আন্দোলনের নাম মাহশা আমিনি

  • 02 December, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 203 view(s)
  • লিখেছেন : মীরা কাজী
যারা পর্দা রক্ষার জন্য হিজাব, বোরখার কথা বলেন, তাদের কাছে প্রশ্ন, যে মহিলাটি অন্যের জমিতে মজুর খেটে, কারখানায় কাজ ক’রে, বা গৃহপরিচারিকার  কাজ ক’রে সংসার প্রতিপালন করেন, তিনি কি ভাবে এই পর্দা রক্ষা করবেন? আমাদের মত গ্রীষ্ম প্রধান,আদ্র আবহাওয়ার দেশে বোরখা পরে বা হিজাব দিয়ে মাথা-মুখ ঢেকে পরিশ্রমসাধ্য কাজ করা কি সম্ভব? আর ওই ফুটপাথবাসিনী মহিলাটি, যার পরনে মোটে বস্ত্রই জোটেনা! তার বেলা? সেখানে কি আলাদা নিয়ম?

"মাহশা আমিনি” সাম্প্রতিক বিশ্বে একটি আন্দোলনের নাম। কিশোরী মাহশা । আর পাঁচটা মেয়ের মতই যার হৃদয় জুড়ে ছিল বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা আর দু চোখে অনাবিল স্বপ্ন। আন্দোলন কাকে বলে তার জানা ছিলনা। জানার কথাও নয়। তবু তাকেই একটা আন্দোলনের হোতা হতে হল। স্বপ্ন দেখা তার হলনা। কেবল মাত্র হিজাব আলগা করে পরার অপরাধে পুলিশ তথা রাষ্ট্রের হাতে বলি হতে হল তাকে! এই নৃশংসতার, অমানবিক কার্যকলাপের বিরূদ্ধে ইরান সহ সারা বিশ্ব উত্তাল হয়ে উঠেছে। ইরানের মহিলারা হিজাব পুড়িয়ে, মাথার চুল কেটে মাহশার মৃত্যুর প্রতিবাদ করে চলেছেন। রাষ্ট্রের তরফে কোনো বাধাই তাদের এই প্রতিবাদকে থামিয়ে দিতে পারছেনা। এই প্রতিবাদ ক্রমশ বৃহত্তর আন্দোলনের রূপ পেতে চলেছে। মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে যারা এই আন্দোলনে সামিল হয়েছেন বা হচ্ছেন তাদের কুর্নিশ জানাই।

 


অন্যদিকে আমাদের দেশ ভারতবর্ষের কর্নাটকে কলেজে হিজাব পরে কলেজে ঢুকতে না দেওয়ার প্রতিবাদে মহিলারা রাস্তায় নেমেছেন। কারণ কর্ণাটকে হিজাবকে ইস্যু করে মুসলিম মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়াটাই মূল লক্ষ্য। আবার হিজাব না পরলে পরিবার হয়ত পড়াশোনা করতে স্কুল, কলেজ যাওয়ার অনুমতি দেবে না। নারীর ওপর পিতৃতান্ত্রিক  শাসকদের অত্যাচার দেশভেদে নানা চেহরায় প্রকাশ পায়।  এখন এই দুই পরষ্পর বিরোধী আন্দোলন থেকে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, মুসলিমধর্মে হিজাব বা পর্দার ব্যবহার অবশ্যপালনীয় কি না। এবং সেই সঙ্গে এটাও প্রমাণিত হয়ে যায়, আরও অনেক কিছুর মত পোশাকের স্বাধীনতাও একজন নারীর অধিকারের মধ্যে পড়ে। সেই স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হলে বিরোধ সংঘটিত হয়। স্বাধীনতার খর্বই এই আন্দোলনের মুখ্য বিষয়। হিজাব, বোরখা এখানে গৌণ। একজন মানুষ নারী পুরুষ যেই হোক, সে কি পোশাক পরবে তা একান্ত ভাবে তার ব্যক্তিগত অভিরুচি। তা অন্য কারো পছন্দ নাও হতে পারে। তবে তাতে হস্তক্ষেপ করার, তার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার,বা নির্দিষ্ট কোনো পোশাক পরতে বাধ্য করার অধিকার সমাজ বা রাষ্ট্র কারো থাকা উচিত নয়।

 

 

আজকাল কি গ্রাম কি শহর প্রায় সর্বত্রই রাস্তায়, ট্রেনে, বাসে, হাসপাতালে প্রচুর বোরখা বা হিজাব
পরিহিত মহিলা দেখতে পাই। কিছুদিন আগে যা ছিল প্রায় হাতে গোনা। স্কুল বা কলেজ পড়ুয়াদের মধ্যেও এর চল এসে গেছে। যদি তারা নিজেরা স্বেচ্ছায় নিজেদের আবৃত করে রাখতে চান তাহলে কিছু বলার থাকেনা। কিন্তু যদি কারো দ্বারা প্ররোচিত হয়ে, কিম্বা পরিবারের মাথা বা সমাজের চাপে এরকম পোশাক পরতে বাধ্য হন (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে), তাহলে আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে একজন নারীর কাছে তা যারপর নাই অপমানের, লজ্জার, একই সঙ্গে আতঙ্কেরও। যারা এই ধরনের পর্দার কথা বলেন, তাদের কাছে প্রশ্ন, যে মহিলাটি অন্যের জমিতে মজুর খেটে, কারখানায় কাজ ক’রে, বা অন্যের গৃহপরিচারিকার  কাজ ক’রে সংসার প্রতিপালন করেন, তিনি কি ভাবে এই পর্দা রক্ষা করবেন? আমাদের মত গ্রীষ্ম প্রধান,আদ্র আবহাওয়ার দেশে বোরখা পরে বা হিজাব দিয়ে মাথা-মুখ ঢেকে পরিশ্রমসাধ্য কাজ করা কি সম্ভব? আর ওই ফুটপাথবাসিনী মহিলাটি, যার পরনে মোটে বস্ত্রই জোটেনা! তার বেলা? সেখানে কি আলাদা নিয়ম?

 

 

এবার অনেক গুলোবছর পিছিয়ে যাচ্ছি। বাঙ্গালী মুসলীম পরিবারে আমার জন্ম। আমার মা, চাচি,মামি, দাদি, নানি, সবাইকে শাড়ি পরতেই দেখেছি। আমি যতদূর জানি, বোরখা পরা তো দুরস্থান বোরখা তারা চোখেই দেখেননি। আমরাও ছোটবেলায় বোরখা দেখিনি। হজ করতে গেলে বোরখা পরতে হয়,তখন এটুকুতেই বোরখার ধারনাটি সীমাবদ্ধ ছিল। হিজাব নামক পরিচ্ছদটির কোন অস্তিত্বই সে সময় ছিলনা। আমার মা, দাদি, নানিরা শেষ বয়সে হজে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তাদের বোরখা পরতে হয়েছিল, নিয়ম পালনের কয়েকটি দিনের জন্য। আমার নানি  হজ থেকে ফিরে এলে সেই প্রথম বোরখা নামক পোষাকটিকে স্বচক্ষে দেখেছিলাম। আত্মীয়,পরিজন,পাড়া প্রতিবেশীরা নানির সাথে দেখা করতে এলে বোরখা নামক আজব পোশাকটি নিয়ে আমাদের মত তাদেরও কৌতূহলের সীমা ছিলনা। তারাও এই ধরনের পোশাক আগে দেখেনি। সবার সঙ্গে দেখা সাক্ষাত পর্ব মিটে গেলে, সেই বোরখাগুলো তোরঙ্গ বন্দি হয়ে থেকে গিয়েছিল হজ করার নিদর্শন হিসাবে। বাকি জীবন তারা শাড়িই পরেছেন। বাড়ির বাইরে গেলেও তাই পরতেন। কেবল মাথার ঘোমটা এবং গায়ের আঁচল একটু বাড়িয়ে নিতেন। একজন বাঙালি হিন্দু মহিলার সঙ্গে তাদের পোশাকের কোনও পার্থক্য ছিলনা। এবং সে সময়ে তারা পর্দানশীন বলেই সমাজের কাছে মান্যতা পেয়েছেন। তার জন্য বাড়তি আচ্ছাদন চাপানোর প্রয়োজন তাদের হয়নি। ইদানীং পর্দা নিয়ে এত হই চই দেখে প্রশ্ন জাগে, এটা কি পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কতৃক মুসলিম মেয়েদের অগ্রগতিকে রোধ করার একটা কৌশল? নাকি এর শিকড় আরো গভীরে!

লেখক : ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক

ছবি : সংগৃহীত 
 

0 Comments

Post Comment