কন্যা সন্তান ও হাজারো প্রতিবন্ধকতা

  • 14 November, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 822 view(s)
  • লিখেছেন : ​​​​​​​শর্মিলা ঘোষ 
কন্যা ভ্রূণ হত্যা , শ্লীলতাহানি, খুন, অনার কিলিং, ধর্ষণ, অ্যাসিড হামলার ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ প্রমাণ করে  লিঙ্গ বিভাজন রুখতে আমরা কতটা ব্যর্থ। শাঁখা পলা সিঁদুর, হিজাব বোরখার বাইরেও মেয়েদের একটা নিজস্ব আকাশ আছে, যেটায় তার নিজের ঘুড়ির লাটাই আর সুতো অন্যের হাতে নয়, সমাজ, স্বামী বা পুত্র সন্তানের হাতে নয়, তার নিজের হাতেই থাকবে। শিশুবেলা থেকেই যেন এই দীক্ষায় স্নাত হতে পারে সব শিশু। শিশুদিবস পালন হোক বিভাজনহীন মননচর্চার শপথদিবস হিসেবে।

কন্যাসন্তান জন্মের মূহুর্ত থেকে শুরু হয় একটা জীবনযুদ্ধ, তাকে সমানাধিকার কেউ কোনোদিন দেয় না, লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। আধুনিকতার দম্ভ নিয়ে শেওলাধরা সমাজে কন্যাশিশুটির বেড়ে ওঠা বিশাল প্রশ্ন চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পুত্রসন্তানটি ইংরেজি মাধ্যম ও কন্যাসন্তানটি বাংলা মাধ্যমের ফারাক নিয়ে শৈশব শুরু করে তারপর আস্তে আস্তে বিয়ে-বাচ্চাকাচ্চা পালন দিয়ে নিজের কাঁচের স্বর্গ ভাঙতে দেখে।

"আরে মেয়ে হয়েছে তো, বিয়ের জন্য পয়সা জমাও"...সমাজের ছুঁড়ে দেওয়া এই বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটিকে ছোটো থেকেই মেয়েদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। তাদের স্বপ্ন দেখার পথ ,তাদের উচ্চ শিক্ষার পথ, তাদের অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী করার পথ আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়।

বিয়ে নামক এই প্রতিষ্ঠানটির সংজ্ঞাও পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। পাত্র বা পাত্রী নির্বাচনের অধিকার সন্তানের ওপরই ছাড়া উচিত। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবার মনে করে কন্যা সন্তানটি কলের পুতুল। বিয়ের বিজ্ঞাপনটি যাতে ভালো মানের হয় তাই লেখাপড়া শেখানো হয়। নাচ, গান, শেখানো হয়। ব্যাঙ্কে একটা মোটা অঙ্কের টাকা রাখা হয় কন্যা সন্তানের বিয়ের জন্য। অথচ এই টাকাই মেয়ের উচ্চশিক্ষায় ব্যবহার করে তাকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা যায়। বিয়ে তো খুব সামান্য খরচেও দেওয়া যায় বা করা যায়। অতিরিক্ত আড়ম্বর, গয়নাগাটি, দামী শাড়ি, সুসজ্জিত প্যান্ডেলের থেকেও মূল্যবান হল জীবনে স্বাধীনভাবে সসম্মানে বেঁচে থাকার জন্য নিজেকে শিক্ষিত করে তোলা।

মায়ের মুখে শোনা কন্যাসন্তান হিসাবে আমার জন্মের পর একটা কাঁসার গ্লাস আমার ঠাকুমা অবজ্ঞা ভরে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন উপহার হিসেবে, সোনাদানা দিয়ে তো নাতির মুখ দেখা হয়, নাতনি তো অভিশাপ। তবে আফশোষ আমার কন্যা সন্তানের পৈতৃক সূত্রে সেটুকুও জোটেনি। অর্থাৎ সমাজ ব্যাবস্থা পোশাকে আধুনিক হলেও মননে আধুনিক হয়নি।

সমঝোতার মাধ্যমে নিজের সব আশা আকাঙ্ক্ষার ভরাডুবি ঘটিয়ে একঘেঁয়ে জীবন যাপন করার শিক্ষাই মেয়েদের দেওয়া হয়। "আরে মানিয়ে নিতে শেখ, শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে তো নাকি!"...কেন অন্যায় বা কুরুচিপূর্ণ জিনিস বা অত্যাচার মেয়েরা মানিয়ে নেবে এই প্রশ্ন তুলতে শেখানো হয় না। শাঁখা পলা সিঁদুর, হিজাব বোরখার বাইরেও মেয়েদের একটা নিজস্ব আকাশ আছে, যেটায় তার নিজের ঘুড়ির লাটাই আর সুতো অন্যের হাতে নয়, সমাজ, স্বামী বা পুত্র সন্তানের হাতে নয় তার নিজের হাতেই থাকবে।

মেয়ে মানুষ একটু লাজুক হবে, প্রশ্ন করবে না, জেদি হবে না, যেন নম্র ভদ্র সুশীল হবার সব গুরুভার মেয়ের ওপরেই ন্যস্ত। ছেলে জেদি হলে গুণের প্রকাশ আর মেয়ে জেদি হলে বদগুণ, ছেলে রাগী হলে ম্যানলী আর মেয়ে রাগী হলে দজ্জাল।

অবলা, অসতী, অপয়া এগুলো যেন কপালে কারা খোদাই করে দিয়েছে যাকে এতবছরের চেষ্টাতেও ঝেড়ে ফেলা যাচ্ছে না।

বারমুডা, ফাটা জিন্স, যখন ছেলেদের পোশাক তখন সেটি স্টাইলিশ কিন্তু যখন মেয়েদের তখন সেটি কুরুচিকর। তাই চরম পিতৃতান্ত্রিক এক রাজনীতির দল-নেতা পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মহিলা বলে তাঁকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে বারমুডা পরার নিদান দেন।

কুরুচির এই পেটেন্ট পিতৃতান্ত্রিক সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবারসহ সবাই নিয়ে রেখেছে, কোথায় কোন মেয়েকে একটু বেকায়দায় দেখবে আর তার কপালে চরিত্রহীনতার লেভেল সাঁটিয়ে দেবে।

কন্যা ভ্রূণ হত্যা , শ্লীলতাহানি, খুন, অনার কিলিং, ধর্ষণ, অ্যাসিড হামলার ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ প্রমাণ করে  লিঙ্গ বিভাজন রুখতে আমরা কতটা ব্যর্থ।

আমারই এক ছাত্রী বীভৎস ভাবে ধর্ষণের পর খুন হয়েছিল, তখন অভিভাবক মহলে, শিক্ষক মহলে বলতে শুনেছি আরে মেয়েটা মাঠেঘাটে ছেলেদের সঙ্গে গল্প করতো। অর্থাৎ ছেলেদের সাথে গল্প করলেই ধর্ষণ হতে পারে! মেয়েদের ওপর অত্যাচারকে জাস্টিফাই করার কত যুক্তি যে সমাজ রেডি রেখেছে তা প্রতি পদে পদে দেখতে পাওয়া যায়।

পারস্পরিক আলোচনায় অংশগ্রহণকারী একজন মহিলা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেই ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনৈতিক দলের নেতা সংবাদ মাধ্যমের সামনেই কুরুচিকর ভাবে বলেন, "ন্যাকামি করবেন না"।

সমাজ রেডি আছে অপদস্থের নানা বিশেষণ নিয়ে, মেয়েরা প্রশ্ন করলেই খনার মতো জিভ কেটে নিতে উদ্যত।

তালাক বা ডিভোর্সি মেয়ে নিয়ে আরো জলঘোলা করার অভ্যাস সমাজের মজ্জাগত! আরে নিশ্চয়ই চরিত্র ভালো ছিল না। সম্পর্ক যদি বোঝা হয় তাহলে সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার অধিকার কেন থাকবে না মেয়েদের! কেন মুসলিম মেয়েরা পাবে না  সম্পত্তিতে সমান ভাগ!  হিন্দুদের সমানভাগে সম্পত্তি দেওয়ার আইন ভারতে থাকলেও কেন মেয়েদের বঞ্চিত করা হয়? আব্রু রক্ষার দায় কন্যাসন্তানটির ওপর চাপিয়ে  আর কতদিন বলিপ্রদত্ত হবে মেয়েরা!

হাঁড়িকাঠে গর্দ্দান দেবার আগে লড়াই করে বাঁচার আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে এগিয়ে আসতে হবে পিতামাতা পরিবার, শিক্ষক সমাজকে, যাতে মেয়েদের স্বপ্নের উড়ান একটা মুক্তির আকাশ পায়।

শেষটা এভাবেই বলি মেয়েরা দাবি তুলুক পণ দিয়ে বিয়ে নয়, দেনমোহর (মুসলিম বিয়ের চুক্তিতে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পাত্রীকে দেওয়ার সর্ত করে পাত্র। ধর্মীয় নিয়মের বিয়েতে এই সর্ত আবশ্যিক। এটাকে কন্যাপণ বলা যেতে পারে) নিয়ে বিয়ে নয়, উভয়পক্ষের আত্মসম্মান বজায় রেখে হোক বিয়ে। সেটা অর্জন করতে হলে চাই উচ্চশিক্ষার সুযোগ, চাই অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা, চাই সম্পত্তিতে সমান ভাগ, আর চাই আত্মবিশ্বাস। তাহলেই নিজের জীবন, নিজের জীবিকা মেয়েরা নিজে বাছাই করে নেবে নিজের কর্মক্ষমতা দিয়ে।

পুনঃপ্রকাশ, প্রথম প্রকাশ ৬ এপ্রিল ২০২১

ছবি : ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

লেখক : শিক্ষক, কবি ও প্রাবন্ধিক

0 Comments

Post Comment