বিবাহিত নারী (ত্রিশ)

  • 26 July, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 256 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
আমরা বরং কল্পনা করি বেল দ্য জুইলঁ-র ব্যতিক্রমী গুণাবলিতে সমৃদ্ধ একজন পুরুষকে। এটা নিশ্চিত যে, কলম্বিয়ের অঞ্চলের ঊষর নির্জনতায় তিনি গ্রস্ত হতেন না। তিনি নিজের জন্য পৃথিবীতে এমন একটি জায়গা তৈরি করতেন যেখানে তিনি কোনো কিছুর দায়িত্ব গ্রহণ করতেন, লড়াই করতেন, কাজ করতেন। বিবাহের গ্রাসে পড়ে কত মহিলাই তো, স্তঁন্দালের ভাষায়, ‘মানবতার জন্য ধ্বংসপ্রাপ্ত!’ হয়েছেন। এটা বলা হয়ে থাকে যে, বিবাহ একজন পুরুষকে খর্ব করে দেয়। কিন্তু বিবাহ একজন নারীকে প্রায় সর্বদাই ধ্বংস করে দেয়।

মেধাবী, সংস্কৃতিমনা, ​​বুদ্ধিমতী, উদ্যমী মাদমোয়াজেল দ্য তুইল্‌[1] ইউরোপকে বিস্মিত করে দিয়েছিলেন। বিবাহে-ইচ্ছুক পুরুষদের তিনি ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। বারো জনকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি। ফলে, অন্যরা--যাঁরা সম্ভবত আরও বেশি গ্রহণযোগ্য ছিলেন--তাঁরা পিছিয়ে গিয়েছিলেন। একমাত্র যে-পুরুষের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল, তিনি হারমেনচেস। তাঁকে অবশ্য স্বামী করার কোনো প্রশ্নই ছিল না। বারো বছর তাঁর সঙ্গে মাদমোয়াজেল দ্য তুইল্‌ চিঠিপত্র চালিয়েছেন। যদিও এই বন্ধুত্ব এবং নিজের পড়াশোনা তাঁকে আর সন্তুষ্ট করেনি। মাদমোয়াজেল দ্য তুইল্‌ বলেছিলেন ‘কুমারী এবং শহিদ’, এটা একটা প্লেওনাজম্‌[2]। আর জুইলঁ-র জীবনের সীমাবদ্ধতা ছিল তাঁর কাছে অসহনীয়। তিনি চেয়েছিলেন একজন নারী, একজন স্বাধীন সত্তা হয়ে উঠতে। তিরিশ বছর বয়সে মঁসিয়ে দ্য শারিয়্যেরকে বিয়ে করেন তিনি। মঁসিয়ে দ্য শারিয়্যের-র মধ্যে পাওয়া ‘হৃদয়ের সততার’ আর ‘ন্যায়বিচারের মন’-এর প্রশংসা করেছিলেন তিনি। প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন স্বামীকে তিনি ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সদয়-ভালোবাসা-প্রাপ্ত স্বামী’ হিসাবে গড়ে তুলবেন। পরে বেঞ্জামিন কনস্ট্যান্ট[3] বলবেন, ‘মাদমোয়াজেল দ্য তুইল্‌ তাঁর স্বামীকে প্রবল কষ্ট দিয়েছিলেন যাতে স্বামী তাঁর সমান তালে চলতে পারেন’। 

স্ত্রী তাঁর এই পদ্ধতিগত জড়তা কাটিতে উঠতে পারেননি। কলম্বিয়ে অঞ্চলে সৎ ও বিষণ্ন স্বামী, বয়স্ক শ্বশুর আর কমনীয়তাহীন দু-জন ননদের মাঝে আটকে থেকে মাদাম দ্য শারিয়ের বিরক্ত-অসন্তুষ্ট হতে শুরু করেন। নোফ্‌শাতেল-এর প্রাদেশিক সমাজ তাঁকে অসন্তুষ্ট করেছিল প্রবল প্রাচুর্য সত্ত্বেও সেই প্রদেশের মানসিক সংকীর্ণতার জন্য। বাড়ির লোকের জামাকাপড় ধুয়ে আর সন্ধ্যাবেলায় ‘ধূমকেতু’[4] খেলে তিনি তাঁর দিনগুলিকে নষ্ট করতেন। একজন যুবক কিছু সময়ের জন্য তাঁর জীবনে এসে তাঁকে আগের চেয়ে আরও বেশি একা করে দিয়ে যান। ‘একঘেয়েমিকেই মিউজ হিসাবে গ্রহণ করে’ তিনি নোফ্‌শাতেল-এর আচার-ব্যবহারের ওপর চারটি উপন্যাস লেখেন। তাঁর বন্ধুদের বৃত্ত আরও ছোটো হয়ে আসে। একটি রচনায় তিনি চিত্রিত করেছিলেন একজন প্রাণবন্ত, সংবেদনশীল মহিলা এবং একজন ভালো যদিও নিরুত্তাপ এবং স্থূল পুরুষের মধ্যে বৈবাহিক জীবনের দীর্ঘ দুর্ভাগ্যকে। বিবাহিত জীবনকে তাঁর মনে হয়েছিল ভুল বোঝাবুঝি, হতাশা, ছোটোখাটো ক্ষোভের অনুবর্তন। এটা স্পষ্ট ছিল যে, তিনি নিজেই অখুশি ছিলেন। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, আরোগ্য লাভ করেন, আবার ফিরে আসেন তাঁর দীর্ঘ নির্জনতায়। এই ছিল তাঁর জীবন। তাঁর জীবনীকার লিখেছিলেন, “এটি সুস্পষ্ট যে কলম্বিয়েরে তাঁর দিনলিপি এবং তাঁর স্বামীর নেতিবাচক ও বশ্যতাপূর্ণ ভদ্রতা একটি চিরস্থায়ী শূন্যতা তৈরি করে দিয়েছিল, যেই শূন্যতাকে মাদাম দ্য শারিয়্যেরের কোনো কার্যকলাপই পূর্ণ করতে পারে না”। তখনই বেঞ্জামিন কনস্ট্যান্টের আবির্ভাব যিনি আট বছর ধরে আবেগের সঙ্গে মাদাম দ্য শারিয়্যেরকে দখল করেছিলেন। মাদাম দ্য স্তায়েল[5]-এর কাছ থেকে বেঞ্জামিন কনস্টান্টকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য গর্বিত মাদাম দ্য শারিয়্যের যখন বেঞ্জামিন কনস্টান্টকে ছেড়ে দিলেন, তখন তাঁর গর্ব আরও বেড়ে গিয়েছিল। একদিন বেঞ্জামিন কনস্টান্টকে তিনি লিখেছিলেন, “কলম্বিয়েরে আমার কাটানো দিনগুলি ছিল জঘন্য। হতাশা ছাড়া আমি সেখানে ফিরে যাইনি। এই জায়গা ছেড়ে আর না-যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং জায়গাটিকে নিজের কাছে সহনীয় করে তুলেছিলাম”। সেখানেই তিনি নিজেকে বন্দি করে রাখেন আর পনেরো দিন নিজের বাগান থেকে বেরোননি। এভাবেই তিনি তাঁর নির্বিকার নীতি বা উপদেশ প্রয়োগ করেছিলেন : ভাগ্যের চেয়ে হৃদয়কে জয় করার চেষ্টা করুন। বন্দি হিসাবে তিনি কেবল কারাগার বেছে নেওয়ার স্বাধীনতাই পেতে পারেন। স্কট বলেছেন, “আল্পস পর্বতমালাকে মেনে নেওয়ার মতো করে তিনি তাঁর পাশে মঁসিয়ে দ্য শারিয়্যের-এর উপস্থিতিকে মেনে নেন”। কিন্তু তাঁর চিন্তাভাবনা ছিল এতটাই স্বচ্ছ যে তিনি এটা না-বুঝে পারেননি, তাঁর এই হাল ছেড়ে দেওয়া ব্যাপারটা ছলনারই নামান্তর। নিজেকে তিনি এতটাই সংবৃত করে নিয়েছিলেন, এতটাই কঠিন হয়ে গিয়েছিলেন, লোকেরা তাঁকে এতটাই হতাশ বলে মনে করতো যে, তাঁকে দেখে লোকে ভয় পেত। নোফশাতেল-এ ঝাঁকে ঝাঁকে আসা অভিবাসীদের জন্য তিনি তাঁর ঘর খুলে দিয়েছিলেন। অভিবাসীদের তিনি রক্ষা করেছিলেন, সাহায্য করেছিলেন, পরিচালনা করেছিলেন। মোহভঙ্গের সেই সব চমৎকার রচনা তিনি লিখেছিলেন যা দুর্দশাগ্রস্ত জার্মান দার্শনিক হুবার অনুবাদ করেছিলেন। অল্পবয়সি মহিলাদের একটি দলকে তিনি উদারচিত্তে পরামর্শ দিতেন এবং তাঁর প্রিয় অঁরিয়েত-কে পড়িয়েছিলেন লক। আশেপাশের কৃষকদের কাছে তিনি স্বর্গীয় সুরক্ষাদাত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পছন্দ করতেন। নোফশাতেল সমাজকে আরও বেশি সাবধানতার সঙ্গে ক্রমশ এড়িয়ে গিয়ে তিনি অহংকারীভাবে নিজের জীবনকে সংকুচিত করে ফেলেছিলেন। “শুধু দিনলিপি তৈরি করার এবং সেই দিনলিপিকে মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছেন” তিনি। তাঁর শান্তভাব এতটাই শীতল ছিল যে তাঁর করুণার প্রকাশও ভীতিপ্রদ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল ... যে-সকল মানুষ তাঁকে ঘিরে থাকতো তাঁদের মনে হত শূন্য ঘরে একটা ছায়া হাঁটাচলা করছে। খুব কদাচিৎ এক-আধটা ঘটনায় জীবনের প্রদীপ্ত শিখা পুনরায় জাগ্রত হয়ে উঠতো।  কিন্তু “বছরগুলো নিষ্ফলাভাবেই কেটে যায়। মঁসিয়ে এবং মাদাম দ্য শারিয়্যের পাশাপাশি বৃদ্ধ হলেন। গোটা পৃথিবী থেকে তাঁরা আলাদা হয়ে গেলেন। দু-একজন অতিথি বাড়ি থেকে বেরোনোর পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবতেন যে একটা বদ্ধ কবরখানা থেকে বেরিয়ে আসা গেছে ... ঘড়ির পেণ্ডুলামে টিকটক শব্দ। নীচেতে মঁসিয়ে দ্য শারিয়্যের গণিত নিয়ে ব্যস্ত। গোলাঘর থেকে উঠে আসছে শস্য পেষাইয়ের ছন্দোময় শব্দ ... শস্য পেষাইয়ের জায়গা থেকে শস্য খালি হয়ে গেলেও জীবন চলে যাচ্ছিল ... নানারকম ছোটোখাটো ঘটনার দ্বারা গ্রথিত তাঁর জীবন আশাহীনভাবে উপনীত হয়েছিল সেই সব কাজের দ্বারা গোটা দিনের সময়ের ফাঁকফোকরকে ভরাট করতে। এরকম জায়গাতেই উপনীত হয়েছিল জেলিদ-কে যিনি এই ক্ষুদ্রতাকে ঘৃণা করতেন”।

কেউ কেউ বলতেই পারেন যে, মঁসিয়ে দ্য শারিয়্যর-এর জীবন তাঁর স্ত্রীর জীবনের চেয়ে বেশি হাসিখুশি ছিল না। অন্ততপক্ষে, মঁসিয়ে দ্য শারিয়্যর এই জীবনকে বেছে নিয়েছিলেন এবং মনে হয় এই জীবন তাঁর মধ্যম মানের সঙ্গে মানানসই-ই ছিল। আমরা বরং কল্পনা করি বেল দ্য জুইলঁ-র ব্যতিক্রমী গুণাবলিতে সমৃদ্ধ একজন পুরুষকে। এটা নিশ্চিত যে, কলম্বিয়ের অঞ্চলের ঊষর নির্জনতায় তিনি গ্রস্ত হতেন না। তিনি নিজের জন্য পৃথিবীতে এমন একটি জায়গা তৈরি করতেন যেখানে তিনি কোনো কিছুর দায়িত্ব গ্রহণ করতেন, লড়াই করতেন, কাজ করতেন এবং বেঁচে থাকতেন। বিবাহের গ্রাসে পড়ে কত মহিলাই তো, স্তঁন্দালের[6] ভাষায়, ‘মানবতার জন্য ধ্বংসপ্রাপ্ত!’হয়েছেন। এটা বলা হয়ে থাকে যে, বিবাহ একজন পুরুষকে খর্ব করে দেয়। বিষয়টি প্রায়শই সত্য। কিন্তু বিবাহ একজন নারীকে প্রায় সর্বদাই ধ্বংস করে দেয়। বিবাহের সমর্থক মার্সেল প্রেভো[7] নিজেই এটা স্বীকার করেছেন।

যখন তিনি অল্পবয়সি একজন মেয়ে তখন থেকেই তাঁকে চেনা। যখন তিনি একজন তরুণী স্ত্রী, তখন তাঁর সঙ্গে কয়েক মাস বা কয়েক বছর পর হাজারও বার সাক্ষাতের সময় আমি বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম তাঁর চরিত্রের তুচ্ছতায়, তাঁর জীবনের নিরর্থকতায়।

এগুলি প্রায় একই শব্দ যা আমরা বিয়ের ছয় মাস পরে সোফি টলস্টয়ের কলমে পাই :

আমার অস্তিত্ব খুবই সাধারণ : এটি একটি মৃত্যু। যদিও স্বামীর রয়েছে প্রতিভা এবং অমরত্ব-সমৃদ্ধ একটি অভ্যন্তরীণ জীবন। (২৩-১২-১৮৬৩)

কয়েক মাস আগে তিনি আরেকটি অভিযোগ উচ্চারণ করেছিলেন :

একজন স্ত্রী কীভাবে সারাদিন হাতে সূঁচ নিয়ে বসে থেকে,পিয়ানো বাজিয়ে, একা থেকে, একেবারে একা থেকে, খুশি থাকতে পারেন যদি তিনি ভাবেন যে তাঁর স্বামী তাঁকে ভালোবাসেন না এবং তাঁকে চিরকালের জন্য দাসত্বে নামিয়ে এনেছেন? (৯ মে, ১৮৬৩)

এগারো বছর পর তিনি এই শব্দগুলি লিখেছিলেন যাতে এখনও অনেক মহিলা সম্মত হয়েছেন :

আজ, আগামিকাল, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এটা সর্বদা, সর্বদা একই জিনিস। সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠলেও বিছানা ছাড়ার হিম্মত হয় না। কে আমাকে ঠেলা দিয়ে তুলতে সাহায্য করবে? আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে? হ্যাঁ, আমি জানি, রাঁধুনী আসবে। তারপর নিয়ানিয়ার আসার পালা। এরপর আমি চুপচাপ বসে থাকবো এবং বিলিতি সূচিকর্মের কাজ শুরু করবো। অতঃপর ব্যাকরণ আর গানের রেওয়াজ করাবো। সন্ধ্যা হওয়ার পর আমি আবার আমার ওই বিলিতি সূচিকর্মে ফিরে যাব যখন আমার ছোটো কাকিমা আর পিয়্যের তাঁদের চিরায়ত পেসেন্স খেলবেন ...

শ্রীমতী প্রুধোঁ-র অভিযোগেও সেই একই সুর অনুরণিত। স্বামীকে তিনি বলেছিলেন, “তোমার নিজস্ব ধারণা আছে। কিন্তু তুমি যখন কাজ করো, সন্তানেরা যখন ক্লাসে থাকে, তখন আমার কিচ্ছুই থাকে না”।

 

 

[1]ইসাবেল দ্য শারিয়্যেরের অপর নাম।

[2]পুনরুক্তির প্রকাশ। ভাষাবিজ্ঞানের প্রকাশভঙ্গি। যেমন : ‘চোখ দিয়ে দেখা’, ‘জ্বলন্ত আগুন’ ইত্যাদি।

[3]ইসাবেল দ্য শারিয়্যেরের সঙ্গে তাঁর ভালোরকম পত্রালাপ ছিল। হারমেনচেস-এর ভ্রাতুশপুত্র ছিলেন তিনি। ছিলেন সুইস-ফরাসি রাজনৈতিক চিন্তাবিদ, কর্মী এবং রাজনৈতিক তত্ত্বলেখক।

[4]এক ধরনের তাস খেলা। পূর্বতন নাম ছিল Manille। ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে হ্যালির ধূমকেতুর আবির্ভাবের সময় তা বর্তমান  নাম লাভ করে। 

[5] নাম : Madame de Staël।

[6]এটি ছদ্মনাম। মূল নাম Marie-Henri Beyle। ঊনবিংশ শকতের বিখ্যাত ফরাসি লেখক। তাঁর লেখা বিখ্যাত উপন্যাসের নাম Le Rouge et le Noir।

[7]ইউজিন মার্সেল প্রেভো (১ মে ১৮৬২ – ৪ এপ্রিল ১৯৪১ ) একজন ফরাসি লেখক এবং নাট্যকার।

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment