- 03 April, 2023
- 0 Comment(s)
- 1223 view(s)
- লিখেছেন : আফরোজা খাতুন
১৯২৩ সাল। প্রকাশিত হল ‘স্বপ্নদৃষ্টা’ উপন্যাস। ঔপন্যাসিক নুরুন্নেচ্ছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী। সাহিত্য সাধনার জন্য নিখিল বঙ্গ সাহিত্য সমিতি থেকে 'বিদ্যাবিনোদিনী' উপাধি লাভ করেন। মুর্শিদাবাদ জেলার শাহপুর (সালার) গ্রামে ১৮৯৪ সালে নুরুন্নেচ্ছার জন্ম। তাঁর বাল্যকাল কেটেছে কঠোর অবরোধের মধ্যে। শৈশবের সেই অবরোধ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘প্রাচীন ভদ্রবংশীয়া মোসলমান আয়মাদার কন্যা বিধায়ে এবং কঠিন পর্দ্দাবগুণ্ঠনের খাতিরে আমার সামাজিক ও পার্থিব অভিজ্ঞতা খুবই কম। বলিতে কি, পিত্রালয়ে অবস্থানকালে অষ্টম বর্ষ পূর্ণ হইবার পর, চতুর্দ্দিকে উচ্চ প্রাচীরবেষ্টিত অন্দর ও মস্তকোপরি চন্দ্রতারকা খচিত নীল চন্দ্রাতপ ভিন্ন কোনই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমার নয়ন পথের পথিক হয় নাই।’(রশিদ আল ফারুকি : নুরুন্নেছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃ. ২০)। অবরোধের কারণে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ করতে পারেননি। তাঁর সাহিত্যচর্চা শুরু হয় বিবাহিত জীবনে। নুরুন্নেছার প্রথম রচনা ‘আহ্বানগীতি’। মাসিক কোহিনুর পত্রিকায় ১৯১১ সালে এটি প্রকাশিত হয়। ১৯২৯ সালে প্রকাশিত ‘নিয়তি’ তাঁর শেষ উপখ্যানমূলক রচনা। নুরুন্নেছার সাহিত্য রচনার জীবন মাত্র ছ’বছর। এই ছ’বছরে তাঁর ‘স্বপ্নদৃষ্টা’, ‘আত্মদান’ ও ‘জানকী বাঈ বা ভারতে মোসলেম বীরত্ব’ (ঐতিহাসিক উপন্যাস) এই তিনটি উপন্যাস এবং ‘ভাগ্যচক্র’, ‘বিধিলিপি’, ও ‘নিয়তি’ তিনটি বড় গল্প প্রকাশিত হয়। এছাড়াও রয়েছে কয়েকটি প্রবন্ধ। এই সব রচনা নিয়ে যে গ্রন্থাবলি প্রকাশিত হয়েছে সেটাই বাঙালি মুসলমান মহিলা রচিত প্রথম গ্রন্থাবলি।
নুরন্নেচ্ছা খাতুনের ‘স্বপ্নদৃষ্টা’ (১৯২৩) উপন্যাস প্রকাশের একবছর পর রোকেয়ার ‘পদ্মরাগ’(১৯২৪) উপন্যাস প্রকাশিত হয়। ‘স্বপ্নদৃষ্টা’ একটি পারিবারিক উপন্যাস। কাহিনির কেন্দ্রে রয়েছে এক উচ্চবংশের অন্তঃপুর। সেখানে অবরোধের যে কড়াকড়ি প্রতিটি ঘটনার মধ্যে তা চিত্রিত হয়েছে। সেই পরিবারের কন্যা মোমেনা অজ্ঞান হয় গেলে তাঁর পিতা হাফেজ ফজ্লর রহমান ডাক্তার নিয়ে আসেন মেয়ের চিকিৎসার জন্য। রুগিকে আপাদমস্তক পুরু চাদরে জড়িয়ে রাখা হয়েছে দেখে ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ কেয়া চিজ হ্যায় হাফেজ সাহাব?’ শুনলেন চাদর জড়ানো অবস্থায় পড়ে রয়েছে হাফেজ সাহেবেরই অসুস্থ কন্যা। বিরক্ত হয়ে ডাক্তার বললেন, ‘কাপড়া মোড়নেসে কেয়া জল্ডি হোস হোগা?’ কিন্তু ডাক্তারকে রুগির শরীরে স্টেথেস্কোপ লাগানোর অনুমতি দিল না মেয়ের বাবা। স্টেথেস্কোপ ডাক্তারের কানে, আর তার ডগাটি বাড়ির কাজের মেয়ে রুগির বক্ষস্থলে বসানোর চেষ্টা করছে। এইভাবে রুগির শরীরের রোগ পরীক্ষা হলো। বোঝা যায় শৈশবের অভিজ্ঞতা নুরুন্নেছা চিত্রিত করেছেন এই উপন্যাসে।
নুরুন্নেচ্ছা বিবাহ পরবর্তী জীবনে অবরোধ ও পর্দার শাসনে ছিলেন না। মুক্ততার স্বাদ গ্রহণ করেছিলেন বলেই অবরোধের জ্বালাকে আরও তীব্রভাবে উপলব্ধি করেছেন। তিনি পর্দা মানতেন না দেখে ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন লিখেছেন-‘মহিলা সংখ্যার (সওগাত) জন্য তাঁর লেখা ও ছবি পাবার আশায় কলকাতা থেকে ট্রেন যোগে শ্রীরামপুরে গিয়ে তাঁর বাড়িতে উপস্থিত হলাম। সে-কালে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজন ছাড়া মেয়েরা অন্য কারো সামনে আসতেন না। ভেবেছিলাম নুরুন্নেচ্ছা খাতুন বাড়ির কোনও লোকের মারফতে আমার কথার জবাব দিবেন। কিন্তু তিনি অতি সহজ-সরলভাবে আমার সামনে এসে বসলেন। আমার আগমনকে অভিনন্দিত করলেন। নারী জাগরণ অভিযানের জন্য সওগাতের খুব প্রশংসা করলেন।’(রশিদ আল ফারুকী : নুরুন্নেচ্ছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী, বাংলা একাডেমী, ঢাকা)। নুরুন্নেচ্ছা কলম ধরেছিলেন মুসলিম নারীকে জাগিয়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। কাহিনি হিসেবে ‘স্বপ্নদৃষ্টা’ ততটা উপাদেয় নয়। কিন্তু বাঙালি মুসলিম মহিলার প্রথম প্রকাশিত এই উপন্যাস তৎকালীন সমাজের দলিল।
দেশ ভাগের পর ভিটেমাটি ছেড়ে ব্যথিত হৃদয়ে তিনি চলে যান পূর্ব বাংলায়। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৭৫ সালে।
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ১১ মার্চ ২০২১
লেখক: কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী
0 Comments
Post Comment