দুই নারী হাতে তরবারি (?)

  • 16 August, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 555 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ অবধি, আমাদের দৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশী করে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে – সেটি হল, সেই একই সময়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মনোবিজ্ঞানের মতো জটিল একটি বিষয়ে যে দুইজন বিশেষজ্ঞ নিজেদের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য এ্যাকাডেমিক লড়াই চালাচ্ছেন – তাঁরা দুজনেই সে সময়ে মহিলা, দুজনেই তাঁদের কৃতিত্ব ভিন্ন আর কোনও কিছু দিয়েই নিজেদের সেই উচ্চতায় পৌঁছননি। তাঁরা নিজেদের উৎকর্ষের মাধ্যমেই মনোবিজ্ঞানের পৃথিবীতে নিজেদের জন্য একেকটি করে স্থায়ী আসন তৈরি করে নিয়েছেন। নারীর বিজ্ঞানচর্চার বিষয়ে ধারাবাহিক (পর্ব ২৪)

ভিয়েনার গেস্টাপো হেডকোয়ার্টার্সে ঢোকবার সময় বৃদ্ধ ভদ্রলোক জানতেও পারেননি, সঙ্গে তাঁর দুই মাঝবয়সী পুত্র ও কন্যা - যথাক্রমে মার্টিন ও আনা, রীতিমতো পকেটে করে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ নিয়ে প্রস্তুত হয়ে এসেছে। নাৎসি বাহিনীর অত্যাচারের মুখে নিজেরা ভেঙে পড়বার আগেই যাতে নিজেদেরকে শেষ করে দেওয়া যায় সেই ভাবনা থেকেই এই পদক্ষেপ। নাৎসি বাহিনীর অত্যাচারের বিবরণ তারা অনেক আগেই শুনেছে। নিজেদের অস্তিত্বকে তাই এত সহজে ভেঙে যেতে দেওয়ার আগেই, নিজেদের আত্মসম্মানকে সবার উপরে বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই - তাদের এই অসমসাহসী সিদ্ধান্ত। কিন্তু শেষ অবধি সেই দিন অবশ্য সপুত্রকন্যা ভদ্রলোক ছাড়া পেয়েছিলেন। কিছুমাসের মধ্যেই পরিবার সমেত সেই ভদ্রলোক নিজের দেশ ছেড়ে অনেক দূরে পাড়ি জমিয়েছিলেন ইংল্যান্ড অভিমুখে। লন্ডনে এসে তাঁরা সপরিবারে থিতু হয়েছিলেন। ১৯৩৯এ তাঁর মৃত্যু হয়। যদিও, বিজ্ঞানের যে বিশেষ ক্ষেত্রটিতে তিনি আক্ষরিক অর্থেই একটি প্রভূত সম্ভাবনাময় দিগন্তকে উন্মোচন করে দিয়ে যেতে পেরেছিলেন – সেই বিষয়েই, তাঁরই প্রদর্শিত পথে ক্রমশ নিজেকে আরও একটু একটু করে প্রতিষ্ঠিত করবেন তাঁরই সুযোগ্যা কন্যা। যে কন্যার নাম আনা ফ্রয়েড - যে পিতার নাম সিগমুণ্ড ফ্রয়েড। আনার জন্ম ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৩রা ডিসেম্বর।

চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে অনেক কথাই ইতিমধ্যে বলা হয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, তাঁদের অবদান ইত্যাদির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু আনা ফ্রয়েডের বিষয়ে লিখতে বসে সত্যি করেই প্রথমটা মনে হচ্ছিল, বিগত দিনগুলিতে আমরা একে অপরের মনের খবরই বা কতটুকু রেখেছি ? বিশেষত যখন অতিমারীর সময়ে আমরা নিজেরা, নিজেদের ঘরের ভিতরে এঁটে দরজা বন্ধ করে বসেছিলাম, তখন শরীরের খবর রাখতে গিয়ে – আমরা মনের খবর রাখিনি। মনের কথাটুকুও জিজ্ঞেস করিনি। তারই ফলস্বরূপ আজ বিশাল এক সংখ্যার মানুষ ক্রমশ মনের অসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন। আমরা জানতে পারছি না কি অদ্ভুৎ এক নৈঃশব্দের ভিতরে তাঁরা তলিয়ে যাচ্ছেন। আর কখনও বোধহয় তাঁরা ভেসে উঠবেন না। তার কারণ, আমাদের সমাজ এখনও মনোরোগ বা মানসিক অসুস্থতা তো অনেক দূরের ব্যাপার, একাকীত্ব অথবা মনোকষ্টকেও সমস্যা হিসেবে স্বীকার করতেই প্রস্তুত নয়। তাঁদেরকে মনে করিয়ে দিই, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের বড়মামা চরিত্রটি কোনও এক গল্পে একবার তাঁর ডাক্তারি চেম্বারের বাইরেটায় বড় বড় করে সাইনবোর্ডে রঙিন হরফে লিখে দিয়েছিলেন, “সব অসুখই মনের, আগে মনের অসুখ সারান”। আমরা কেবল সেই উক্তিকে হাসির গল্পের সংলাপ মনে করেই এড়িয়ে গিয়েছি। আমাদের কাছে সাহিত্য যে সবসময়েই আয়েশ করে বালিশে হেলান দিয়ে পড়বার জিনিস।

ছোটবেলায় দিদি সোফি অথবা মার্থার চেয়ে বাবা সিগমুণ্ডের কাছেই বেশী থাকতে চাইতেন আনা। বাবা, তাঁর দুই মেয়ের মধ্যে এই প্রচ্ছন্ন দূরত্বকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন এই দূরত্ব হচ্ছে সৌন্দর্যের সঙ্গে মস্তিষ্কের দূরত্ব। কিশোরী বয়স থেকেই আনা ক্রমশ পিতার কাজকর্মের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন – এমনকি, সিগমুণ্ড ফ্রয়েড কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ভিয়েনা সাইকোএ্যানালিটিক্যাল সোসাইটির সভাগুলিতেও নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন। স্কুলে পড়তে পড়তেই কিশোরী আনা ইংরেজি, ফরাসি ও ইতালিয়ান ভাষাতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে বেশ কিছুদিনের ছুটিতে তিনি ইতালি ভ্রমণ করেন। শীতের সময়ে এই দীর্ঘ অবকাশে তিনি তাঁর মনের মধ্যে নিজের ভবিষ্যৎ, নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে নানাবিধ মানসিক চিন্তা বা উপলব্ধিকে ক্রমশ জন্ম নিতে, ক্রমশ বেড়ে উঠতে দেখেন। এই সময়ই তিনি নিজের মানসিক টানাপোড়েনের বিষয়গুলিকে নিয়ে তাঁর পিতার সঙ্গে পত্রালাপ শুরু করেন। পাশাপাশি পিতার লেখা বিভিন্ন বই ও গবেষণাপত্র ইত্যাদি থেকেও তিনি নিজের উপলব্ধিগুলির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজতে সচেষ্ট হন। শীতের ইতালিতে এভাবেই ক্রমশ কিশোরী আনার মনোবিজ্ঞানের পথে যাত্রা শুরু হয়।

এর কিছুদিন পর, আনা ফ্রয়েড তাঁর নিজেরই স্কুল কটেজ লাইসিয়াম’এ শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে ১৯১৫ থেকে ১৯১৮, এই সময়ের মধ্যে তিনি শিক্ষিকা হিসেবেও অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁর শিক্ষাদানপদ্ধতি এবং শিশু ও কিশোরদের বিষয়ে তাঁর মনোভাব, তাদের সঙ্গে বন্ধু অথবা মায়ের মতো করে মিশে যাওয়ার একটা প্রবণতা – এই প্রত্যেকটি বিষয়ই ধীরে ধীরে আনার ভিতরকার সুপ্ত মনোবিদ-সত্তাটিকে উন্মোচিত করেছিল। পরবর্তীকালে এই শিশু-মনস্তত্ত্বের বিষয়েই তিনি জগদ্বিখ্যাত হয়ে উঠবেন।

১৯১৫ সালেই তিনি তাঁর পিতার সহায়তায় ভিয়েনা সাইকোএ্যানালিটিক্যাল সোসাইটির উদ্যোগে জেমস জ্যাকসন পুটন্যাম এবং হারমাইন হুগ-হেলমুথের মনোবিজ্ঞান সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্রকে জার্মান ও ইংরেজি ভাষাতে অনুবাদ করেন। ১৯১৮ সাল থেকে তিনি মনোবিজ্ঞান সংক্রান্ত আরও কয়েকটি কর্মশালাতে অংশ নেন, এবং নিজেকেই একজন ‘সাবজেক্ট’ বা ‘পরীক্ষার বস্তু’ হিসেবে ধরে নিয়ে নিজের মানসিক অবস্থাগুলিকে মনোবিজ্ঞানের তত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট হন। দুর্ভাগ্যবশত ১৯১৮ সালে আনা ফ্রয়েড  যক্ষ্মা রোগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘ অসুস্থতার কারণে তিনি শেষ অবধি শিক্ষিকার দায়িত্বভার থেকে অব্যাহতি নেন এবং একান্ত ভাবেই মনোবিজ্ঞানের চর্চাতে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯২৩ সালে সিগমুণ্ড ফ্রয়েড চোয়ালের ক্যানসারে আক্রান্ত হলে পরে পিতা ও পুত্রী একে অপরের আরও কাছাকাছি আসেন। কেবল কন্যা হিসেবে সেবাই নয়, এই সময়ে আনা ফ্রয়েড, কার্যত দেশে ও বিদেশে সিগমুণ্ড ফ্রয়েডের ব্যক্তিগত সচিব এবং মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেন। মনোবিজ্ঞান সংক্রান্ত একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশ ও সম্মেলনে পিতা সিগমুণ্ডের পরিবর্তে কন্যা আনাই তাঁর প্রতিনিধিত্ব করেন।

১৯২২ সালে আনা ফ্রয়েড কর্তৃক প্রকাশিত ‘বিটিং ফ্যান্টাসিস এ্যান্ড ডে-ড্রিমস’ প্রবন্ধটিকে, তাঁর মনোবিজ্ঞান সংক্রান্ত রচনাগুলির মধ্যে প্রথম মৌলিক রচনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।  এই প্রবন্ধটি সেই বছরই ভিয়েনা সাইকোএ্যানালিটিক্যাল সোসাইটির একটি আলোচনা সভায় পঠিত হয় এবং আনা ফ্রয়েড সোসাইটির বিশেষ সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯২৩ সাল থেকে আনা বিশেষ ভাবে শিশু-মনস্তত্ত্বে মনোনিবেশ করেন এবং ব্যক্তিগত ভাবে মনোবিদ হিসেবে প্র্যাকটিস করতে শুরু করেন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁরই কলমে প্রকাশিত হয় ‘এ্যান ইনট্রোডাকশন টু দ্য টেকনিক অব চাইল্ড এ্যানালিসিস’। এই বইটির মাধ্যমেই আনা শিশু-মনস্তত্ত্বের বিষয়ে তাঁর ভাবনাচিন্তাগুলিকে লিপিবদ্ধ করেন, এবং এমন একেকজন রোগীর ক্ষেত্রে একজন মনোবিদের কোন পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত সেই বিষয়েও আলোচনা করেন।

১৯২৫ থেকে ১৯৩৪ সাল অবধি আনা ফ্রয়েড ইন্টারন্যাশনাল সাইকোএ্যানালিটিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শিশুমনের সত্তা, রাগ, একাকীত্ব, দৌর্বল্য ও মানসিক টানাপোড়েনের বিষয়ে তিনি তাঁর গবেষণায় আলোকপাত করেন। ইগো বা সত্তার বিষয়ে, ইগো সাইকোলজির বিষয়ে আনা ফ্রয়েড কর্তৃক রচিত, ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ইগো এ্যান্ড দ্য মেকানিজমস অব ডিফেন্স’ – এই বইটিকেই এই বিষয়ে অন্যতম প্রথম এবং প্রধান গবেষণামূলক কাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৩৮ সালে নাৎসি বাড়বাড়ন্তের দৌলতে ফ্রয়েড পরিবারকে অবশেষে দেশত্যাগ করতে হয়, তাঁরা লন্ডনে এসে বসবাস করতে শুরু করেন।

১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে আনা ফ্রয়েড এবং ডরথি বারলিংহ্যামের উদ্যোগে লন্ডন শহরের উপকন্ঠে হ্যাম্পস্টেড ওয়ার নার্সারির প্রতিষ্ঠা হয়। অস্ট্রিয়া এবং জার্মানি থেকে আগত নাৎসি সন্ত্রাস এবং জার্মান কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলির দুর্বিষহ বিভীষিকাকে প্রত্যক্ষ করে আসা উদ্বাস্তু শরণার্থী শিশুদের জন্যই মূলত এই নার্সারিটির কথা ভাবা হয়েছিল। আনা ফ্রয়েড নিজে উদ্যোগী হয়ে এই নার্সারির সমস্ত আবাসিক চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবকদের, মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাঁদের আচার-আচরণ-কর্মপদ্ধতি ঠিক কেমনটা হওয়া উচিত, সেই বিষয়ে বুঝিয়ে দেন। এই সময়ে সমসাময়িক আরেক বিখ্যাত মহিলা মনোবিদ মেলানি ক্লেইনের সঙ্গে শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষানিরীক্ষা ও চিকিৎসার বিষয়ে একজন মনোবিদের পদক্ষেপ কেমনটা হওয়া উচিত – সেই নিয়ে আনা ফ্রয়েডের মতবিরোধ ঘটে। মেলানির বক্তব্য অনুসারে, আনা যেভাবে শিশুদের জন্য মানসিক চিকিৎসার বিষয়ে মনোবিদদেরকে ডাক্তারের চেয়েও বেশী করে মাতৃসুলভ হয়ে উঠবার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন তার মধ্যে কিছুটা হলেও সুপ্ত রক্ষণশীলতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়াও শিশুদের ক্ষেত্রে ইডিপাস কমপ্লেক্সের মতো জটিল একেকটি মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসা পদ্ধতি ঠিক কেমনটা হওয়া উচিত সেই নিয়েও দুজনের মধ্যে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

কিন্তু শেষ অবধি, আমাদের দৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশী করে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে – সেটি হল, সেই একই সময়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মনোবিজ্ঞানের মতো জটিল একটি বিষয়ে যে দুইজন বিশেষজ্ঞ নিজেদের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য এ্যাকাডেমিক লড়াই চালাচ্ছেন – তাঁরা দুজনেই সে সময়ে মহিলা, দুজনেই তাঁদের কৃতিত্ব ভিন্ন আর কোনও কিছু দিয়েই নিজেদের সেই উচ্চতায় পৌঁছননি। তাঁরা কেবল নিজেদের বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষের মাধ্যমেই মনোবিজ্ঞানের পৃথিবীতে নিজেদের জন্য একেকটি করে স্থায়ী আসন তৈরি করে নিয়েছেন। এমনকি কেরিয়রের শুরুতে আনা ফ্রয়েড কিছুটা হলেও তাঁর পিতার জগৎজোড়া খ্যাতি ও উপস্থিতির বিষয়ে সুবিধা পেলেও, মেলানি ক্লেইন একক দক্ষতায় নিজের কেরিয়রকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কেরিয়রের শুরুতে এজন্য তাঁকে যথেষ্ট পরিমাণেই পুরুষ সহকর্মী ও ঊর্ধ্বতন অধ্যাপকেদের টিটকিরি ও বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তবু মেলানি এবং আনা, এঁরা দুজনেই তাঁদের গবেষণার মাধ্যমে, তাঁদের দীর্ঘ পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে মনোবিজ্ঞান এবং শিশু-মনস্তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকে একটি নতুন পরিসরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন।

শেষ জীবনে আনা ফ্রয়েড একাধিকবার আমেরিকা গমন করেন। সেখানকার ইয়েল ল স্কুলে তিনি নিয়মিত ব্যবধানে তাঁর কাজের বিষয়ে বক্তৃতা করেন। ১৯৭০ সালের পর থেকে একাধিক ব্যক্তিগত শোকের তাড়নাতে ক্রমশ আনা ফ্রয়েড নিজেই বিধ্বস্ত হয়ে পড়তে শুরু করেন। তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত বন্ধু ডরথি বারলিংহ্যামের জীবনেও এই সময়ে একের পর এক শোকসংবাদ আসতে শুরু করে। ডরথির কন্যা ম্যাবি এই সময়ে মানসিক রোগের কারণে আনার দ্বারস্থ হয়, কিন্তু আনার কাউন্সেলিংয়ের পরেও তার মানসিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। শেষ অবধি ১৯৭৪ সালে ম্যাবি আত্মহত্যা করে। এই সমস্ত কারণে ক্রমশ শারীরিক ভাবে ভাঙতে শুরু করেন আনা ফ্রয়েড। ৯ অক্টোবর, ১৯৮২তে লন্ডন শহরে আনা ফ্রয়েড শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। লন্ডনের গোল্ডার্স গ্রিন সমাধিক্ষেত্রে পিতা সিগমুণ্ডের পাশেই আনাকে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর চেয়ে বয়সে খানিকটাই বড় ছিলেন মেলানি ক্লেইন। ১৮৮২ থেকে ১৯৬০ সাল অবধি তাঁর জীবৎকালে এই মেলানি ক্লেইনও শিশু মনস্তত্ত্বের বিষয়ে দিগন্ত উন্মোচনকারী কিছু কিছু বক্তব্য রাখেন। আনার সঙ্গে তাঁর মতাদর্শের বিরোধ থাকলেও মনোবিজ্ঞানের ইতিহাসে এই দুই নারীই এক চিরন্তন অনুসন্ধিৎসুতার পরিচয় রেখেছেন। তাঁদের হাতে তরবারি থাকলেও, সেই তরবারি ছিল কেবল যুক্তির দ্বারা, জ্ঞানের দ্বারা, অধ্যবসায়ের দ্বারা শাণিত। তাঁদের তরবারি যুদ্ধ হতো কাগজে-কলমে, আর সেই যুদ্ধের ফলস্বরূপ মনোবিজ্ঞানের পৃথিবীতে আমাদের সভ্যতা এগুতো আরও কয়েক কদম।

সূত্রঃ

[১] ‘আনা ফ্রয়েড, অস্ট্রিয়ান-ব্রিটিশ সাইকোএ্যানালিস্ট’, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা

[২] এলিজাবেথ ইয়াং-ব্রুহেল, ‘আনা ফ্রয়েডঃ এ বায়োগ্রাফি’, ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৮

[৩] পিটার গ্রে, ‘রিডিং ফ্রয়েড’, ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯০

[৪] ‘আনা ফ্রয়েড – হার লাইফ এ্যান্ড ওয়ার্ক’, ফ্রয়েড মিউজিয়াম পাবলিকেশনস, ১৯৯৩

[৫] আর. ডি. হিনশেলউড, ‘ক্লিনিক্যাল ক্লেইন’, বেসিক বুকস, ২০০৩

[৬] সুসান শেরউইন-হোয়াইট, ‘মেলানি ক্লেইন এ্যান্ড ইনফ্যান্ট অবজার্ভেশন’, ইনফ্যান্ট অবজার্ভেশন, খন্ড ২০, সংখ্যা ১, জানুয়ারি, ২০১৭

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক

ছবি: সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment