- 14 January, 2021
- 0 Comment(s)
- 727 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
ফ্রান্স-সম্পর্কে এই জাতীয় কোনো দলিল বিদ্যমান নেই। কিন্তু ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামের বুর্জোয়াদের অবস্থান একইরকম বলে আমরাও তাই ফ্রান্স সম্পর্কে নিঃসন্দেহে তার প্রতিবেশী দেশের মতোই অনুরূপ সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারি। অন্যান্য দেশের তুলনায় ফ্রান্সে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজের সংখ্যা অনেক বেশি এবং বিখ্যাত ‘Green Ribbon Club’ ক্লাব, যা ক্রমসমৃদ্ধ হয়ে চলেছে এবং যাঁর সদস্যরা বিভিন্ন পার্টিতে মিলিত হন পুরুষ ও নারীকে কাছাকাছি আনার উদ্দেশ্যে, বিবাহের বিজ্ঞাপন সেখানেও খবরের কাগজের অনেক লম্বা লম্বা কলাম দখল করে রাখছে।
আমেরিকার মতো ফ্রান্সেও মায়েরা, বাড়ির বড়ো বোনেরা এবং মহিলাদের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনগুলো ছদ্মবেশে যুবতী মেয়েদের শিক্ষা দিয়ে চলে স্বামী-ধরার কলাকৌশল। ফ্লাইপেপার দিয়ে যেমন মাছি ধরা হয়, ঠিক তেমনিভাবেই স্বামী ধরার শিক্ষা দেওয়া হয় যুবতী মেয়েদের। এটাও এক ধরনের ‘মাছ ধরা’ বা ‘শিকার করা’ যার জন্য বেশ দক্ষতার প্রয়োজন। মেয়েদের শিক্ষা দেওয়া হয় তাঁরা যেন লক্ষ্য খুব উঁচু বা নীচু না করেন, রোমান্টিক হওয়ার বদলে তাঁরা যেন বাস্তববাদী হন, বিনয় বা শালীনতার সঙ্গে মিশিয়ে দেন ভালোবাসার ভাণ। তাঁদের চাহিদা যেন খুব বেশি বা খুব কম না হয় ... যুবক ছেলেরা সেই সমস্ত মেয়েকে অবিশ্বাস করেন “যাঁরা বিয়ে করতে চান”। বেলজিয়ামের এক যুবক ঘোষণা করেছিলেন “ছেলেদের কাছে এর চেয়ে বেশি অপ্রীতিকর আর কিছুই হতে পারে না যখন তিনি বুঝতে পারেন তাঁকে ধাওয়া করা হচ্ছে, যখন তিনি বুঝতে পারেন কোনো মহিলা তাঁকে ধরার জন্য হাত বাড়িয়েছে”। ছেলেরা তখন একান্তভাবে নিজেদের নিয়োজিত করেন মহিলাদের পাতা ফাঁদ ব্যর্থ করতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একজন যুবতী মেয়ের পছন্দের পরিসর খুব সীমিত হয় : তাঁর পছন্দ কখনোই স্বাধীন হতে পারে না যদি-না বিবাহ না-করার ব্যাপারে তিনি পুরুষের সমান স্বাধীনতা উপভোগ করেন। সাধারণত, মেয়েদের এই সিদ্ধান্তের পেছনে যতটা-না উৎসাহ থাকে, তার থেকে বেশি থাকে হিসেবনিকেশ, বিতৃষ্ণা এবং সমর্পণ। “যে যুবাপুরুষ মেয়েটিকে বিয়ে করতে চান, তাঁর সঙ্গে মেয়েটির কেরিয়ার, স্বাস্থ্য বা চারপাশ যদি মোটামুটি মিলে যায়, তাহলেই মেয়েটি ভালো না বেসেও ছেলেটিকে মেনে নেয়। অনেক ‘কিন্তু’ থাকা সত্ত্বেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে মেয়েটি ছেলেটিকে স্বীকার করে নেয়।
যদিও মহিলারা বিবাহ করতে চাইলেও একইসঙ্গে তাঁরা কিন্তু বিবাহ ব্যাপারে প্রায়শই শঙ্কিত থাকেন। বিয়ে যেহেতু একজন পুরুষের চেয়ে একজন মহিলার কাছে অনেক বেশি সুবিধার, তাই জন্যই একজন মহিলা বিয়ে করার ব্যাপারে অনেক বেশি লালায়িত থাকেন। অথচ বিবাহ তাঁর কাছ থেকে অনেক বেশি ত্যাগ দাবি করে। বিশেষত অতীতের সঙ্গে অনেক বেশি নিষ্ঠুর চিড় ধরিয়ে দেয়। দেখা যায়, অনেক কিশোরীই বিয়ের জন্য তার বাপের বাড়ি ছাড়ার ব্যাপারে পীড়িত বা যন্ত্রণার্ত থাকে। বিয়ের সময় যত এগিয়ে আসে, উদ্বেগও তত বাড়তে থাকে। ঠিক এই সময়েই মেয়েদের অনেক স্নায়বিক সমস্যার জন্ম হয়। এই সমস্যা সেই সমস্ত যুবক ছেলের মধ্যেও দেখা যায়, যারা তাদের নতুন দায়িত্ব নেওয়ার ব্যাপারে ভীত থাকে। যদিও এই সমস্যা যুবতী মেয়েদের মধ্যে অনেক বেশি পরিব্যাপ্ত। এর কারণ ইতিমধ্যেই আমরা দেখেছি এবং এই সংকট মুহূর্তে সেইসব সমস্যার ভার সবচেয়ে বেশি বেড়ে যায়। স্টেকেল (পুরো নাম Wilhelm Stekel। অস্ট্রিয়ার বাসিন্দা। চিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞান। ফ্রয়েডের অন্যতম বিশিষ্ট অনুবর্তী। ) থেকে ধার করে এই ব্যাপারে আমি একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ভালো বংশের একটি যুবতী মেয়ের চিকিৎসা তাঁকে করতে হয়েছিল। মেয়েটির মধ্যে এইরকম অনেক স্নায়বিক সমস্যার লক্ষণ ছিল।
স্টেকেলের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের সময়েই সে বিবমিষায় ভোগে, প্রত্যেক সন্ধ্যায় মরফিন নেয়, মাঝেমধ্যেই মেজাজ হারায়, স্নান করতে চায় না, খাটে বসে খায়, ঘরেতেই বন্দি হয়ে থাকে। সে তখন বাগ্দত্তা এবং নিশ্চিত করেই জানায় যে, সে তার প্রেমিককে প্রবল ভালোবাসে। স্টেকেলের কাছে স্বীকার করে, প্রেমিকের কাছে সে নিজেকে সঁপে দিয়েছে ... কিছুক্ষণ পরে সে জানায় যে তার জীবনে কোনো আনন্দ নেই : ছেলেটির চুম্বনের স্মৃতি তার মধ্যে ঘৃণার উদ্রেক করে এবং এই স্মৃতিই তার বমির উৎস। পরে বোঝা যায়, ছেলেটির কাছে মেয়েটি নিজেকে সঁপে দেয় মা-কে শাস্তি দেওয়ার জন্য। মেয়েটির অনুমান তার মা তাকে ভালোবাসেন না। ছেলেবেলায় সে তার বাবা-মায়ের ওপর নজরদারি চালাতো যাতে তাঁরা তাকে আর কোনো ভাই বা বোন দিতে না-পারেন। মা-কে সে ভালোই বাসতো। “এখন তাকে বিয়ে করতেই হবে। বিয়ে করলে তাকে বাপের বাড়ি, বাবা-মায়ের শোওয়ার ঘর ছেড়ে যেতেই হবে? এটা অসম্ভব”। নিজেকে সে তাই মোটা করলো, আঁচড় কেটে হাত নষ্ট করলো, নিজেকে বেকুব বানালো, অসুস্থ হয়ে পড়লো। চেষ্টা করলো সকল উপায়ে নিজের প্রেমিককে অসন্তুষ্ট করতে। ডাক্তারের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠলেও সে তার মায়ের কাছে প্রার্থনা করে বিয়ের ব্যাপারটিকে ভেস্তে দিতে। “সে চেয়েছিল সবসময়ের জন্যই নিজের বাড়িতে থাকতে, শিশুসন্তানের মতো থাকতে”। তার মা জেদ ধরেছিলেন যাতে মেয়ে বিয়ে করে। বিয়ের এক সপ্তাহ আগে বিছানায় মৃত অবস্থায় তাকে পাওয়া যায়। রিভলবারের একটি বুলেটেই সে নিজেকে শেষ করে দিয়েছে।
অন্যান্য ক্ষেত্রে মেয়েরা দীর্ঘ সময়ের জন্য অসুস্থ হয়ে পড়ে। তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে যায় কারণ তার অবস্থান তাকে সেই পুরুষের সঙ্গে বিবাহে সম্মতি দেয় না যাকে “সে ভালোবাসে”। সত্যি করে বলতে গেলে, মেয়েটি নিজেকে অসুস্থ করে তোলে যাতে সেই পুরুষটিকে তাকে বিয়ে করতে না হয়, আর একমাত্র সেই এনগেজমেন্ট ভাঙার পরেই মেয়েটি তার স্থিতাবস্থা ফিরে পায়। অনেক সময় মেয়েটির ভয় জেগে ওঠে তার পূর্ব যৌন অভিজ্ঞতার জন্য যা ছেলেটি ধরে ফেলতে পারে, নির্দিষ্ট করে বললে, সে ভয় পায় তার কুমারীত্ব হারানোর বিষয়টি ধরা পড়ে যাবে বলে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাবা, মা, বোন বা বাপের বাড়ির কোনো ব্যক্তির প্রতি গভীর টানই কোনো এক অচেনা পুরুষের কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়ার ধারণাকে অসহনীয় করে তোলে। আর এদের মধ্যে অনেকেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়, কারণ তাদের ওপর চাপ তৈরি করা হয়, তারা জানে যে বিয়েটা হল একটা যুক্তিগ্রাহ্য পথ। স্ত্রী ও মা হিসাবে তারা একটি স্বাভাবিক অস্তিত্ব চায়, কিন্তু মনের গোপনে থাকা রহস্যময়তা এবং বিয়ে করার প্রতি একগুঁয়ে প্রতিরোধী মানসিকতাই তাদের দ্বৈত জীবনের সূচনাকে বাধাগ্রস্ত করে তোলে, এমনকি এটা তাদের সুখী ভারসাম্য পেতেও বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
সাধারণত ভালোবাসার ওপর নির্ভর করে বিবাহের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় না। ফ্রয়েড বলেছেন, “বলতে গেলে, স্বামী কখনোই ভালোবাসার পুরুষের বিকল্পের বেশি কিছু হতে পারে না, এবং কখনোই সেই মানুষটি তো নয়ই”। এই পৃথকীকরণ কিন্তু আকস্মিক নয়। বৈবাহিক প্রতিষ্ঠানের প্রকৃতির মধ্যেই তা নিহিত। পুরুষ ও নারীর অর্থনৈতিক ও যৌন মিলন এই কার্যকে অতিক্রম করে সমূহের স্বার্থের দিকে প্রাগ্রসর হয়। তা তাঁদের ব্যক্তিগত আনন্দকে নিশ্চিত করে না। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে, এখনও কিছু মুসলিম পরিবারে, পিতামাতার সম্মতিতে নির্বাচিত পাত্রপাত্রীরা বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত এক-অপরের মুখ দেখেন না। সামাজিক প্রেক্ষিতকে হিসাবের মধ্যে আনলে সেখানে আজীবন উদ্যোগের কোনো প্রশ্নই আসে না, আছে আবেগপ্রবণতা ও ইরোটিক খেয়ালখুশি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক।
ছবি সৌজন্য : ইন্টারনেট।
0 Comments
Post Comment