বিবাহিত নারী (পঞ্চদশ পর্ব)

  • 10 October, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 515 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
বাড়ির কাজ করার মধ্য দিয়েই নারী তাঁর নিজের ‘বাসা’-র সৃষ্টি করেন। এই কারণে, ‘সাহায্যকারী পেলেও’ তিনি নিজের কাজ নিজে করতে আগ্রহী। অন্ততপক্ষে তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ, সমালোচনার মাধ্যমে তিনি চেষ্টা করেন চাকরদের থেকে প্রাপ্ত ফলাফলকে নিজের ফলাফল ভাবতে। গৃহ-প্রশাসন চালানোর মাধ্যমেই নারী তাঁর সামাজিক ন্যায্যতা অর্জন করেন। তাঁর কাজ হল খাদ্য, কাপড়, সাধারণভাবে পারিবারিক কোম্পানির রক্ষণাবেক্ষণ করা। এভাবেই বিবাহিত নারী এই সমস্ত বিষয়কেই কাজ হিসাবে উপলব্ধি করেন।

কিন্তু নিজের মধ্যে একটি ঘর খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রথমেই কাজের মধ্যে নিজেকে উপলব্ধি করতে হবে। বাড়ির অন্দর সম্পর্কে ছেলেরা নিজেদের অভ্যন্তর সম্পর্কে সামান্য আগ্রহী, যেহেতু সমগ্র মহাবিশ্বেই তাঁর প্রবেশাধিকার আছে আর বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্য দিয়ে তিনি নিজের উপস্থিতিকে সুনিশ্চিত করতে পারেন। বিবাহিত সম্প্রদায়ের মধ্যে বন্দি থাকার পরিবর্তে নারীর উচিত এই কারাগারকে তাঁর রাজত্বে রূপান্তরিত করা। বাড়ির প্রতি নারীর মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি এমন এক দ্বান্দ্বিক অবস্থানের দ্বারা পরিচালিত হয় যা সাধারণত তাঁর অবস্থাকে সংজ্ঞায়িত বা নির্ধারণ করে দেয় : নিজেকে শিকারে পরিণত করেই নারী নিজেকে ত্যাগের মাধ্যমে মুক্ত করে তোলেন। পৃথিবীকে প্রত্যাখ্যান করেই তিনি অন্য একটি পৃথিবীকে জয় করে নিতে চান।

এমনটা নয় যে, কোনো আফসোস ছাড়াই নারী তাঁর বাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয়। যুবতী মেয়ের কাছে গোটা পৃথিবীটাই তাঁর রাজত্ব। বন-জঙ্গলও তাঁর অধিকারগত। কিন্তু বর্তমানে, একটি সীমাবদ্ধ স্থানের মধ্যে তিনি বন্দি। ছোটো হতে হতে প্রকৃতি এখন জেরানিয়ামের একটি পাত্রের মতো। দিগন্তকে বাধা দিয়েছে বাড়ির দেওয়াল। ভার্জিনিয়া উলফের এক নায়িকা বিড়বিড় করে বলেন :

শীতকালকে আমি আর গ্রীষ্মকালের থেকে আলাদা করতে পারি না ঘাস বা বিস্তীর্ণ পতিত জমির ওপর গুল্ম দেখে। আলাদা করতে পারি জানলার কাচের ওপর কুয়াশা বা হিম-পড়া দেখে। জে পাখির পড়ন্ত নীল পালক দেখতে দেখতে বিচ বনের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতাম, হাঁটার সময় দেখা হত ভবঘুরে আর রাখালদের সঙ্গে ... আমি এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাই, হাতে থাকে পালকের ঝাড়ু।

তবে, নারীর সবসময়ের প্রচেষ্টা হবে এই সীমাবদ্ধতাকে অস্বীকার করে। নিজের চার দেওয়ালের মধ্যেই কম-বেশি ব্যয়বহুল স্থলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর আকারে তিনি বন্ধ করে রাখেন বিদেশ এবং অতীত যুগকে। স্বামীকেও এই চার দেওয়ালের মধ্যে তিনি তালাবদ্ধ করে রাখেন যে স্বামী তাঁর কাছে মানব সম্প্রদায়ের সংক্ষিপ্তসার। আর তালাবন্ধ করে রাখেন নিজের শিশুকে যে তাঁকে বহনযোগ্য আকারে দেবে সম্পূর্ণ ভবিষ্যৎ। ঘরই তখন হয়ে ওঠে পৃথিবীর কেন্দ্র এবং এমনকি একমাত্র সত্য। এই বিষয়টিই যথাযথভাবে নোট করেছিলেন বাশ্লার, এটি “এক ধরনের প্রতিমুখী-মহাবিশ্ব বা এমন এক মহাবিশ্ব যা প্রতিমুখী”। ঘর পৃথিবীর কেন্দ্র এবং এমনকি তার একমাত্র সত্য হয়ে ওঠে; আশ্রয়, পশ্চাদপসরণ, নকল গুহা, গর্ভ। বাইরের বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে এই ঘর। আর বাড়ি হল এই দিশাহারা বাহ্যিকতা অবাস্তব হয়ে ওঠে।

বিশেষ করে সন্ধ্যায়, যখন দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন নিজেকে রানি মনে করেন মহিলারা। দুপুরের পরিব্যপ্ত সার্বজনীন সূর্যের আলো তাঁকে বিব্রত করে। রাতের বেলা তাঁকে আর শিকড়হীন মনে হয় না, কারণ যা তাঁর নয় তা তিনি বাতিল করে দেন। প্রদীপের ছায়ার নীচে থেকে তিনি একটি আলো দেখতে পান যা তাঁর নিজের এবং যা একমাত্র তাঁর ঘরকেই আলোকিত করে: আর কিছুরই কোনো অস্তিত্ব নেই। ভার্জিনিয়া উলফের একটি লেখা আমাদের দেখায় ঘরের মধ্যে কেন্দ্রীভূত বাস্তবতাকে, যখন নারীর বাইরের পরিসর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

মখমল, রেশম, এবং চীনামাটির বাসন যা দিয়ে তিনি নিজেকে ঘিরে রেখেছেন, তা দিয়ে বিবাহিত নারী আংশিক হলেও তৃপ্ত করতে পারেন তাঁর প্রগাঢ় কামুকতাকে, যা তাঁর বৈবাহিক জীবন সাধারণত তৃপ্ত করতে পারে না। এই সাজসজ্জার মধ্যেই তিনি খুঁজে পান নিজের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ। তিনিই বেছে নিয়েছিলেন, তৈরি করেছিলেন আসবাবপত্র আর ছোটোখাটো গহনা। এই জিনিসগুলিকেই তিনি একটি নান্দনিকতা অনুসারে সাজিয়েছিলেন যেখানে সব কিছু ঠিকঠাক সাজানো হয়েছে কি না এই উদ্বেগ একটি বড়ো জায়গা দখল করে থাকে। এই জিনিসগুলিই সামাজিকভাবে তাঁর জীবনের মান তুলে ধরে তাঁর নিজস্বতাকে তৈরি করে। তাই ঘরই পৃথিবীতে তাঁর নিজের জায়গা, তাঁর সামাজিক মূল্যবোধ এবং তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সত্যের প্রকাশ। যেহেতু তিনি কিছুই করেন না, তাই এই সবের মধ্যেই তিনি খোঁজ করেন যা-কিছু তাঁর নিজস্ব।

বাড়ির কাজ করার মধ্য দিয়েই নারী তাঁর নিজের ‘বাসা’-র সৃষ্টি করেন। এই কারণে, ‘সাহায্যকারী পেলেও’ তিনি নিজের কাজ নিজে করতে আগ্রহী। অন্ততপক্ষে তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ, সমালোচনার মাধ্যমে তিনি চেষ্টা করেন চাকরদের থেকে প্রাপ্ত ফলাফলকে নিজের ফলাফল ভাবতে। গৃহ-প্রশাসন চালানোর মাধ্যমেই নারী তাঁর সামাজিক ন্যায্যতা অর্জন করেন। তাঁর কাজ হল খাদ্য, কাপড়, সাধারণভাবে পারিবারিক কোম্পানির রক্ষণাবেক্ষণ করা। এভাবেই বিবাহিত নারী এই সমস্ত বিষয়কেই কাজ হিসাবে উপলব্ধি করেন।  

গৃহকর্মের কবিতাগুলি আমরা অত্যন্ত প্রশংসা করেছি। এটা সত্য যে, গৃহকর্মই নারীকে গৃহকাজের উপাদানের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে। আর এই সমস্ত উপাদানের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠতা উপলব্ধি করেন। এই ঘনিষ্ঠতাই তাঁর নিজস্ব সত্তাকে প্রকাশ করে। ফলস্বরূপ, তাঁকে সমৃদ্ধ করে। ‘মারির সন্ধানে’ গ্রন্থে মাদলিন বুরদুক্স বর্ণনা করেছেন তাঁর নায়িকার উনুন পরিষ্কার করার জন্য লেই ছড়িয়ে দিয়ে আনন্দ পাওয়ার ঘটনা। আঙুলের গোড়াতেই সেই নায়িকা অনুভব করেন তাঁর মুক্তি এবং শক্তি।

 লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

ছবি : সংগৃহীত 

0 Comments

Post Comment