যাসফল্ট চকচকে রাস্তার পাশ দিয়েই খরস্রোতা সেই কাবুল নদী প্রবাহিত। তার কুলকুল, ঝরঝর শব্দকে শুনতে শুনতেই অনায়াসে গাড়ি চালানো যায়। রুক্ষ, পাথুরে পাহাড়গুলোর উপরে সূর্যের আলো এসে পড়ে। ছোটবেলায় এই রাস্তাতে গাড়ি চালাতে চালাতেই ওর বাবা ওকে দেশবিদেশের সমস্ত মহীয়সী নারীদের গল্প শোনাতেন। ভ্যালেন্টিনা তেরেস্কোভার গল্প। এ্যামেলিয়া ইয়ারহার্টের গল্প। মরিয়মের মনে পড়ে সেসব। সোভিয়েত আগ্রাসন, মুজাহিদিন শাসন, তালিবানের ক্ষমতা দখল, আর সবশেষে মার্কিনি হামলা ও হামিদ কারজাইয়ের শাসন। বিগত পঞ্চাশ বছরে আফগানিস্তানের ইতিহাস এমন ভাবেই বদলিয়েছে। বারংবার একেকটা উত্থান আর একেকটা পতনের ধাক্কাতে রকেট লঞ্চার, অথবা এয়ার রেডের আকস্মিক সাইরেনের শব্দকে তাদের জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ করে নিতে কাবুলবাসীর অন্তত অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। কারজাইকে সামনে রেখে আফগানিস্তানে আমেরিকার শাসন চললেও দেশের মানুষের উন্নতিতে তার ততটাও প্রভাব পড়েনি। অন্তত মরিয়মের তাই মনে হয়। প্রভাব পড়লে কি আর এতদিন পরেও এমনটা অনায়াসেই তালিবান মোল্লারা ক্ষমতা দখল করে নিতে পারত ? অন্ধকার কাবুল জালালাবাদ হাইওয়ে ধরে শোঁ শোঁ করে জিপটা ছুটে চলেছে।

মরিয়মরা পালাচ্ছে। মরিয়মদেরকে পালাতে হয়। সবসময় পালাতে হয়। তাদের বাড়বাড়ন্তকে সমাজ ভালো চোখে দেখে না। একথা মরিয়ম (অথবা মন্দিরাদের মতো একেকজন) নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছে। হাইওয়ের উপরে কয়েকটা আলো জ্বলছে। কয়েকটা টয়োটার হেডলাইট। উপরে কয়েকটা অবয়ব। মাথায় কাপড় ঢাকা। কয়েকটা বিসদৃশ নল উঁচিয়ে রয়েছে তাদের পিঠ থেকে। মরিয়ম নিজের গাড়িটাকে থামিয়ে দিতে বলল।

এই জায়গাটা অপরূপ সুন্দর। মরিয়ম বেরুবার সময়েই খেয়াল করেছিল আজ পূর্ণিমা। দুপাশের পাহাড়গুলোর উপরে ভরা চাঁদের জ্যোৎস্নাতে যেন বান ডেকে গিয়েছে। পাথর, নুড়ি, এমনকি ঘাসগুলোও কেমন যেন ফ্যাকাশে একটা আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠে মিটমিট করে মরিয়মের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। কাবুল নদীর একেকটা ঢেউ, অন্য একেকটার উপরেই আছড়িয়ে পড়তে পড়তে চলেছে। কুলকুল ঝরঝর শব্দ ভিন্ন আর কোথাও কোনও শব্দ নেই। মরিয়ম জিপ থেকে নেমে এল। এখানে হাইওয়ের একেবারে পাশ দিয়েই নদীর কোলটিতে সটান নেমে যাওয়া যায়। চাঁদের জ্যোৎস্নাতে আজ এই কাবুল নদীতেও যেন আনন্দের বান ডেকে গিয়েছে। মরিয়মের রুমির কবিতাকে মনে পড়ছিল। আর মনে পড়ছিল জালালাবাদ। মুঘল সম্রাট বাবরের পৌত্র জালালউদ্দিনের নামে যে শহরের নামকরণ করা হয়েছিল, সেই জালালাবাদ। মরিয়ম শুনেছে আরও পূবের দেশ ভারতবর্ষেও নাকি আফগানিস্তান নিয়ে চর্চা করা হয়। বাঙালী নোবেল লরিয়েট রবীন্দ্রনাথ, তাঁর ছাত্রেরা কয়েকজন ... মরিয়ম ভাসা ভাসা শুনেছিল কোনও এক সেমিনারে – তাঁদের বিষয়ে। তাঁদের লেখালিখির বিষয়ে। মরিয়ম কাঠখোট্টা বিচারক। তবু কবিতাকে, ছবিকে দেখতে, উপভোগ করতে তার ভালো লাগে। গান্ধার আর্ট নিয়ে পড়াশোনা করতে ভালো লাগে।

এও সত্য। সত্য ভিন্ন আর কিছুই নয়। আফগানিস্তানের প্রতিটা ফুল, প্রতিটা সুন্দর কুসুমকে আমরা এভাবেই পদদলিত করেছি। মরিয়ম নদীর দিকে নামতে নামতে ভাবছিল, অনেক দূরেকার কোনও এক দেশের মাটিতে, কোনও এক সংবেদনশীল মানুষ – হয়তো বা এমনটাই ভাবতে ভাবতে চলেছে। অথচ তার হাতেও যে আর বেশি সময় নেই। মরিয়ম দাঁড়িয়ে পড়ল। টয়োটা গাড়িদুটো এবারে ওদের গাড়িটার দিকেই এগিয়ে আসছে। মরিয়ম চওড়া হাসি নিয়ে পাহাড়গুলোর দিকে তাকালো। নদীটার দিকে তাকালো। অপারেশান ডানকার্ক। ডানকার্কেও সকলকে বাঁচানো যায়নি। এই ডিজিটাল ডানকার্কেও তাই এমন একেকটা ফলআউট প্রত্যাশিতই ছিল বোধহয়।

অনেক দূরেকার দিল্লিতে, ছোট বেসরকারি একটি নার্সিংহোমের বিছানাতে শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে মন্দিরাও তখন কিসের যেন এক উপলব্ধিকে অনুভব করতে চেষ্টা করছিল। কিছুতেই পেরে উঠছিল না। ওই আগুনে-যন্ত্রণার আড়ালে আর কোনও কিছুকেই তখন অনুভব করা চলে না। মন্দিরা আর মরিয়ম, পাশাপাশি শুয়েছিল।

... এখন সবসময় ওদের মনের মধ্যে, শরীরের মধ্যে একটা পোড়া, জ্বালা-ধরানো অনুভূতি হতে থাকে। কিছু একটা যেন পুড়ছে। বেশ অনেকক্ষণ ধরে পুড়ছে। গন্ধটা ওদের নাকে এসে লাগে। এই গন্ধতে ওরা এখন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে ...

বেশ, পুড়ুক। সমস্তকিছু পুড়ুক।

এইটুকুই

[এই রচনার ফুটনোট হিসেবে জানাতে চাইব, ২০২১এর জানুয়ারি মাসে আফগানিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত দুজন মহিলা বিচারপতিকে অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীরা গুলি করে হত্যা করে। আগস্ট, ২০২১এ তালিবানদের হাতে আফগানিস্তানের পতনের পরেপরেই ‘ডিজিটাল ডানকার্ক’ অপারেশনের মাধ্যমে ‘ইন্টারন্যাশনাল এ্যাসোসিয়েশন অব উইমেন জাজেস’দের তরফে আরও একগুচ্ছ সংগঠন আফগানিস্তানের মহিলা বিচারপতিদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা ও প্রয়োজনে তাদের অভিবাসনের জন্য কাজ করে চলেছে। এই রচনা তাদেরকে মনে রেখেই।]

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক

ছবি: সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment