- 19 March, 2023
- 0 Comment(s)
- 199 view(s)
- লিখেছেন : মীরা কাজী
— বৌদি! শশাঙ্কদা বাড়িতে আছে?
— না! কোথাও একটা বেরিয়েছে! দেখোনা চা জুড়িয়ে জল হয়ে গেল!
— কখন বেরিয়েছে জানো?
— ভোরবেলায় হবে। ঘুম থেকে উঠে থেকে তো দেখছি না।
— রাতে ঘরে ছিল তো? নাকি তাও—!
— ঘরে থাকবে না তো কোথায় যাবে?
— বলা তো যায় না? যদি আবার?
— তোমার কিছু দরকার থাকে তো বলো না? এলে বলব।
— না। এমনি শুধোলাম। তুমি আর বসে না থেকে চা খেয়ে নাও। আমি পরে আবার আসব।
ললিতা পাড়া সম্পর্কে শশাঙ্কর বোন। ললিতার কথাগুলোর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারে না মাধুরী। এত সকালে সে এলই বা কেন? আবার খুলে বললও না কিছু। যাকগে! অতশত ভাববার সময় নাই তার। হাজারও কাজ পড়ে আছে। পুতুল ওঠার আগে কিছুটা কাজ সেরে রাখতে পারলে ভাল হয়। নাহলে ঘুম থেকে উঠে মেয়েটা বড় ঘ্যান ঘ্যান করে। ললিতা চলে যেতেই সংসারের কাজে হাত লাগায় সে।
— বৌমা! শশাঙ্কর সাথে তোমার কোনো ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে? পুতুল ঘুম থেকে উঠলে তাকে দুধ খাওয়াতে বসেছে মাধুরী। শশাঙ্কর কাকা নরেশ বাড়িতে ঢুকেই তাকে শুধোয়।
— কই না তো? কেন? মাধুরী কাকা শ্বশুরকে দেখে গা-মাথার কাপড় টানতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
খাওয়ায় ব্যাঘাত ঘটায় পুতুল তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করে।
— ঝগড়া টগড়া হয়নি বলছ? তাহলে হতভাগাটা এমন একখানা কাজ করল কি করে?
— কী কাজ? কিছু বুঝতে না পেরে, কাকাশ্বশুরের মুখের দিকে তাকায় মাধুরী।
— বৌটার কথা না হোক, মেয়েটার কথাও ভাবলি না? শশাঙ্করের কাকি সুমতি স্বামীর আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বলে।
— কি হয়েছে? পুতুলের বাপ কি করেছে? অস্ফুটে শুধোয় মাধুরী।
— কী করে বলি? বলতেও যে মুখে বাধছে। সবই আমাদের কপাল! বলতে বলতে নরেশ নিজের কপালে হাত চাপা দিয়ে উঠোনে বসে পড়ে।
মাধুরীর বুক কাঁপতে লাগে। কিছু জিজ্ঞেস করতেও ভরসা হচ্ছে না। যদি এমন কিছু বলে, যাতে তার পায়ের তলাকার মাটি সরে যাবে। সেইসময়টা যত পরে আসে ততই ভালো। কিছু না বলে শোনার জন্য অপেক্ষা করে সে।
— এখন থেকে তোমাকে শক্ত হতে হবে। যা হবার তো হয়েই গেছে। মেয়েটাকে বড় করতে হবে তো? মাথায় হাত চাপা অবস্থাতেই আবার নরেশ বলে।
তাহলে কি সব শেষ? মাধুরী আর পারে না। ডুকরে কেঁদে ওঠে।
— এখন কেঁদে কী করবে? আগে যদি রাশটা টেনে ধরতে তাহলে এমন দিন কি তোমাকে দেখতে হত? সুমতি বেশ ঝাঁঝের সাথে বলে।
— সকালে যখন শুধোতে এলাম, তখন এমন ভাব দেখালে? যেন কিছুই হয়নি! স্বামী যেন তোমার আঁচলে বাঁধা আছে। এর মধ্যে কখন ললিতাও এসে দাঁড়িয়েছে। খরখরিয়ে ওঠে সে।
মাধুরীদের উঠোনে পাড়ার লোকজন একেএকে প্রায় সবাই এসে উপস্থিত হয়েছে। কেউ একজন মাধুরীর কোল থেকে পুতুলকে তুলে নিয়ে ভোলাবার চেষ্টা করে। তাতে অবশ্য উলটো ফল হয়। সে আরো জোরে কাঁদতে শুরু করে।
— লোকের কাছে মুখ দেখাবার জো রইল না? নরেশ মাথা নাড়তে নাড়তে বলে।
— মুখ একেবারে পুড়িয়ে ছাড়ল ছোঁড়া? ছিঃ! ছিঃ! শশাঙ্কর কাকি মাধুরীর কাছে আরো খানিকটা এগিয়ে এসে বলে।
তাহলে পুতুলের বাপ বেঁচে আছে? কিন্তু সে কী এমন কাজ করেছে যাতে পাড়ার লোকের মুখ পুড়েছে? তবে কি সে চুরি করেছে? পুতুলের বাপ চোর? বিশ্বাস করতে মন চায় না মাধুরীর। তার মাথা ঘুরতে শুরু করে। বুকের ভিতরটা কেমন করতে থাকে।
এতগুলো মানুষ সবাই কথা বলতে ব্যস্ত। কার কথা কে শুনছে তা নিয়ে কেউ ভাবছে না। এত কথার মাঝখানে আসল কথাটাকে ছেঁকে বার করতে না পেরে বুকের আঁকুপাঁকু ভাবটা বেড়ে যায় মাধুরীর।
‘নার্গিস’ এই একটা শব্দ, একটা নাম বার বার কানে আসছে মাধুরীর। আজকের দিনে এই নামটা কেন সবার মুখে মুখে ঘুরছে,বুঝে উঠতে পারে না সে। অসহায়ভাবে এর ওর মুখের দিকে তাকায়।
— বুঝতে পারছিস না তো? তাহলে বলি শোন! শশাঙ্ক পালিয়েছে।
— পালিয়েছে? কোথায়?
— ওইটুকু শুনেই ওমনি চোখ কপালে উঠল? আগে সবটা শোন? শশাঙ্ক একা পালায়নি! আলমের বৌ, দুই মেয়ের মা নার্গিসকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়েছে। একজন বয়স্কা মহিলা, মাধুরী যাকে কনক পিসি বলে। মাধুরীকে ঠেলে নড়িয়ে দিয়ে সে বলে।
— তা কি করে হবে? আমাকে কিছুই—!
— তোকে কি বলত লো? ওগো! আমি অমুকের সাথে—! গোটা গাঁ ঢি ঢি পড়ে গেল? আর উনি এখন বলছেন, তা কি করে হবে? মরন হয় না মাগী তোর? ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে কনকলতা।
নিজের কানকেও বুঝি বিশ্বাস করতে পারেনা মাধুরী। পুতুলের বাপ পুতুলকে ফেলে, তাকে ফেলে পালিয়েছে। চোরের মত চুপি চুপি। তাও আবার একা নয়? একজনের বৌকে নিয়ে? সত্যি বলছে এরা? কিন্তু এতগুলো মানুষ সবাই কাজকাম ফেলে, মিথ্যে কথা বলার জন্য এখানে এসে ভিড় করেছে। তাই বা কি করে হয়?
এই সত্যিটা কি করে সইবে মাধুরী? এরচেয়ে এতক্ষণ যেগুলো ভেবে তার হৃদকম্প হচ্ছিল, পায়ের তলার মাটি সরে যাবার ভয় হচ্ছিল, সেগুলো হলেও বুঝি সে সয়ে নিতে পারত। এখন কান্নাও আসছে না তার। লজ্জায় ঘেন্নায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
কিছুক্ষণ পর একে একে সবাই চলে যায় মাধুরীর বাড়ি থেকে। কেবল কনকলতা আরো কিছুক্ষণ থাকে। একসময় সেও চলে যায়। ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে নিয়ে একা বসে থাকে মাধুরী। আজ দুপুরে ভাত রাঁধা নাই। কাপড় কাচা নাই। কেউ কাজ থেকে ফিরে কি খাবে তা জোগাড় করার তাড়া নাই। শুধু আকাশ-পাতাল ভাবা ছাড়া আর কিছু কাজ নাই তার হাতে।
আজ চার বছরের ওপর পুতুলের বাপের ঘরে এসেছে মাধুরী। কাজপাগল মানুষ। কাজ ভিন্ন মুখে অন্য কথা নাই। অন্যের জমিতে রোয়া-পোঁতা, কাটাই-ঝাড়াই এর কাজ করে ফিরতে ফিরতে সেই বিকেল। ফিরেই দুটো মুখে দিয়ে আবার সংসারের উনটিখুনটি কাজ নিয়ে পড়ত। কখনো শুকনো কাঠ চ্যালা করছে? কখনো ছাগলের জন্য ঘাস-পাতা আনছে। কিছু না পেলে তো কোদাল দিয়ে উঠনের ঘাস চেঁচে পরিষ্কার করছে। শোওয়া নাই বসা নাই। কেবল কাজ আর কাজ!
— খানিক জিরোলেও তো পার? পরের জমিতে খেটে এসে আবার এসব না করলেই কি নয়?
— কি করব? হাত-পা কোলে করে বসে থাকব? আর এই কাজগুলো কে করবে শুনি? আমার সুমুন্দী? মাধুরীর কথার উত্তরে গাঁকগাঁক করে বলত পুতুলের বাপ।
— আর কথা বাড়ত না মাধুরী। কত মানুষের কত ধরনের নেশা থাকে— মদ, ভাং। তার চেয়ে আরো খারাপ নেশাও থাকে কারো কারো। পুতুলের বাপের ওই একটাই নেশা— কাজের নেশা। ওই নিয়েই থাকুক। মাধুরীও নিশ্চিন্ত মনে সংসারের কাজে মেতে থাকত। কাজের তো আর কমতি নাই।
বিকেল বেলায় আবার একদফা আলোচনা সভা বসে মাধুরীর উঠোনে
— জানো! আমি একদিন দেখে ফেলেছিলাম! অভয়ের বোন ছায়া ভিড়ের ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়ে বলে।
— কি দেখেছিলি? কি? কি? সবাই উৎসুক্ হয়ে ওঠে। মিইয়ে যাওয়া মজলিসটা আবার যেন প্রাণ ফিরে পায়।
— তখন সাঁজ হব হব। হারু মোড়োলের বাগানে নুয়ে পড়া আমগাছটার একটা ডালে দুজনে বসে পা দোলাচ্ছিল। নার্গিস ভাবী কি একটা বলতে—!
— ওকে আবার ভাবী বলিস কোন আক্কেলে? নচ্ছাড় ছুঁড়ি? সুমতি মুখ ঝামটে ওঠে।
— আগে আগে তো তাই বলেছি? মুখ দিয়ে তো সেটাই বেরুবে নাকি?
— বেশ! তাই হল। এবার বল? সবার যেন তর সয় না। ভয় হয় এই গোলমালে ছায়া যেটি বলতে শুরু করেছে সেটি আবার হারিয়ে না যায়?
— হ্যাঁ, নার্গিস কি একটা বলতেই শশাঙ্কদা হো হো করে হেসে উঠল। আমি গিয়েছিলাম ছাগলের জন্য পাতা ভাঙ্গতে। রইল আমার পাতা ভাঙ্গা! ওদের রকম-সকম দেখে পালিয়ে আসতে পথ পাইনা।
— ওমনি এসে পাড়ার পাঁচ জনাকে বলতে পারলি না? তাহলে একটা বিহিত করা যেত। অন্য জাতের মেয়ের সাথে অমন অনাছিষ্টি কাণ্ডটা হত না।
— তোমরা এখন একথা বলছ? তখন বলতে গেলে উলটে আমার নামেই পাঁচকথা কইতে। জানতে বাকি নাই। ছায়া ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে।
— আমি তো ওই কারণেই বলিনি। মুখে কুলুপ এঁটে ছিলাম। দুলালের ভাইঝি চুমকি এবার ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসে।
— তুই আবার কী বলবি? তা বল না বাপু? হাটে হাঁড়ি যখন ভেঙ্গে গেছে, তখন আর লুকোছাপার কী আছে?
— শুনতে চাইছ, শোনো। মাস দুই আগের কথা। আমি বড়পুকুরে শাঁপলা তুলতে গেছি। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি কারা যেন চান করছে। কাছাকাছি যেতেই দেখি, ওমা গো! এযে শশাঙ্ক মামা! আর তার সাথে আলম মামার বৌ নার্গিস! যে শশাঙ্ক মামা, — বড় হওয়া অবধি আমাদের মুখের পানে চেয়ে কথা বলে না? সে নার্গিসের সাথে জল ছোঁড়াছুঁড়ি খেলছে? সত্যি বলছি বাপু! দেখে আমার ভাল ঠেকেনি, বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠেছিল। তারপর দেখি, নার্গিস একবুক জলে দাঁড়িয়ে আছে। আর শশাঙ্কমামা মাঝপুকুর থেকে তাকে শাঁপলা তুলে তুলে এনে দিচ্ছে। আমাকে দেখতে পেয়ে শশাঙ্ক মামা জল থেকে উঠে এল। নার্গিস তখনো দাঁড়িয়ে থাকল, শাঁপলার রাশ বুকে নিয়ে।
— অনেকদিন থেকে তবে এই সব চলছে?
— একদিনে কি হয়?
— ছোঁড়াটার মাথাটা একেবারে চিবিয়ে খেয়েছে।
এইসব কথা হচ্ছে জোরে জোরে। মাধুরীকে শুনিয়ে শুনিয়ে। ওদিকে কিছু কথা চলছে, মাধুরীর কান বাঁচিয়ে।
— যাই বল বাপু! মাধুরীর নিশ্চয় কিছু দোষ আছে। না হলে শশাঙ্ক ঠাকুরপোর মত মানুষ, এমন কাজ করল কী করে? মন্দ স্বভাবের মানুষ তো সে ছিল না। তাকে আজ থেকে তো দেখছি না।
— একটা কথা বোঝার আছে। ঘরে সুখ থাকলে কি কেউ বারমুখো হয়?
— ওই দেখো না? কাঁদা-কাটা নাই। স্বামীকে গাল পাড়া নাই। কাঠ হয়ে বসে আছে। আমি-তুমি হলে কি হত? ভাব দিকিনি?
— তবে? শুধু ছোঁড়ার দোষ দিলেই হবে?
যত শোনে ততই অবাক হতে থাকে মাধুরী। পুতুলের বাপ হাসছে। তাও আবার হো হো করে? এই পাঁচ বছরে ক’বার হাসতে দেখেছে পুতুলের বাপকে, গুনে বলে দিতে পারে মাধুরী। পুতুল পেটে শাঁপলা ভাজা খাওয়ার শখ হয়ে ছিল মাধুরীর। পুতলের বাপকে সেকথা বলতে সে বলেছিল- “তুমি নিজে গিয়ে তুলে এনো। কত জনাই তো যায়। আমার সময় কোথায়? আমি কাজ ফেলে এখন যাই তোমার জন্য শাঁপলা তুলতে?” তখন কিছু মনে হয়নি। একরাশ শাঁপলা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নার্গিসের মুর্তিটা কল্পনা করে এতদিন পরে, অরুচির মুখে শাঁপলা ভাজা খেতে না পাওয়ার দুঃখটা বুঝি উথলে ওঠে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে তার।
( ২ )
— ওঠ দিকিনি? ওঠ! অমন কাঠ হয়ে বসে থাকিস না? কার কথা ভাবছিস? সে তো অন্যের বৌ নিয়ে ফুর্তি করছে। তোর কথা ভাবতে তার বয়েই গেছে? মাধুরীকে ঠেলা মের ওঠায় কনকলতা। পাড়ার মধ্যে এই একটা মানুষ মাধুরীকে স্নেহ করে। আজ বলে নয় বৌ হয়ে আসার সময় থেকে।
এই দু দিন ধরে কেবল ভেবেই চলেছে মাধুরী। নিজের জন্য নয়। ভাবনা হচ্ছে পাঁচ মাসের মেয়েটার জন্য। এ দুদিনেই মেয়েটা শুকিয়ে আমলতা হয়ে গেছে। মাধুরী আজ দুদিন কিছুটি দাঁতে কাটেনি। তাই মেয়েটাও ঠিক মত দুধ পাচ্ছে না। এদিকে গাভীন ছাগলটা ম্যামাচ্ছে। কনক পিসি দুটো পাতা ভেঙ্গে দিয়ে যাচ্ছে তাই খেয়ে রয়েছে।
কনকপিসি ঠিকই বলছে, তাকে উঠতে হবে। বাইরে বেরোতে হবে। পাঁচজনের চোখে চোখ রাখতে হবে। মাধুরী নিজের ভিতর নিজেকে গুছিয়ে প্রস্তুত করে। পুতুলকে কনকপিসির কাছে রেখে, ছাগলটাকে মাঠে দিগদড়া দেবে বলে বেরিয়েছে মাধুরী। মাঠের ধারে একটা বাড়ি থেকে একটা শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনতে পায় সে। মাধুরী যখন মাঠ থেকে ফিরছে, শিশুটি তখনও কেঁদে চলেছে— হেঁচকি তুলতে তুলতে। বুঝি কাঁদবার শক্তিও আর নাই।
এদিকটায় কখনো আসেনি মাধুরী। পাড়াটা তার অচেনা। আশপাশের বাড়ি থেকে লোকজনের কথাবার্তা, হাঁড়ি-বাসনের ঠুংঠাং আওয়াজ কানে আসছে। বাচ্চাটার কান্না তারা কি শুনতে পাচ্ছে না? কান্না থামাতে কেউ আসছে না! অবাক হয় মাধুরী। ওর মা কো্ন চুলোয় গেছে?
মাধুরী থাকতে না পেরে পায়েপায়ে খোলা দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢোকে। দাওয়ায় একটা চটে বাঁধা দোলনায় পুতুলের বয়সি কিম্বা তার চেয়ে সামান্য ছোটো একটা বাচ্চা হাত ছুঁড়ে কেঁদে চলেছে। চারদিক চেয়ে আর কাউকে দেখতে পায় না। বাচ্চাটিকে দোলনা থেকে তুলে দুলিয়ে দুলিয়ে ভোলাতে চেষ্টা করে সে। মাধুরীর বুকের আশ্রয়ে বাচ্চাটা আরো ছটফট করতে থাকে। সে কী চাইছে, মাধুরীর বুঝতে বাকি থাকে না। প্রথমে সে আড়ষ্ট বোধ করে। বাচ্চাটিকে দোলনায় শুইয়ে চলে যাবার কথা ভাবে। পরক্ষণেই বাচ্চাটার শীর্ণ, অভুক্ত মুখের পানে চেয়ে কী যে হয়ে যায় তার? বাচ্চাটাকে নিয়ে সেখানেই বসে পড়ে সে। কাপড় সরিয়ে শিশুটির মাথা্টা টেনে নেয় নিজের বুকে।
বেশ কিছুক্ষন কেটে গেছে। ভরপেট খেয়ে শিশুটি ঘুমিয়ে কাদা। এমন সময় বছর পঁচেকের একটা মেয়ে সেখানে এসে দাঁড়ায়। ময়লা কাপড়চোপড়। ধুলিধূসর চেহারা। সে বলে— তার নাম সাবি। এই বাচ্চাটা তার বোন। সে কিছুক্ষণ আগেই তাকে বার্লির জল খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে রেখে খেলা করেতে গিয়েছিল। এর মধ্যে বোনের ঘুম ভেঙ্গে গেছে।
— কার কাছে থাকিস?
— আব্বার কাছে। আব্বা কাজে গেছে। বিকেলে ফিরবে।
— মা নাই?
— ছিলতো? কোথায় চলে গেছে। মায়ের কথায় দু চোখ জলে ভরে আসে সাবির। মাধুরীর বুকের ভিতরটাও ধক করে ওঠে।
— কী নাম তোর মায়ের? শুকনো গলায় জিঞ্জেস করে মাধুরী।
— নার্গিস।
— নার্গিস! চমকে ওঠে মাধুরী। ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে দোলায় নামিয়ে রেখে ছটফটিয়ে সেই বাড়িটা থেকে বেরিয়ে আসে সে।
এরপর থেকে সেই রাস্তা দিয়ে আর যায় না মাধুরী। দিন কতক পরে ছাগলটাকে বেঁধে ফেরার সময় তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ যেন তাকে টেনে নিয়ে সাবিদের উঠোনে দাঁড় করায়। সেদিনেও শিশুটি তেমনই কাঁদছে। তবে আজ সে একা নয়। সাবি তাকে ভোলাবার চেষ্ট করছে।
— দ্যাকোনা? কিচুতেই চুপ করচে না! মাধুরীকে দেখে সাবি বলে।
— সর! দেখছি! মাধুরী সাবির কোল থেকে বাচ্চাটাকে তুলে নিজের বুকে জড়িয়ে নিতেই তার কান্না থামে। আজ মাধুরীর মনে কোন অপরাধ বোধ নেই।
সেদিন সন্ধ্যা উতরে গেছে। আগের মত সন্ধ্যা দেওয়া হয় না আর। ভাল লাগেনা। পুতুলকে ঘুম পাড়াতে বসেছে মাধুরী। সাবিকে ঢুকতে দেখে আবাক হয়।
— সাবি? তুই? কি হয়েছে?
— আব্বা এয়েচে। মৃদু হেসে সাবি বলে।
— তোর আব্বা? কোথায়? মাধুরী নিজেকে গুছিয়ে নেয়।
— উই যে! সাবি দরজার দিকে আঙ্গুল বাড়ায়।
— এই যে! আমি! গলা খাঁকারি দিয়ে একজন মাধুরীর উঠোনে এসে দাঁড়ায়।
— তুমি কয়েকদিন ধরে আমার বাড়ি গিয়ে আমার ছোটো মেয়েটাকে দেখাশোনা করছ। কী বলে যে তোমাকে— ! আল্লা তোমার ভাল করবে।
— মেয়েটা কাঁদছিল তাই। এ আর এমন কি? অমন যে কেউ করে।
— ভাই-ভায়াদ, পাড়ার মানুষ সবাই তো ছিল। কেউ যে অমনটা করেনি তা তো তুমি দেখেছ? মেয়ে দুটোকে নিয়ে বিশেষ করে লাবিটাকে নিয়ে কি অকূল পাথারে যে পড়েছি তোমাকে কি আর বলব? আলমের গলাটা ধরা ধরা শোনায়।
মাধুরী মনে মনে ভাবে। অকূল পাথারে পড়া কাকে বলে তাকে আর বোঝানোর দরকার নাই। এই কয়েকটা দিনে হাড়ে হাড়ে বুঝেছে সে।
— এক একবার ভাবি বিষ খাই। কিম্বা গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ি। মেয়ে দুটোর জন্য পারি না। কেউ যদি ওদের ভার নিত, তাহলে যেদিকে দু চোখ যায় চলে যেতাম। এ জীবন আর সইতে পারি না।
— কেউ কারো ভার নেয় না। নিজের ভার নিজেকেই নিতে হয়। তবে কেউ সাথে থাকলে ভারটা টুঁটি টিপে ধরে না। কিছুটা হলেও হাল্কা মনে হয়। এই আর কি?
কথাকটি বলার পর মাধুরীর অবাক লাগে। নিজের মনের কথাকটি এই অচেনা মানুষটাকে কেন বা বলতে গেল সে?
— তা তো হয়। তবে আমার আর তেমন কে আছে? কেমন করে হাবুডুবু খাচ্ছি দেখার মানুষের অভাব নাই। কিন্তু পাশে দাঁড়াবার কেউ নাই। সে যাকগে। যে কথা বলতে আসা। মেয়েটার যা হয় হোক। বাঁচার হলে বাঁচবে না হয় মরবে। তুমি আর যেওনা।
— ভর সন্ধ্যে বেলায় অমন কুকথা বলতে আছে?
— অনেক দু;খে বলছি। শশাঙ্কদা নাই। পাড়ার মানুষ দেখলে তোমার নিন্দে হবে।
— তা যে হবে আমি জানি। তবে নিন্দের ভয় করে কী করব? একজন যে রাত দুপুরে বৌ-মেয়েকে ফেলে চোরের মত পালাল। তাতে তার নিন্দেই কী শুধু হচ্ছে? আমার হচ্ছে না? আমি কী দোষে দোষী আজও বুঝতে পারলাম না। তবে এ ব্যাপারে আমার পাড়ার মানুষরা আমাকে রেহাই দিয়েছে। তারা নিজেরাই আমার দোষ-ঘাট খোঁজার ভার নিয়েছে। অনবরত তারই চর্চা চলছে। তোমারও কী নিন্দে হচ্ছে না ভেবেছ?
— হলে আর কী করব? আমি তো নার্গিসকে কোনদিন কষ্ট দিই নাই। ভাল রাখার চেষ্টাই করেছি। তার অনেক অন্যায় আবদারও মুখ বুজে সহ্য করেছি। তবুও সে কী করে যে এমনটা করল আমার সাথে? একজন পুরুষ মানুষের কাছে এযে কত বড় লজ্জার, অপমানের কী করে বোঝাই? লোকে রসালো ফেঁদে মজা লুটছে। আমার যা হল হল, তোমার সংসারটাও ছারখার হয়ে গেল! এত বড় অন্যায় করে তারা যদি সুখ পায় পাক। আয় সাবি! লাবি এবার উঠে পড়বে। সাবির হাত ধরে চলে যাবার জন্য পেছন ফেরে আলম।
— শোন?
মাধুরীর ডাক শুনে আলম যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।
— ঠিক আছে, তোমার বাড়ি যাব না। তবে আমার একটা কথা রাখতে হবে। মাধুরী বলে।
— কি কথা?
— আমি যখন মাঠে যাব তখন সাবি যেন আমার সাথে দেখা করে। ছাগলটা দুয়ে খানিকটা দুধ দোবো। লাবির জন্য।
— সেটাও কি ঠিক কাজ হবে? তাতেও তো—?
— ওটুকু নিন্দে আমি সইতে পারব।
— আমি বলি কী, তুমি লাবির কথা ছাড়ান দাও। নিজের মেয়েটার কতা ভাব।
— কেন? ছাড়ান দোবো কেন? দুটো মানুষের ফুর্তির মাশুল দেবে ওই দুটো দুধের শিশু? পুতুল, লাবি কারো কথা ছাড়ান দেওয়া যাবে না।
আলম ও সাবি চলে গেছে। আজ অনেক দিন পর হালকা বোধ হচ্ছে মাধুরীর। পুতুলের বাপ চলে যাবার পর থেকে আজ পর্যন্ত তার আত্মীয়স্বজন পাড়াপ্রতিবেশীরা তাকে সান্ত্বনা দেবার ছলে তাকে বারংবার অপমানিত, লাঞ্ছিত করেছে। একমাত্র কনকপিসি কিছুটা আলাদা। তার মনে হয়েছে সে বুঝি ভিন্ন গোত্রের জীব। এ সমাজে মেশার যোগ্যতা সে হারিয়ে ফেলেছে। কয়েক মুহূর্ত আগে সে বুঝেছে, সে একা নয়। অন্য সমান্তরালে আরো একটা জীবন একই দুঃসহয়তায় বয়ে চলেছে। প্রদীপটা খুঁজে বার করে সন্ধ্যে দেবার আয়োজন করে মাধুরী। আগের মত।
ছবি : সংগৃহীত লেখক : গল্পকার
0 Comments
Post Comment