ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : জন্মদিন উপলক্ষে ফিরে দেখা

  • 25 September, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 384 view(s)
  • লিখেছেন : অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০৩তম জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর প্রতি শুধুমাত্র প্রশস্তিসূচক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। একজন নারীবাদী ইতিহাস-গবেষকের দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর অবস্থার উন্নতির উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগরের উদ্যোগকে আমি এই প্রবন্ধে পুনর্বিচার করতে প্রয়াসী হবো। বুঝতে চেষ্টা করব কিভাবে বিদ্যাসাগর সমকালীন হিন্দু সমাজের নারীর অধস্তনতাকে মোকাবিলা করেছিলেন। মেয়েদের অবস্থার উন্নতির উদ্দেশ্যে তাঁর বিভিন্ন পদক্ষেপকে ফিরে দেখার চেষ্টা করব।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০৩তম জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর প্রতি শুধুমাত্র প্রশস্তিসূচক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। একজন নারীবাদী ইতিহাস-গবেষকের দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর অবস্থার উন্নতির উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগরের উদ্যোগকে আমি এই প্রবন্ধে পুনর্বিচার করতে প্রয়াসী হবো। বুঝতে চেষ্টা করব কিভাবে বিদ্যাসাগর সমকালীন হিন্দু সমাজের নারীর অধস্তনতাকে মোকাবিলা করেছিলেন। মেয়েদের অবস্থার উন্নতির উদ্দেশ্যে তাঁর বিভিন্ন পদক্ষেপকে ফিরে দেখার চেষ্টা করব।

১৮৫৬ সালে পাশ হওয়া হিন্দু বিধবার পুনর্বিবাহ আইন প্রণয়নের পেছনে বিদ্যাসাগর মহাশইয়ের প্রধান উদ্যোগ ছিল। বিদ্যাসাগর ব্রিটিশ সরকারকে এই আইন পাশ করার জন্য চাপ দিয়েছিলেন, বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন এই আইন কতটা প্রয়োজন। প্রধানত বিদ্যাসাগরের আবেদন, নিবেদন এবং কিছুটা চাপের কাছে নতিস্বীকার করেই লর্ড ডালহৌসী এই আইন প্রণয়ন করেন এবং পরবর্তী গভর্নর জেনেরাল লর্ড ক্যানিং এই আইন কার্যকরী করেন। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে সদ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করেন যে তারা ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না, এবং দেওয়ানী, অর্থাৎ বিবাহ, উত্তরধিকার, ভরনপোষণ, দত্তকগ্রহণ প্রভৃতি বিষয়গুলি প্রত্যেকটি সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত আইন অনুসারে পরিচলিত হবে। অর্থাৎ হিন্দুদের এই বিষয়গুলি এই সংক্রান্ত হিন্দু শাস্ত্রীয় অনুশাসন অনুসারে পরিচালিত হবে। তবে মজার কথা হল এই যে হস্তক্ষেপ না করার নীতি গ্রহণ করলেও উনিশ শতকে দেখছি বারবার ব্রিটিশ সরকার মেয়েদের অবস্থার উন্নতি করার উদ্দেশ্যে হিন্দুদের ব্যক্তিগত আইনে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হচ্ছে। এবং এই উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়ন করছে যাকে আইনী পরিভাষায় বলা যেতে পারে statutory law। প্রত্যকটি ক্ষেত্রেই একজন বিশিষ্ট বাঙালি বিদ্বজ্জনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সতীদাহপ্রথা নিবারণ আইনের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়, বিধবার পুনর্বিবাহ আইনের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর। ১৮৫৬ সালে হিন্দু বিধবার পুনর্বিবাহ বৈধ করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার যে আইন পাশ করলেন সে আইন সমস্ত বয়সের হিন্দু বিধবা, সন্তানবতী অথবা সন্তানহীনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হল। তবে এই আইনের বলে বিধবারা পুনর্বিবাহের ন্যায়সঙ্গত অধিকার লাভ করলেও তাদের হারানোরও ছিল অনেক কিছু। প্রথমত, প্রথম স্বামীর সম্পত্তির ওপর আর কোন অধিকার থাকবে না পুনর্বিবাহ করা বিধবার। তার যদি সন্তান থাকে এবং সেই সন্তান যদি নাবালক হয় তাহলে সন্তানের অভিবাবকত্ব তার মৃত স্বামীর আত্মীয়পরিজনদের ওপর বর্তাবে, সন্তানটি যেন অনাথ, এইভাবেই দেখা হবে তাকে। অর্থাৎ দ্বি্তীয়বার বিয়ে করলে একজন হিন্দু বিধবা তার প্রথম স্বামীর সম্পত্তি এমনকি সন্তানও হারাবে। বিদ্যাসাগার বিধবা বিবাহ সম্বন্ধে তার প্রথম ও দ্বিতীয় পুস্তকে এই হারানোর কথা বলেন নি। আইন আরো বলেছে, একজন বিধবা যদি নাবালক হয় অথবা তার স্বামী সহবাস না ঘটে থাকে তাহলে অভিভাবকের সম্মতি ছাড়া সে পুনর্বিবাহ করতে পারবে না। বিদ্যাসাগর বয়স ও স্বামী সহবাসের সঙ্গে বিবাহের সম্মতি দেওয়ার অধিকারকে সংযুক্ত করেননি। সুতরাং বিদ্যাসাগর যে আইনের জন্য ব্রিটিশ সরকারের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তার থেকে ব্রিটিশ প্রণীত আইন অনেকটাই আলাদা ছিল।

 

বিদ্যাসাগর কোন ভাবনা থেকে বিধবাবিবাহ প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন? বিদ্যাসাগর কি নারীমুক্তির উদ্দেশ্যে এই সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন? ওঁর ভাবনার মধ্যে রক্ষণশীলতার উপাদান খুঁজে পেয়েছি আমরা অনেকেই। আমাদের মনে হয়েছে বিদ্যাসাগর পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের ঘেরাটোপের বাইরে যেতে পারেননি। মেয়েরাও মানুষ, মেয়েদের ও মানসিক, শারীরিক চাওয়া আছে, এই মানবতাবাদী বোধ থেকে সম্ভবত বিদ্যাসাগার বিধবাবিবাহ প্রচলনের জন্য আন্দোলন করেননি। তিনি বিধবাদের যৌন চাহিদাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু বিধবাদের যৌনতা তাঁর কাছে ছিল মর্মান্তিক পাপ ও নৈতিক অবক্ষয়ের উৎস। এই নৈতিক অবক্ষয় দূর করার একমাত্র রাস্তা হল বিধবাদের পুনর্বিবাহ, তাদের যৌনকামনাকে বৈধ খাতে প্রবাহিত করা।

 

দ্বিতীয়ত, বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের শাস্ত্রীয়তা প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন এবং পরাশর সংহিতায় বিধবাবিবাহের সমর্থনে নির্দেশ খুঁজে পেয়েছেন। প্রশ্ন জেগেছে, তিনি যদি শাস্ত্রীয় সমর্থন না জোগাড় করতে পারতেন তাহলে কি আইনের জন্য আন্দোলন করতেন না? স্পষ্টভাবে উচ্চারণ না করলেও একথা অনুমান করা বোধ হয় ভুল হবে না যে বিদ্যাসাগর মূলত বালবিধবাদের পুনর্বিবাহ কাম্য মনে করেছেন। বয়স্কা সন্তানবতী বিধবার তাঁর চিন্তার পরিসরের মধ্যে ছিল না।

 

বিদ্যাসাগরের নারীভাবনাকে মূল্যায়ন করতে হলে মনে রাখতে হবে যে যুগটা ছিল টানাপোড়েনের যুগ, দুই পা এগিয়ে, এক পা পেছনোর যুগ। যে কোনো পরিবর্তনশীল সময়ে বিপরীতমুখী পরস্পরবিরোধী ভাবনার সহাবস্থান ঘটে থাকে, একই ব্যক্তির মননের মধ্যেও ভাবনার পরস্পরবিরোধী স্রোত বহমান হওয়াটাই স্বাভাবিক, এই দোলাচল ও স্ববিরোধিতা উনিশ শতকের রেনেঁসাসের প্রত্যেকটি মননশীল ব্যক্তির মধ্যেই লক্ষ করা যায় – রামমোহন রায়, কেশবচন্দ্র সেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ। এমনকি, মহিলারা লেখালেখির মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করলেও তাদের বক্তব্যও স্ববিরোধিতায় দীর্ণ। স্ত্রীশিক্ষা, বিধবাবিবাহ, বাল্যবিবাহ, প্রভৃতি বিষয়ের পক্ষে কখনো বিপক্ষে কথা বলেছে। সুতরাং বিদ্যাসাগরের মধ্যেও পিতৃতান্ত্রিক রক্ষণশীলতা থাকবে তা আর আশ্চর্য কি? তিনি তাঁর সমকালীন মানুষদের মতোই নারীর যৌন-উল্লংঘনের আশংকায় উদ্বিগ্ন থাকতেন এবং ‘ব্যভিচার’ এর ঘটনায় বিচলিত হতেন। বিধবা যে স্বামীর প্রতি অনুগত থাকবে, বৈধব্য এলেও সতীত্ব, পাতিব্রত্য যে নারীর জীবনের মোক্ষ, মূলমন্ত্র, এই কথায় তিনি বিশ্বাস করতেন, তাই এই আদর্শ থেকে বিচ্যুতি তাঁকে পীড়া দিত। বিদ্যাসাগরের পার্থক্য এইখানে, তিনি আক্ষেপ করেই ফুরিয়ে যান নি, সমস্যার সমাধান খুঁজেছেন।

 

বিদ্যাসাগরের যে সমাজের প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধের বিরুদ্ধে খুব বেশি কথা বলতে চাননি, তার প্রমাণ পরবর্তীকালেও পাই। ১৮৭৩ সালে হাইকোর্টে ‘অসতী’ বিধবার বিষয়াধিকার সংক্রান্ত একটি মামলা উঠল। এই মামলার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আসামের এক বিধবা যার নাম কেরি কলিটানী। তাঁর স্বামী গেন্ডেলার মৃত্যুর পর তিনি ব্যভিচারিণী হয়েছেন এই অভিযোগে গেন্ডেলার এক দূরসম্পর্কের ভাই মণিরাম কলিটা কেরিকে তাঁর স্বামীর অধিকার থেকে বিচ্যুত করতে মামলা রুজু করেন। দাবি করেন যে, তিনি নিজেই গেন্ডেলার বিষয়ের একমাত্র ন্যায়সঙ্গত আধিকারী। নিম্ন আদালত থেকে এই মামলাটি কলকাতা হাইকোর্টে উঠলে প্রধান বিচারপতি রিচার্ড কাউচের নেতৃত্বে হাই কোর্টের ফুল বেঞ্চে বিচার শুরু হয়। বাঙালি বিচারক দ্বারকানাথ মিত্র এবং কেম্প ও গ্লোবার নামের দুইজন ব্রিটিশ বিচারক কেরিকে বিষয়াধিকার থেকে বিচ্যুত করার পক্ষে রায় দিলেন, কিন্তু প্রধান বিচারক সহ আরো সাতজন ইংরেজ বিচারক ঘোষণা করলেন যে, হিন্দু আইন অনুসারে কোন বিধবা যদি একবার তার স্বামীর সম্পত্তির অধিকারিণী হয় তবে তাকে তা থেকে অধিকারচ্যুত কখনোই করা যাবে না, ব্যভিচারের অভিযোগ সত্ত্বেও। বলা বাহুল্য, সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের মতামতই বলবৎ হল।

 

‘অসতী মোকদ্দমা’ হিসেবে চিহ্নিত ও বিজ্ঞাপিত এই মামলাটির শুনানি চলাকালীন সেই যুগের বিখ্যাত শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের মতামত গ্রহণ করা হয়েছিল। এঁদের মধ্যে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মহেশচন্দ্র বিদ্যারত্ন, ভারতচন্দ্র শিরোমণি, তারকনাথ তর্কবাচস্পতি, প্রাণনাথ পণ্ডিত প্রমুখ। প্রসঙ্গত মনে রাখা প্রয়োজন, কেরি যে শুধুমাত্র বাঙালি ছিলেন না তা নয়, বর্ণব্যবস্থায় তার অবস্থান সম্ভবত খুব উঁচু ছিল না। একথা স্বীকৃত যে, নিম্নবর্ণের মানুষের ক্ষেত্রে বিবাহ, বৈধব্য, সম্পত্তির অধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলি প্রথাগত আইন অনু্যায়ী পরিচালিত হত। হিন্দু শাস্ত্রীয় বিধি-নির্দেশের সঙ্গে প্রথাগত আইনের বেশ ফারাক ছিল। সাধারণভাবে প্রথাগত আইন অনুসারে একজন নিম্নবর্ণের বিধবা স্বচ্ছন্দে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে পারত। এবং, করলে প্রথম স্বামীর সম্পত্তির অধিকার হারাত না। তাছাড়া, সাধারণভাবে নিম্নবর্ণের মানুষদের মধ্যে বিধবা বা স্বামীপরিত্যক্তা নারীর অন্য পুরুষসংসর্গ সম্বন্ধে বিশেষ ছুৎমার্গ ছিল না। কী ধরনের মূল্যবোধের পরিকাঠামোর মধ্যে কেরি অবস্থান করত তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও, এ-কথা বললে অন্যায় হবে না যে, ‘অসতীত্ব’ সম্বন্ধে এই শোরগোল তার সমাজে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনাই ছিল। আরো বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, বাঙালি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ কেরিকে নিয়ে অভূতপূর্বভাবে চিন্তিত হয়ে উঠলেন। অসুস্থতা হেতু বিদ্যাসাগর স্বয়ং সেই সভায় উপস্থিত থাকতে না পারলেও, ব্যক্তিগতভাবে তিনি এই মতামত ব্যক্ত করেছিলেন যে, যদিও তিনি ব্যভিচারের পক্ষপাতী নন, তবু মনে করেন যে একবার কারো হাতে সম্পত্তি অর্পিত হলে তা কেড়ে নেওয়া উচিৎ নয়। অন্যান্য পণ্ডিতগণ একমত হয়ে ঘোষণা করেন যে, কোন স্ত্রী স্বামী বর্তমানে ব্যভিচারিণী হোক বা তার মৃতুর পরে হোক, স্বামীর বিষয়াধিকার থেকে বিচ্যুতি হল ব্যভিচারের শাস্ত্রনির্দিষ্ট শাস্তি। বক্তব্যের সমর্থনে তাঁরা রঘুনন্দন, কাত্যায়ন, বৃহৎ মনু প্রণীত বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করেন। শেষমেষ অবশ্য বিচারের রায় কেরির অনুকূলে গেছিল।

 

এর পর ১৮৯১ সালে পাশ হল সহবাস সম্মতি আইন। এই আইন সমস্ত সম্প্রদায়ের মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হল। অবিবাহিত, বিবাহিত, সব মেয়েদের ক্ষেত্রে সহবাসের ন্যূনতম বয়স দশ থেকে বাড়িয়ে ১২ করা হল। এই আইনের বিরুদ্ধ বঙ্গদেশে প্রবল এক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছিল। ক্রমশ জোরদার হচ্ছিল হিন্দু পুনরুত্থানবাদী জাতীয়তাবাদ এবং জাতীয়তাবাদে উদবুদ্ধ হয়ে বিদ্বৎসমাজের এক অংশ সোচ্চার হয়েছিল এই অভিযোগে যে এই আইন, হিন্দুধর্ম, পারিবারিক জীবনে ব্রিটিশরা অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ করেছে, বিবাহ, দাম্পত্য, পরিবার এই বিষয়গুলো হিন্দু জাতির সার্বভৌমত্বের পরিসরের অন্তর্ভুক্ত, ব্রিটিশ সরকারের কোনো এক্তিয়ার নেই এগুলোয় হস্তক্ষেপ করা। এই হস্তক্ষেপের ফলে একটি পবিত্র হিন্দু প্রথা - ‘গর্ভদান’ বিপন্ন হবে। বিদ্যাসাগর মহাশয় তখন বৃদ্ধ, সহবাস আইনকে তিনি স্বাগত জানাতে পারছেন না, তিনি মনে করছেন, সহবাসের বয়স নির্দিষ্ট না করে একজন মেয়ের রজস্বলা হবার বয়সটাই হোক তার সহবাস সম্মতির বয়স। তাহলে শাস্ত্রসম্মত গর্ভদান প্রথা অক্ষুণ্ণ থাকে। অল্প বয়সে সহবাস যে মেয়েদের পক্ষে কতটা বিপজ্জনক তা ফুলমণি আর কয়েকটি ঘটনায় প্রমাণিত হয়ে গছে। কিন্তু বিদ্যাসাগর মেয়েদের দৈহিক নিরাপত্তার থেকেও গর্ভদান প্রথাকে বেশি গুরুতপূর্ণ মনে করছেন। তবে সত্যিই কি বিদ্যাসাগর বিশ্বাস করতেন যে শাস্ত্রই শেষ কথা বলে? একথা অস্বীকার করে লাভ নেই যে বিদ্যাসাগর সতীত্ব-অসতীত্ব, পাপ-পুণ্য ধারণা, শুচী নারী-ব্যভিচারিণী - এই সব binary র বাইরে ভাবতে পারেননি, কিন্তু তাঁর সমসাময়িক কতজনই তা পেরেছেন? তবে আবার বলছি, নারীর অবস্থার উন্নতির উদ্দেশ্যে সংস্কারের ক্ষেত্রে বারবার শাস্ত্রীয় সমর্থন খোঁজা সম্ভবত উদ্দেশ্যপূরণের জন্য বিদ্যাসাগরের একটি কৌশল বা strategy হতে পারে।

 

একথা ঠিক যে বিদ্যাসাগর তাঁর সংস্কারপ্রয়াসের মাধ্যমে পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শকে সোচ্চারভাবে সুস্পষ্টভাবে চ্যালেঞ্জ করেননি, কিন্তু তিনি বিভিন্ন কুপ্রথার নিষ্পেষণে পীড়িত মেয়েদের জন্য বাঁচার রাস্তা খুলে দিয়েছিলেন। পুনর্বিবাহ আইন বিধবাদের মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করেছিল। তাছাড়া বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহকে আইনত নিষিদ্ধ করার উদ্যোগকে ব্যঙ্গ করেছিলেন ঠিকই কিন্তু এই প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগরের কথা বলা যে ক্রমশ এই কুপ্রথার করালগ্রাসকে ক্রমশ শিথিল করে তুলছিল সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। স্ত্রীশিক্ষার উদ্দেশ্যে তাঁর উদ্যোগ সম্বন্ধে কিছু বলার নেই। বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠায় বিদ্যাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা ছিল। হুগলী, বর্ধমান, মেদিনীপুর আর নদিয়া জেলার ৩৫টি মেয়েদের স্কুল তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রিটিশ সরকার এই স্কুলগুলিকে আর্থিক সাহায্য দিতে অস্বীকার করলে বিদ্যাসাগর দায় তুলে নেন নিজের কাঁধে। স্কুলগুলিকে আর্থিক সহায়তাদানের উদ্দেশ্যে তিনি নারীশিক্ষা ভাণ্ডার প্রতিষ্ঠা করেন। আর একথা মানতেই হবে যে স্ত্রীশিক্ষা অনিবার্যভাবে মেয়েদের বোধ-চেতনাকে জাগিয়ে তুলেছিল। তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল কর্মজগতে, সক্রিয় রাজনীতির আঙিনায় পা ফেলতে। প্রণোদিত করেছিল পিতৃতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করতে। এইভাবেই বিদ্যাসাগর মেয়েদের অপ্রতিহত অগ্রযাত্রার সরণি নির্মাণ করেছিলেন। জন্মদিন উপলক্ষে তাঁকে কুর্নিশ।

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক 

ছবি : সংগৃহীত 

0 Comments

Post Comment