সাহায্য 

  • 01 July, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 615 view(s)
  • লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
গৃহবধূ মানে সংসারের সব কাজ তাকে করতে হবে। শাশুড়ির কথামত ওঠবস করতে হবে। মানাতে না পারলে চলে যাও বাপের বাড়ি। আর সেখানে গিয়ে পরজীবী হয়ে বেঁচে থাকা। পরতে পরতে টের পায় বাপের বাড়ি তার বাড়ি নয়। এই বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে আসা যে কী কঠিন ফুটে উঠেছে এই গল্পে।


প্রায় দু মাস হয়ে গেল এষা বাপের বাড়িতে এসে বসে আছে। এখনো পর্যন্ত নড়ার নাম মাত্রও নেয়নি। সকলে মিলে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলো— পারিবারিক অশান্তি নিজেদের মধ্যে যত তাড়াতাড়ি মিটিয়ে ফেলা যায় ততই মঙ্গল। কিন্তু এষা কেন ক্ষমা চাইতে যাবে? ও তো কোনো দোষ করেনি। এমন ভাবে অমানুষিক খাটনি কেউ খাটায়? লকডাউনে ঘরের সবকটা পুরুষ-মানুষ পায়ের ওপর পা তুলে বসে ফোনে বন্ধুদের সাথে দিন-রাত আড্ডা দিয়ে যাবে আর তাদের সমস্ত ফাইফরমাস খেটে যেতে হবে একা এষাকে। বাড়িতে কাজে সাহায্য করার মতো একটা লোকও নেই। এষা বিয়ে করে এ বাড়িতে পা রাখার পর কটা দিন যেতে না যেতেই শাশুড়ি মা বদমাইসি করে কাজের মহিলাটিকেও ছাড়িয়ে দিলেন। প্রথমেই এষা বাড়ির সব কাজ একা করতে কোনো ভাবেই রাজি হয়নি। অনেক দুঃসাহসিকতার সাথে বলেছিল শাশুড়িকেও ওর সাথে কাজে হাত লাগাতে। সেটা যে কত বড় অপরাধ করে ফেলেছিল এষা তা পরে বুঝতে পারে। শাশুড়িরা যে অভিনয়ে এতটা পারদর্শিনী হন এষার তা জানা ছিল না। এষার এই ধৃষ্টতা দেখে শাশুড়ি মা প্রথমে রেগে আগুন হয়ে যেতে গিয়েও সাথে সাথে নিজের ভোল বদলে ফেললেন। তার কোমরের ব্যথাটা নাকি বেড়ে গেছে শতগুণ। তারপরেই শুরু হল উচ্চস্বরে হাউমাউ করে সে কি কান্না! গোটা পাড়াসুদ্ধু লোককে তো জানাতে হবে বউমার এই রকম নির্দয় অত‍্যাচারের কথা। এষা তখন খুবই ভয় পেয়ে যায়। মাথা গরম করে কি খুব বাজে ভাবে শাশুড়ি মা-‌র সাথে কথা বলে ফেলেছে? না, সেরকম তো কই মনে হল না। এষা তো যতটা পেরেছে নম্র ভাবেই বলার চেষ্টা করেছে। আর তাছাড়া শাশুড়ি মা-‌কে কাজ করতে বলার আগে তাকে দেখে তো মনে হয়নি যে কোমরের এই প্রচণ্ড ব্যথায় তিনি ভুগছিলেন। বলার সাথে সাথেই ব্যথা চলে এল? কাজ করবেন না তো করবেন না, তার জন্য এত নাটক করতে হবে কেন? এষা শাশুড়িকে কি এমন খারাপ কথা শুনিয়েছিল, তা দু দিন ধরে চিন্তা করেও খুঁজে পেল না। শাশুড়ির কান্না শুনে সেদিন বাড়ির সকলে ছুটে এসে এষাকে যাচ্ছেতাই ভাবে অপমান করেছিল। বাপের বাড়ি তুলে সবসময় কথা বলাটা শ্বশুরবাড়ির লোকেদের চিরকালীন পরম্পরা, তার সাথে এষাকে অপয়া অপবাদ না দেওয়া পর্যন্ত সেদিন কারোরই মনের আঁশ মিটলো না। এষা জানে তার শ্বশুর-শাশুড়ি প্রতিবেশীদের কাছে ওর বদনাম রটিয়ে বেড়ায়। তাও প্রতিবেশীদের কাছ থেকেই শোনা। কিন্তু সব থেকে অদ্ভুত বিষয় হল এটাই যে এষার স্বামী কোনোদিন এর প্রতিবাদও করেনি। এষা যতবারই এ নিয়ে স্বামীর কাছে দুঃখ করেছে সে ততবারই এগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই বলেনি। কিন্তু সবসময় কি সবকিছু সহ‍্য করে নেওয়া যায়? শ্বশুর-শাশুড়ির কেন যে ওর প্রতি এত রাগ এষা তা বুঝতেই পারেনা। প্রতিদিনই প্রায় কারণে অকারণে একটা না একটা ঝগড়া, খিটিমিটি লেগেই থাকে। যতই ভাবে ওনাদের অপমানকে গায়ে মাখবে না ততই যেন কথাগুলো আরও তিরের ফলার মতো বুকে এসে বিঁধতে থাকে। এষার চোখ ছলছল করে। বাবার কাছে কি ভালোই না ছিল। কোনো দিন কারোর কাছে কোনো কথা শুনতে হত না। বাবা সবসময় মেয়েকে আগলে আগলে রাখতেন। আর এখন এত কঠিন ভাবে নিষ্ঠুর ভাষায় এনারা গালি দেন যে... না, অনেক হয়েছে আর সহ‍্য করতে পারছে না এষা। এবার ঠিক করেছে সত‍্যিই বাবার কাছে ফিরে যাবে। পরের দিন সকাল হতে না হতেই এষা সব জিনিসপত্র প্যাক করে নিয়ে অ‍্যাপস্ ক‍্যাব ধরে সবার মুখের সামনে দিয়ে সোজা চলে এল বাপের বাড়িতে।


এষাকে এভাবে হঠাৎ বাপের বাড়ি ফিরে আসতে দেখে সকলে খুশি হলেও বাবার কোথাও যেন একটা খটকা লেগেছিল। লকডাউনে সংসারের অবস্থা এমনিতেই খারাপ তারমধ্যে নয়নয় করে প্রায় দু মাস কাটতে চললো, এষা এ বাড়ি ছেড়ে নড়বারও নাম নিচ্ছে না। মায়ের মনে একটু একটু করে সন্দেহ দানা বাঁধছে, বাবারও উদ্বেগ বাড়ছে, মেয়ে আবার ঝগড়াঝাটি করে এ বাড়িতে চলে আসেনি তো? ওদিকে বেয়াই তো আর ফোনই ধরতে চাইছেন না। বিবাহিত মেয়েকে এতদিন ঘরের ভেতর পুষে রেখে দেওয়াটাও তো সমাজের চোখে ভালো দেখায় না। এষার মা একদিন এষাকে প্রশ্ন করেই ফেললো, — ‘‌জামাই তোকে নিতে আসছে কবে?’‌
এষা বুঝতে পারে মা এবার ওকে জোর করে ঠেলে শ্বশুরবাড়িতে পাঠাতে চাইছে। এষা মুখটাকে ফিরিয়ে নিয়ে জবাব দেয়,— ‘‌ও আমাকে আর কোনোদিন নিতে আসবে না।’‌
মেয়ের কথা শোনামাত্র মায়ের মাথায় যেন বাজ ভেঙ্গে পড়লো। কি সর্বনাশ করে চলে এসেছে মেয়ে, নিজের সংসার নিজের হাতে ভেঙে দিয়ে এসেছে! এবার তো ওর নরকেও ঠাঁই হবে না।

যতদিন যাচ্ছে এ বাড়িতে এষার অস্বস্তিটা ততই বেড়ে চলেছে। এই বাড়িটা যেন আজ ওর নিজের বাড়ি নয়। যেখানে ছিল সেটা ওর শ্বশুরের বাড়ি আর এটা ওর বাবার বাড়ি। তাহলে কোথায় ওর নিজের বাড়ি? কোথাও নেই। এ বাড়ির সকলের কাছেই এখন ও একজন অপরাধী। বাবাও কেমন যেন বদলে গেছেন। মেয়েকে আবার ফিরে এসে ঘাড়ে চেপে বসতে দেখেই বাবার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। এখন বাবা এষাকে তো আর সবকিছুতে আগের মতন সাপোর্ট করেন না। মাও সেই স্নেহ দিয়ে আর আগের মত আগলে রাখেন না। বাবা ওকে দেখলেই রাগ করে বসে থাকেন। একবারটি মেয়ে মুখ ফুটে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথাটা বলুক, ব্যস্, বাকি সমস্ত ব্যবস্থা বাবা একাই বেয়াইয়ের হাতে পায়ে ধরে মেয়ের হয়ে ক্ষমাটমা চেয়ে করে দেবে। 

মা, বাবা, দাদা সবার কাছ থেকেই এষা একটু একটু করে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। এদের সকলের বিরক্তির একমাত্র কারণ এষা। তবে একজন এখনো ওর কাছে আসে, বৌদি জয়ী। জয়ীই এখন এ বাড়িতে এষার একমাত্র বন্ধু যার সাথে মনের দুটো কথা একটু খুলে বলতে পারে। বৌদি ওর সমস্ত দুঃখের কথা চুপচাপ শুনে যায়, কখনোসখনো সহমর্মিতাও দেখায়। তবে আজ পর্যন্ত কোনো খারাপ ব্যবহার এষা জয়ীর কাছ থেকে পায়নি। জয়ীও এষার সাইকোলজিটা বোঝার চেষ্টা করে। তবে, শ্বশুর-শাশুড়িকে তোষামোদ করে চলতে গেলে এষাকে পুরোপুরি ভাবে সমর্থন করলেও চলবে না। জয়ী দুই পক্ষের মধ্যেই একটা সামঞ্জস্য রেখে চলার চেষ্টা করে, এই জন্যে সে মাঝেমধ্যে সকলের কাছে খারাপও হয়ে যায়। কিন্তু কি করবে, সংসারের অখণ্ডতা বজায় রাখার সমস্ত দায়িত্ব তো বউদের ঘাড়েই বর্তায়।

বিকেল বেলা এষা নিজের ঘরের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। ঐ যে দেখা যাচ্ছে সামনের বাড়িটার ছাদ, সূর্য এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক তার মাথায়। বড় একটা উজ্জ্বল গোল কমলা লেবুর মতো দেখতে লাগছে সূর্যটাকে। উল্টো দিকের আকাশে তখন একটু একটু করে ভিড় জমাচ্ছে অন্ধকার। সূর্যটা এক্ষুনিই ঝুপ করে পড়ে যাবে ঐ ছাদটার পিছনে আর ওপাশের অন্ধকারটাও রেরে করে ছুটে এসে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেবে আলোক বিন্দুর শেষ স্মৃতিচিহ্ন টুকুকে। জয়ী একটা কাঁচের প্লেটে করে আম কেটে নিয়ে এসে ঢুকতে গিয়ে দেখে, ঘর অন্ধকার। মন ভালো নেই তাই বাবা-মায়ের ওপর অভিমান করে জানলার ধারে গিয়ে চুপচাপ বসে আছে এষা। জয়ী ওর পাশে বিছানায় এসে বসলো। এষার হাতটা জয়ী চেপে ধরে বললো,— ‘‌এভাবে আমাদের ওপর রাগ করে বসে থেকো না। আমার খুব খারাপ লাগে। বাবা মা তো তোমার ভালোর জন্যই বকাবকি করেন। ওনাদের কথায় কখনো রাগ করতে নেই। ঠাকুরকে ডাকো দেখবে কটা দিন পর সব ঠিক হয়ে গেছে।’‌
এষা ঝটকা মেরে হাতটাকে সরিয়ে নিল,—‘‌উফ্ কি গরম বৌদি তোমার হাতটা। জ্বরটর এসছে নাকি?’‌
জ্বরজ্বর ভাবটা দুপুর থেকেই মনে হচ্ছিল জয়ীর। এখন সেটা আরও বেড়ে গেছে, কিন্তু এষাকে কিছুতেই সেটা বুঝতে দেওয়া যাবে না। জয়ী এষার থেকে সরে এসে বললো,— ‌‘‌না না, ও কিছু না। তুমি আমগুলো খেয়ে নিও। আমার কাজ আছে আমি চলে যাচ্ছি।’‌
‘‌না দাঁড়াও’‌ বলে এষা উঠে গিয়ে তাড়াতাড়ি লাইটের সুইচটাকে অন করলো।  জয়ীর চোখ দুটো রাঙা হয়ে উঠেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে শরীরটা যথেষ্ট দূর্বল। অন্ধকারে এষা তা এতক্ষণ খেয়ালই করতে পারেনি। এষা জয়ীর কপালে হাত রাখতেই দেখে গা একেবারে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। জয়ী যত বিষয়টাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো এষা তত আরও জোরে জোরে চেঁচাতে লাগলো যাতে বাড়িসুদ্ধ লোকের কান পর্যন্ত জয়ীর অসুস্থতার খবরটা পৌঁছতে পারে। এষাকে থামাতে না পেরে জয়ী একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এষার চেঁচামেচি শুনে মা ঘরের দিকে এগোতে গিয়েই দেখলো জয়ী ছুটে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে। ঘরে ঢুকে এষার কাছে জয়ীর জ্বরের খবরটা জানতে পেরেই তার মাথায় দ্বিতীয়বার বাজ ভেঙ্গে পড়লো।

অনতিবিলম্বেই শ্বশুরমশাইয়ের আদেশ চলে এল জয়ীর কাছে— তাকে এ বাড়ি ছাড়তে হবে। জয়ী তখনই ছুটে গেল শ্বশুরমশাইয়ের কাছে। কি করে কোনো টেস্ট না করেই ওনারা জয়ীকে ঘর থেকে তাড়াতে পারেন? এটা কোভিড না হয়ে সাধারণ কোনো জ্বরও তো হতে পারে। একবারটি জয়ী ডাক্তার দেখিয়ে আসুক তারপর না হয় বাপের বাড়ি চলে যাবে। এখন না হলে ও কোথায় যাবে? কিন্তু শ্বশুরমশাইয়ের কড়া জবাব — যেখানে ইচ্ছা যাও, জাহান্নমে যাও, আমাদের তা ভেবে কোনো কাজ নেই। তবে এক্ষুনি সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে যেন জয়ী ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এ বাড়িতে শ্বশুরের মুখের ওপর কেউ কথা বলে না তাই এর বেশি অনুনয় করার সুযোগটুকুও জয়ী পেল না। জয়ী নিজের ঘরে এসে ফোন করে বাবাকে সবটা জানালো। ওদিক থেকে বাবাও পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে, ও বাড়িতে জয়ীর প‍্রবেশ নিষেধ। বাইরে থেকে জ্বর গায়ে নিয়ে কেউ যেন ওই বাড়িতে না ঢোকে।

শুধুমাত্র আজকের রাতটুকুই হাতে সময়, কালকে ভোর থাকতে বেরিয়ে না গেলে এরা সকলে মিলে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে জঞ্জালের মতো। সকলের মনে একটা ঘৃণা জন্মে গেছে জয়ীর ওপর। ঘরের একটা কোণায় বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে জয়ী সবথেকে অসহায়, বাসাহীন, উদ্দেশ্যহীন, নিঃসঙ্গ পাখিটির মতো। সারাজীবন ধরে যাদেরকে আপন ভেবে এত সেবা করে গেল তাদের কারোর কাছেই জয়ী আর আপন হয়ে উঠতে পারলো না। আজ বিবাহিত এই মেয়েটির দায়িত্ব নেওয়ার মতো কেউ নেই। জীবনের বাকি যুদ্ধটা একাকেই চালাতে শিখতে হবে।

জিনিসপত্র প্যাক করে ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো বটে, কিন্তু এখন কোথায় যাবে জয়ী এই অসুস্থ শরীরে তার কোনো ঠিক নেই। ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করলো কোথায় যাবেন, জয়ী কোনো সদুত্তর দিতে পারলো না। শুধু বললো,— ‘‌কাছাকাছি কোনো সেফ হোমের ঠিকানা জানা আছে তোমার?’‌


চোদ্দটা দিন কেটে গেছে। জয়ী এখন অনেকটাই সুস্থ। রিপোর্ট প্রথমে পজিটিভ এলেও এখন নেগেটিভ এসেছে। জয়ী এখন দিব্বি আছে এই সেফহোমে। তিন-চার জন বন্ধুও জুটে গেছে এখানে। তবে সকলেই বয়সে ওর থেকে অনেকটাই বড়। তাই একটু স্নেহের চোখেই ওরা জয়ীকে দেখে। আর মাত্র আজকের রাতটা তারপর আবার যে যার বাড়িতে ফিরে যাবে। কিন্তু জয়ী কোথায় যাবে? যাদের কাছে ওর কোনো দাম নেই আবার তাদের কাছেই ফিরে যেতে হবে? এতগুলো দিন জয়ী বাড়ির বাইরে এই সেফহোমে রয়েছে, শ্বশুরবাড়ি বা বাপের বাড়ি থেকে একটা ফোনও আসেনি। জয়ীর বাঁচামরা নিয়ে কারোর কোনো মাথা ব্যথা নেই। তবে শ্বশুরবাড়ির ড্রাইভারটা নিজে থেকেই ওর খোঁজখবর নিতে দু-একবার ফোন করেছিল মানবিকতার খাতিরে। এই সামান্য মানবিকতার চিহ্নটুকুও জয়ীর আত্মীয়বন্ধুরা কেউ দেখাবার প্রয়োজনও বোধ করেনি। এমনকি নিজের প্রিয় ননদ এষাও নয়। জয়ী সেফহোমে তার এই নতুন বন্ধুদের কাছে পেয়ে বুঝতে পারে নিজের মূল্যটা ঠিক কতখানি।

বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। আজ সারা রাতে বৃষ্টির বিরাম লাগারও কোনো সম্ভবনা নেই। ইতিমধ্যেই জয়ীর সামনের বেডে তার বন্ধু কাকু-কাকিমারা সবাই গোল হয়ে বসে আড্ডাটা বেশ জমিয়ে ফেলেছেন। যে কাকিমা ভালো গান গাইতে পারেন তিনি একটা গানও জুড়ে দিয়েছেন আড্ডার সাথে —
‘‌‘‌যদি সবাই ফিরে যায়,
যদি গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায়—
তবে পথের কাঁটা 
ও তুই রক্তমাখা চরণতলে একলা দলো রে।।’‌’‌
জয়ী ওদের কাছে এসে বসে পড়লো। মনটা খুব ভালো লাগছে কিন্তু কালকের চিন্তাটা মাথা থেকে কিছুতেই সরছে না। কাকিমা জয়ীকে দেখে গান থামিয়ে বললেন,— ‘‌কালকে কোন বাড়িতে ফিরবে বলে ঠিক করলে?’‌
জয়ী ক্লান্ত ভাবে উত্তর দিল,— ‘‌ওদের কাছে ফিরে যেতে আর মন চাইছে না।’‌
কাকিমা আবার বললেন,— ‘‌যে জীবনটাকে একবার ফেলে চলে এসেছ সেখানে আর ফিরতে হবে না। তোমার একটা থাকার জায়গা দরকার এই তো? আমি একা মানুষ, রিটায়ার্ড পার্সন, সংসারপাতি বলেও কিছু নেই। আমার বড় বাড়িটা তো ফাঁকায় পড়ে থাকে। তুমি যদি চাও তাহলে আমার সাথে নিরাপদেই থাকতে পারবে। আর আমারও ভালো লাগবে তুমি থাকলে। জয়ী, তুমি নিজের জীবনটাকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখো। জীবনটা বড়ই দুর্গম কিন্তু এই পথে তোমাকে একাই যেতে হবে, কেউ ইচ্ছা করলেও তোমাকে সাহায্য করতে পারবে না। নতুন ভাবে নিজের ব্যক্তি সত্ত্বাটাকে বাঁচার একটা সুযোগ করে দাও।’‌
জয়ী বললো,— ‘‌ঠিকই বলেছেন কাকিমা। এছাড়া আমার অস্তিত্বটাকে টিকিয়ে রাখার বোধহয় আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু এখন আবার শূন্য থেকে কীভাবে শুরু করবো, কী করে নিজের পায়ে দাঁড়াবো সেটাই বুঝতে পারছি না।'
ওদের কথাগুলো শুনে কাকু বললেন,— ‘‌আচ্ছা একটা কাজ করলে তো হয়, আমরা সকলে মিলে যদি একটা কিচেন খুলে কোভিড পেসেন্টদের বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করি।’‌
অন্য একজন বললেন,— ‘‌হ‍্যাঁ সে তো খুবই ভালো কথা। মানুষকে সাহায্য করারও একটা সুযোগ পাওয়া যাবে আর আমাদের কাউকে ছেড়ে ছেড়ে থাকতেও হবে না। সবাই মিলে একসাথে কাজ করতে পারবো। তুমি রাজি তো জয়ী?’‌
জয়ী কিছু বলার আগেই ওর একটা ফোন এল। দেখলো বাবা ফোন করছে। জয়ী ফোনটা কেটে দিয়ে এসে বললো,— ‘‌একজন মানুষ হিসাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে আমি রাজি।’‌‌‌

লেখক: ছাত্রী, গল্পলেখক

0 Comments

Post Comment