- 10 October, 2020
- 0 Comment(s)
- 1499 view(s)
- লিখেছেন : আফরোজা খাতুন
‘ওসব হাদিস কালাম আমার কাছে শোনাতে এসো না। মানুষকে পথের ভিখিরী করতে আল্লা বলে দিয়েছে?’১ বক্তব্যটি শওকত ওসমানের ‘জননী’ (প্রকাশকাল ১৯৫৮) উপন্যাসের দরিয়াবিবির। তবে বর্তমান ভারতের বহু দরিয়াবিবির মুখেও আজ এই প্রশ্ন। কাহিনির দরিয়াবিবি ছিল সংগতিপূর্ণ কৃষক পরিবারের গৃহবধূ। শ্বশুর জীবিত অবস্থাতেই সাপের কামড়ে স্বামীর মৃত্যু হয়। শ্বশুরের সম্পত্তির অংশ থেকে বঞ্চিত হল দরিয়াবিবি ও তার ছেলে মোনাদির। বাচ্চা মোনাদিরকে কিছুটা সম্পত্তি লিখে দেওয়ার আবেদন জানিয়েছিল দরিয়াবিবি। তার উত্তরে স্বামীর অন্য ভাইয়েরা জানিয়ে দিল, ‘কোরান–কেতাবে যা হুকুম আছে, সেই মত কাজ করছি, আমাদের দোষ দাও কেন? বাপের কোলে বেটা মরলে তার ওয়ারিসানদের কোন দাবি দাওয়া থাকে না।’২ তবে থাকা–খাওয়া দিতে আপত্তি করেনি দেওররা। দরিয়াবিবি দেখলো শ্বশুর বাড়িতে সে সস্তার শ্রমিক। কায়িক শ্রম দিলে থাকা নিশ্চিত হবে। শ্বশুর বাড়ির দাসীত্ব ত্যাগ করে বেরিয়ে গেল দরিয়াবিবি। বৈধব্যের সঙ্গে দরিয়াবিবির জীবনে এল দারিদ্র্য, ধর্মভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামোর কারণে।
রোকেয়ার ‘পদ্মরাগ’ (প্রকাশকাল ১৯২৪) উপন্যাসে দেখি কাহিনির নায়ক লতীফের বাবা মারা যান দাদু জীবিত থাকতেই। তাই চাচা হাজী হবীব আলম সব সম্পত্তির মালিকানা পেলেন। লতীফের মা হবীব আলমের স্ত্রীকে তুষ্ট করল দাসীর মতো আচরণ করে। নইলে বাচ্চাদের নিয়ে পথে ভাসতে হবে। চাচা হবীব আলমের আর্থিক সাহায্যে লতীফ উচ্চশিক্ষা লাভ করেছে। চাচার মতানুসারে তার চলা উচিত। অভিভাবকগণের তেমনটাই মত। প্রথম স্ত্রী জয়নব থাকা সত্ত্বেও লতীফ তাই অর্থলোভী চাচার লোভ পূরণ করতে দ্বিতীয়বার বিয়ে করে দাম্পত্য সুখ জলাঞ্জলি দিল।
কাজী ইমদাদুল হকের ‘আব্দুল্লাহ’ (প্রকাশকাল বাংলা ১৩৩৩) উপন্যাসের আবদুল কাদের চাকরিস্থলে মারা যায় স্ত্রী হালিমা ও সন্তানদের রেখে। বাবা তখনও জীবিত। মৃত ছেলের বউ, সন্তানরা শ্বশুর/দাদুর সম্পত্তি পেল না, কিন্তু মৃত ছেলের সম্পত্তিতে তো বাবার অংশ রয়েছে। কাদেরের বাবা তাই তার ভাগের অংশ আদায় করে নিল হালিমার কাছ থেকে। শিশু সন্তানদের নিয়ে আর্থিক নিরাপত্তাহীন জীবনেও এই ধর্মীয় নিয়ম মানতে বাধ্য হালিমা।
উপন্যাসের দরিয়াবিবি, লতীফের মা, হালিমাদের খুঁজে পায় এই একবিংশ শতকের ভারতেও। বাবা বেঁচে থাকাকালীন কোনো সন্তান মারা গেলে সেই মৃতের পরিবার উত্তরাধিকার সম্পত্তির আইনি অধিকার পাচ্ছে না এখনও। তবে পাকিস্তানে ১৯৬১ সালে এই ধর্মীয় আইন সংস্কার করা হয়েছে। জীবিত অবস্থায় যে–পরিমাণ সম্পত্তির ভাগ পেত, মৃত ব্যক্তির (বাবা বেঁচে থাকাকালীন) পরিবার সেই পরিমাণ সম্পত্তিই পাবে—যা এখন বাংলাদেশেও চালু আছে। এখানে দয়ার দানে নয়, আইনি অধিকারে সম্পত্তির মালিক হচ্ছে মৃতের বিধবা স্ত্রী ও সন্তানরা। কিন্তু ভারতে এই আইনের সংস্কার হয়নি বলেই বাঁকুড়ার পারভিনকে (পরিবর্তিত নাম। কারণ তিনি এখনও সন্তানকে কিছুটা সম্পত্তি দেওয়ার অনুরোধ করছেন শ্বশুরকে। তাই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বারবার শ্বশুরের কাছে দান চেয়ে আবেদন করতে হচ্ছে। এক বছরের ছেলে রেখে স্বামী মারা গেল। অবস্থাপন্ন ঘরের গৃহবধূ পারভিনও ভিটেমাটি হারাল। শ্বশুর–শাশুড়ি বলছেন পারভিন অপয়া বলেই তাঁদের ছেলে মারা গিয়েছে। অজুহাত খাড়া করে ছেলে–বউকে ভিটে ছাড়া করেছে পারভিনের শ্বশুর।
স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য হুগলির নার্গিস এখনও অনুতাপ করেন নিজের অবস্থানের দিকে তাকিয়ে। তাঁর বাবা শৈশবেই দাদুকে হারিয়েছেন। তখনও দাদুর বাবা বেঁচে ছিলেন। নার্গিসের বাবা দাদুর এক টুকরো সম্পত্তিও পাননি। বাবা লেখাপড়া শেখার সুযোগ হারিয়েছেন দারিদ্র্যের কারণে। বাবার জীবনের এই বঞ্চনা নার্গিসদেরও বইতে হচ্ছে। দাদুর অন্য ভাইয়ের পরিবারগুলো অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানে নার্গিসদের থেকে অনেকটা উচ্চে। কারণ দাদুর বাবা যথেষ্ট সম্পদশালী ছিলেন। নার্গিসের দাদুর মৃত্যুর কারণে সেই সম্পদ থেকে নার্গিসের দাদুর পরিবার বাদ পড়ে।
ইদ মহম্মদ খুব চিন্তিত নাগরিক পঞ্জিতে নাম তোলা নিয়ে। কারণ ইদ মহম্মদের ছ–বছর বয়সেই বাবা মারা গেছেন। ইদ মহম্মদের দাদু তাঁর নামে কোনো সম্পত্তি লিখে দেননি। বাসস্থানও না। কায়িক শ্রমে পরিবারের খাওয়াটা জুটিয়ে নেন। তাই উত্তরাধিকারের ধারায় তিনি যে এদেশের নাগরিক তা প্রমাণ করবেন কী দিয়ে? আধার কার্ড, ভোটার কার্ড দেখিয়ে হবে না— বলে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কোনো কাগজ লাগবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন অমুসলিমদের। তাহলে উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত মুসলিমদের? এই প্রশ্নই তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে ইদ মহম্মদকে।
মানুষের বাসস্থান, খাওয়া–পরা, পরিচয়কে অনিশ্চিত করাটা কোনো নিয়ম হতে পারে না। মৃত সন্তানের পরিবার মৃতের বাবা–মায়ের দ্বারে দয়ার দান চেয়ে ঘুরবে, এটাও ধর্ম বা মানবিকতা নয়। এই আইনের সংস্কার দরকার। সে জন্যই পাকিস্তান, বাংলাদেশে মৃতের পরিবারের জন্য সম–অধিকার আইন তৈরি হয়েছে। ভারতীয় মুসলিমদেরও ভাবতে হবে। মুসলিমদের পারিবারিক আইন নিয়ে বিজেপি বিভাজনের রাজনীতি করে। একে প্রতিহত করে সম্প্রদায়ের ভেতর থেকেই সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সংখ্যালঘুরা ধর্মকে বেশি করে আঁকড়ে ধরতে চায়। তাঁদের ধর্ম–ভাবনায় আঘাত পড়লে নির্বাচনে প্রভাব পড়বে, এই আশঙ্কায় মুসলিমদের সংস্কার আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক দলগুলি দূরে অবস্থান করে। আসলে সংখ্যালঘুরা সব দেশেই গুরুত্বপূর্ণ ভোটার।
মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে নারী–পুরুষের সম–অধিকার নেই। যে পিতা–মাতার সবগুলিই কন্যা–সন্তান তাকে দুশ্চিন্তায় কাটাতে হয়। কারণ তাঁদের সম্পত্তিতে নিকট আত্মীয়দের ভাগ বর্তায়। মুর্শিদাবাদের শিরিনের মা–বাবা দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারবেন ভেবে দুই মেয়েকে জমি, বাড়ি সব লিখে দিলেন। তারপরই শুরু হল মানসিক পীড়ন। শিরিনের মাসিরা জানালেন— এটা ধর্মবিরোধী কাজ হয়েছে। তাঁদের অবর্তমানে যার যা প্রাপ্য সে তা পেত। অন্যদের হকের জিনিস কেড়ে নেওয়ার বিচার আল্লা করবে। এই হুমকি–ধমকিতে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে শিরিনের মা। একদিকে কন্যা সন্তানদের জন্য সম্পত্তি রক্ষার তাগিদ। সেখানেও আতঙ্ক আছে, নিজেদের জীবনের আর্থিক নিরাপত্তাকেও তো উপেক্ষা করেছে। অন্যদিকে লিখে দেওয়ার জন্য ভাই–বোনদের সঙ্গে মনোমালিন্য। তার সঙ্গে ধর্মভীতি। সন্তান স্নেহে বুঝি বা বড্ড অন্যায় করে ফেললেন! জীবন নিয়ে এই টানাপোড়েনের ছবি শিরিনের মা–বাবার মতো আরও অনেক মুসলিম দম্পতির। কন্যাদের সঙ্গে একটি পুত্র–সন্তান বা শুধুই পুত্র–সন্তান থাকলে এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না। শুধুই কন্যা সন্তানের জনক–জননীদের প্রতি এই অপমান ও অবিচার বন্ধ হওয়া দরকার। মেয়েদের প্রতিও অপমান রুখতে হবে। একটি দাদা বা ভাই ছাড়া কেন মুসলিম মেয়েরা পরিপূর্ণ সন্তানের স্বীকৃতি পাবে না? সামাজিক সমস্যাগুলির নজির টেনেই মুসলিম নারী–পুরুষের উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে সম–অধিকারের দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে এদেশে।
একটি ছেলে পাবে দুই মেয়ের অংশের সমান। অপরদিকে স্বামীর সম্পত্তিতেও স্ত্রীর ভাগে কম অংশ বরাদ্দ। অথচ স্ত্রীর সম্পত্তিতে স্বামীর বরাদ্দ বেশি। ‘তোমাদের স্ত্রী যা রেখে যায় তার অর্ধেক তোমরা পাবে, যদি তাদের একটি সন্তান থাকে তবে তোমরা পাবে তাদের রেখে–যাওয়া সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ, তাদের অসিয়তের দাবি বা ঋণ পরিশোধের পরে। আর তারা পাবে তোমরা যা রেখে যাও তার চার ভাগের এক ভাগ যদি তোমাদের সন্তান না থাকে, কিন্তু যদি একটি সন্তান থাকে তবে যা রেখে যাও আট ভাগের এক ভাগ তারা পাবে, তোমাদের অসিয়তের দাবি বা ঋণ পরিশোধের পরে। (সুরা নিসা)’৩ এই যে স্ত্রী মারা গেলে স্বামী পাবে স্ত্রীর সম্পত্তির অর্ধেক, যদি সন্তান না থাকে। অথচ স্বামী মারা গেলে আর সন্তান না থাকলে স্ত্রী কেন স্বামীর সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ পাবে? এই নির্যাতন, এই অর্থনৈতিক শোষণ বর্তমানে কোন যুক্তিতে টিকে থাকতে পারে? কোনো এক সময় মেয়েদের ঘরে থাকতে বাধ্য করা হত। গার্হস্থ্য শ্রম আর পরিবারের সেবার কাজেই তাদের আটকে রাখত। আজ সে ভাবনার পরিবর্তন ঘটেছে। শিক্ষালয় থেকে কর্মক্ষেত্র—মুসলিম মেয়েদের গতিবিধি বেড়েছে। তারা পরিবারের আর্থিক দায়িত্ব নিতেও শুরু করছে। প্রচলিত নিয়মের বাইরে বেরোনোর বাধা যখন কমেছে, ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরাও একই কাজে যখন অংশ নিতে পারছে, তখন আর নিয়মগুলিও একই হবে না কেন? উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে মুসলিম মেয়েদের বঞ্চনা বন্ধের বিরুদ্ধে তাই সরব হওয়া দরকার। মেয়েকে বাড়তি বা বহিরাগত ভাবনা থেকে মুক্ত হতে হবে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ–ভাবনা হল মেয়েদের বিয়ের জন্য তৈরি করা। বিয়েতে খরচ করে বিদায় দেওয়া। মুসলিম–অমুসলিম সব মেয়েদের ক্ষেত্রেই এই মানসিকতা লালন করা হয়। মুসলিমদের পণ দেওয়া–নেওয়া হারাম (নিষিদ্ধ)। তবু পণ দেওয়া–নেওয়া চলে। আর পণের দাবি পূরণ করতে গিয়ে আর্থিক শোষণও মেয়েদেরই করা হয়। সম্পত্তিতে ছেলেদের ভাগ বেশি ছাড়তে গিয়ে মেয়েদের ভাগে কম পড়ছে। আবার সেই ছেলেদের পণের খাকতি মেটাতে গিয়েই মেয়েদের নিঃস্ব করা হচ্ছে। যাঁরা সম্পত্তিতে মেয়েদের সমান অধিকার আটকান ধর্মের দোহাই পেড়ে, তাঁদের মধ্যে অনেকেই পণ নিয়ে বিয়ে করেন। ধর্ম–অধর্ম বোধটা বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী গড়ে তুলেছে পিতৃতন্ত্র। তাঁদের সুবিধায়, তাঁদের মর্জিতে নিয়ম চলে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মেয়ের আর্থিক স্বনির্ভরতা নেই। তারপর সম্পত্তির ভাগে সমতা নেই। বাড়ির ভাগ দেওয়ার কথা তো বেশিরভাগ মানুষের চিন্তাতেই আসে না। ছেলেরা বাড়ির। মেয়েরা পরের বাড়ির। এই গেঁথে যাওয়া ভাবনা মেয়েদের বহিরাগত করে রাখে। তাই বিয়ে ভেঙে গেলে বা বিধবা হয়ে শ্বশুর বাড়ি হারালে মেয়েদের জীবনের লড়াইটা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তার ওপর যদি সঙ্গে সন্তানরা থাকে। বাবার বাড়ি বা ভাইদের বাড়ি, যেটা একসময় তারও বাড়ি ছিল সেখানে ফেরার পথ বন্ধ হয়ে যায়। তার জন্ম ভিটেয় সে তখন যায় অতিথি হয়ে (ব্যতিক্রম থাকতে পারে। তবে এটাই সমাজের সাধারণ ছবি)। অধিকার নিয়ে নয়। কিন্তু অধিকারটা যে খুব দরকার। আর্থিক নিরাপত্তা দিতে এবং স্ত্রীলিঙ্গীয়জনিত অপমান আটকাতে। মুসলিম উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারী–পুরুষের সমান অধিকারের দাবি তাই আরও সোচ্চার হোক মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেই।
কাজী আবদুল ওদুদ কোরান অনুবাদের সুরা আন্–নিসা মুখবন্ধে লেখেন—‘ওহোদের যুদ্ধে ৭০০ মুসলমান যোদ্ধার মধ্যে ৭০ জন নিহত হয়। এর ফলে নারী আর অভিভাবকহীন ছেলে–মেয়ে একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। এই সুরায় বিবাহের বিধি–নিষেধ সম্বন্ধে আর নারীদের ও অনাথদের সম্পত্তির অধিকার সম্বন্ধে অনেক কথা আছে।’৪ সামাজিক প্রেক্ষাপটেই আইন তৈরি হয়েছে সেটা স্পষ্ট। ইসলাম ধর্ম প্রথম উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার ঘোষণা করেছে এটাও ঠিক। বাস্তবের বড়ো সমস্যা থেকেই মেয়েদের নিরাপত্তার কারণে অধিকার তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেই লিঙ্গবৈষম্যের আইনকে পরিবর্তন করা যাবে না এমনটা নয়। ইসলামি আইনের উৎস হচ্ছে কোরান, হাদিস, ইজমা, কিয়াস ও উরফ্। হজরত মহম্মদ যা করেছেন এবং বলেছেন সেটাই হল হাদিস। আইনতত্ত্বের মূল নীতির প্রণেতা আবু হানিফার চেষ্টায় ‘কিয়াস’ গৃহীত হয় মুসলিম আইনতত্ত্বের গ্রহণযোগ্য উৎসরূপে। ‘এই নীতির মূল কথা হইতেছে বাস্তবতার সহিত আইনের সূত্রকে খাপ খাওয়াইয়া লওয়া।’৫ ঐকমত্যকে বলে ইজমা। হজরত মহম্মদের সাহাবাগণ কোনো বিষয়ে একমত হলে সেটাই প্রামাণিক আইন বলে গ্রহণ করা হত। এইভাবে সাহাবাদের অনুসারীদের গৃহীত ইজমা বা একমত প্রামাণিক আইন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ইসলামি আইনতত্ত্ববিদ আবু হানিফার মতে—‘যে কোন কালে পূর্বতন ইজমার অনুরূপ কোন সমস্যার উদ্ভব হলে পরবর্তী যুগেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাইতে পারে।’৬ স্থানীয় রীতিনীতি হল উরফ্। আইনে উরফ্–এর অবদানকেও আবু হানিফা স্বীকৃতি দিয়েছেন। ফলে ইসলামি আইনের মধ্যেই রয়েছে সংস্কারের ধারা। সেই ধারা বহমান ভারতের বাইরে বহু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে। সেসব দেশে তালাক, নিকাহ্ হালালা, বহু বিবাহ, সম্পত্তি ভাগের বিষয়গুলি প্রয়োজনমত কিছুটা সংস্কার হয়েছে। কিন্তু কোনো সংস্কার হয়নি কেবল গণতান্ত্রিক ভারতে। মুসলিম মৌলবাদ বিরোধিতা করছে এই অজুহাতে সংস্কার প্রক্রিয়া আটকিয়ে যায় মূলত এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে। নির্বাচনকে প্রাধান্য দিয়ে ভোটের হিসেব করেই রাজনৈতিক দলগুলো পক্ষ নেয়। কারণ মৌলবাদকে রুষ্ট করে যুক্তিবাদী, নিরপেক্ষ হতে গেলে যে ভোটে টান পড়তে পারে।
সামাজিক–অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনে। সচেতন মানুষের যুক্তির দাবিতে আইন তৈরি হয়, আইনের সংস্কার হয়। হিন্দু মেয়েরা এখনও পুড়ে মরত হিন্দুত্ববাদীদের অত্যাচারে যদি লড়াই করে রামমোহন সতীদাহপ্রথা রোধ আইন না করাতেন। হিন্দু বিধবার আবার বিয়ে! হিন্দু সমাজ একসময় ভাবতে পারত না। হিন্দু মেয়েরা সম্পত্তির ভাগীদার হবে? রক্ষণশীলরা বিরোধিতা করেছে। সব প্রতিবন্ধকতা প্রতিরোধ করেই এ দেশের হিন্দু মেয়েদের অধিকারের জন্য হিন্দু ধর্ম সংস্কার করে আইন তৈরি হয়েছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও মুসলিম মেয়েদের কথা ভেবেই পারিবারিক আইনের সংস্কার হয়েছে। এদেশের মুসলিমদেরও কথাটা ভেবে দেখা দরকার।
সব ধর্মীয় আইন কি পালন করে মুসলিমরা? সুরা নিসা–তেই আছে ‘আর সম্পত্তি ভাগের সময়ে যখন উপস্থিত থাকে আত্মীয়রা আর অনাথরা আর গরীবরা তখন তা থেকে তাদের (কিছু) দাও, আর তাদের সঙ্গে ভালো কথা বলো।’৭ আমাদের চারপাশে অনাথ, গরীবের সংখ্যা তো কম নয়। সম্পত্তি ভাগের সময় তাঁরা উপস্থিত থেকে কিছু পেয়েছেন বা উপস্থিত থাকলে অবশ্যই কিছু পাবেন এমন আশ্বাস কেউ দিতে পারবেন কি? এই ভাগ জাকাত বা ফিতরা (দুই ইদে দরিদ্রদের দান করা) দিয়ে তো পূরণ হবে না।
নাগরিকপঞ্জি আর সংশোধিত নাগরিক আইনের বিরুদ্ধে একটা গান চারিদিকে খুব শোনা যাচ্ছে—‘আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু’। মেয়েদের সম–অধিকারের দাবি, সেটাও মানুষের দাবি। মানুষের ধর্ম হল সব বৈষম্য দূর করা। সে সম্প্রদায়ভেদে বৈষম্য হোক বা নারী–পুরুষ ভেদে বৈষম্য হোক। মুসলিম নারী পুরুষের সম–অধিকার, সম–সম্পত্তির দাবিও মানুষের ধর্ম প্রতিষ্ঠার দাবি। লিঙ্গসাম্যের প্রয়োজনে, মানুষের ধর্ম প্রতিষ্ঠা করার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়, এই আশা রাখি।
লিঙ্গভেদে আর্থিক বৈষম্য টিকিয়ে রাখা উন্নতকামী সমাজের চাহিদা হতে পারে না। উন্নয়নের সঙ্গেই যুক্ত নারী–পুরুষের সামাজিক–আর্থিক সম–অধিকার।
তথ্যসূত্র:
১। শওকত ওসমান : জননী, স্টুডেন্ট ওয়েজ বাংলাবাজার, ঢাকা, তৃতীয় সংস্করণ, ১৩৯৬, পৃ ৪৪মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান :
২। শওকত ওসমান, পূর্বোক্ত, পৃ ৪৪
৩। কাজী আবদুল ওদুদ : পবিত্র কোরআ্ন (প্রথম ভাগ), কাজী আবদুল ওদুদ রচনাবলী, ষষ্ঠ খণ্ড, বাংলা একাডেমী ঢাকা, ১৯৯৫, পৃ ২৪১
৪। কোরানসূত্র, বাংলা একাডেমি ঢাকা, তৃতীয় সংস্করণ, ২০০৩, পৃ ১৫২
৫। গাজী শামছুর রহমান : স্যার আবদুর রহিম-ইসলামী আইনতত্ত্ব, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ১৯৮০, পৃ ২৭
৬। গাজী শামছুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃ ২৭
৭। কাজী আবদুল ওদুদ, পূর্বোক্ত, পৃ ২৪২
ছবি : সংগৃহীত
লেখক : অধ্যাপক ও সমাজকর্মী
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ১৪ মে, ২০২০
সৌজন্য 'সিউ পত্রিকা', ডিসেম্বর, ২০১৯
0 Comments
Post Comment