- 28 November, 2023
- 0 Comment(s)
- 845 view(s)
- লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে একফালি হালকা রোদ। শীতের দুপুরে স্নান সেরে সবেমাত্র অদ্রিজা রোদের দিকে পিঠ করে একটু বসেছে। কয়েক মুহূর্ত কাটতে না কাটতেই পাশের ঘর থেকে শুনতে পেল শাশুড়ির গলার আওয়াজ, ‘ও বউমা, একটু দুধ দাও না গো খাবো।’
ক্লান্ত শরীর নিয়ে অদ্রিজা রোবটের মতো উঠে গেল রান্নাঘরে। ছোট্টো খোপের মত অন্ধকার রান্নাঘরে একজনের বেশি মানুষের দাঁড়ানোর জায়গার সংকুলান হয় না। ঘুপচি স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে দীর্ঘদিন ধরেই মনুষ্যেতর অনেক জীবের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে রান্নাঘরটি। দুধের বাটি গরম করতে বসিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অদ্রিজা দেখে দেওয়াল জুড়ে বিভিন্ন রকম নকশাচিত্র তৈরী করেছে গেঁড়ি গুগলির দল। এই সকল বিষহীনদের পাশাপাশি বেশ কিছু বিষাক্ত অতিথির আনাগোনাও আছে। কেঁচো, মাকড়সা, আরশোলা, কেন্নো থেকে শুরু করে টিকটিকি, বিড়াল, ইঁদুর কোনো কিছুই বাদ নেই। অদ্রিজা রান্নাঘরে একা একা সমস্ত শত্রুজীব বিতাড়িত করে সংসারের দুবেলার সমস্ত রান্নাবান্না সেরে স্বামী ও অসুস্থ বৃদ্ধা শাশুড়ির মুখে খাবার জোগায়। শাশুড়ির বদহজমের সমস্যাটাও ইদানিং বেড়েছে। একটু ভালোমন্দ খাবার তার পেটে সয় না। অদ্রিজা অনেকবার শাশুড়িকে ডায়েপার পরানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হননি। ভোর থেকে উঠে সারাদিন সংসারের নানাবিধ কাজকর্ম, রান্নাবান্না সমস্ত একা হাতে সেরে বুড়ির সেবা শুশ্রূষা করার পর রাতে স্বামীর লাগামছাড়া মাতলামো অদ্রিজার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
সেদিন আলমারি গোছাতে গিয়ে হঠাৎই অদ্রিজার চোখ আটকে গেল তার ওয়েস্টার্ন ফিলোজফি বইটার ওপর। পুরোনো কাগজপত্রের ঢিপির তলা থেকে বের করে এনে সামনের মলাটের ওপর সামান্য ফুঁ দিয়ে একটু মুছে নিল শাড়ির আঁচল দিয়ে। তারপর বিছানায় বসে বিক্ষিপ্তভাবে উলটাতে লাগল হলদেটে পাতাগুলোকে। ধুলো গন্ধ ছাড়ছে বইটা থেকে। এককালে অদ্রিজা অনেক পড়েছে পুরোনো স্মৃতি বিজড়িত এই বইটি। তাই বিয়ের পরেও এ বাড়িতে সাথে করে আনতে ভোলেনি। চোখের কোণটা একটু ভালো করে মুছে লাল মলাটের বইটাকে নিজের চোখের সামনে বিছানার ওপর বের করে রাখলো অদ্রিজা। অনেক রাতে অদ্রিজার স্বামী সুশোভন ফিরে এল বাড়িতে। দরজায় দুড়ুমদাড়াম আওয়াজ করে টলতে টলতে সোজা ঢুকে গেল শোবার ঘরে। বইটা চোখে পড়া মাত্র অদ্রিজাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলো সুশোভন, ‘এই বইপত্র বিছানার ওপর রেখেছো কেন? বিছানাটা কি বই রাখবার জায়গা? শোবো কোথায় আমি, তোমার মাথায়?’
—‘সরিয়ে দিচ্ছি এত চিৎকার করার কিছু হয়নি।’
বিছানার উপর পা মেলে হেলান দিয়ে বসেই অদ্রিজার হাতটা টেনে ধরলো সুশোভন, ‘শোনো মাথাটা একটু টিপে দাও তো, প্রচুর যন্ত্রণা করছে।’
—‘তোমার বুড়ি মাকে আর ঘরকে সামলাতে সামলাতে আমারও মাথা ব্যথা করে।’
—‘বড় বাড় বেড়েছো না তুমি!’
সুশোভন অদ্রিজার হাত থেকে বইটা ছিনিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল মেঝেতে। অদ্রিজা সুশোভনের থেকে ছিটকে সরে এসে বইটাকে তুলে পৃষ্ঠাগুলো ভালো করে সোজা করে গুছিয়ে নিয়ে চেপে ধরলো বুকের কাছে।
—‘এখন বই বের করেছো কেন কে পড়বে?’
—‘আমি পড়া শুরু করবো আবার।’
অদ্রিজাকে ভেঙ্গিয়ে সুশোভন বলে, ‘পড়াশোনা করবো! সেসব করার বয়স তোমার আছে? কবে তো ছেড়ে দিয়েছো। তোমার শয়তান বাপটা ঝুলিয়ে দিল আমার গলায়।’
—‘তুমি কি তখন ভালোবাসতে না আমাকে? নিজেই তো বাবাকে গিয়ে বলে এসেছিলে বিয়ে করবে। এখন মাতাল হয়ে সব ভুলে গেছো?’
—‘তখন জানতাম না যে তুমি এমনধারা মেয়ে।’
—‘এমনধারা মেয়ে মানে?’
চুপ করে থাকে সুশোভন। পাশের ঘর থেকে শাশুড়ির গলার খ্যানখ্যানে আওয়াজ শুনতে পায় অদ্রিজা— ‘ও বউ, খোকা এখন ফিরলো বুঝি?’
অদ্রিজা কোনো উত্তর না দিয়ে বিছানায় শুতে যায়। পিছন থেকে দু’হাতের কব্জি চেপে ধরে সুশোভন। ধরে রাখে বেশ অনেকক্ষণ। ছাড়াতে না পেরে অদ্রিজা বিছানায় পড়ে ব্যথায় কোঁকাতে থাকে। ভালোবাসার এই প্রতিদান এমন অনেক রাতেই সহ্য করতে হয় তাকে।
পরদিন সকালে অদ্রিজাকে বিছানা থেকে ধাক্কা মেরে ঘুম থেকে তোলে সুশোভন, ‘শোনো বাজার থেকে চালের গুঁড়ি, গুড়, নারকেল, সুজি, ক্ষীর সব কিনে দিয়ে যাচ্ছি। পঞ্চাশ পিস্ মতো পাটিসাপটা বানিয়ে রেখো। শীতকালে এখন দোকানে পিঠেপুলির বেশ ডিম্যান্ড আছে, ময়দা আছে তো বাড়িতে?’
ভাঙ্গা গলায় অদ্রিজা জবাব দেয়, ‘আমি বানাতে পারিনা। পিঠে বানানোর সময় নেই আমার, নিজে মিষ্টিওয়ালা হয়ে বৌকে দিয়ে পিঠে বানাও লজ্জা করে না তোমার?’
অদ্রিজার দিকে এগিয়ে গিয়ে বিছানার ওপর হাঁটু গেঁড়ে বসে সুশোভন বলে, ‘লজ্জা করবে কেন আমি ঠিকঠাক বানাতে পারিনা বলেই তো তোমাকে বলছি, সোনা বউ আমার।’
সুশোভন জোর করে অদ্রিজার ঠোঁটে চুমু খেতে যায়। অদ্রিজা সরিয়ে নেয় নিজেকে। বিছানা থেকে নেমে শার্টের তলাটা একটু নামিয়ে নিয়ে সুশোভন হন্তদন্ত হয়ে চলে যায় বাজারে। কাল সারারাত ধরে কেঁদেছে অদ্রিজা। যন্ত্রণায় আর ঘুম আসেনি। আরক্ত নেত্রে চুলে খোপা করতে করতে সে এগিয়ে গেল কলঘরের দিকে। অ্যাসবেস্টাসের চালে একটা জায়গায় ছোট্ট ফুটো হয়ে গিয়েছিল গত তিন মাস আগে। একশো বার কানে কথাটি তোলা হলেও এর প্রতিকারের সময় সুশোভন কোনোদিন বের করে উঠতে পারেনি। শীতের সকালে ফুটো দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া নেমে আসে ঘরের ভেতর। সুশোভন পিঠের জোগাড় করে রেখে চলে গেছে দোকানে। হঠাৎ অদ্রিজার কি মনে হল মুখে পাউডার মেখে ভালো করে সেজেগুজে বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়। অনেক দিন পর রাস্তায় খোলা হাওয়াতে শ্বাস নিতে পারছে অদ্রিজা। লকডাউনের পর এই প্রথম গৃহবন্দি জীবন থেকে মুক্ত করলো নিজেকে। হাতের কালসিটেগুলো শাড়ির আঁচলের তলায় লুকিয়ে অদ্রিজা সোজা চলে গেল সুশোভনের দোকানের সামনে। শহরতলির এককোণে একটা ব্যস্ত সরু রাস্তার ওপর সুশোভনের ছোট্ট দোকান। দোকানের মাথার উপর কালচে নীল রঙের সাইনবোর্ডে বড় বড় হলদে অক্ষরে লেখা ‘অদ্রিজা সুইটস্’। এটাই ছিল অদ্রিজার প্রতি সুশোভনের পুরোনো নিঃস্বার্থ ভালোবাসার একটা মাইল ফলক। এখন তাতে অনেক ধুলো জমেছে সংস্কারের অভাবে। রাস্তার ওপার থেকে সোজাসুজি দোকানের ভেতর অদ্রিজা একটা অল্পবয়সি অচেনা মেয়েকে বসে থাকতে দেখতে পায়। ঘন ঘন হাসিতে ফেটে পড়ছে মেয়েটি। দোকান সামলানোর দায়িত্ব কর্মচারী ছেলেটার হাতে ছেড়ে দিয়ে সুশোভন সেই মেয়েটির সাথে খোশগল্পে মশগুল। অদ্রিজা দ্রুত পদে ফিরে এল বাড়িতে। আবারও সুশোভন বাড়ি ফিরলো অনেক রাত করে। অদ্রিজা ততক্ষণে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছে। সুশোভন ঘরে ঢুকে আস্তে করে মিষ্টি গলায় ডাকলো অদ্রিজাকে। চোখ মেলতেই চুলের মুঠি ধরে টেনে তুললো তাকে। অদ্রিজা চিৎকার করতেই ওর মুখটা এক হাতে চেপে ধরে জোরে ঝাঁকাতে লাগলো সুশোভন, ‘পিঠেগুলো বানাসনি কেন বল্ শিগগির।’
সজোরে মুখের থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে অদ্রিজা চেঁচিয়ে উঠলো, ‘আগে বলো দোকানের মেয়েটা কে?’
—‘কোন্ মেয়েটা?’
—‘একদম মিথ্যে কথা বলবে না আমি আজ দোকানে গিয়ে দেখে এলাম।’
—‘কখন গেলে তুমি দোকানে?’
—‘বুবাই বললো ও নাকি তোমার নতুন গার্লফ্রেন্ড। এমন আর কটা গার্লফ্রেন্ড পাতিয়েছো তুমি? আমার জীবনটা নষ্ট করে শান্তি নেই, আরও মেয়েদের সর্বনাশ করছো? আমি তোমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারি জানো।’
অদ্রিজার গালে সশব্দে একটা চড় মেরে সুশোভন অদ্রিজার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে চাপা গলায় বললো, ‘একদম চুপ্। যদি বেশি ট্যাঁইয়াপ্যাঁইয়া করবি তো সারাজীবন এই ঘরে আটকে রেখে দেবো। খাওয়া দাওয়া সব বাদ।’
সুশোভনের মুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা দেশি মদের জোরালো গন্ধে শ্বাস রোধ হওয়ার উপক্রম হল অদ্রিজার। সুশোভন বাইরে থেকে দরজায় ছিটকানি লাগিয়ে বেরিয়ে গেল। দরজা খুললো আবার সকালবেলা। সকালে আর কোনো কথা হল না দু’জনের মধ্যে। দোকানে বেরিয়ে যাওয়ার আগে সুশোভন শুধু বলে গেল, ‘সময় হলে পাটিসাপটাগুলো বানিয়ে রেখো।’
আজ আর ঘরের কোনো কাজ করতে ইচ্ছা করছে না অদ্রিজার। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। সকাল থেকে সারাদিন হাত-পা গুটিয়ে চুপ করে আঁটোসাঁটো হয়ে বসে আছে বিছানায়। বউমাকে ডাকতে ডাকতে চুপ করে গেছেন শাশুড়ি। মনের দুঃখের কথা বাড়ির লোককে জানানোর মতো সাহস হল না অদ্রিজার। বাবা এ বিয়েতে মত দিলেও মায়ের কোনো মত ছিল না। মা চেয়েছিলেন আগে মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করতে। কিন্তু নিজের কেরিয়ারের কথা না ভেবে অদ্রিজা তখন এ বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। যে সুশোভনকে সে এতদিন ভালোবেসেছিল সে ছিল এক অন্য মানুষ। সুশোভনের হাত ধরে নিশ্চিন্তে গ্র্যাজুয়েশনের ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা অসমাপ্ত রেখেই শুরু করতে চেয়েছিল জীবনের একটা নতুন অধ্যায়। ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে কললিস্টে গিয়ে চোখে পড়লো তার সে সময়ের কলেজের বেস্টফ্রেন্ড সংযুক্তার ফোন নম্বর। সংযুক্তাকে ফোন করে ফেললো অদ্রিজা।
—‘হ্যালো কে বলছেন?’
—‘সংযুক্তা চিনতে পারছিস আমি অদ্রিজা বলছি।’
—‘কোন্ অদ্রিজা সেই কলেজের বন্ধু অদ্রিজা?’
—‘হ্যাঁ রে।’
—‘বল্ কি ব্যাপার, এতদিন কোথায় ছিলিস? ফোন করিসনি কেন?’
—‘আমি ভালো নেই রে।’
—‘কেন লাস্টবার শুনেছিলাম তোর তো বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।’
—‘হ্যাঁ, সুশোভন আমাকে ঠকিয়ে আবার অন্য একটা মেয়ের সাথে প্রেম করছে।’
—‘সে কি! তাহলে কি করবি এখন?’
—‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না।’
অদ্রিজার চোখের পাতা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে।
—‘তুই এক কাজ কর কয়েকদিনের জন্য আমাদের বাড়িতে চলে আয় তারপর বাকি কথাগুলো শুনবো।’
—‘তোর অসুবিধা হবে না?’
—‘আমার আবার কি অসুবিধা? শুধু আমি আর মা-বাবাই তো থাকি, তুই কদিনই বা আর থাকবি তার মধ্যে একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এখন সুশোভনের সাথে থাকার কোনো দরকার নেই তুই চলে আয়।’
—‘না রে আমি আর বিশ্বাসের জোরে চলতে চাই না, এই শ্বশুরবাড়িটা এখন আমার কাছে নরকের মতো হয়ে গেছে, তুই একটা স্থায়ী সমাধান বল্।’
—‘তুই তো লাস্ট ইয়ারের এক্সামটা দিলি না... তুই বরং শতাক্ষীকে ফোন কর। পড়াশোনার ব্যাপারে ও তোকে ভালো বলে দিতে পারবে। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট না করে তুই কোনো ভালো চাকরিতে জয়েন করতে পারবি না। শতাক্ষী এখন এম এ কমপ্লিট করছে ইউনিভার্সিটি থেকে। ঠিক আছে তুই শতাক্ষীকে ফোন কর তারপর আমাকে জানাস।’
—‘তুই এখন আর পড়ছিস না?’
—‘না রে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হওয়ার সাথে সাথেই একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি পেয়ে গেলাম তাই আর এগোলাম না।’
ফোনটা কেটে অদ্রিজা শতাক্ষীর নম্বর খুঁজে ফোন করলো।
—‘হ্যালো শতাক্ষী আমি অদ্রিজা বলছিলাম রে চিনতে পারছিস?’
—‘হ্যাঁ... তুই আমাদের সাথে কলেজে পড়তিস তো, কেমন কাটছে তোর মারেজ লাইফ?’
—‘ভালো না, সুশোভন রোজ আমার ওপর টরচার করে, এখন আবার অন্য একজনের সাথে প্রেমও করছে।’
—‘আগেই বলেছিলাম স্টাডিটা ছেড়ে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করিস না। শুনলি তো না-ই আবার রাগ হয়েছিল তোর। এইসব ছেলেরা এইভাবেই প্রেমের ফাঁদে ফেলে মেয়েদের লাইফটাকে পুরো ডেস্ট্রয় করে দেয়। আমার এক পিসতুতো দিদির সাথেও এমনটাই হয়েছিল।’
—‘এখন আমি কি করবো সেটা একটু বল না।’
—‘কি আবার করবি লাস্ট ইয়ারের এক্সামটা দিবি। তোকে আমি কলেজে ভর্তির ডেট জানিয়ে দেবো, লাস্ট সেমে ভর্তি হয়ে যাস আরেকবার, তোর কাছে বইগুলো আছে তো?’
—‘হ্যাঁ আছে।’
—‘তাহলে তো কোনো ব্যাপার না, ঐ শ্বশুরবাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে চলে যা তারপর পড়াশোনা স্টার্ট করে দে ব্যস্।’
—‘নিজের বাড়ি নেই আমার।’
—‘কেন তোর বাবা কিছু জানেন না এসব?’
—‘না, তাছাড়া ওটা তো বাবার বাড়ি। বিয়ের পর থেকে ও বাড়ির দরজা আমার জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কথা শুনেও কেউ আমাকে এখন আর ও বাড়িতে এক্সেপ্ট করে নেবে না।’
—‘তাহলে থাকবি কোথায়?’
—‘সংযুক্তা ওদের বাড়িতে থাকতে বলেছে।’
—‘তাহলে তো কোনো সমস্যা নেই।’
—‘কিন্তু ডিভোর্স কেসের টাকা, পড়াশোনার খরচ এসব চালাবো কি করে? সংযুক্তার থেকে আমি টাকা চাইতে পারবো না।’
—‘আমি তোকে পরে সব কথা বলছি। তুই আগে ওদের বাড়িতে চলে যা। কিন্তু তোদের লাভ ম্যারেজ হওয়ার পরেও এইসব আবার কবে থেকে?’
—‘ঐ লকডাউন চলছিল তখন থেকেই সুশোভনের মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে।’
—‘কিন্তু যতদূর জানি মিষ্টির দোকান তো খোলার পারমিশন ছিল রাইট?’
—‘হ্যাঁ মোটামুটি একমাস পর থেকেই অল্প অল্প করে খোলার পারমিশন ছিল কিন্তু সুশোভন কেন এমন করছে তা আমি জানিনা।’
—‘যাক্ ছাড় মানুষ চিরকাল একরকম থাকে না। তোর বর এখন ঘরে নেই তো?’
—‘না’
—‘তাহলে যেটা বললাম সেটা কর। এখন কুইক্ পালিয়ে যা ওখান থেকে।’
অদ্রিজা নিজের জামাকাপড় গুছিয়ে নিতে শুরু করলো। যত্ন সহকারে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল সেই লাল মলাটের ফিলোজফি বইটাকে। শাশুড়ি হয়তো পাশের ঘর থেকে টের পাচ্ছিলেন সবই। যথাসময়ে অদ্রিজা সংযুক্তাকে ফোন করে ডেকে নিল। সংযুক্তা বাড়িটা একটা চক্কর কেটে এসে অদ্রিজার ঘরের জানলা দিয়ে হাঁক পাড়লো, ‘ঐ অদ্রিজা, যাচ্ছিস কোথায় এদিকে শোন।’
—‘তুই এখানে কি করছিস, আমি দরজা খুলছি দাঁড়া।’
—‘খুলবি কি করে, তোর বর দরজায় তালা দিয়ে তোকে বাড়িতে আটকে রেখে গেছে।’
প্রাথমিক ভাবে অদ্রিজার কথাটা বিশ্বাস হল না। সে ছুটে গিয়ে দরজাটা একবার খোলার চেষ্টা করলো। দরজাটা সত্যিই বাইরে থেকে লক্ করা। নিজের ঘরে ফিরে এসে বিছানার তলা থেকে একটা ডুপ্লিকেট চাবি বের করে জানলা দিয়ে গলিয়ে সংযুক্তার হাতে দিল। সংযুক্তা তালাটা খুলতেই অদ্রিজা সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে এসে সোজা গিয়ে উঠে পড়লো সংযুক্তার নীল স্কুটিটাতে। দু-তিনবার স্টার্ট নিয়েই একরাশ কালো ধোঁয়া ছেড়ে ঝড়ের বেগে আওয়াজ তুলে স্কুটি এগিয়ে গেল বাড়িটাকে পিছনে ফেলে। স্কুটির পিছনে বসে অদ্রিজা শেষবারের মতো দেখতে পেল তার শ্বশুরবাড়ির প্লাস্টার খসা দেওয়ালটার গা ঘেঁষে হেলে পড়েছে দুপুরের কাঁচা সোনালী রোদ। সবুজ রং করা কাঠের দরজাটার কড়ায় লেগে থাকা খোলা তালাটা চিকচিক করছে গায়ে রোদ মেখে। স্কুটির চাকায় চাকায় ধুলো আর রাশি রাশি শুকনো পাতা উড়ে একটু একটু করে ধোঁয়ার মতো ঝাপসা করে দিল সামনের দৃশ্যটি।
সংযুক্তার বাড়ি পৌঁছে হাত-মুখ ধুয়ে সামান্য জল খেয়েই অদ্রিজা ফোন করলো শতাক্ষীকে, ‘পরের প্ল্যানটা বল এবার।’
—‘তুই আপাতত গুগলে একটা হোম ডেলিভারির অ্যাডভারটাইজমেন্ট দে, তুই তো খুব ভালো রান্নাবান্না পারিস তাই না? কীভাবে সব করতে হবে পরে আমি তোকে বলে দিচ্ছি।’
—‘খাবার হোম ডেলিভারি! ব্যবসার কিছুই তো আমি জানিনা। যদি সামলাতে না পেরে ঠকে যাই।’
—‘আরে আমরা তো আছি পাশে, তুই ঠকবি না। প্রথমে হয়তো একটু লসে রান করতে পারে। তারপর দেখবি সব ঠিকঠাক সামলাতে পারবি। অত ভয় পেলে চলবে না। মানুষ ঠকতে ঠকতেই তো একদিন জিততে শেখে! এছাড়া মাঝেমধ্যে রান্নার বিভিন্ন রেসিপি ইউটিউবে ভিডিও করে আপলোডও করতে পারিস। আমরা তোর চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার জোগাড় করে দেবো।’
মাঝে কেটে গেছে প্রায় দেড় মাস। অদ্রিজা পুরোপুরিভাবে সুশোভনের সাথে সমস্ত সম্পর্কের ইতি টেনেছে। সংযুক্তার বাড়িতে আসার আগে নিজের ঘরে ভিডিও করে বলা শেষ কথাগুলো শুধু হোয়াটস্অ্যাপে সুশোভনকে পাঠিয়ে দিয়েছিল সেই দেড় মাস আগে। মনের সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সে এতদিনে সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলে ব্যবসাটিও একটু একটু করে মাথা চাড়া দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। অল্পস্বল্প খাবারের অর্ডারও আসছে তার কাছে। পড়াশোনা ও ব্যবসার ফাঁকে নিজের থাকার জন্য একটা বাড়িরও খোঁজ চালাচ্ছে অদ্রিজা সংযুক্তাকে আড়াল করে। সামনের পৌষ পার্বণে অদ্রিজার হাতে তৈরি পাটিসাপটা খাওয়ার একটা দাবি রয়েছে সংযুক্তার। কিন্তু সুশোভনের সব স্মৃতিগুলোকে মন থেকে মুছে ফেলতে অদ্রিজা এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি। একদিন সকালে একটা অচেনা নম্বর থেকে কল আসে অদ্রিজার ফোনে। ফোনটা তুলে কানে চেপে ধরতে শুনতে পায় ওপার থেকে ভেসে আসছে একটি মহিলার কন্ঠস্বর, ‘হ্যালো এখানে কি খাবার হোম ডেলিভারি করা হয়? আমি আপনাকে একটা অ্যাড্রেস মেল করে দিচ্ছি আপনি ঐ অ্যাড্রেসে পঞ্চাশ পিস্ ক্ষীরের পাটিসাপটা একটু পাঠিয়ে দেবেন প্লিজ....’
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ১৫ জানুয়ারি ২০২১
লেখক: শিক্ষার্থী, গল্পলেখক
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment