দাদা একটু লেডিজ সিটটা ছেড়ে দেবেন

  • 29 June, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1385 view(s)
  • লিখেছেন : রোশন কুমার
যাঁরা নিয়মিত কলকাতা শহরে বাসে ওঠেন, তাঁরা জানেন, উঠে যদি মহিলা সিটে পুরুষ দেখেন, তাহলে তিনটে উপায়, এক, পুরুষ নিজেই জায়গা ছেড়ে দেন; দুই মহিলাকে বলতে হয়; অথবা তিন কন্ডাক্টার বা বাসের অন্যরা বলেন সিট ছাড়তে। মহিলাদের এই সিট সংরক্ষণ নিয়ে তাই নানা প্রশ্ন দেখা দেয়।

দাদা একটু লেডিজ সিটটা ছেড়ে দেবেন। কলকাতাবাসী তথা সোজা কথায় কলকাতার বাসে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করা মানুষদের খুব পরিচিত একটি বাক্য এটি। কলকাতায় বাস মূলত দু-রকমের। সরকারি ও বেসরকারি। বেসরকারি বাসগুলোতেই এই কথা শোনা যায়। বাস যেদিক যাচ্ছে সেইদিকে মুখ করলে বাম হাতের সিটগুলো মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। বেশ, খুবই ভালো। এর মানে হল কোনো মহিলা এইরকম বাসে উঠলে ওই সিটে বসার অগ্রাধিকার পাবেন, এবং কোনো পুরুষ সেই সিটে বসে থাকলে তাকে উঠতেও বলতে পারেন তিনি। এখানে বলে রাখি, অনেক বেসরকারি ও সরকারি বাসে মহিলা সিট থাকে না। সেগুলো বাদ দিয়ে, যেগুলোতে থাকে সেগুলো নিয়েই কথা বলছি।

প্রথম কথা হল মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ কেন বাসে?

বিভিন্ন বয়সি মহিলার সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম যে এই সংরক্ষণের মূলের ভাবনা ছিল, ‘equity’। মানে কী? মানে হল, সমদর্শিতা বা ন্যায়বিচার। কেন প্রয়োজন ইকুইটি? ছোটো করে বলতে, বহু যুগ ধরে মহিলাদের উপর হতে থাকা অত্যাচার বা অবিচারের বিরুদ্ধে ন্যায়প্রয়োগ। ঠিক যেমন, রোবোটের সঙ্গে মানুষের প্রতিযোগিতা সম্ভব নয়, তেমনই বহু যুগ ধরে সমস্ত সুবিধা পেতে থাকা পুরুষের সঙ্গে নারীর তুলনা অসম্ভব। আমি এবং আমার মতো অনেকেই বিশ্বাস করেন, পুরুষ ও নারীর কর্মক্ষমতা একই। সেক্ষেত্রে এই সংরক্ষণের প্রয়োজন শুধু মাত্র অবস্থাগত। মানে নারীদের ঘরে-বাইরে তথা সমাজে  মহিলা হওয়ার কারণে অনেক ধরনের লড়াই করতে হচ্ছে, তাই বাসে তাদের জন্য বসার জায়গাটুকু সংরক্ষিত হওয়া দরকার।

অনেক মহিলা আবার মনে করেন, বাসে/ট্রেনে/যে-কোনো ভিড় জায়গাতেই বেশ কিছু পুরুষ মহিলাদের সঙ্গে যা করেন, তা থামানোর ক্ষেত্রে এই মহিলা সিট থাকাটা খুবই উপকারী।  আবার বিপরীত মতামতও অনেকে রাখেন। তাঁদের মতে, যে মহিলা বাস/ট্রেন/মেট্রোয় উঠে মহিলা সিটের জন্য একজন পুরুষের সঙ্গে লড়াই করছেন, সেই একই লড়াই তিনি বাড়িতে বা সমাজে করবেন না/করেন না। বাড়িতে বলেন না যে "চা করতে পারবো না এখন"/"আমিও অফিসেই যাচ্ছি, নিজেদের টিফিনগুলো নিজেরা করে নাও"/"আমিও সমান কাজ করি, অমুক বাবুর সমান বেতন আমারও প্রাপ্য"। এই অধিকারগুলো চাইতে পারেন না, অথবা চান না, বদলে বাসে ট্রেনে সংরক্ষিত সিটে বসার জন্য লড়াই করেন, বাড়িতে বা অন্য কোথাও তাঁর সঙ্গে হওয়া লিঙ্গবৈষম্যের ক্ষতিপূরণ পেতে।

দ্বিতীয়ত, কীভাবে প্রয়োগ হবে এই সংরক্ষণের?

যাঁরা নিয়মিত কলকাতা শহরে বাসে ওঠেন, তাঁরা জানেন, উঠে যদি মহিলা সিটে পুরুষ দেখেন, তাহলে তিনটে উপায়, এক, পুরুষ নিজেই জায়গা ছেড়ে দেন; দুই মহিলাকে বলতে হয়; অথবা তিন কন্ডাক্টার বা বাসের অন্যরা বলেন সিট ছাড়তে। এবার একটু ভাবুন, যিনি উঠে গেলেন, বা যাকে ওঠানো হলো, তিনি বেশ বয়স্ক, এবং যিনি এসে বসলেন, তিনি যুবতী এবং কোনো শারীরিক অসুবিধা নেই।

শারীরিক কোনো সমস্যা নেই এবং বয়স যথেষ্ট কম তাও কেন একজন মহিলা আরেকজনকে (যাঁর প্রয়োজন) সিট থেকে তুলবেন? যিনি উঠে গেলেন, ধরা যাক তিনি খুব বয়স্কও নন, তিনি হয়তো কাজে যাচ্ছেন, অথবা ফিরছেন, খুবই ক্লান্ত, হয়তো-বা কাজের চাপে আজ খাওয়াই হয়নি।  এ তো হল শুধু কী হতে পারে, বা কী হল তার কথা। এর একটা সুদুরপ্রসারী প্রভাবও আছে। যা হল, কম বয়সি ছেলেরা মহিলাদের প্রতি(সমবয়স্ক ও গুরুজন) অসহিষ্ণু হয় পড়ে। আমি আমার বহু পুরুষ বন্ধুকে মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলতে শুনেছি, "তোরা তো বাসে উঠেই বসতে পাস, তোদের আবার ক্লান্তি কী রে?" শুধু তাই নয়, এই সংরক্ষণ ও তার প্রয়োগের মাঝে হারিয়ে যায় অনেক নারীর সত্যিকারের লড়াই।  অফিসে পুরুষ কলিগের সম-পরিমাণ কাজ করেও কম পারিশ্রমিক কেন পাবো, এই প্রশ্নেও "বাসে বা মেট্রোতে তো বসাটা তোদের সেট" শুনতে হয়। 

এখানেই শেষ নয়, বাসে বাকি সিটগুলো কিন্তু জেনারেল। মানে সেগুলো নারী-পুরুষ উভয়েরই জন্য। সেখানে একজন নারীর বসাটা খুবই মুশকিল হয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, না জেনেই অনেকে বলে দেন, "এটা জেন্টস, এখানে কেন? লেডিজ-এ যান"। বকিরা জানলেও খানিক শ্লেষের সঙ্গেই বলেন যে "আপনাদের সিট আছে তো? সেখানে যান। আমরা তো আর সেটায় বসতে পারবো না"।

বাসে-মেট্রোতে যে-কোনো লিঙ্গের মানুষই অপরকে মানবিকতা থেকেই বসতে বলতে পারেন। এইটাই খুব কমজন করেন। ছোটো ছেলেদের শেখাতে শুনেছি, "বাবু দিদিকে বসতে দাও"। “কেন?” না এটা আমার প্রশ্ন নয়। বাচ্চা ছেলেটির প্রশ্ন। মায়ের উত্তর "মেয়েদের বসতে দিতে হয়, তুমি ছেলে না? তুমি শক্তিশালী তো"। এই বক্তব্যের দ্বারা নিজের ছেলের মাথায় আর সমাজে যে কতটা টক্সিক ম্যাস্কুলিনিটি ঢুকিয়ে দিলেন সেই আলোচনায় আর গেলামই না। এরই উলটো অভিজ্ঞতা হয়েছে আরেকদিনের ঘটনায়। আমি উঠেছি বাসে দুটো ভারী ব্যাগ নিয়ে। বসেছি। বাসে্র লেডিজ সিটেই। এক মা উঠলেন ছেলেকে নিয়ে, ছেলেটি নবম শ্রেণিতে সম্ভবত পড়ে বলেই আমার মনে হল (পড়া নিয়ে আলোচনা থেকে)। মায়েরও বয়স এমন কিছু নয়, আর নিজের হাতে ছেলের স্কুলের ব্যাগটা ছাড়া আর কিছু নেই। হঠাৎ ২০ মিনিট আমাকে লক্ষ করার পর ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, "বাচ্চা ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে, স্কুলে যাচ্ছে, একটু উঠে বসতে দেওয়ার কথা মনে হল না?"

দুজনই মা, দুজনই ছেলের মা, তবে কত আলাদা! আর লক্ষণীয় দুটো পদ্ধতিই কী সাংঘাতিক ভুল!

অন্যদিকে, যতবার নিজে উঠে (লেডিজ সিট থেকে) কোনো পুরুষকে (যার প্রয়োজন) বসতে দিয়েছি, ততবার পরের স্টপে মহিলা উঠে, তাঁকে তুলে আবার বসেছেন। এক মুহূর্তের জন্যও ভাবতে দেখিনি যে, যিনি বসে ছিলেন তাঁর শারীরিক ক্ষমতা যিনি বসতে যাচ্ছেন তাঁর থেকে কম।

মা-মাসিমাদের কাছে শুনেছি, মহিলাদের সংরক্ষণ থাকলে মহিলারা encouraged হবেন। বেশি করে কাজে যোগ দেবেন, আরও এগিয়ে যাবেন।

তাই যাচ্ছে কি?

যে মা-কাকিমারা এই কথা আমাকে শিখিয়েছেন, সেই যুগে তাঁরা দুনিয়ার সঙ্গে লড়াই করে নিজের চাকরি, সমাজে নিজের জায়গা সব করেছেন। আর এখন নিজের চারপাশটা দেখে তো মাঝে মাঝেই মনে হয়, আমরা কি ওই মহিলা সিটটায় বসা নিয়ে যুদ্ধটাকেই চূড়ান্ত যুদ্ধ মনে করে ফেললাম?  অধিকারের লড়াই ‘মহিলা সিট’-এ বসার অগ্রাধিকার সুরক্ষিত করা নয়, তা আসলে মানুষ হিসেবে সমান অধিকার পাওয়া। এটা না বুঝলে  পিতৃতন্ত্র আরও কোটি বছর মহিলাদের ‘লেডিজ সিট’-এর নামে হাতে ললিপপ ধরিয়ে দিয়ে ‘মহিলারা তো একটু দুর্বল’ প্রমাণ করে দেবে।

ছবি: সংগৃহীত

লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী

0 Comments

Post Comment