- 05 June, 2022
- 0 Comment(s)
- 330 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
অনুভূতি, আসলে এক তীক্ষ্ণতার মতো। যখন তা গভীর হয়ে ওঠে, ভিতরে – বড় ভিতরে গিয়ে সে হুল ফোটায়, থাবার নখ বসায়। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মধুশ্রীর মতো মানুষেরাই সেই বিষয়টাকে সবচাইতে বেশি করে উপলব্ধি করে। এই গল্প মধুশ্রীদের জন্য।
মফস্বল নয়। খাস কলকাতা শহর। দক্ষিণ কলকাতার এক নির্জন গলির ভিতরে হাহাকার ফেটে পড়ছিল। রাত অনেক তখন। আড়াইটে অথবা তিনটেরই কাছাকাছি হবে বোধহয়। সেই গলিতে আলোর ব্যবস্থা নেই। ছিল কোনও একসময়। কিন্তু এখন সেগুলির মধ্যে একটি আলোও আর কাজ করে না। মধুশ্রীর ঘুম ভেঙে গেল। প্রচণ্ড চিৎকার, “বাঁচাও, বাঁচাও! কে আছো – সর্বস্ব লুঠে নিয়ে গেল আমার! বাঁচাও!” মধুশ্রী ধড়মড় করে উঠে এসে জানালার কাছটিতে দাঁড়াল। আলো জ্বালতেও সাহস পেল না। যেমনটা পায়নি অন্য কেউ। মধুশ্রী অন্ধকারের ভিতর দিয়েই উপলব্ধি করতে পারল অন্যান্য বাড়ির জানালাতেও অনেকগুলো করে অবয়ব এসে দাঁড়িয়েছে। মানুষটার দুর্দশাকে দেখছে সবাই। শ্বাসটুকুও ফেলছে না। সামান্য ছিনতাইয়ের ব্যাপার। তবে এক্ষেত্রে এক ট্যাক্সিড্রাইভারের কাছ থেকে মদ্যপ কিছু মানুষেরা টেনে নিচ্ছে তার সারাদিনকার রোজগার। একজন আবার কেড়ে নিতে চাইছে গাড়ির চাবিটাকেই। লাথি মেরে লোকটাকে গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া হলো। লোকটা তখনও চিৎকার করে চলেছে। মদ্যপ লোকগুলো গাড়িটাকে চালাতে সাহস পেল না। একজন নেমে এসে লোকটাকে ছুরি দেখাচ্ছে। মাথার পিছন থেকে একজন ভোঁতা একটা কিছু দিয়ে লোকটার মাথায় আঘাত করল। লোকটা পড়ে যাচ্ছে। বাকি লোকগুলো অন্ধকারের ভিতর দিয়ে ছুটে পালাল। ড্রাইভার লোকটি আবারও উঠে দাঁড়িয়েছে। এই অন্ধকারের ভিতরে গলিঘুঁজির আড়ালে বাকিদেরকে খুঁজে বের করারও কোনও উপায় নেই। গাড়ির চাবিটাকে কুড়িয়ে নিল সে, একটা ঝোপের ভিতর। সে বোধহয় কাঁদছে। অথবা নয়। মধুশ্রীর পিঠে কেউ একজন হাত রাখল। ওর বাবা-মা দু’জনেই শোবার ঘর থেকে উঠে এসে ওর পিছনে দাঁড়িয়েছেন। “শুয়ে পড়ো সোনা, অনেক রাত হয়েছে,” ওর মা কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন। মধুশ্রী শুয়ে পড়বে। লোকটা এখনও গাড়ির বনেটের উপরে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাড়ার একটা জানালাতেও আলো জ্বালেনি কেউ।
সকাল। মধুশ্রী কাল রাতের ঘটনাটাকে ভুলে গিয়েছে। যেমনটা ভুলে গিয়েছে আর সবাই। ব্রেকফাস্ট টেবলেও এই নিয়ে আর কোনও কথা হয়নি। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘দহন’ অনেক বড় ব্যাপার। সামান্য কোনও কিছুতেই আজকাল (বা কখনই) বোধহয় আর কোনও মানুষ ঝামেলায় জড়াতে বিশেষ পছন্দ করে না। এইটাই আজকালকার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। মধুশ্রী দেখেছে ওর অভিভাবকেরা একেকটি বিশেষ বিষয় নিয়ে কথা উঠলে পরেই, সেই সময় কেমন যেন এক আশ্চর্য হিরণ্ময় নীরবতায় দারুণ স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে ডুবে যেতে পারেন। ‘এই নীরবতাই আদতে স্বর্ণাভ’। মধুশ্রীদেরকে সেই ইস্কুল-জীবন থেকেই এই বাক্যবন্ধটিকে পাখিপড়ার মতো করে শিখিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। কেউ কেউ কিছুতেই কিছু শিখে উঠতে পারে না বোধহয়। সেই নীরবতা তখন তাদের প্রত্যেকের শরীরের ভিতরে, বিবেকের ভিতরে এক দারুণ বিস্ফোরণেরও জন্ম দেয়। যার কারণে তাদেরই মনের ভিতরকার নিঃশব্দ কুঠুরিগুলো তখন জ্বলে-পুড়ে-ফেটে-ছিঁড়ে নিঃশেষ হয়ে যেতে থাকে।
মধুশ্রীর আরও একটা ঘটনাকে মনে পড়ছিল। মানুষের নিশ্চিন্ততা, মানুষের ভিতরকার প্রেজুডিস – এভাবেই কেমন যেন একেকটা ক্ষুদ্রস্য ক্ষুদ্র ঘটনার মধ্যে দিয়েই চকিতে বেআব্রু হয়ে সামনেটায় এসে দাঁড়ায়। মধুশ্রী সরকারি স্কুলের সিনিয়র টিচার, সেকেণ্ডারি বিভাগের দায়িত্বে। কাছেই একটি সরকারি স্কুলে সে বিজ্ঞান ও ভূগোলের শিক্ষিকা। এছাড়াও বয়স এবং অভিজ্ঞতার কারণে স্কুলের প্রশাসনিক কিছু দায়দায়িত্বও তাকে সামলাতে হয়। বেশ কিছুদিন ধরেই মধুশ্রী লক্ষ্য করছিল ক্লাস সেভেনের কুলসম বেগম এ্যাবসেন্ট করে চলেছে। প্রায় পনেরোদিনের উপর। গার্জেনের নম্বরেও সে বেশ কয়েকবারে ফোন করে দেখেছে। কারোর সাড়া মেলেনি। সেদিন কথায় কথায় ক্লাস সেভেনের টিচার-ইন-চার্জ শ্রীময়ী রক্ষিতের সঙ্গে কুলসমের বিষয়টাকে সে তুলে এনেছিল। সটান স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ছিল শ্রীময়ীর, “আরে বুঝতেই তো পারছ, ওদের রিলিজিয়ন। দেখ গে বিয়েটিয়ে করে নিয়েছে বোধহয়। ওদের তো আবার ...” এরপরের কথাগুলোকে আর ছাপার অক্ষরে লিখতে চাইবে না কেউ। প্রেজুডিস বেড়ে যাচ্ছে। মধুশ্রী মনে মনে ভাবতে চেষ্টা করছিল, কোনওদিন – কখনও কি সে তার ক্লাসের কোনও ছাত্র বা ছাত্রীর জাত-ধর্ম-বর্ণ ইত্যাদিকে নিয়ে ভাবিত হতে চেয়েছে ? তার কাছে এগুলি সবসময়েই কেবল ফর্ম ফিলাপের রঙবেরঙের চৌখুপ্পির জিনিস হিসেবেই প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। হয়তো বা স্কলারশিপের ব্যবস্থা করার জন্য ... কিন্তু তাই বলে এমন অম্লানবদনে একেকটি এমন প্রতিক্রিয়াকে যখন সামলাতে হয় কোথাও, মনের মধ্যেকার অন্ধকারটুকুকেই আরোই ঘনীভূত হয়ে আসতে দেখতে হয়। ভিতরে আবারও ঘটে বিস্ফোরণ।
চিৎকার করে এই সমাজকে শোনাতে হয়। কিন্তু এই সমাজ চিৎকার করতে ভুলে গিয়েছে। বহুদিন হলো এই সমাজের কারোকে মধুশ্রী চিৎকার করতে শোনেনি। যেমনটা সেই লাস্ট লিয়রের পর্দাতে নায়িকাকে চিৎকার করতে শিখিয়েছিলেন শেক্সপিয়রের সাহিত্যে পাগল আরেক বর্ষীয়ান অভিনেতা স্বয়ং, তাঁর আশ্চর্য সাবলীল অভিনয়ের মাধ্যমে। কিন্তু সেও তো কেবল সেই সেলুলয়েডের সৃষ্টিতেই। মধুশ্রীর সেই পাহাড়গুলোকে মনে পড়ছিল। মধুশ্রীর সেই খাদগুলোকে মনে পড়ছিল। নিয়ম, নিয়ম, আর গতানুগতিকতার গয়ংগচ্ছতা। এই সমাজের স্থবিরতাকে ভাঙা প্রয়োজন। এই সমাজের স্থবিরতাকে ভাঙা অসম্ভব। মধুশ্রীর মধ্যে মধ্যে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয়। কতদিন, কতমাস যে সে হৃদয় নিংড়ে চিৎকার করে ওঠেনি। অথচ কতবারই না তার তেমনটা করতে ইচ্ছে হয়।
একদিন সেই সুযোগ এসেছিল। একদিন চিৎকার শুনেছিল শহর। কিন্তু সেই চিৎকারেও ...
কুলসমকে পড়া ছেড়ে দিতে হয়েছে। মায়ের অসুখ ওর। উদয়াস্ত ভ্যানরিকশ চালিয়েও যেটুকুও বা পয়সা ঘরে আনতে পারত ফিরদৌস, ‘বাংলা’র কল্যাণে তার অধিকাংশটাই বাইরে খরচ হয়ে আসে। পাঁচ বাড়িতে কাজ করে এসেও সংসারের হেঁশেল ঠেলতে সেই কুলসমের মা’কেই তাই বসতে হয়। কুলসমের মায়ের নাম শবনম; (অথবা যা কিছু একটা নাম তার জন্য বোধ করি আপনারাও একটু ভেবে নিতে পারেন। এই ‘রোজনামচা’র এমন প্রত্যেক চরিত্রই যে আদতে পরিচিত আপনাদের। একটু খুঁজলে পরেই তাদেরকে আপনারাও দেখতে পেয়ে যাবেন। মধুশ্রী অথবা কুলসম, এরা কেউই কোনও ব্যতিক্রমী জনগোষ্ঠীর একমাত্র প্রতিনিধিস্বরূপ, এমনটা মোটেও নয়।)
অনেক রাত। অন্ধকার শহরের আরেক নির্জন গলিপথ। উত্তর কিংবা মধ্য কলকাতার কোথাও। জায়গাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ সেই নির্জনতাটুকুই। যাতে প্রশান্তির পরিবর্তে লুকিয়ে আছে দীর্ঘশ্বাস। চাপা এক আতঙ্কের অনুভূতি কেবল। চাল নিয়ে ফিরছিল কুলসম। আজ অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছে। যে বাড়িতে প্রতিদিনকার দুপুরে সে নিয়মিত আয়ার কাজ করে এখন, ছাড়তে ছাড়তে তারা অনেকটাই দেরী করিয়ে দিয়েছে। হনহন করে সে হেঁটে যাচ্ছিল। নিরাপত্তার অভাব বোধ করাটা এখন তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমাদের প্রত্যেককেই এখন (হয়তো বা কুলসমের মতোই) ভয়ে ভয়ে পথ চলতে পারার অভ্যাসটুকুকে নানাভাবে, নানা কায়দাতে অনুশীলন করতে হয়। উদ্যত হাতের ছোবল, অথবা ইতিউতি চাউনির হদিস ... চিৎকার আসে না কোথাও। নীরবতাই দলা পাকিয়ে ওঠে কেবল। গঙ্গার জল। ঢেউ বোধহয় চলকিয়ে উঠেছে।
রাত বাড়ছে খুব। হাতগুলোকে কুলসম এগিয়ে আসতে দেখেছিল। চিৎকার করে ওঠারও সুযোগ পায়নি।
[***]
“আগুন! আগুন! কে কোথায় আছেন! বেরিয়ে আসুন প্লিজ!” হাতের বইখাতাগুলোকে রাস্তার উপরেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পাগলের মতো মিত্তিরজেঠুদের বাড়িতে দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করেছিল মধুশ্রী। আগুন যে লেগেছে তাদের বাড়ির দোতলাতেই। মিত্তিরজেঠু তো এই সময় নিশ্চিত করেই তাসের আড্ডাতে গিয়েছেন। জেঠিমাকে দেখার জন্য ১২ ঘন্টার যে আয়া মেয়েটি থাকে, সেও কি তবে বাড়িতে নেই ? সুপর্ণা না কি যেন নাম! ছুটি নেবে সে কি বলে গিয়েছিল ? হয়তো বা তারও বাড়িতে স্বামীর অসুখ ? দোতলাতেই তো জেঠিমা আটকে পড়ে রয়েছেন। আজকের দিনটাতেও কি তাহলে তাসের আড্ডাতে না যেতে পারলে জেঠুর চলছিল না ? মধুশ্রী পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকে। দরজা ধাক্কিয়ে যায়। পাশের বাড়িতে একটা আলো জ্বলেছে। আগুনের লকলকে শিখাগুলো যে এই সময়ে তাদের বাড়ির জানালাতেও গিয়ে ঠেকতে শুরু করেছে। বেরিয়ে এসেছে কেউ। এভাবে পাড়ার সবকটা বাড়িতেও যদি বা আগুনের শিখা গিয়ে না পৌঁছয়, কেউই কি তবে বেরিয়ে আসবে না ? কোনও ভাবেই ?
প্রশ্ন করারও অবকাশ মেলে না কোথাও। একে একে আরও দু’চারজন বেরিয়ে এসেছে। আগুনের তাপ বড়ই উত্তেজনাকর। বড়ই সে ক্ষতিকারক, মানুষকে যেন বা কোথাও সে এককাট্টা করেই বের করে নিয়ে এসে রাজপথে দাঁড় করায়। অবশ্য যদি বা সেই আগুন তারই ঘরের নিকটবর্তী কোনও এলাকাতেই লেগে থাকে কোথাও ... অঙ্কের হিসেব।
চিৎকার করছিল মধুশ্রী। অনেক মানুষ বেরিয়ে এসেছে আজ।
নিজেদেরকে বাঁচানোর প্রয়োজনে। কিন্তু মধুশ্রী কিছুতেই থেমে যেতে পারছিল না।
তার গলা বুজে আসছিল। চিৎকার তবু থামছিলই না তার।
পনেরো কিলোমিটার দূরে কোথাও অন্ধকার একটা গলিতে চৌদ্দ বছরের একটি মেয়েকে ধর্ষণ করা হচ্ছিল তখন।
0 Comments
Post Comment