নারীত্ব ও মাতৃত্ব

  • 16 July, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1326 view(s)
  • লিখেছেন : মোনালিসা পাত্র
আমাদের সমাজ সার্বিকভাবে পিতৃতান্ত্রিক হবার পর নারীত্ব ও মাতৃত্বকে একটি বন্ধনে জুড়ে নারীত্ব ও মাতৃত্বকে একে অপরের পরিপূরক সত্তা হিসেবে ব্যক্ত করেছে। মাতৃত্বকে একটি পবিত্রতা এবং মহান জৈবিক প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করে তাকে নারীত্বের পরিপূরক হিসাবে দেখা হয়ে থাকে। তাই সমাজের চোখে একজন আদর্শ মা তিনিই যিনি সর্বংসহা,আত্মত্যাগী এবং সর্বদা সন্তানকেই জীবনের একমাত্র গুরুত্ব হিসাবে দেখবেন। কিন্তু মাতৃত্বকে কেবলমাত্র মহিলাদের সাথে জুড়ে একটি gendered তকমা দেওয়া অত্যন্ত সরলীকরণ।

মাতৃত্ব ও নারীত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রাথমিক ভাবে মাতৃত্ব ও নারীত্বের সংজ্ঞা এবং ব্যাপ্তিকে ভালো করে বোঝা দরকার। একজন মানুষ বা যেকোনও প্রাণী নারী বা পুরুষ কি না সেই লিঙ্গটি নির্ধারিত হয় জন্মের সময় তার শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে কিন্তু নারীত্ব বা femininity যা কি না তার gender তা একটি সমাজ নির্ধারিত যাপন। একজন নারী তার নারীত্ব অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জন করেন, সমাজ তার নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় তাকে সংজ্ঞায়িত করে।

এবার আসা যাক নারীত্বের সংজ্ঞায়। মাতৃত্বের প্রচলিত সংজ্ঞা হল জৈবিক ভাবে সন্তান ধারন করা এবং স্বাভাবিক নিয়মেই সন্তান ধারনের ক্ষমতা নারীদের থাকার কারণে নারীত্ব ও মাতৃত্বকে অনেক সময় সমার্থক করে তোলা হয় এবং মাতৃত্বকে মহিলাদের জীবনের সর্বাপেক্ষা কাঙ্ক্ষিত, প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসাবে ধরা হয়ে থাকে। আমি আমার এই লেখায় নারীত্ব ও মাতৃত্বের সংজ্ঞাকে একটু ব্যাপ্তি দেবার চেষ্টা করছি; পাশাপাশি নারীত্ব ও মাতৃত্বের সংযোগ কোথায় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার প্রয়াস করছি।

প্রথমত, নারীত্ব একটি সামাজিক ব্যাখ্যা এবং কিছু আচরণবিধির দ্বারা তা নির্দিষ্ট করা হয় যা বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি করে, যেমন সামাজিক সমস্ত বিষয়বস্তুকেই একটি gendered lens দিয়ে দেখার চেষ্টা হয়ে থাকে, যেমন পোশাক-আশাক, বাচনভঙ্গি এবং সর্বোপরি কাজ সবকিছুতেই পুরুষ ও নারীর জন্য ভূমিকা নির্ধারিত করা হয়ে থাকে।  

সামাজিক জীবনযাপনের একদম গোড়ার দিকে যদি যাওয়া যায় তবে দেখা যাবে যে মানুষ যখন খাদ্য সংগ্রাহকের ভূমিকা পালন করত তখন পুরুষরা দূরের খাদ্য সংগ্রহ বা শিকারের কাজটি করতেন এবং নিকটবর্তী স্থানের খাদ্য সংগ্রহ ও বাসস্থানটিকে সুরক্ষিত রাখার কাজটি মুলত মহিলারা করতেন কারণ তাঁদের সন্তানধারণ ও প্রতিপালনের জৈবিক প্রক্রিয়াটি পালন করতে হত। আমাদের সমাজ সার্বিকভাবে পিতৃতান্ত্রিক হবার পর নারীত্ব ও মাতৃত্বকে একটি বন্ধনে জুড়ে নারীত্ব ও মাতৃত্বকে একে অপরের পরিপূরক সত্তা হিসেবে ব্যক্ত করা হয়েছে যা বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে পুরুষতান্ত্রিক হতে সাহায্য করে। মাতৃত্বকে একটি পবিত্রতা এবং মহান জৈবিক প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই মাতৃত্বকে নারী জীবনের অঙ্গ বা একটি সচেতন সিদ্বান্ত হিসেবে না দেখে নারীত্বের পরিপূরক হিসাবে দেখা হয়ে থাকে। তাই একজন আদর্শ মা তিনিই যিনি সর্বংসহা,আত্মত্যাগী এবং সর্বদা সন্তানকেই জীবনের একমাত্র গুরুত্ব (exclusive priority) হিসাবে দেখবেন। এর জন্য নারীদের সাহিত্যে, আলোচনায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এক ঐশ্বরিক সৃষ্টির সাথে তুলনা করা হয়েছে। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তৈরি হয়- মাতৃত্ব কি কেবলমাত্র একটি জৈবিক প্রক্রিয়া না একটি আনুভুতি যা ঠিক gendered হওয়া উচিত না? যিনি জন্ম দেন তিনিই কেবল মাতৃত্বের  অধিকারী এমনটা নাই হতে পারে। এক্ষেত্রে যিনি দত্তক নিচ্ছেন বা যিনি কোনো চিকিৎসা বিজ্ঞানের সহায়তায় একটি সন্তানের দায়িত্ব নিচ্ছেন তিনি কি মাতৃত্বের  অধিকারী নন? মাতৃত্ব বা mothering কে কেবলমাত্র মহিলাদের সাথে জুড়ে একটি gendered তকমা দেওয়া আমার মনে হয় অত্যন্ত সরলীকরণ। তাই নারী পুরুষ নির্বিশেষেই যিনি বা যারা স্বেচ্ছায় একটি  প্রাণের বেড়ে ওঠার দায়িত্ব নিচ্ছেন তাদের সকলকেই মাতৃত্বের ব্যাখ্যায় জুড়লে মাতৃত্বের  ব্যাখ্যাটি একটু ব্যাপ্তি দেওয়া হয়।  

দ্বিতীয়ত, মাতৃত্ব কি নারীত্বের পরিপূরক হতে পারে? সম্ভবত না। একজন নারী মা হবেন কি হবেন না সেই সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা তার থাকা উচিৎ, কারণ মাতৃত্বও একটি যাপন তার জন্য নির্দিষ্ট সময় এবং ইচ্ছা থাকাটা প্রয়োজনীয় এবং জৈবিক মাতৃত্বের সঙ্গে আসা শারীরিক এবং জীবনযাপনগত পরিবর্তনগুলির সাথে তাকে স্বচ্ছন্দ বোধ করতে হবে। তাই যেমন কোন বিবাহিত দম্পতি সন্তান নাই চাইতে পারেন, তেমনি আবিবাহিত পুরুষ বা মহিলা বা সমকামী অথবা রূপান্তরকামী মানুষও মাতৃত্ব যাপন করতে চাইতেই পারেন। তাই মাতৃত্বকে নারীত্বের পরিপূরক হিসেবে ধরলে কেবলমাত্র বিষয়টির গভীরতা নিরূপণ করা হয় না তাই নয়, অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক স্থিতিকে অস্বীকার করা হয়। মাতৃত্বের যাপনকে লিঙ্গভিত্তিক করে ফেললে মহিলাদের ওপর অযথা একটি সামাজিক চাপ তৈরি হয় যা সন্তানধারণে শারীরিক ভাবে অক্ষম বা অনিচ্ছুক মহিলাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। সামাজিক পরিকাঠামোতে মহিলাদের জীবনের অবশ্যকরণীয় কর্তব্যের মধ্যে বিবাহের পাশাপাশি মাতৃত্বকে বাল্যকাল থেকেই জুড়ে দেওয়া হয়। তাই মেয়েবেলায় খেলার পুতুল তার সন্তান হয় এবং সে তার সার্বিক ক্ষমতায় তার যত্ন করে। যত্ন বা সেবা করা শেখার মাধ্যমেই একটি কন্যাশিশু বড় হবে তা যেমন সমাজের নির্ধারণ, তেমনই মাতৃত্বকেও বাধ্যতামূলক কর্তব্য হিসেবে ভাবতে শেখার জটিলতাও সমাজের নির্ধারণ। মাতৃত্ব কখনই নারীত্বের পরিপূরক বা একমাত্র পরিচয় হতে পারেনা।

তৃতীয়ত, মাতৃত্বের সাথে জুড়ে আছে নানারকম সামাজিক বিশ্বাস, পারিপার্শ্বিক চাপ, যা নারীদের কেবলমাত্র সামাজিক চাপের মুখেই ফেলে না অনেক সময় তাদের এক অপরাধবোধের সম্মুখীন করে। প্রথমত যারা জৈবিক মাতৃত্বের মধ্যে দিয়ে যান তারা সর্বদাই  ‘good enough mother’ হবার চেষ্টা করেন । যিনি সদাসর্বদা সন্তানের জন্য  উপস্থিত, সন্তানকেই জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে নিজের ভালোলাগা, খারাপলাগার বোধটিকেই বিসর্জন দিতে প্রস্তুত থাকেন। একজন ভালো মা স্বভাবতই নিরলস, নিঃস্বার্থ এবং আত্মত্যাগী হবেন এমনটাই সমাজ, সাহিত্য, বিজ্ঞাপন এবং বিনোদন মনে করে। তবে সেই সব মায়েরা যারা চাকরি করেন বা যাদের গৃহী জীবনের  বাইরেও একটি অন্য পেশা আছে তারা মাতৃত্বে full-time commitment পূরণ করতে না পারার গ্লান্তিতে ভোগেন কারণ একজন মহিলা তার মাতৃত্বের দায়িত্বকে নিজের আগে রাখবেন এবং সর্বদা হাসিমুখে সেটাই পালন করবেন এমনটাই সর্বস্তরের নিয়ম। এপ্রসঙ্গে সম্প্রতি কোভিড মহামারীর সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি বেশ চর্চিত হয়েছিল। একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা অক্সিজেন সাপোর্ট নিয়েই রান্না করছেন এবং অনেকেই তা শেয়ার করে লিখেছেন যে মায়েরা কখনই ছুটি নেন না। এইরকম সামাজিক নির্মাণ জনমানসে মাতৃত্বের একটি এমন ব্যাখ্যা তৈরি করে যা কেবলমাত্র এবং কেবলমাত্র আত্মত্যাগের কথাই বলে এবং এমন আত্মত্যাগের কথাই বলে যা একজন মাকে নির্বিচারে সামাজিক ও পারিবারিক শোষণের শিকার হওয়াকেই স্বাভাবিকত্ব  প্রদান (normalize)করে। তাই ব্যতিক্রমী যেসমস্ত মহিলারা পেশাগত প্রয়োজনে বা স্বেচ্ছায় মা হতে চান না বা যে দম্পতি সন্তান চাইছেন না বা কোনো কারণে পারছেন না তারা নানারকম কটাক্ষ, অনুযোগ, অভিযোগের শিকার হন এবং এক্ষেত্রেও কটাক্ষ ও সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে মহিলারাই থাকেন। তাই এপ্রসঙ্গেও মাতৃত্বকে বিবাহের মতোই একটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হিসাবে মেনে নেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়া যেতে পারে।

চতুর্থত, মাতৃত্ব এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সংযোগ স্থাপন করতে গেলে দেখা যায় পুরুষতন্ত্রের ধারণাই প্রতিষ্ঠিত ও বহমান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মহিলাদের শোষণের মাধ্যমে। একথা বলাই বাহুল্য যে মাতৃত্বকে মহিলাদের এবং কেবলমাত্র মহিলাদের দায়িত্ব হিসাবেই সমাজ ভাবতে, দেখতে এবং বুঝতে শিখিয়েছে। এর দুটি দিক আছে, মাতৃত্বকে একটি ঐশ্বরিক ক্ষমতার সাথে সর্বদাই তুলনা করা হয়, যা মহিলাদের মধ্যেও মাতৃত্বকে একটি গুরুদায়িত্ব এবং নিঃস্বার্থ অবশ্যকর্তব্য হিসেবে মেনে নিতে প্রস্তুত করে। এক্ষেত্রে মা যেহেতু জন্মদাত্রী তাই তিনি সন্তানের সর্বাপেক্ষা ভালো বোঝেন এবং নাড়ীর টান ও mother’s instinct জাতীয়  বহুব্যবহৃত তুলনা টেনে একজন মাকে সর্বদাই ভালো মা এবং অপরিহার্য করে পুরুষদের দায়িত্বমুক্ত করে। অপরদিকে মহিলারা দীর্ঘকালীন চর্চায় সন্তানের সমস্ত দায়িত্ব মায়ের ওপর দিয়ে বা মায়েরই হওয়া উচিত এহেন সামাজিক নির্মাণ তৈরি করেন যা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পরিচালন ব্যবস্থার অনুকূল ও বিশেষভাবে সহায়ক। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পিতা মাতার দায়িত্ব ভাগ করাই থাকে এবং সেখানে অন্দরমহলটি মায়ের (নারীর) ও বর্হিমহলটি পিতার (পুরুষের) জন্যই নির্দিষ্ট থাকে। তাই যেসমস্ত মহিলা চাকুরিরত তারা তাদের জীবনসঙ্গীর সাথে এই দায়িত্ব ভাগ করে নিতে চাইলে পরিবার ও সমাজ প্রশ্ন তোলে। কোনও মহিলা বা পুরুষ এককভাবে সন্তানের দায়িত্ব নিলেও সমাজ প্রশ্ন তোলে আবার প্রশ্ন ওঠে সন্তান না চাইলেও- এর কারণ হল পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীত্ব ও মাতৃত্বকে একে অপরের সাথে সমার্থক করে তুলেছে যেখানে মাতৃত্ব নারীর যাপন বা ব্যক্তিগত সিদ্বান্ত নয়, এক সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং নিজেকে প্রমাণ করার একটি মাধ্যম।

অর্থাৎ এই আলোচনায় স্পষ্ট মাতৃত্ব ও নারীত্ব সমাজনির্ধারিত সরল সমীকরণের দ্বারা বিবেচনা করা যায় না। প্রতিনিয়ত মহিলাদের মাতৃত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সামাজিক দায়বদ্ধতার শিকার হতে হয়। বিবাহিত মহিলাদের প্রতিনিয়ত মাতৃত্ব সংক্রান্ত একটি অত্যন্ত ব্যক্তিগত বিষয়কে নিয়ে পরিবার, আত্মীয়, আনাত্মীয় প্রত্যেকের সাথে আলোচনা করতে হয়, তাদের অভিযোগ, অনুযোগ এবং অযাচিত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। অবিবাহিত মহিলাদের বিবাহের  সময় সর্ম্পকে  পরামর্শে ক্রমাগত সামাজিক চাপের সম্মুখীন হতে হয়। কারণ জৈবিক মাতৃত্বের সঙ্গে মহিলাদের নির্দিষ্ট বয়স এবং শারীরিক স্থিতির যোগাযোগ আছে। এক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে  অন্যান্য অনেক আলোচনায় যেমন ব্রাত্য করা হয় তেমনই এক্ষেত্রেও করা হয়।

মাতৃত্বের সাথে নারীত্বের পূর্ণতা প্রাপ্তির এবং মাতৃত্বের সাথে এক ঐশ্বরিক অলৌকিক প্রাপ্তি ও ক্ষমতার তুলনা করে যারা মাতৃত্ব চাইছেন না বা মা হতে পারছেন না, বিভিন্ন কারণে তাদের মনে এটি একটি অপরাধবোধের সঞ্চার করে এবং মাতৃত্ব ও নারীত্বকে এক সূত্রে আবদ্ধ করে মাতৃত্বের মত যাপন বা অনুভূতিকে কেবলমাত্র সঙ্কীর্ণই করে। নারী, পুরুষ, বিবাহিত, অবিবাহিত সকলেই সন্তানের দায়িত্ব নিতে পারেন, মাতৃত্বকে যাপন করতে পারেন। মাতৃত্ব একটি সিদ্বান্ত এবং একটি অনুভূতি তা কেবলমাত্র সন্তানের প্রতি না হয়ে যেকোনও প্রাণীর প্রতি হতে পারে। এক্ষেত্রে লিঙ্গ এবং জৈবিক প্রক্রিয়া কোনটিই ততটা গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিৎ নয়।

পুনঃপ্রকাশ।  প্রথম প্রকাশ ৭জুন ২০২২ 

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

ছবি : সংগৃহীত      

0 Comments

Post Comment