বেলারুশের লড়াই – এক বাঁশুরিয়ার কাহিনী

  • 01 December, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 251 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
পর্দাতে বড় বড় করে নাম ভেসে উঠেছে, মারিয়া কালেসনিকাভা – ফ্লুটিস্ট, তলায় লেখা বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী, বেলারুশ। মারিয়ার প্রথম পরিচয় তিনি শিল্পী। তিনি একজন বাঁশুরিয়া। জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে স্টেট ইউনিভার্সিটি অব মিউজিক এ্যাণ্ড পারফর্মিং আর্টস থেকে তিনি দু’দুটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রির অধিকারী। বেলারুশ এবং জার্মানিতে একাধিক নামজাদা সঙ্গীত সম্মেলনে তিনি অনুষ্ঠান করেছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। কেউই সঠিক করে জানাতে পারছে না, ঠিক কি কারণে এমন ভাবে মারিয়ার শারীরিক অবনতি ঘটল।

কে বলে নারী অবলা? কেই বা নারীর লড়াইকে ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতায় বেঁধে রাখতে চায়? শহর থেকে গ্রাম, নদী থেকে পাহাড়, দেশ পেরিয়ে মহাদেশের গণ্ডিতে নারীর আন্দোলন ছড়িয়েছে। সেই আন্দোলন মুক্তির আন্দোলন। সেই সব আন্দোলন গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন। সেই সমস্ত আন্দোলনেই আমাদের চোখে পড়ছে মেয়েদেরই সর্বাগ্র উপস্থিতি। ইতিপূর্বে আনা পোলিতকোভস্কায়ার কথা শুনিয়েছি, শুনিয়েছি শ্বেতলানা গানুশকিনার খবর। রাশিয়া পেরিয়ে আজ বেলারুশের কথা শোনাব। বেলারুশ শব্দটির অর্থ হোয়াইট রাশিয়া অথবা শ্বেত-রাশিয়া, তেমন ভাবেই এই দেশটিকে বর্ণনা করা চলে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই দেশ বেলারুশের, সোভিয়েত-ইউক্রেন অঞ্চলে ১৯৮৪ সালে ভয়াবহ চেরনোবিল পরমাণু দুর্ঘটনার কারণে ইউক্রেন ভিন্ন অন্যান্য সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলির তালিকায় প্রথমেই রয়েছে তাদের নাম। এই দুর্ঘটনার ক্ষত সারিয়ে বেলারুশ ক্রমশ স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে। কিন্তু রাজনীতি, সমাজ, গণতন্ত্রের ইতিহাসে ক্রমশই তারা অন্ধকারের সুমুখে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ সেই লড়াইয়েরই বৃত্তান্ত শোনাব।

সামাজিক মাধ্যমে কেবলই যে আকাশকুসুম গল্পেরা ঘুরে বেড়ায়, কেবলই তা সময় নষ্টের উপকরণ – এমনটা নয় মোটেও। এমন সমস্ত সামাজিক মাধ্যমগুলিরই আনাচকানাচ থেকে অনেক সময়ে আমরা জানতে পেরে যাই আনা পোলিতকোভস্কায়া, ভিয়াতলানা শিখানুস্কায়া অথবা ভেরোনিকা ৎসাপকালা’র খবর। চিনতে শিখি এদের লড়াই, জানতে পারি এদের উপাখ্যান। ঠিক তেমনই, গতকাল যখন রাত অনেক – সামাজিক মাধ্যমের পর্দায় খবর ভেসে উঠল বেলারুশিয়ান বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী মারিয়া কালেসনিকাভাকে হঠাৎ করেই জেলবন্দি অবস্থা থেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁর আইনজীবীরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। নির্বাসিত বেলারুশীয় বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দেরাও, কেউ, কোনও ভাবেই মারিয়ার খবর জোগাড়ে অক্ষম। এ্যালেক্সেই নাভালনির কথা মনে পড়ল। রাশিয়ান বিরোধী কণ্ঠ হিসেবে অন্যতম পরিচিত মুখ এই নাভালনি, তিনিও দীর্ঘদিন যাবৎ সাইবেরিয়ার জেলে অন্তরীণ। মাঝে মাঝেই তাঁর স্বাস্থ্যেরও অবনতির খবর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ভেসে ওঠে। ২০২১ সালে এই নাভালনিকেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ভুক্ত সমস্ত দেশ মানবাধিকার রক্ষায় শাখারভ পুরষ্কারে সম্মানিত করে। ২০২২এ এই সম্মান উৎসর্গ করা হয়েছে ইউক্রেনের সংগ্রামী জনগণের উদ্দেশ্যে। এই পুরষ্কারের কথা কেন বললাম, কিছু পরে সে বিষয়ে আলোকপাত করব। আপাতত মারিয়ার কথায় ফিরি।

স্বাভাবিক কৌতূহল-বশত নামটিকে আন্তর্জালের দুনিয়াতে ভাসালাম। প্রথম যে পরিচয়টি ভেসে উঠল, অবাক হয়ে ভাবলাম আমার খোঁজাখুঁজিতে কোনও বিশেষ ভুল হয়ে গেল নাকি। পর্দাতে বড় বড় করে নাম ভেসে উঠেছে, মারিয়া কালেসনিকাভা – ফ্লুটিস্ট, তলায় লেখা বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী, বেলারুশ। মারিয়ার প্রথম পরিচয় তিনি শিল্পী। তিনি একজন বাঁশুরিয়া। জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে স্টেট ইউনিভার্সিটি অব মিউজিক এ্যাণ্ড পারফর্মিং আর্টস থেকে তিনি দু’দুটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রির অধিকারী। বেলারুশ এবং জার্মানিতে একাধিক নামজাদা সঙ্গীত সম্মেলনে তিনি অনুষ্ঠান করেছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। কেউই সঠিক করে জানাতে পারছে না, ঠিক কি কারণে এমন ভাবে মারিয়ার শারীরিক অবনতি ঘটল।

২০২০ সালে বেলারুশীয় একনায়ক এ্যালেকজাণ্ডার লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে যে ত্রিমুখী জোট আন্দোলন দানা বেঁধে ছিল, মারিয়া তারই অন্যতম অংশীদার ছিলেন। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রথমে ভিক্টর বাবারিকা’র রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়নকে সমর্থন করলেও, ক্রমশ ভিক্টর ও তাঁরই সঙ্গে ভিয়াতলানা শিখানুস্কায়া ও ভেরোনিকা ৎসাপকালা’র যে ত্রিমুখী রাজনৈতিক জোট গড়ে ওঠে তারই প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ মুখ হয়ে ওঠেন এই বাঁশুরিয়া। ত্রিমুখী জোটের মূল প্রার্থী হিসেবে ভিয়াতলানা শিখানুস্কায়া’র নাম ঘোষণা হয়। নির্বাচনে ব্যাপক গরমিল, লুঠতরাজ, সন্ত্রাসের পরেও স্রেফ গায়ের জোরে লুকাশেঙ্কো ক্ষমতা দখল করেন। বিশ্বজুড়ে এই ঘটনার কড়া নিন্দা করা হয়। বেলারুশ জুড়ে বিক্ষোভ, গণ-আন্দোলন শুরু হলেও পুলিশি নৃশংসতা ও অত্যাচারের মাধ্যমে সেই আন্দোলনের কন্ঠকে দমিয়ে দেওয়া হয়। দেশ জুড়ে শুরু হয় ধরপাকড়। বলপূর্বক ভিয়াতলানা শিখানুস্কায়া ও ভেরোনিকা ৎসাপকালা’কে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এই মুহূর্তে ভিয়াতলানা শিখানুস্কায়া’র নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত বেলারুশীয় গণতান্ত্রিক বিরোধী সংগঠন (অথবা ডেমোক্র্যাটিক অপোজিশন অব বেলারুশ) পোল্যাণ্ড থেকে তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মারিয়া নিজেও এই সংগঠনেরই কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের সদস্য। মারিয়া, ভিয়াতলানা অথবা নোবেলজয়ী বেলারুশীয় সাহিত্যিক শ্বেতলানা এ্যালেক্সেইভিচের সদস্যপদে সমৃদ্ধ এই সংগঠনকেই ২০২০ সালে মানবাধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ শাখারভ পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়। কিন্তু মারিয়া, অথবা বাঁশুরিয়া কালেসনিকাভার বৃত্তান্ত আরেকটু পালটিয়ে গিয়েছে।

খবরের ধাঁচেই বলে চলি। এই সব ঘটনাকে নিয়ে সাহিত্য অথবা সুললিত ভাষাবিন্যাসেরও কোনও সময় বা প্রবৃত্তিও জেগে উঠতে পারে না। কেবল নারীপুরুষ নির্বিশেষে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার যে লড়াই সেই লড়াইয়ের সম্মুখে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে থাকতে ইচ্ছে হয়। ২০২০ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর বেলারুশীয় সরকারি সংবাদমাধ্যমের তরফে জানানো হয় অজ্ঞাতপরিচয় কিছু মানুষ গায়ের জোরে রাজধানী মিনস্ক শহরে তাঁর বাসভবন থেকেই মারিয়া কালেসনিকাভাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছে। পরে প্রত্যক্ষদর্শী ও অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া খবরে জানা যায় সেদেশের পুলিশ ও গুপ্তচর সংস্থার কর্মীরাই এই অপহরণের পিছনে রয়েছে। গাড়িতে চাপিয়ে মারিয়াকে ইউক্রেন সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁকে বিনা প্রতিবাদে ইউক্রেনে দেশান্তরী হবার আদেশ শোনানো হয়। এমনি ভাবেই ভিয়াতলানা শিখানুস্কায়া ও তাঁর উল্লেখযোগ্য সঙ্গীদেরকেও দেশ থেকে তাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বাঁশুরিয়া মারিয়া গাড়িতে চেপে দুই দেশের সীমান্তের মধ্যবর্তী যে অঞ্চল, অর্থাৎ কি না নো ম্যানস ল্যাণ্ড যে অংশটিকে বলা হয়ে থাকে – সেই অংশ দিয়ে গাড়ি যাওয়ার সময় পিছনের জানালার কাচ ভেঙে মাটিতে লাফিয়ে নেমে পড়েন। মুক্তমনা সেই বাঁশুড়িয়া তখন মুক্ত দেশ ও কাঁটাতার বিচ্ছিন্ন পৃথিবীর কথা মনে রেখেই, একই সঙ্গে নিজের দৃঢ় রাজনৈতিক চেতনার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই, নিজের পাসপোর্টটিকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে আকাশে উড়িয়ে দেন। দেশ ছাড়ার কোনও অবকাশই আর থাকে না তাঁর। তিনি পায়ে হেঁটে বেলারুশ সীমান্তে ফিরে এলে পরে, সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

দীর্ঘ পুলিশি অত্যাচার, বিচারের নামে টানা প্রহসন, এই সবকিছুর পর – ১১ মাসের বিচারপ্রক্রিয়া শেষে ৪ঠা আগস্ট ২০২১, মারিয়াকে ১২ বছরের সশ্রম কারাবাসে দণ্ডিত করা হয়। দীর্ঘ এই বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালীন তাঁর বাবা, বোন অথবা পরিবারের কাউকেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। সূত্রের খবর অনুযায়ী প্রতি মাসে তিনি প্রায় ১৫০টি করে চিঠি লিখলেও, তার মধ্যে মাত্র ২০টি করে চিঠি নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছতে সক্ষম হতো। তাঁর উদ্দেশ্যে যত চিঠি আসত, তার মধ্যে মাত্র ৫% চিঠিকে তাঁর কাছ অবধি পৌঁছতে দেওয়া হতো। বিশ্বখ্যাত এই বাঁশুড়িয়াকে কোনও বই পড়তে দেওয়া হয়নি। তাঁকে বাঁশি ব্যবহারেরও কোনও অনুমতি দেওয়া হয়নি, এই কথা জেনেও যে – তাঁর স্তরের একজন বাঁশুড়িয়া যদি একবছর ধরে রেওয়াজ না করতে পারেন, তাহলে চিরতরে সঙ্গীতের দুনিয়ায় তাঁর ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যেতে পারে। তাঁর হয়ে যে প্রধান আইনজীবী সওয়াল করেছিলেন, এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বেলারুশের আইন অনুযায়ী তাঁর আইন ব্যবসায়ের অধিকারও চিরতরে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। জানা যাচ্ছে যে, মারিয়ার জেলকুঠুরির বাইরে, তাঁর চারপাশে, ইচ্ছে করে ধূমপায়ী এমন সমস্ত ব্যক্তিদেরকেই নজরদার হিসেবে রাখা হয়েছে, যাতে কিনা পরোক্ষ ধূমপানের কারণে তাঁর ফুসফুসের এতটাই ক্ষতি হয় যে, তিনি আর কোনও দিনও বাঁশির মঞ্চে ফিরতে না পারেন।

ইউক্রেন যুদ্ধে আমরা জেনেছি, অধীকৃত খারসন অঞ্চলে রুশ বাহিনীর দ্বারা আয়োজিত এক জলসায় দেশবরেণ্য সঙ্গীত-আয়োজক ইউরি কার্পাটেঙ্কো অনুষ্ঠান করতে না চাওয়ায়, তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ইজিয়াম প্রদেশে যুদ্ধ চলাকালীন শিশুসাহিত্যিক ভোলোদিমির ভাকুলেঙ্কোকেও হত্যা করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। বাঁশুরিয়া মারিয়া কালেসনিকাভাকেও চিরতরে শেষ করে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। গতরাতে শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী হঠাৎ করেই শারীরিক অসুস্থতার কারণে মারিয়াকে জেল থেকে বের করে নিয়ে গিয়ে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়েছে। এ ব্যতীত বাইরের পৃথিবীর কেউই আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না, অথবা তাঁর কোনও খবরও পেয়ে উঠতে পারছেন না। পুতিন অথবা লুকাশেঙ্কোর দাপটে এমন আরও কত শিল্পীকেই যে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার মূল্য চোকাতে হবে আমরা জানি না। কিন্তু এই সমস্ত নীরবে চলে যাওয়া শিল্পী, এই সমস্ত নীরবে লড়াই করে চলা মেয়েদের, মানুষদের লড়াইয়ের যে ইতিহাস, তাকে জনসমক্ষে তুলে ধরার আমাদের যে দায়িত্ব, সেই দায়িত্ব পালনেও যদি আমরা অক্ষম প্রতিপন্ন হই – তাহলে বিরাট এই পৃথিবীতে আমাদের মুখটুকু লোকানোরও জায়গা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে।

আমরা মারিয়া কালেসনিকাভার দ্রুত সুস্থতা কামনা করি।

সূত্রঃ

[১] https://en.wikipedia.org/wiki/Maria_Kalesnikava

[২] https://en.wikipedia.org/wiki/Sviatlana_Tsikhanouskaya

[৩] https://en.wikipedia.org/wiki/Veronika_Tsepkalo

[৪] https://en.wikipedia.org/wiki/Belarusian_opposition

[৫] https://www.euronews.com/2022/11/29/belarus-political-prisoner-maria-kolesnikova-in-intensive-care-opposition

[৬] https://en.wikipedia.org/wiki/Yurii_Kerpatenko

[৭] https://en.wikipedia.org/wiki/Volodymyr_Vakulenko

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment