কাদম্বিনী, প্রীতিলতা, রোকেয়া ও ‘জাস্টিস ফর অভয়া’

  • 28 October, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 132 view(s)
  • লিখেছেন : অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রত্যেকটি গণআন্দোলন খুঁজে নেয় তার নিজস্ব প্রতিবাদের ভাষা। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে অভয়ার ন্যায়বিচারের দাবিতে চলমান গণআন্দোলন এর ব্যতিক্রম নয়। মিছিলে, ধর্ণায়, জমায়েতে মুখরিত হচ্ছে বিচিত্র সব শ্লোগান। রাস্তার বুকে আঁকা হচ্ছে হরেক রকম ছবি, পোস্টারে, প্ল্যাকার্ডে দেখছি মৌখিক শ্লোগানের প্রতিলিপি। শ্লোগানে, পোস্টারে বিশেষভাবে কয়েকজনের নাম ঘুরে ফিরে আসছে আন্দোলনের শুরু থেকেই --  কাদম্বিনী, রোকেয়া ও প্রীতিলতা।

প্রত্যেকটি গণআন্দোলন খুঁজে নেয় তার নিজস্ব প্রতিবাদের ভাষা। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে অভয়ার ন্যায়বিচারের দাবিতে চলমান গণআন্দোলন এর ব্যতিক্রম নয়। মিছিলে, ধর্ণায়, জমায়েতে মুখরিত হচ্ছে বিচিত্র সব শ্লোগান। রাস্তার বুকে আঁকা হচ্ছে হরেক রকম ছবি, পোস্টারে, প্ল্যাকার্ডে দেখছি মৌখিক শ্লোগানের প্রতিলিপি। শ্লোগানে, পোস্টারে বিশেষভাবে কয়েকজনের নাম ঘুরে ফিরে আসছে আন্দোলনের শুরু থেকেই --  কাদম্বিনী, রোকেয়া ও প্রীতিলতা। এঁদের নাম যে সব শ্লোগানে উচ্চারিত হচ্ছে তার বয়ান মোটামুটি এই রকমঃ কাদম্বিনী/রোকেয়া/প্রীতিলতার এই মাটিতে/বাংলায় ধর্ষকদের ঠাঁই নাই। বোঝাই যাচ্ছে, আন্দোলনকারী নবীন ডাক্তারবৃন্দ এবং সামগ্রিকভাবে নাগরিক সমাজ কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে বাঙালির আদর্শ বা আইকন হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে, সসম্মানে উপাস্থাপিত করছে। স্বাধীনত্তা-উত্তর বাংলায় এর আগে আর কোনও গণআন্দোলনে এঁদের নাম উচ্চারিত হয়েছে কি না জানিনা তবে এটা অনস্বীকার্য যে বাঙালি এঁদের এতদিন ভুলে ছিল। আমরা যারা আশি-নব্বইয়ের দশকে কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস পড়েছি এবং পরবর্তীকালে ইতিহাস পড়িয়েছি, আমাদের পাঠ্যক্রমে একুশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত এঁরা ছিলেন  অনুপস্থিত। অবশ্য ভারতে মানবীবিদ্যা/মানবী ইতিহাসচর্চা শুরু হয়েছে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে কিন্তু তা মূলত গবেষণাপত্রেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। পাঠ্যক্রমের স্তরে সেই গবেষণাজাত জ্ঞানের অন্তর্ভুক্তি ঘটতে সময় লেগেছে আরো অনেকদিন। আজকের ছাত্রছাত্রীরা সামান্য হলেও যে এঁদের কথা জানেন, এঁদের কৃতিত্বের কথা জানেন, কাদম্বিনী, রোকেয়া, প্রীতিলতা -- এই ব্যক্তিত্বত্রয় বর্তমানে যে জনমানসে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, আপসহীন সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছেন সেটা নারীবাদী জ্ঞানচর্চার সাফল্যকেই ইঙ্গিত করে।   

এঁদের প্রত্যেকের প্রতিবাদের ধরন স্বতন্ত্র। কেউ যাপনে, কেউ লেখনীর মাধ্যমে আবার কেউ মৃত্যুমুখী বৈপ্লবিক ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছেন। কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়  (১৮ জুলাই ১৮৬১ – ৩ অক্টোবর ১৯২৩) চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার অদম্য চেষ্টায় প্রতি পদে পদে লিঙ্গবৈষম্য ও লিঙ্গভিত্তিক হেনস্থার শিকার হয়েছেন কিন্তু নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন, রোগীর সেবায় ক্লান্তিহীন ভাবে আত্মনিয়োগ করেছেন। এই আপসহীন সংগ্রামে তাঁর পাশে থেকেছেন তাঁর জীবনসঙ্গী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। কাদম্বিনী মেডিকাল কলেজে প্রবেশাধিকার পাচ্ছিলেন না। বাংলায় ১৮৮৩ পর্যন্ত মেয়েরা ছিল চিকিৎসাবিদ্যার প্রাতিষ্ঠানিক পঠন-পাঠনে ব্রাত্য। কঠিন লড়াই করে ভর্তির সুযোগ পেলেও, চূড়ান্ত পরীক্ষায় তাঁকে একজন বাঙালি শিক্ষক একটি পরীক্ষায় ইচ্ছাকৃতভাবে ফেল করিয়ে দিয়েছিলেন। এমবি ডিগ্রি না পেলেও GCMB ডিগ্রি দেওয়া হয় তাঁকে, এবং পরে স্কটল্যান্ডের এডিনবরো গিয়ে তিনটি  মূল্যবান ডিপ্লোমা অর্জন করে আসেন যার জোরে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই দেশে-বিদেশে দুরন্ত পসার জমিয়ে ফেলেন। শোনা যায়, নেপালের মহারাণী তাঁকে চিকিৎসার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। তবে বাঙালি সমাজের রক্ষণশীল অংশ কি আর অত সহজে রেহাই দেবেন তাঁকে? মাতৃত্ব, গার্হস্থ্য ও কর্মজীবন একসাথে সুষ্ঠুভাবে সামলালেও ক্রমাগত আক্রমণের, হেনস্থার শিকার হতে হয় তাঁকে। তাঁকে ব্যঙ্গ করে বিচিত্র সব প্রহসন লেখা হয়, আঁকা হয় কার্টুন। দুই পত্রিকার সম্পাদক তাঁর চরিত্রহনন করার চেষ্টা করেন, একজনের বিরুদ্ধে দ্বারকানাথ মামলা করেন, আরেকজনের মুখে তিনি নিজের ছাপা কাগজ গুজে দেন। কাদম্বিনী কোনও ডায়েরি বা আত্মকথা রেখে যাননি তাই তাঁর মনের ভেতর কী চলেছিল জানতে পারি না, অনুমান করতে পারি শুধু। লিঙ্গবৈষম্য সম্বন্ধে কাদম্বিনীর কোনও সোচ্চার বক্তব্য না পাওয়া গেলেও দৈনন্দিন যাপনে তিনি লিঙ্গবৈষম্য ও লিঙ্গভিত্তিক হেনস্থার বিরুদ্ধে ক্লান্তিহীন ভাবে লড়াই করে গেছেন।

অন্যদিকে লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে রোকেয়া হোসেনের (৯ ডিসেম্বর ১৮৮০ – ৯ ডিসেম্বর ১৯৩২) লড়াইয়ের অস্ত্র ছিল কলম। একের পর এক প্রবন্ধে সমাজে নারীর অধস্তনতার কারণ অন্বেষণ করেছেন, সমাজ কীভাবে নারীর ওপরে নানাবিধ উপায়ে তার আধিপত্য কায়েম করে তা উন্মোচন করেছেন, অবরোধপ্রথার মর্মান্তিক চিত্র তুলে ধরেছেন। ‘সুলতানার স্বপ্ন’-তে এমন এক কল্পরাজ্যের ছবি এঁকেছেন যেখানে পুরুষের অবস্থান গৃহে এবং নারী জনপরিসরে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করে। এই লেডিল্যান্ডে যুদ্ধ হয় না, আইন শৃংখলা রক্ষার জন্য পুলিশ লাগে না কারণ পুরুষের কারণেই মেয়েদের যত সমস্যা, যত অপরাধ, যত হিংসা।

এবার প্রীতিলতা ওয়াদ্দারের (৫মে ১৯১১ – ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৩২) কথায় আসি। কলকাতার বেথুন কলেজে পড়ার সময় তাঁর বিল্পবী আন্দোলনে দীক্ষা। সূর্য সেনের নেতৃত্বে ভারতীয় প্রজাতান্ত্রিক বাহিনীর একজন একনিষ্ঠ সৈনিক হিসেবে দেশের স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে আত্মবলিদানের জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। ১৯৩২ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর প্রীতিলতার নেতৃত্বে পনেরজন সশস্ত্র বিপ্লবী পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। প্রীতিলতার পরনে ছিল পুরুষের পোষাক। শাসকদের একজনের মৃত্যু হয় এবং কয়েকজন আহত হয়। বিপ্লবীদের অধিকাংশ ধরা পড়ে। প্রীতিলতা পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে নিজের জীবনের ইতি টানেন। এইভাবে তাঁর আত্মবলিদানের স্বপ্ন পূরণ হয়। পুলিশ তাঁর পকেটে একটি চিরকুট খুজে পান। Long Live Revolution নামের প্রীতিলতার মৃত্যু-পূর্ববর্তী বয়ান। এই ঘোষণাপত্রে প্রীতিলতা যে প্রশ্নগুলো তুলেছিলেন তার উত্তর আজও মেলেনি। তিনি লিখেছিলেনঃ

… আমি ভেবে বিস্মিত হই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী পুরুষের মধ্যে পার্থক্য থাকবে কেন? যদি দেশমাতৃকার জন্য ভাইয়েরা ভাবতে পারে এবং লড়াইয়ে সামিল হতে পারে তবে বোনেরা নয় কেন?... স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদানের প্রশ্নে নারীরা পুরুষের তুলনায় দুর্বল, এরকম মনে করা নারীদের প্রতি অবিচার নয় কি?...

যে কোন বিপ্লব বা গণআন্দোলনের ক্ষেত্রে ইতিহাস খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ইতিহাসের পাতা থেকে অনুপ্রেরণা অর্জন করেই নির্মিত হয় বৈপ্লবিক মনস্তত্ত্ব। চলমান ‘জাস্টিস ফর আর জি কর’ আন্দোলনও এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। অনশন, অরন্ধন, মিছিল ধর্না, এই সবই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অহিংস ধারার বিভিন্ন প্রতিবাদের পন্থা। তবে এখনকার আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য বিষয় হল পুরুষ সংগ্রামীদের নাম যত না উচ্চারিত হচ্ছে তার থেকে অনেক বেশি মহিলাদের নাম উঠে আসছে। লিঙ্গভিত্তিক অসাম্যের বিরুদ্ধে কাদম্বিনী, প্রীতিলতা ও রোকেয়াদের এই নিরলস প্রতিবাদ যে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়নি, জনস্মৃতি থেকে মুছে যায়নি, আপামর বাঙালিকে যে আজও উদ্দীপিত করে, প্রতিবাদে পথে নামতে অনুপ্রাণিত করে তার প্রমাণ তাঁদের নামে এই সব শ্লোগান। শুধুমাত্র ডাক্তারদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে নয়, স্বাস্থ্যব্যবস্থার শুদ্ধিকরণ নয়, দুর্নীতির কলুষমুক্ত এক সমাজের দাবি নয়, এ আন্দোলন প্রথম থেকেই লিঙ্গরাজনৈতিক, পিতৃতন্ত্রবিরোধী। এই আন্দোলন নারীর ওপর অবিরাম ঘটে যাওয়া যৌন হিংসার বিরুদ্ধে সোচ্চার এক প্রতিবাদ, আরেকটি অভয়ার যেন অপমৃত্যু না ঘটে তা নিশ্চিত করার প্রয়াস। এই আন্দোলন সমাজ-শুদ্ধিকরণের আন্দোলন এবং পিতৃতন্ত্র সমাজের একটা অন্যতম কঠিন অসুখ। আর এই অসুখ সারানোর জন্য বারবার উচ্চারিত হচ্ছে তাদের নাম যারা পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে আপসহীনভাবে লড়াই করে গেছে দৈনন্দিন যাপনের মাধ্যমে, লেখনীর মাধ্যমে, বিপ্লবের মাধ্যমে। লিঙ্গসাম্যের লক্ষ্যে, হিংসা-দুর্নীতিবিহীন এক সমাজের স্বপ্নকে পূরণ করার উদ্দেশ্যে চলমান এই গণআন্দোলনের অংশগ্রহণকারীদের সম্মিলিত স্বরে ধ্বনিত হচ্ছে তাঁদের নাম। ‘প্রীতিলতা/কাদম্বিনী/রোকেয়ার বাংলায় ধর্ষকদের ঠাঁই নাই’ – এই দৃপ্ত উচ্চারণে মুখরিত হচ্ছে বাংলার আকাশ।

কাদম্বিনী, রোকেয়া, প্রীতিলতার বাংলায় আজও নারী নিগ্রহ ঘটে চলেছে অবিরাম। ধর্ষণ আজও রোজকার ঘটনা। এঁদের লিঙ্গসাম্যের স্বপ্ন আজও অধরা। তবে লড়াই জারি রাখতে হবে। হার মানলে চলবে না। এবং অবশ্যই সংবেদনশীল পুরুষ এবং ভিন্ন যৌনঝোঁকসম্পন্ন সব মানুষকে সাথে নিয়েই এই লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, 

ছবি : সংগৃহীত 

 

0 Comments

Post Comment