প্রবাসী শ্রমিকদের আর্তনাদ

  • 14 May, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1115 view(s)
  • লিখেছেন : সুকান্ত ঘোষ
এই লকডাউনে দেশের আনচে কানাচে লাখ লাখ শ্রমিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। কাজ নেই, টাকা নেই, খাবার নেই। অনির্দিষ্ট কালের জন্য তাঁদের ঘরে ফেরা আটকে গেছে। সারাক্ষণ একটা বড় জিজ্ঞাসা চিহ্ন তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাঁদের।

‘সে বড়ো সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয়।’  -  শক্তি চট্টোপাধ্যায়

এখন লকডাউন চলছে — কিছু আর্তনাদ আর ঘড়ির শব্দ। সত্যি আজ ‘ওরা’ বড় দুঃখে আছে। আমরা, যাদের মাথার উপর ছাদ আছে, দুবেলা অন্নের সংস্থান আছে, আর সঙ্গে আছে নেটফ্লিক্স —তাঁরা বিলাসিতা করে এখনো বলতে পারছেন ‘বোরড’ লাগছে। হ্যাঁ বোর-ই তো। আনন্দের উপকরণগুলো এই অসময়ে স্থবির, অচল। তাই বলিউড অভিনেত্রী হুমা কুরেশি তাঁর সাক্ষাৎকারে এন ডি টি ভি-কে বলেছেন হোম কোরেন্টাইন এক ধরনের বিলাসিতা। তবে খুব শিগগিরি এই বিলাস ঘুচবে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। সত্যিকারের বিষন্ন আসলে কারা? এই লকডাউনের সময় কারা সুদেআসলে মাশুল দিচ্ছেন? আমরা কতজন, কতবার তাদের কথা ভাবছি?

প্রবাসী শ্রমিকরা এখন সবথেকে বেশি সমস্যায় পড়েছেন। দিনমজুরদের অবস্থা ভয়াবহ। অনেকেই তাঁদের সাহায্য করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তাঁরা কতটা সাহায্য পাচ্ছেন সে তো দেখাই যাচ্ছে। প্রতিদিন একবেলা খাবারের আশায় শ্রমিকরা লাইন দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকছেন, কারো খাবার জুটছে, কারো জুটছে না। দেশের আনচেকানাচে শ্রমিকরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। তাঁরা কেউ ঘরে ফিরতে পারেননি, অনির্দিষ্ট কালের জন্য তাদের ঘরে ফেরা আটকে গেছে। কতজন বাড়ি ফিরতে পারবেন!  সারাক্ষণ একটা বড় জিজ্ঞাসা চিহ্ন তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাঁদের।

সরকার অবিলম্বে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে, কত শ্রমিক যে অনাহারে  কিংবা ঘরে ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে দুই পা, সাইকেলকে অবলম্বন করে রাস্তায় বেঘোরে প্রাণ হারাবেন তার হিসেব নেই। ইতিমধ্যে একাধিক হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটেছে।

দীর্ঘ লকডাউন চললে দুর্ভিক্ষ হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন ইনফোসিসের কর্ণধার নারায়ণমূর্তি। তিনি বলেছেন, ‘‘আমাদের জন্য যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল, এই পরিস্থিতি (লকডাউন) আমরা দীর্ঘ দিন ধরে চালিয়ে যেতে পারব না। কারণ একটা সময় আসবে, যখন করোনায় মৃতের সংখ্যাকে ছাপিয়ে যাবে অনাহার ও অপুষ্টিতে মৃত্যু।"
( তথ্যসূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, ১/০৫/২০২০)

রাজ্য, কেন্দ্র —দুই সরকারই  বারবার আবেদন জানিয়েছিলেন, এই সময় যাতে কোনো শ্রমিক ছাঁটাই না হয়।  তবে সরকারের কথা কতটা শিরোধার্য করেছেন মালিকেরা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে, কারণ ইতিমধ্যে আসানসোলের একটি কারখানা কর্মী ছাঁটাই করেছে। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়তো ভবিষ্যতে দেখা যাবে! 
 
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর সংগে এক ভিডিও কনফারেন্সে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর রঘুরাম রাজন করোনা পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন। সেখানে তিনি পরিষ্কার ভাষায় জানিয়েছেন, করোনার যুদ্ধে লড়তে কেবলমাত্র গরিবদের জন্যই দরকার ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এই প্রসঙ্গে তিনি  আরও জানান, ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে দীর্ঘ সময় ধরে লকডাউন সম্ভব নয়, পরিকল্পনা মাফিক কাজ করতে হবে। ধাপে ধাপে লকডাউন খুলতে হবে। অপরদিকে আমরা দেখছি করোনার মোকাবিলায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এখনো পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা খরচের কথা জানিয়েছেন।

ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO) করোনাকে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষনা করেছে, একথা আমাদের কারো অজানা নয়। তবে কিছু খটকা, সংশয় আমাদের মগজে এসে বারবার ধাক্কা মারে। কেন? সে প্রসংগে আসার আগে একবার আমাদের ফিরে যেতে হবে জানুয়ারি মাসে। WHO  প্রধান ডক্টর তেদ্রোজ আধানম গত ৩০ জানুয়ারি করোনা ভাইরাসকে ‘আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ইমারজেন্সি’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রগুলিকে, কিন্তু কেউ বিষয়টিকে তেমন পাত্তা দেননি। তার ফল আমরা পাচ্ছি। ভারতে ৩০ জানুয়ারি প্রথম কোভিড পজেটিভ পাওয়া যায় কেরালাতে। ভারত সরকার তখন ব্যস্ত ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে। যাই হোক এরপর দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলো। তখন দেশ ঘুমিয়ে, তারপর ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, ২২ মার্চ অর্থাৎ রবিবার সারা দেশ জুড়ে জনতা কার্ফু হবে। সেখানে দেশের উদ্দেশ্যে যে সব স্বাস্থ্য কর্মী, পুলিশ, আরও নানান আপৎকালীন কর্মকাণ্ডে যুক্ত আছেন যাঁরা তাঁদের সম্মান জানানো হবে। তাই সকাল থেকে গৃহবন্দী থেকে বিকেল ৫টায় থালাবাসন, হাততালি বাজিয়ে তাঁদের সম্মান জানানো হল। সারা পৃথিবীতে এক্সপার্টরা ফুল প্রটেকটিভ গিয়ারে এফেক্টেড হয়েছেন। কিন্তু আমাদের এখানে তখন PPE নিয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ডাক্তাররা তখন বাধ্য হয়ে আবেদন জানান যাতে তাদের উপযুক্ত সুরক্ষিত ব্যবস্থা দেওয়া হয়। 

এবার আসা যাক শ্রমিকদের প্রসংগে। তাঁদের কথা কখনো সেভাবে ভাবা হয়নি। হঠাৎ একদিন লকডাউন ঘোষণা করা হল পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া! হাজার হাজার মানুষ আটকে পড়লো। আনন্দবিহার, মুম্বাই-এর ঘটনা দেখে আমরা হতভম্ব হয়ে গেলাম! কী অদ্ভুত ব্যবস্থা, দেশের মানুষকে সরকার সামান্য কীট পতঙ্গ মনে করেন। একাধিক শ্রমিকের মৃত্যু, হেনস্থা,  আমাদের সামনে আসতে থাকলো প্রতিদিন ।

ঘটনাএক
স্থান:দিল্লি
জঠর  জ্বালায় শ্মশান থেকে কলা কুড়িয়ে খাচ্ছ প্রবাসী শ্রমিকরা। দিল্লির নিগমবোধ ঘাটের এই দৃশ্য দেখে আমরা মর্মাহত হয়েছিলাম। কয়েকদিন খাবার জোটেনি। গুরুদ্বারে লংগরখানায়  কিছু খাবার পাওয়া যায় কোনদিন। কোনদিন অনাহারে থাকতে হয়। সেজন্য খাবার সন্ধানে হন্য হয়ে ঘুরতে থাকা কিছু শ্রমিক পৌঁছে যান শ্মশানে। নিয়ম অনুযায়ী শেষকৃত্যর  সময়  মৃতের পরিবারকে কলা নিয়ে যেতে হয়। সৎকারের কলা ব্যবহার করার পর ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়। তিনজন শ্রমিক সেই কলা সংগ্রহ করে খাচ্ছিলেন। কিছু কলা নিজের থলেতে রেখে উত্তরপ্রদেশের এক শ্রমিক বলেন , ''কলা কয়েকদিন ঠিক থাকে তাই কুড়িয়ে নিচ্ছি। খাওয়ার জন্য কিছু তো পাওয়া গেল!''

ঘটনা দুই
স্থান: গুজরাট
পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকরা গুজরাটে এমবয়ড্রারির কাজ করেন। কিছু শ্রমিক জানান লকডাউনের আগের দিন মালিক কিছু টাকা তাঁদের দিয়েছিলেন, সে টাকা তাঁদের শেষ হয়ে যাবার পর, তাঁরা কেবল কলের জল খেয়ে আছেন। বর্ধমানের শ্রমিক রহমান আলি (নাম পরিবর্তিত) জানান, আমাদের খুব দুর্বিষহ অবস্থা, দয়া করে আমাদের কথা ভাবুন।

ঘটনা তিন
স্থান: ব্যাঙ্গালোর
কয়েক হাজার প্রবাসী শ্রমিক এখানে কাজ করেন। তাঁদের অবস্থাও অন্যান্য জায়গার মত শোচনীয়। ব্যাঙ্গালোরের বাসিন্দা মিজ রোজি, পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি জানান, "প্রতিদিন আমাদের কাছে ৮০ থেকে ১০০-রও বেশি ফোন আসছে। সবাই বলছে তাঁদের হাতে পয়সা নেই, খাবার নেই, এমনকি জল কেনারও পয়সা নেই। অনেক জায়গাতেই জল কিনে খেতে হয়।"  (তথ্য সূত্র: বিবিসি বাংলা)

ঘটনা চার
স্থান: ওড়িশা
ওড়িশায় পশ্চিমবঙ্গের অনেক শ্রমিক কাজ করেন। কাপড়ের ব্যবসার সংগে যুক্ত আছেন কিছু শ্রমিক। তাদের বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলায়। অন্যান্য স্থানের মত তাদের অবস্থাও সংকটময় হয়ে উঠেছে। হাতের পয়সা শেষ হয়ে গেছে। কবে ঘরে ফিরতে পারবেন জানেন না! নিজামুদ্দিন কান্ড ঘটার পর ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়ার ফলে এই শ্রমিকদের পুলিশি জেরার সম্মুখীন হতে হয়েছে। 

ভারতে লকডাউনে সবচেয়ে নাজেহাল হয়ে চলেছেন প্রবাসী  শ্রমিকরা। কমপক্ষে চার কোটি প্রবাসী শ্রমিকের জীবন প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বলে মনে করেছেন বিশ্ব ব্যাংক। তাদের রিপোর্টে সে কথায় প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, স্বাভাবিক পরিস্থিতি আসলেও শ্রমিকদের জীবনে স্বাভাবিকতা আসতে ঢের দেরি হবে। এই অদেখা শত্রুর সাথে লড়তে গিয়ে একটা বড় মানবিক সঙ্কট দেখা দেবে বলে মনে করছেন মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স সলিডারিটি নামের একটি সংগঠনের নেতা রাতুল ব্যানার্জী। ( তথ্য সূত্র: বিবিসি বাংলা)

সরকার বারবার আশ্বস্ত করেছেন খাদ্য, আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে সর্বহারাদের, কিন্তু সেই অনুদান সত্যিই কি পাচ্ছেন সবাই? জানুয়ারিতে যখন WHO সাবধান করে দিয়েছিলেন তাহলে সঠিক সময়ে সঠিক ভাবে দেশ কেন সাবধানতা অবলম্বন করেনি? কেন দ্রুত রাজ্যের শ্রমিকদের ঘরে পাঠানো হল না? বিপদের মাঝে কীভাবে সরকার শ্রমিকদের ঠেলে দিল? এত প্রশ্নের সদুত্তর কোথায় গেলে পাওয়া যাবে? দিনদিন সহ্যের সীমা অতিক্রম করছে। লকডাউনের সময় সীমা পুনরায় বৃদ্ধি পেল। শ্রমিকদের অবস্থা আরো ভয়াবহ হবে! অদূর ভবিষ্যতে অসহায়রা সমবেত কন্ঠে গর্জে উঠবে – 
“নহি যন্ত্র নহি যন্ত্র, আমি প্রাণী
 আমি জানি
 হীরক রাজার শয়তানি..( হীরক রাজার দেশে) 

কভার ছবি: ঘরে ফেরার আকুতি নিয়ে হাজার হাজার শ্রমিকের জমায়েত, মুম্বাইয়ে। ছবি: সংগৃহীত

ভিতরের ছবি: দু-পায়েই হাজার মাইল পাড়ি। ছবি: সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment