- 18 January, 2023
- 0 Comment(s)
- 450 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
আইনগত গর্ভপাতের বিরুদ্ধে আহূত বাস্তব কারণগুলির কোনো ওজনই নেই। নৈতিক যুক্তির দিক দিয়ে সেগুলি পুরোনো ক্যাথলিক তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই নিজেকে নামিয়ে এনেছে। অর্থাৎ, ভ্রূণের একটি আত্মা রয়েছে। ব্যাপ্টিজিমের আগে সেই আত্মাকে শেষ করে দেওয়ার অর্থ তাকে স্বর্গের প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত করা। এটাও আবার লক্ষ করার বিষয় যে, গির্জাও কখনো-সখনো প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের হত্যার অনুমোদন দেয়। যেমন যুদ্ধে অথবা মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্তদের বিষয়ে। ভ্রূণের জন্য চার্চ অবশ্য একটি আপসহীন মানবিকতা রক্ষা করে চলেছে। ব্যাপ্টিজিমের দ্বারা কিন্তু ভ্রূণ রক্ষা পায় না। কাফেরদের বিরুদ্ধে পবিত্র যুদ্ধের সময় সেই কাফেরদের কিন্তু ব্যাপ্টিজিম করানো হয়নি। বরং গণহত্যাকে প্রবলভাবে উৎসাহিত করা হয়েছিল। ইনকুইজিশনের যাঁরা শিকার--প্রায় নিঃসন্দেহে বলা চলে যে তাঁরা সকলেই অনুগ্রহের অবস্থায় ছিলেন না। এমনকি আজ যে-সমস্ত অপরাধীদের গিলোটিন করা হচ্ছে অথবা যাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত--তাঁরাও অনুগ্রহ পাওয়ার অবস্থায় নেই। এই সমস্ত ক্ষেত্রেই অনুগ্রহের বিষয়টি চার্চ ছেড়ে দিয়েছিল ঈশ্বরের হাতে। চার্চ স্বীকার করে যে, মানুষ ঈশ্বরের হাতে কেবল একটি যন্ত্র এবং আত্মার পরিত্রাণ বা মুক্তি নির্ভর করে আত্মা ও ঈশ্বরের ওপর। তাহলে ঈশ্বরকে কেন ভ্রূণাবস্থিত আত্মাকে স্বর্গে গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখা হবে? এখন একটি চার্চ কাউন্সিল যদি বিষয়টিকে অনুমোদন করে, তাহলে বিধর্মীদের পবিত্র হত্যাকাণ্ডের সেই গৌরবময় যুগের চেয়ে বেশি প্রতিবাদ ঈশ্বর করবেন না। আসল সত্য হল : নৈতিকতার সঙ্গে বিন্দুমাত্র কোনো সম্পর্ক নেই এমন পুরোনো একরোখা ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে এখানে আমরা ঠোক্কর খাই। ইতিমধ্যেই আমি যে পুরুষালি ধর্ষকামিতা নিয়ে আলোচনা করেছি সেই বিষয়টিকেও বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে। ১৯৪৩ সালে পেত্যাঁ-কে ডাক্তার রায় যে-বইটি উৎসর্গ করেছিলেন, সেই বই হল এই বিষয়ের একটি বিস্ফোরক উদাহরণ। খারাপ বিশ্বাসের একটি বড়ো উদাহরণ হল এই বই। পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা থেকেই বইটিতে জোর দেওয়া হয়েছিল গর্ভপাতের বিপদের ওপর। কিন্তু সিজারিয়ান অপারেশনের চেয়ে বেশি স্বাস্থ্যসম্মত আর কিছু আছে বলেই তাঁর মনে হয় না। গর্ভপাতকে তিনি সামান্য অপকর্ম নয়, বরং অপরাধ হিসাবেই গণ্য করতে চান। তাঁর ইচ্ছা যে, এমনকি থেরাপিউটিক আকারের অধীনেও গর্ভপাত নিষিদ্ধ হোক, অর্থাৎ, যখন গর্ভবতী মায়ের জীবন বা স্বাস্থ্য বিপন্ন হয়। তিনি ঘোষণা করেন যে, জীবন বা অন্যটির মধ্যে কোনো একটিকে বেছে নেওয়া অনৈতিক। আর এই যুক্তির বলে বলীয়ান হয়ে তিনি মায়ের জীবন বলি দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি ঘোষণা করেন : ভ্রূণ মায়ের অধিকারগত নয়, সেটি একটি স্বাধীন সত্তা। যাই হোক, যখন এই একইরকম ‘সুচিন্তিত’ ডাক্তাররা মাতৃত্বের উচ্চকিত প্রশংসা করেন, তখন তাঁরা নিশ্চিত করেন যে, ভ্রূণটি মাতৃ-দেহেরই অংশ। মায়ের খাদ্যে পুষ্ট সেই ভ্রূণ কোনো পরজীবী নয়। নারীদের মুক্তি দিতে পারে--এমন সব কিছু প্রত্যাখ্যান করার জন্য কিছু পুরুষের এই উন্মাদনা দেখায় যে নারীবিরোধিতা এখনও কতটা জীবন্ত।
অধিকন্তু, যে আইনটি বিপুল সংখ্যক তরুণীর মৃত্যু, বন্ধ্যাত্ব এবং অসুস্থতার জন্য দায়ী, সেই আইনটিই কিন্তু জন্মহার-বৃদ্ধি নিশ্চিত করার ব্যাপারে সম্পূর্ণরূপে অক্ষম। আইনি গর্ভপাতের সমর্থক এবং শত্রুরা যে বিষয়ে একমত তা হল--দমনমূলক আইনের আমূল ব্যর্থতা। অধ্যাপক ডলেরিস, বালথাজার্ড এবং ল্যাকাসাগনের মতে, ১৯৩৩ সালের আশেপাশে ফ্রান্সে গর্ভপাতের সংখ্যা ছিল প্রতি বছর ৫০০,০০০। ডাক্তার রায়ের উদ্ধৃতি অনুসারে ১৯৩৮ সালে খাড়া করা একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী সেই সংখ্যা দশ লক্ষ। ১৯৪১ সালে বর্দো-র ডাক্তার ওব্যর্ত্যাঁ-র মতে, সংখ্যাটি ছিল ৮০০,০০০ থেকে দশ লক্ষের মধ্যে। শেষ সংখ্যাটিই মনে হয় সত্যের সবচেয়ে কাছাকাছি। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ‘কোম্বা’-তে লেখা একটি নিবন্ধে ডাক্তার দেসপ্লা লিখেছেন:
গর্ভপাত আমাদের রীতি-প্রথার মধ্যে ঢুকে গেছে ... দমনমূলক আইন কার্যত ব্যর্থ ... ১৯৪৩ সালে স্যেন অঞ্চলে ১৩০০ টি তদন্তের মধ্যে ৭৫০ টিতে অভিযুক্তের মধ্যে ৩৬০ জন মহিলাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, ৫১৩ জন দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এক বছরের কম থেকে পাঁচ বছরের বেশি সময় পর্যন্ত যা সেই অঞ্চলের আনুমানিক ১৫,০০০ গর্ভপাতের তুলনায় কম। ভূখণ্ডের ওপর ১০,০০০ উদাহরণ রয়েছে।
তিনি আরও যোগ করেছেন :
তথাকথিত অপরাধমূলক গর্ভপাত সমাজের সমস্ত স্তরে ততটাই পরিচিত যতটা আমাদের এই কপট সমাজের দ্বারা গর্ভনিরোধক নীতিগুলি গৃহীত। গর্ভপাত করানো মহিলাদের দুই-তৃতীয়াংশই হলেন বিবাহিত মহিলা… আমরা মোটামুটি অনুমান করতে পারি যে ফ্রান্সে যত সংখ্যক গর্ভপাত হয়, তত সংখ্যক শিশুরই জন্ম হয়।
এর কারণ, গর্ভপাত করানোর অপারেশনগুলি প্রায়শই বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে সম্পন্ন হয়। অনেক গর্ভপাতই শেষ হয় যে-সব মহিলার গর্ভপাত করানো হচ্ছে তাঁদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
প্রত্যেক সপ্তাহে প্যারিসের অ্যাঁন্সতিত্যু মেদিকো-লেগাল1 -এ দুটি করে মৃতদেহ আসে
গর্ভপাত করানো মহিলাদের মধ্য থেকে। অনেকেরই গর্ভপাতের ফলে স্থায়ী অসুস্থতা
দেখা দেয়।
কখনও কখনও বলা হয়েছে যে গর্ভপাত একটি ‘শ্রেণি অপরাধ’। কথাটি অনেকাংশে সত্য।
বুর্জোয়াদের মধ্যেই গর্ভনিরোধক অভ্যাসগুলি অনেক বেশি পরিব্যাপ্ত। নিজস্ব বাথরুমের
অস্তিত্বই বুর্জোয়াদের মধ্যে এই প্রয়োগকে আরও সহজ করে তুলেছে শ্রমিক এবং কৃষকদের
তুলনায়--একনাগাড়ে জল পাওয়ার সুযোগ থেকে যাঁরা বঞ্চিত। অন্যান্যদের তুলনায় বুর্জোয়া
সমাজের তরুণীরা অনেক বেশি বিচক্ষণ। এই পরিবারগুলিতে শিশুরা কম বোঝা। দারিদ্র্য,
স্থানাভাব, বাড়ির বাইরে মহিলাদের কাজ করার প্রয়োজন হল গর্ভপাতের সবচেয়ে সাধারণ
কারণগুলির মধ্যে অন্যতম। মনে হয়, দু-বার মাতৃত্বের পরেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্তানের
জন্মদানকে সীমিত করার সিদ্ধান্ত নেন দম্পতি। ফলত গর্ভপাত করা একজন কুৎসিত
বৈশিষ্ট্যের মহিলাই হলেন সেই মহৎ মা যিনি তাঁর দুই বাহুতে তাঁর দুই স্বর্ণকেশী দেবদূতকে দোল
খাওয়াচ্ছেন : এঁরা দু-জন তো আসলে একই মহিলা। ১৯৪৫ সালের অক্টোবরের লে তঁ মোদ্যার্ন 2 -এ ‘কমন ওয়ার্ড’ শিরোনামে শ্রীমতী জ্যনোভিয়্যাভ্ সারো এমন এক হাসপাতাল কক্ষের বর্ণনা
দিয়েছেন যে-কক্ষে তাঁর কিছুদিন কাটানোর সুযোগ হয়েছিল এবং যেখানে অসুস্থ মহিলা ছিলেন
যাঁদের সবে-সবে কিউরেটার্জ 3 হয়েছে। এই ১৮ জন মহিলার মধ্যে ১৫ জনেরই মিসকারেজ হয়েছিল, যার অর্ধেকের বেশিও ছিল স্ব-প্রণোদিত। ৯ নাম্বার মহিলাটি ছিলেন বাজারের কুলির স্ত্রী। দুটি বিবাহ থেকে তাঁর সন্তান-সংখ্যা ১০ হলেও মাত্র তিন জন সন্তান জীবিত ছিলেন। তাঁর সাত বার মিসকারেজ হয়েছিল, যার মধ্যে পাঁচটি ছিল স্ব-প্রণোদিত। তিনি স্বেচ্ছায় ‘কোট হ্যাঙ্গার’4 -এর কৌশলটি ব্যবহার করেছিলেন যা তিনি আত্মতুষ্টির সঙ্গে প্রদর্শন করেছিলেন। সেইসঙ্গে
স্বেচ্ছায় ব্যবহার করেছিলেন ট্যাবলেট--যার নাম তিনি তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন। ১৬ নাম্বার মহিলাটি ছিলেন ১৬ বছর বয়সি ও বিবাহিত। তাঁর অনেকগুলি সম্পর্ক ছিল এবং তিনি সালপিনজাইটিস 5 রোগাক্রান্ত হয়েছিলেন গর্ভপাত করানোর ফলে। ৩৫ বছর বয়সি ৭
নাম্বার মহিলা ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন : “কুড়ি বছর হল আমি বিবাহিত। কিন্তু স্বামীকে আমি
কখনোই ভালোবাসিনি। এই কুড়ি বছর স্বামীর সঙ্গে আমি ঠিকঠাক ব্যবহার করেছি। তিন মাস হল আমার একজন প্রেমিক হয়েছে। কেবল একবার একটি হোটেলের ঘরে থাকি। আমি গর্ভবতী হয়ে যাই ... ফলত এটা ছাড়া আর কীই-বা হওয়ার ছিল? আমি গর্ভপাত করিয়ে নিই। কেউ কিছুই জানতে পারেননি, না আমার স্বামী, না ... প্রেমিক। ব্যাপারটি এখন সমাপ্ত। আমি আর কখনোই এর মধ্য দিয়ে যাব না। আমি বড্ড ভুগেছি ... আমি কিউরেটার্জের কথা বলছি না ... না, না, এটা অন্য বিষয় : এটা হল নিজের প্রতি ভালোবাসা, বুঝতে পেরেছেন?” ১৪ নাম্বার মহিলার পাঁচ বছরে পাঁচটি সন্তান হয়েছিল। চল্লিশ বছর বয়সে তাঁকে একজন বৃদ্ধ মহিলার মতো দেখতে লাগতো। প্রত্যেক মহিলার মধ্যেই হতাশা থেকে এক ধরনের পরাজয় স্বীকারের মানসিকতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। দুঃখের সঙ্গে তাঁরা বলতেন : “নারীদের জন্মই হয় দুঃখভোগের জন্য”।
1 মর্গ।
2 চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমার নামাঙ্কিত এই পত্রিকাটি ছিল একটি রাজনৈতিক জার্নাল। এ ছাড়াও, এখানে দর্শন ও সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হত। ১৯৪৫ সালে এই জার্নালের যাত্রা শুরু হয়। সার্ত্রে ও বোভোয়ার ছিলেন এই জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা।
3 জরায়ুর চিকিৎসা করার জন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন। ভারী রক্তপাত, মিসকারেজ বা গর্ভপাতের পর জরায়ুর ওপরের আস্তরণ পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়।
4 বেআইনি গর্ভপাতের পরিচিত প্রতীক।
5 ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ফলে ঘটা ফ্যালোপিয়ান টিউবের প্রদাহ।
0 Comments
Post Comment