মা (পঞ্চম কিস্তি )

  • 29 May, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 168 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
গর্ভপাতের বিষয়টিকে হালকাভাবে নেওয়ার প্রবণতা পুরুষদের মধ্যে দেখা যায়। গর্ভপাতের বিষয়টিকে পুরুষরা সেই সব অসংখ্য দুর্ঘটনার মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচনা করেন যেগুলির জন্য প্রকৃতির কূটকৌশল কেবল নারীদেরই বাধ্য করে এই ঝামেলা পোহানোর জন্য। নারীরা এমন এক সময়ে নারীত্বের গুরুত্ব, নিজেদের মূল্যবোধকে অস্বীকার করে বসেন যখন পুরুষের নীতিশাস্ত্র এই নারীত্বের গুরুত্ব বা নারীদের মূল্যবোধের সঙ্গে সবচেয়ে উগ্র উপায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। একজন নারীর গোটা নৈতিক ভবিষ্যৎ-ই এর ফলে কেঁপে ওঠে।

গর্ভপাতের বিষয়টিকে হালকাভাবে নেওয়ার প্রবণতা পুরুষদের মধ্যে দেখা যায়। গর্ভপাতের বিষয়টিকে পুরুষরা সেই সব অসংখ্য দুর্ঘটনার মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচনা করেন যেগুলির জন্য প্রকৃতির কূটকৌশল কেবল নারীদেরই বাধ্য করে এই ঝামেলা পোহানোর জন্য। গর্ভপাতের সঙ্গে জড়িত গুরুত্বকে পুরুষেরা পরিমাপ করেন না। নারীরাও এমন এক সময়ে নারীত্বের গুরুত্ব, নিজেদের মূল্যবোধকে অস্বীকার করে বসেন যখন পুরুষের নীতিশাস্ত্র এই নারীত্বের গুরুত্ব বা নারীদের মূল্যবোধের সঙ্গে সবচেয়ে উগ্র উপায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। একজন নারীর গোটা নৈতিক ভবিষ্যৎ-ই এর ফলে কেঁপে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে, শৈশব থেকেই মেয়েদেরকে আমরা বারবার বলে চলি, সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্যই মেয়েদের সৃষ্টি। তাঁদের কাছে আমরা মাতৃত্বের গুণগান গেয়ে চলি। পিরিয়ড, অসুস্থতা ইত্যাদি তাঁর অসুবিধার দিকগুলি, গৃহস্থালির কাজে একঘেয়েমি সব কিছুকেই পৃথিবীতে সন্তানের জন্ম দেওয়ার এই বিস্ময়কর বিশেষ সুযোগের দ্বারা ন্যায্যতা দান করা হয়। এখন একজন পুরুষ, নিজের স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য, নিজের পেশার স্বার্থে একজন নারীকে বলেন নারী-জাতির একজন হিসাবে নিজের বিজয়কে ত্যাগ করতে, অর্থাৎ গর্ভধারণ না-করতে বা গর্ভ নষ্ট করে দিতে। সন্তানও তখন আর কোনো অমূল্য ধন নয়। সন্তানের জন্ম দেওয়াও আর কোনো পবিত্র কাজ নয়। পৃথিবীতে উত্তরাধিকারের বিস্তার তখন হয়ে ওঠে শর্তসাপেক্ষ বা অনিশ্চিত, অপ্রয়োজনীয়। এটি এখন আবার নারীত্বের ত্রুটিগুলির মধ্যে একটি। ঋতুস্রাবের মাসিক কষ্টকে তুলনামূলকভাবে আশীর্বাদ হিসাবেই প্রতিভাত হয়। এখন, এই লাল স্রাবের প্রত্যাবর্তন, একদা যা ছোট্ট মেয়েটিকে আতঙ্কে নিমজ্জিত করে দিয়েছিল, তার জন্য উদ্‌বিগ্নভাবে অপেক্ষা করে থাকা হয়। সন্তানের জন্মদানের আনন্দের প্রতিশ্রুতি দিয়েই তাঁরা তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিল। এমনকি গর্ভপাতের জন্য সম্মতি দিলেও, সেই গর্ভপাত চাইলেও, একজন মহিলা সেই গর্ভপাতকে দেখেন তাঁর নারীত্বের জলাঞ্জলি হিসাবে। নিশ্চিতভাবেই সেই নারী তখন থেকে তাঁর লিঙ্গের মধ্যে একটি অভিশাপ, এক ধরনের দুর্বলতা, একটি বিপদ দেখতে পাবেন। এই অস্বীকারের শেষ পর্যায়ে গিয়ে কিছু মহিলা গর্ভপাতের মানসিক আঘাতের ফলে সমপ্রেমী হয়ে ওঠেন। যাই হোক, একই সময়ে একজন পুরুষ যখন পুরুষ হিসাবে তাঁর ভাগ্যের আরও সফলতার জন্য একজন মহিলাকে বলেন তাঁর শারীরিক সম্ভাবনাকে বলি দিয়ে দিতে, তখন সেই পুরুষ কিন্তু পুরুষদেরই নৈতিক কোডের ভণ্ডামিকে নিন্দা করেন। বিশ্বজুড়ে পুরুষেরাই গর্ভপাতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, তাঁরাই আবার এই গর্ভপাতকে গ্রহণ করেন একটি সুবিধাজনক সমাধান হিসাবে। চমকপ্রদ নিন্দাবাদের সঙ্গে নিজেদের বিরোধিতা করা সেই সব পুরুষের পক্ষে সম্ভব। কিন্তু একজন নারী তাঁর ক্ষতবিক্ষত শরীরে এই বৈপরীত্যগুলি অনুভব করেন। পুরুষালী এই খারাপ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে বিদ্রোহ করার ক্ষেত্রে মেয়েরা সাধারণত বেশিমাত্রায় লাজুক। নিজেকে এমন একটি অন্যায়ের শিকার বলে একজন মহিলা বিশ্বাস করেন যা তাঁকে নিজেকেই অপরাধী বলে ঘোষণা করে। নিজেকে তিনি নোংরা, অপমানিত বোধ করেন। সেই মুহূর্তেই একজন মহিলা স্পষ্ট করে নিজের মধ্যেই মূর্ত করে তোলেন পুরুষের দোষ-ত্রুটিকে। একজন পুরুষ দোষ-ভুল করেন, যদিও নারীর ঘাড়ের ওপর বন্ধুক রেখেই সেই পুরুষ সেই দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্তি পান। একজন পুরুষ কেবল কথাগুলি বলেন অনুনয়, হুমকি, যুক্তিসংত, ক্ষিপ্ত স্বরে : তারপর তিনি দ্রুত সেগুলি ভুলে যান। ব্যথা এবং রক্তে এই বাক্যাংশগুলির অনুবাদ নির্ভর করে সেই মহিলার ওপর। মাঝেমধ্যে পুরুষটি কিছুই বলেন না, কেবল চলে যান। কিন্তু পুরুষের এই নীরবতা এবং এড়িয়ে-চলা হল পুরুষদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সমস্ত নৈতিক কোডের আরও সুস্পষ্ট অস্বীকার। নারীদের ‘অনৈতিকতা’ বলতে যা বলা হয় – তা নিয়ে আমাদের বিস্মিত হওয়া উচিত নয়, যদিও তা নারীবিদ্বেষীদের একটি প্রিয় বিষয়। পুরুষেরা প্রকাশ্যে যে অহংকারী নীতিগুলি প্রদর্শন করেন এবং গোপনে নিন্দা করেন – কীভাবে মহিলারা এই অহংকারী নীতিগুলির প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস বা অবজ্ঞা অনুভব না-করে থাকতে পারেন? মহিলারা তখন শিখে যান পুরুষদের সেই সব কথাকে আর বিশ্বাস না-করতে যখন পুরুষেরা মহিলাদের উচ্চকিত প্রশংসা করেন বা নিজেদের প্রশংসায় ভরিয়ে দেন। একমাত্র নিশ্চিত জিনিস হল এই ছিন্নভিন্ন তছনছ হয়ে-যাওয়া রক্তাক্ত পেট, এক টুকরো লাল ভ্রূণ, অর্থাৎ সন্তানের অনুপস্থিতি। প্রথম গর্ভপাতের সময় থেকে একজন মহিলা এটি ‘বুঝতে’ শুরু করে। তাঁদের অনেকের কাছেই পৃথিবী আর একইরকম থাকবে না। যদিও, গর্ভনিরোধক পদ্ধতির প্রসারের অভাবের জন্য ফ্রান্সে এখনও গর্ভপাতই সেই সব মহিলার কাছে একমাত্র পথ যাঁরা চান না পৃথিবীতে সেই সব সন্তানের জন্ম দিতে যারা দৈন্য-দুর্দশার কারণে মারা যাবে। এই বিষয়টিকে উপযুক্তভাবে বলেছেন স্টেকেল : “গর্ভপাত-নিরোধক আইনটি একটি অনৈতিক আইন যেহেতু প্রত্যেক দিন প্রত্যেক ঘণ্টায় বাধ্যতামূলকভাবে এই আইনকে লঙ্ঘন করতে হবে”।

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক 

ছবি : সংগৃহীত 

 

0 Comments

Post Comment