জন্মনিয়ন্ত্রণ ফতোয়া ও নারী অধিকার

  • 25 July, 2021
  • 1 Comment(s)
  • 822 view(s)
  • লিখেছেন : সরিতা আহমেদ
বিশ্বব্যাপী মহামারীর সংকটকালে নানা সমীক্ষায় উঠে এসেছে মেয়েদের উপর কী হারে বাড়ছে গার্হ্যস্থ হিংসার মাত্রা – সেখানে নারীর জরায়ুর অধিকারের প্রশ্নে রাষ্ট্রের ফতোয়া নেমে এলে কন্যাভ্রূণ হত্যার পাশাপাশি সার্বিক লিঙ্গানুপাত আরও নেতিবাচক হবে।

সাম্প্রতিককালে উত্তরপ্রদেশ সরকারের চালু করা জন্মনিয়ন্ত্রণ আইন নিয়ে দেশ উত্তাল । সার্বিক উন্নয়নমুখী ও জনহিতৈষী এই আইনের চটকদারিতা ও বিরোধী রাজনৈতিক কারবারিদের কাদা ছোঁড়াছুড়ির আড়ালে যে প্রশ্নটি চাপা পড়ছে তা হল নারী স্বাস্থ্য ও তার মানবাধিকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি। 

মূলত এই আইনটি ২০১৯ সালেই ভারতে জন্মনিয়ন্ত্রণ বিল (Population Regulation Bill, July 2019) নামে সংসদে উত্থাপিত হয়েছিল। দুই সন্তানের বেশি জন্ম নিষেধ, অন্যথায় সরকারি চাকরি হারানো, ভোটের টিকিট না পাওয়া, সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা, জীবন বিমা এবং স্কুল শিক্ষায় অধিকার হারানোর মত বেশ কঠিন কিছু শাস্তির কথা বলা হয়েছিল। আজকের যোগী সরকার সেটাতেই বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে। 

২০২১ সালের ওয়ার্ল্ড হেলথ স্ট্যাটিসটিক্স রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে নারী পুরুষের লিঙ্গবৈষম্যের ফলে কীভাবে মেয়েদের জীবনের মান, স্বাস্থ্য ও গড় আয়ু ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। দারিদ্র্যজনিত অপুষ্টি এর প্রধান কারণ হলেও পারিবারিক উদাসীনতা, ন্যূনতম পরিষেবার অপ্রতুলতার জন্য মেয়েদের নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলাও যথেষ্ট পরিমানে দায়ী। মেয়েদের সুস্থতা-অসুস্থতা নিয়ে সার্বিক গুরুত্বহীনতা বাধা দেয় তাদের স্বাধীন চলাফেরায়। ফলে উপেক্ষিত থেকে যায় তাদের হৃদরোগ, যৌনরোগ এবং মানসিক রোগের বিষয়গুলো। যার সাথে ‘মা’ হওয়াটা অঙ্গাঙ্গী যুক্ত। সমীক্ষায় দেখা গেছে, মেয়েদের মধ্যে ‘হিস্টিরিয়া’ রোগের সাথে জরায়ুর অসুখের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। এর পাশাপাশি যৌনাঙ্গের নানা রোগকে চেপে রেখে বন্ধ্যাত্বকে আহ্বান জানানো এই মহিলারা ক্রমাগত শারীরিক-মানসিক নিগ্রহ সইতে থাকেন কেবলমাত্র ‘মা’ না হতে পারার জন্য। মনের উপর ক্রমাগত চাপ তাদের মানসিক রোগের কবলে ফেলে। অথচ সমাজ আজও মেয়েদের গাইনো সমস্যাকে ‘মেয়েলি বিষয়’, ঝাড়ফুঁকের মত অযৌক্তিক পন্থা অবলম্বন এবং ‘মেয়েদের ওসব হয়েই থাকে’ ইত্যাদি ট্যাবুর আড়ালে স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছে।

আর এসবেরই ফল মেয়েদের ফার্টিলিটি রেটের এলার্মিং পতন। ১৯৬০ সালে TFR (Total Fertility Rate) যেখানে ছিল ৬, সেটা ২০১৮ সালে নেমে এসেছিল ২.২ তে এবং চলতি বছরে ২০২১ সালে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ২.১ এ। পরিসংখ্যানের আরেকটা হাস্যকর অধ্যায় হল, যে ঘিঞ্জি মুসলিম মহল্লাগুলোকে ‘জব্দ’ করার জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ আইনের এত কঠিন শাস্তির বহর, সেই মুসলিম সমাজে মেয়েদের (পড়ুন হবু মায়ের) অবস্থা আরও খারাপ। তাদের TFR –এর পারদ দলিত হিন্দু মহিলাদের চেয়েও দ্রুত নিম্নগামী। 

এমতাবস্থায় প্রথম সন্তান হোক বা দ্বিতীয়, হবু মায়েদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণের জন্য রাষ্ট্র কি আদৌ দায়িত্বশীল?

এরপর আসে বাচ্চা জন্মের পেছনে মেয়েদের ভূমিকার কথা। ক’বছর আগেই সুপ্রিম কোর্ট সিঙ্গল মাদারদের অধিকার নিয়ে যুগান্তকারী রায় দিয়েছিল যাতে শিশুর অধিকারের পাশাপাশি মায়েদের স্বাধীন অধিকারের প্রশ্নটিও গুরুত্ব পেয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক জন্মনিয়ন্ত্রণ আইনের প্যাঁচে মেয়েদের সামাজিক প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারটি আরও অতলে তলাবে, কারণ বিয়ের পরে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবর্গের পরিবারের মেয়েরা কার্যতই ‘পরের ঘরের সম্পত্তি’ হয়ে যায়। সেখানে তারা নিজেদের শরীর এবং বাচ্চার জন্ম দেওয়ার বিষয়ে কতটুকু সিদ্ধান্ত নিতে পারে? স্বামীর বাড়ির লোকেদের বংশে বাতি দেওয়ার জন্য অন্ধ পুত্রমোহ যেখানে মেয়েদের আঁতুরে ঢোকা ইস্তক নিজের বাঁচা-মরার প্রশ্নেই জর্জরিত করে রাখে, সেখানে পুত্রকামনায় ফি-বছর বাচ্চা পয়দার চাপ, যাবতীয় ঝক্কি এবং একাধিক বাচ্চা পয়দার রাষ্ট্রীয় শাস্তির কোপ তাদের ঘাড়ে পড়লেও, জন্মনিয়ন্ত্রণের রাশ আদৌ তাদের হাতে কিনা সে প্রশ্ন কি সরকার ভাবছে?

পঞ্চায়েত স্তরে ভারতের হাজারো গ্রামের দায়িত্বে এখন মহিলা গ্রামপ্রধানরা রয়েছেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা যাই থাক কিন্তু লিঙ্গপরিচয়ের ভিত্তিতে জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে নিজ পরিবারে কার্যত ক্ষমতাহীন - এইসব অর্ধশিক্ষিত ও নিম্নবর্গের মহিলাদের সন্তান-সংখ্যার নিরিখে যদি সরকারি পদ কেড়ে নেওয়া হয় তবে মহিলাদের ক্ষমতায়নের দাবী নিয়ে এতশত ঢক্কানিনাদ বৃথা যাবে।

শিক্ষিত সমাজেও পরিবারের মাথার চাকরি বাঁচাতে বাড়বে যথেচ্ছ গর্ভপাতের ঘটনা। সে সাবালিকা হোক বা নাবালিকা তার স্বাস্থ্যের বিষয়ের চেয়েও বড় স্বার্থ হয়ে দাঁড়াবে বাড়ির কর্তার (কিছু ক্ষেত্রে তাদের নিজেদেরও ) ‘স্ট্যাটাস মেনটেইন’! কারণ ‘মাই বডি/ মাই চয়েস’ স্লোগানে যতই উত্তাল হোক সামাজিক মাধ্যম- বাস্তব সমাজে তাদের ‘বডি’ অথবা ‘চয়েস’ সম্পূর্ণ রাষ্ট্রের মর্জি মাফিক চলে, আমাদের পাড়া, গ্রাম কিম্বা শহুরে সমাজ যার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ বিশেষ । রাষ্ট্র যখন চাইছে জন্ম নিয়ন্ত্রণ, তখনও মেয়েদের শরীরে পড়ছে কোপ – আবার যেদিন আজকের ‘বৃদ্ধ নাগরিকে জেরবার’ দুই-সন্তান নীতির বাহক চীনের মত আগামী ভবিষ্যতে ভারত সরকার ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে বলবে ‘রাষ্ট্রের আরো কর্মক্ষম শ্রমিক, কৃষক, সেনা দরকার। সুতরাং বাড়াও জন্মহার’ – সেদিনও সেই মেয়েদের শরীরেই নেমে আসবে কড়াল থাবা।

যদি ততদিনে চীনের মেয়েদের মত আমাদের দেশের মেয়েরাও চাকরি বাঁচাতে, সম-মজুরির স্বার্থে এবং পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ মেটারনিটি লিভের কারণে জরিমানা, পদাবনতি, গুরুত্বহীন কাজে নামিয়ে দেওয়া, বেতন বন্ধ কিম্বা ছাঁটাই এড়াতে – ‘মা’ হতে না চায়, তখনো কি রাষ্ট্রের তথা সমাজের পেষণ যন্ত্র তাদের শরীরের বখরায় ভাগ বসাবে না!

বিশ্বব্যাপী মহামারীর সংকটকালে নানা সমীক্ষায় উঠে এসেছে মেয়েদের উপর কী হারে বাড়ছে গার্হ্যস্থ হিংসার মাত্রা – সেখানে নারীর জরায়ুর অধিকারের প্রশ্নে রাষ্ট্রের ফতোয়া নেমে এলে কন্যাভ্রূণ হত্যার পাশাপাশি সার্বিক লিঙ্গানুপাত আরও নেতিবাচক হবে। এছাড়াও অধিক সন্তানের ক্ষেত্রে শাস্তি এড়াতে যথেচ্ছ বাড়তে পারে সন্তান বিক্রি এবং শিশু পাচার। এক্ষেত্রে বিক্রি অথবা পাচার যাই হোক কন্যাশিশু হলে এসব অপরাধ চক্রের আরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটে তা বলাবাহুল্য।  ইতোমধ্যেই দেশের অনেক অভিভাবকই নিরাপত্তা, আর্থিক সংস্থান ইত্যাদির অভাবে নিজের আত্মজকে ন্যূনতম মূল্যে বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন। বহু জায়গায় বেওয়ারিশ শিশুদের বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষাবৃত্তি করানো কিম্বা অত্যাচারে মৃত শিশুদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে কালোবাজারে চড়া দামে বিক্রির নজির ভুরিভুরি। এমনিতেই দরিদ্র পরিবারের উপার্জনের এক্সট্রা মাধ্যম হিসেবে শিশুশ্রম এদেশের জ্বলন্ত সমস্যা। অন্যদিকে সমাজে ব্রাত্য অনাথ পথশিশুদের নানা ছোটবড় অপরাধে নাবালক সংশোধনাগার উপচে পড়ে। সেখানে কন্যাসন্তানদের সংখ্যা মোটেও কম না। জন্মনিয়ন্ত্রণ আইনের অতিরিক্ত কঠোরতা নিম্নআয়ের পরিবারের ক্ষেত্রে আরও অপরাধের জন্ম দেবে কিনা ভাবতে হবে তা নিয়েও।    

এমতাবস্থায় যদি সরকার জন্মনিয়ন্ত্রণ আইনের চোখরাঙানির পাশাপাশি এমন কিছু সুবিধা দানের ব্যবস্থা করে যাতে পরিবারের প্রথম মেয়ে সন্তানের সুরক্ষা, হবু মা ও সদ্যজাত শিশুর যত্নআত্তি ইত্যাদি সুনিশ্চিত করতে বাড়ির পুরুষদের এগিয়ে আসায় বাধ্য করা যায়, দুই সন্তানের দরিদ্র পিতাদের কর্মসংস্থান অথবা আর্থিক প্যাকেজের দ্বারা ভ্যাসেক্টমিতে আগ্রহী করা যায়  – তবে যদি নারী নির্যাতনের ছবিটা একটু বদলায়। নইলে দেশের জন্মহারের রেট যাই হোক না কেন মহিলা-মৃত্যু রেট রকেট স্পিডে বাড়বে, কন্যাভ্রূণ তথা শিশুর নিরাপত্তা নিয়ে আইন আদালতের চক্কর কাটতে কাটতে মানবাধিকারের প্রশ্নটি পেন্ডুলামের মত দুলে যাবে, আর ওদিকে সরকারের বদল নিয়মমাফিক ঘটতেই থাকবে।

মা ও শিশুর স্বাস্থ্য এবং মানবাধিকারের বিষয়টি নিয়ে সরকার কি আদৌ ভাববে, নাকি সংসদের কুঠুরিতে নিয়ে আগামীতেও শোনা যাবে ‘শিশিরের শব্দ’ – তা সময়ই বলবে। তবে আপাত চটকদার বিল নিয়ে শিক্ষিত সমাজের ভাবা প্র্যাকটিস করাটা আশু কর্তব্য।

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার 

ছবি : প্রতীকী, সংগৃহীত । 

 

1 Comments

সৌভিক সান্যাল

26 July, 2021

একেবারে সঠিক বিশ্লেষণ।

Post Comment