- 18 November, 2022
- 0 Comment(s)
- 274 view(s)
- লিখেছেন : সরিতা আহমেদ
খুব বেশি দিন আগের কথা না, মাত্র বছর খানেক আগেই আমাদের স্বাধীনতা দিবসে আমাদেরই প্রতিবেশী এক রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্ব, ফেডেরাল স্ট্রাকচার হারিয়ে পরাধীন হয়েছে একটি ইসলামিক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর হাতে। দেশটির সাথেই তার নাগরিকরা বিশেষত মেয়েরা হারিয়েছে বহু কষ্টার্জিত স্বাধীনতা। মেওয়া আর কাবুলিওয়ালার সেই মরু দেশটির নাম - আফগানিস্তান । তালিবানরাজ শুরু হওয়ার পরে পরেই সে দেশের একটা সাধারণ ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রাণ বাঁচাতে মেয়েরা ঘরের পর্দা, বস্তা,চাদর ইত্যাদি যা কিছু কাপড় হাতে পাচ্ছে তাই দিয়ে মুড়ে ফেলছে শরীর । এক হাতে বন্দুক ও অন্যহাতে মাইক নিয়ে উগ্রবাদী জঙ্গীরা টহল দিয়ে, নোটিশ দিয়ে জানাচ্ছে মেয়েদের বাইরে বেরোবার শর্ত। সেই আবশ্যিক শর্তগুলির মধ্যে সবচেয়ে উপরে স্থান পেয়েছে বোরখায় মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি সবটুকু শরীর ঢেকে রাখতে হবে। মানলে প্রাণে বাঁচবে, নইলে প্রকাশ্যে মাথায় গুলি করে অথবা জ্যান্ত গর্তে ঢুকিয়ে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হবে ‘বেয়াদব বেতমিজ ঔরাত’দের। অথচ মাত্র কয়েক দশক আগেও আফগানিস্তানের মেয়েদের ছবিটা এরকম ছিল না। ১৯৪৬ সালে আফগান মহিলাদের ভোটাধিকার সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করলেও তাদের প্রকৃত অগ্রগতি ঘটে ১৯৮০ দশকে। প্রথমে বারবাক কামাল ও পরে ডঃ নাজিবুল্লার শাসনকালে আফগানিস্তানের সমাজে কল্যাণকামী মুখ হিসেবে উঠে আসেন বহু নারী-নেতৃত্ব । ‘৯০ দশকের শুরুতে মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই শিক্ষকদের মধ্যে ৭০%, সিভিল সার্ভেন্টের ৫০% এবং ডাক্তারিতে ৬০% স্থান অধিকার করেন মহিলারা। গোল বাঁধে ১৯৮৯ সালে প্রথমবার তালিবানি অভ্যুত্থানে যখন নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয় ডঃ নাজিবুল্লাহকে। মেয়েরা পরিনত হয় পর্দাঢাকা পণ্যে যার প্রকাশ্যে নিলাম অবধি হয় মানুষ-হাটে !
আর এবারের অভ্যুত্থানে মাত্র এক বছরেই আফগানিস্তানের কঙ্কাল বেরিয়ে গেছে। মেয়েদের স্কুলে কেন পুরুষ শিক্ষক থাকবে শুধুমাত্র এই যুক্তিতেই এক বছরের মধ্যে ১৫টি স্কুল জ্বালিয়ে দিয়েছে আজকের শাসকেরা। স্কুলের ছাত্রীদের শুধু বোরখাই বাধ্যতামূলক করা হয়নি, রীতিমত স্থানীয় সামন্ত প্রভুদের বিচারশালায় সতীত্বের পরীক্ষা দিয়ে তবে বাঁচার ছাড়পত্র মেলার নজিরও পাওয়া গেছে। মাত্র কয়েক মাস আগেই স্কুলছাত্রীদের প্রকাশ্যে নগ্ন করে সতীচ্ছেদ্দ পরীক্ষা করা হয়েছে বলে স্বীকার করেছে সে দেশের সরকারি বুলেটিন। ফলে বহু মেয়ে স্কুল ছেড়ে কার্যত গৃহবন্দী হয়ে মৃত্যুভয়ের মধ্যেই জীবন কাটাচ্ছে, স্রেফ নিশ্চিন্তে শ্বাসপ্রশ্বাসের তাগিদে তারা ভুলেছে স্কুলের রাস্তা।
অন্যদিকে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধেই কিছু সাহসিনীর ছবিও উঠে এসেছে যারা বন্ধুকের নলের সামনে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র হয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে প্রতিবাদে মুখর হয়েছে । সারা বিশ্বের সমর্থন পেয়ে আন্দোলনের নয়া ইতিহাস লিখেছে। এরপর শতশত দেশের তরুণীরা বোরখা পুড়িয়ে, কোরান জ্বালিয়ে প্রতিবাদে সামিল হয়েছে।
২০২১-এর আফগানিস্তানের মতই প্রতিবাদ দেখল ২০২২ সাল । স্থান ইরান ।
ইরান এমন একটি দেশ যেখানে রাজতন্ত্রের সময় নারীদের বেশি স্বাধীনতা ছিল, কিন্তু ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর নারীদের ধর্মীয় মৌলবাদের দাসে পরিণত করা হয়। যে মহিলারা প্রতিবাদ করেছিল তাদের কারারুদ্ধ করা হয়েছিল এবং যারা বাধ্যতামূলকভাবে এটি গ্রহণ করেছিল তাদের ‘ইরানের আদর্শ নারী’ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছিল।
২০১৫ সালে ইরানের নাগরিকদের বায়োমেট্রিক কার্ড তৈরি করা হয়। ওই আমাদের ‘আধার কার্ড’-এর মতই। এই কার্ডের তথ্য ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তিতে যুক্ত করা হয়েছে। ইরানের প্রায় সব সরকারি অফিস, বাস, ট্রেন, রেলস্টেশন এবং পাবলিক প্লেসে ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তি সহ ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। হিজাব ছাড়া কোনো নারীকে দেখা গেলেই তার তথ্য চলে আসে সরকারি প্রতিষ্ঠানে। হিজাবের নিয়ম লঙ্ঘনকারী নারীদের চিহ্নিত করার পর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এর অর্থ ইরানে ইসলাম ধর্মান্ধতা এমন যে নারীদের সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হয়। ফলে সমীক্ষায় জানা যায় শুধুমাত্র সরকারী সংস্থাগুলির ক্যামেরাই সাত বছরের বেশি বয়সী প্রতিটি মহিলাকে অনুসরণ করে৷ এ কি সত্যিই একুশ শতকের সভ্য সমাজ ?
ফলে প্রগতিশীল সচেতন শিক্ষিত মেয়েদের মধ্যে যে এমন অমানবিক রাষ্ট্রীয় ফতোয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দানা পাকিয়ে উঠবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই । বহুদিন ধরেই মহিলাদের একটা অংশ এসব ফতোয়ার বিরুদ্ধে লেখালিখি ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছিলই ।
সেইরকমই একটি সোশাল মিডিয়া প্রতিবাদ হল হ্যাশট্যাগ NO-TO-HIJAB। মজার কথা হিজাবের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদের তারিখটি ছিল ১২ জুলাই - যা ইরানে হিজাব এবং সতীত্বের জাতীয় দিবস উদযাপিত হয় ! এ সময় সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোকে পুরো সপ্তাহে হিজাব প্রচারের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ইরানের স্বাধীনচেতা প্রতিবাদী নারীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এই দিনে তারা হিজাবের বিরোধিতা করবেন। সামাজিক মাধ্যমে ভার্চুয়াল আন্দোলনটি যখন জনসমর্থন পেয়ে যায় তখন নড়েচড়ে বসে প্রশাসন।
এই ঘটনার পর ১৫ আগস্ট হিজাব আইনে নতুন পরিবর্তন আনা হয়।
নতুন নিয়ম অনুযায়ী, কোনো নারী হিজাব ছাড়া ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হবে। সরকারি সুযোগ-সুবিধা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কারাদণ্ড ১০ দিন থেকে ২ মাস পর্যন্ত হতে পারে। ৫০ হাজার থেকে ৫লাখ ইরানি ‘রিয়াল’ পর্যন্ত জরিমানা এবং ৭৪ বেত্রাঘাতের শাস্তিও দেওয়া হবে। অর্থাত মধ্যযুগীয় বর্বরতার নয়া কালা কানুন লাগু হয়। এই ফতোয়ার ফলে হিজাবের প্রতিবাদে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট বা ছবি দেওয়া প্রত্যেক মেয়েকে ইরান পুলিশ শনাক্ত করে, আটক করে ও অকথ্য নির্যাতন চালায়।
এরকমই এক নির্যাতনে প্রতিবাদী তরুণী মাশা আমিনি মারা যান পুলিশি হেফাজতেই।
মাশা আমিনির খুনের পরে প্রতিবাদ আরও জোরদার হয় – হিজাববিরোধী মেয়েরা প্রকাশ্যে চুল কেটে, হিজাব পুড়িয়ে নানাপ্রকারে কণ্ঠ ছাড়ে জোরে, অবশ্যই প্রগতিশীল পুরুষদের পাশে নিয়েই। সেখানে একসময় কেটে ফেলা কুন্তলগুচ্ছ হয়ে ওঠে অনৈতিক ইসলামপন্থী শাসকের আগ্রাসন থেকে নারী মুক্তির পতাকার প্রতীক । সেই ছবি সারা বিশ্বকে তোলপাড় করে।
নানা ধর্মীয় আলোচনায়, পুঁথি গবেষণায় স্বাভাবিকভাবেই এসব নজিরবিহীন বর্বরতাগুলির চিরুনীতল্লাশির দরকার পড়ে। বিশেষত জনতার দরবারে, টক শো’য়ে । এখানেই ধর্মাদেশ নামক পচা পেঁয়াজের খোসা যত খুলে পড়ে তত ছড়িয়ে পড়ে তার বিশ্রী ঝাঁঝ যা কেবল মেয়েদেরই কারণে অকারণে আল্লাহের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে কলের পুতুলের মতো সতী কিম্বা সীতা সাজতে বাধ্য করে।
কোরানে হিজাব ও বোরকার মতো শব্দের সরাসরি কোনো উল্লেখ নেই – একথা প্রমাণের জন্য কোনও মুফতির দরকার নেই, নিজের মাতৃভাষায় কোরান পড়ে দেখলেই বোঝা যায়। আধুনিক ভাষান্তরে কোরানে হিজাব বা বোরকাকে ‘খিমার’ এবং ‘জিবাব’ শব্দের পরিবর্তে বসানো হয়েছে । পাতি শব্দান্তর বা ভাষা প্রতিস্থাপন যাকে বলে । খিমার বা জিবাবের অর্থ এমন এক চাদর যা মাথা এবং মুখ ঢেকে রাখে।
মজার কথা হল, ইসলামের উৎপত্তির আগে আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে হিজাব ও বোরকা পরার প্রথা খুবই জনপ্রিয় ছিল। অর্থাৎ এই পোষাক, ইসলাম দুনিয়াকে দেয়নি। বরং ইসলাম ধর্মের এই পোশাকটি তার সাংস্কৃতিক পরিচয় পেয়েছে আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। সুতরাং সহি মুসলিম মহিলা মাত্রেই পর্দাপ্রথাকে বাধ্যতামূলক মান্যতা দিতে হবে – এই বিধান নিজেই একটি অইসলামিক ফতোয়া। কোনও নির্দিষ্ট স্থানের কালচার যখন ধর্মের আধারে প্রতিষ্ঠা পায় হঠাত করেই – তখন তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ভাবা প্র্যাকটিস করাও দরকার। হিজাব প্রসঙ্গে মুসলিম নারীদের উপর ইসলামিস্টদের বাড়াবাড়ি খবরদারিকে এবার শক্তপোক্ত থাপ্পড় মারার সময় এসেছে।
পোষাক – যখন নারীদেহে ওঠে তখন তা কেবল লজ্জানিবারক হয়ে থাকে না , ঠিক-বেঠিক, শালীন-অশালীন ইত্যাদি নীতিপুলিশির (নাকি নীতি-পুরুষের!) ভরকেন্দ্র হয়ে নারী চরিত্রের শুদ্ধ/ অশুদ্ধের মাপকাঠি হয়ে ওঠে। যুগ পাল্টালেও মেয়েদের উপর খবরদারি করার এই পুরুষালি মাপকাঠিগুলো পালটায় না। তাই আমরা দেখছি যখন বাংলাদেশের লড়াকু মেয়ে খেলোয়াড়রা সাফ গেমসে সোনা জিতে ফিরেছে, তখন নারীদের হাটু বের করা জার্সি পরে ফুটবল খেলা নিয়ে পুরুষদের হাস্যকর ধর্মানুভূতি আহত হচ্ছে। সোশাল মিডিয়ায় সোনার মেয়েদেরকে কুৎসিত ভাষার গালাগালি ছুঁড়ে ‘শান্তির ধর্মে’র অনুগামী আল্লাহবাদী পুরুষরা তৃপ্ত করছে নিজেদের বিকৃতকাম মানসিকতাকে। নাহ, পর্দাবিরোধীদের উপর কোনও আসমানী খোদার গজব নয় বরং পার্থিব দুনিয়ার ভোগবাদী
পুরুষেরই গজব নামছে নারীদের উপর । প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নামক দর্শনকে হাতিয়ার করে প্রতিবার এভাবেই পুরুষেরা খোদার উপর খোদকারি করার লাইসেন্স নিজেদের হাতেই তুলে নেয়, যাকে মিডিয়ার ভাষায় বলে ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া’। আর এভাবেই তারা প্রমাণ করে কোনও আল্লা বা পয়গম্ববর নয় সমস্ত ধর্মীয় কেতাব যা মেয়েদের অবগুণ্ঠিতা অসূর্যস্পশ্যা করে রাখে- আসলে তাদের ‘আপন মনের মাধুরী’ মিশিয়ে রচিত। নইলে যদি কুদৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য বা বাড়তি সওয়াব পেতেই হিজাব-বোরকা সৃষ্টি হত তবে তা পুরুষেরা ব্যবহার করে না কেন, প্রশ্ন করত পুরুষেরাই ।
তবে আজকের এই বিশ্বব্যাপী বোরখা-জেহাদে যখন নারীপুরুষ নির্বিশেষে তরুণতুর্কিরা পথে নামছে, মৌলবাদী প্রভাবিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে হাল না ছেড়ে বরং কণ্ঠ ছাড়ছে জোরে- তখন আশার আলো ফুটে উঠছে বৈ কি ! ইরানে মাশার অনুগামীদের প্রতিবাদে যত বাড়ছে পুলিশি অত্যাচার তত তা উস্কে দিচ্ছে কিশোরদের বিবেক – তারা নয়া আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে নিজেদের লম্বা চুল ছেঁটে, সোশাল মিডিয়ায় আপলোড করে, প্রকাশ্যে মৌলভীর মাথার পাগড়ি হ্যাঁচকা টানে খুলে, সরাসরি ইসলামের ঠুনকো নির্জীব খুঁটিতে আঘাত দিচ্ছে নিজেদের মতো করে।
মত ও পথ তাদের যত ভিন্নই হোক উদ্দেশ্য কিন্তু একটাই – পাশ্চাত্যবিশ্ব তাদের রাজনৈতিক কূটনীতিক মারপ্যাঁচে যতই মৌনব্রত বা ধীরে চলো নীতি বেছে নিক না কেন, আমজনতা কোনও মতেই মধ্যযুগীয় বর্বরতায় বাস করবে না। আগামী প্রজন্মের কাছে এই ‘আলো হাতে চলা আঁধারের যাত্রী’দের নয়া দৌড় নিশ্চিতভাবেই নারী মুক্তি আন্দোলনের আরেকটি পালক হয়ে রইবে।
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment