- 18 May, 2023
- 0 Comment(s)
- 2627 view(s)
- লিখেছেন : সাইদুর রহমান
আমাদের প্রচলিত সমাজ পরিবেশে একজন পুরুষের কাছে নারী স্ত্রী, রক্ষিতা, প্রেমিকা, দাসী, ক্রীতদাসী পরিচয়ে থাকতে পারে। একদা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এগুলোই ছিল পুরুষের সাথে নারীর সহবাসের বৈধ সার্টিফিকেট। বহুবিবাহ বা একের বেশি বিয়ে বা রক্ষিতা রাখা যে কোনও সমাজের যে কোনও পুরুষের একটি ফ্যাশন হিসেবেও বিবেচিত হত। আর এখান থেকেই সমাজে ‘বহুবিবাহ’ প্রথার উৎপত্তি। একসময় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বহুবিবাহের প্রচলন ছিল। সেখানে পুরষেরাই একাধিক বিবাহ করত। নারীদের একাধিক বিয়ের ইতিহাস থাকলেও তার সামাজিক বৈধতার ইতিহাস খুব একটা জানা যায় না। এক একজন পুরুষের শতাধিক নারী থাকার তথ্য বহু প্রাচীন। প্রাচীন রাজা, সম্রাট বা জমিদারদের একাধিক স্ত্রী রাখার ঘটনা তো প্রবাদে পরিণত।
সমাজের সাথে ধর্মের একটি নিকট সম্পর্ক আছে। ফলে বিয়ের মত একটি সামাজিক বিষয়ের সাথে ধর্মের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গী। স্বভাবতই আধুনিক সমাজে ধর্ম বহুবিবাহকে কোন চোখে দেখে তা আলোচনার দাবি রাখে। বৌদ্ধধর্মে বিবাহকে প্রাতিষ্ঠানিক রীতি হিসেবে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তাঁদের কাছে এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়, এবং সাধারণত বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এতে অংশ নেন না। (যদিও এর কিছু ব্যতিক্রম আছে) খ্রিষ্টান ধর্মে ওল্ড টেস্টামেন্টে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ নয়। যদিও নিউ টেস্টামেন্ট বহুবিবাহ সম্পর্কে মূলত নীরব। হিন্দু সমাজে বহু বিবাহের প্রচলন ছিল। প্রাচীন ইতিহাসের কথা বাদ দিলেও এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ ছিল শাস্ত্রসম্মত। কৌলীন্য প্রথাকে কেদ্র করে হিন্দু সমাজে বহুবিবাহের চরম ব্যাপ্তি ঘটে। এই প্রথার সুযোগ নিয়ে ব্রাহ্মণরা একাধিক বিয়ে করতেন। ক্ষত্রিয়, বৈশ্যরাও খুব একটা পিছিয়ে থাকতেন না। যদিও শূদ্রদের একটি বিবাহই শাস্ত্রসম্মত ছিল। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বহুবিবাহের বিরুদ্ধে বহু লড়াই করে বন্ধ করেছিলেন।
স্বাধীন ভারতবর্ষে ১৯৫৫ সালে ভারতীয় সংসদ দ্বারা হিন্দু বিবাহ আইন কার্যকর করা হয়। এবং মুসলমানদের বাদে ভারতে প্রত্যেকের জন্য বহু বিবাহকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। ১৯৫৫-র আগে, বহুবিবাহ হিন্দুদের জন্য অনুমোদিত ছিল। এবং এই প্রসঙ্গে ইসলামে বহবিবাহের প্রসঙ্গটি দীর্ঘ আলোচনার দাবি রাখে।
ইসলাম ধর্মে বহুবিবাহের অনুমোদন আছে। এই অনুমোদনের পক্ষে ছিল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। ব্যাপকতা ও ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে ‘ওহুদ যুদ্ধ’ ছিল ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই যুদ্ধে হজরত মহম্মদ (সঃ)-এর নিকটাত্মীয় অনেক ‘সাহাবি’ শহীদ হয়েছিলেন। এর ফলে তাঁদের স্ত্রীরা বিধবা ও সন্তানসন্ততি ‘এতিম’ হয়ে পড়েন। এই সমস্ত বিধবাদের ব্যবস্থাপনা ও তাঁদের সন্তানদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতেই ইসলামের নবী হযরত মহম্মদ (সঃ) সুবিচারের শর্ত সাপেক্ষে ‘বহুবিবাহে’র নির্দিষ্ট নিয়ম করে দিয়েছিলেন। সাথে সাথে হযরত মহম্মদ (সঃ) স্পষ্টভাবে এটাও ঠিক করে দেন যে, সবার সুবিচার করতে না পারলে একটির বেশি বিয়ে করা যাবে না। ইসলামে এতিম বা সমাজের ওই ধরনের অসহায়-অক্ষম মহিলাদের সাথে যদি ন্যায় বিচার করা না যায়, তাঁদেরকে বিয়ে করে স্ত্রীর সঠিক মর্যাদা প্রদান করা না যায়, তাহলে শুধু সম্পদের জন্য এঁদের বিয়ে করা হবে সীমালঙ্ঘনের পর্যায়ভুক্ত। আর আল্লাহতায়ালা সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।
এছাড়াও ইসলামে বহুবিবাহ অনুমোদনের পেছনে রয়েছে তত্কালীন আরবের সামাজিক বাস্তবতা। ইসলাম-পূর্বযুগে আরব সমাজের পুরুষরা বহু বিধবা নারীকে বিবাহ এবং এতিমদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করত তাদের সম্পদের নিরঙ্কুশ মালিক হওয়ার জন্য। কিন্তু তাদের প্রতি বিন্দু পরিমাণ সুবিচার করত না। জাহেলিয়া যুগের সেইসব নারীর অধিকার ক্ষুণ্ণ করার পরিবর্তে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ইসলামের নবী পুরুষের বিবাহের একটি নির্দিষ্ট নিয়ম করে দেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগেও সীমাহীনভাবে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। সাহাবীদের কারও কারও চারের বেশি স্ত্রী ছিলেন। এক পর্যায়ে বহু বিবাহের কারণে নারীদের অধিকার খর্ব হচ্ছে কিনা এ নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা জোরদার হয়। সেই সময়ে ইসলাম ধর্মীয় মনীষীদের অধিকাংশই বহু বিবাহের কারণে নারীরা অপমানিত ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার দিকে মত দেন। তাঁদের মতামত ও সিদ্ধান্তক্রমে বহুবিবাহকে নিয়ন্ত্রণে আনা শুরু হয়।
ইসলাম ধর্মে একজন পুরুষ সর্বোচ্চ চারজন নারীকে বিয়ে করতে পারেন, তবে তা সম্পূর্ণ শর্ত সাপেক্ষ। তা না হলে একজন স্ত্রীই যথেষ্ট। শর্তগুলি এইরকম —
১। যে দেশে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি।
২। বিধবা ও এতিম মেয়েদের অভিভাবকত্ব গ্রহণের প্রয়োজনে।
৩। অসহায়, দরিদ্র, দুঃস্থ নারীদের দেখভালের জন্য।
৪। স্ত্রী দুরারোগ্যে আক্রান্ত হলে।
৫। স্ত্রীর বন্ধ্যত্বের কারণে সন্তান না হলে।
৬। স্বামীর যৌন কামনা মেটাতে স্ত্রী অক্ষম হলে।
সময়ের সাথে সাথে মানুষের ভাবনাচিন্তায় এসেছে নানা পরিবর্তন। সেই পরিবর্তন থেকে ‘বহুবিবাহ’ বিষয়েও চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন আসে। তুরস্ক প্রথম মুসলিম দেশ যেখানে ১৯২৬ সালে প্রথম বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৫৬ সালে তিউনেশিয়ার সংসদ বহুবিবাহ প্রথা বন্ধের আইন পাশ করে। পরে ১৯৬৪ সালে তা দেশ জুড়ে লাগু হয়। ইজরায়েলে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হয় ১৯৭৮ সালে। সেই পথ ধরেই একে একে মিশর, সুদান, আলজেরিয়া, জর্ডন, সিরিয়া, মরক্কো, বাংলাদেশ, ইরাক, ইরান, কুয়েত, লেবানন প্রভৃতি দেশে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হতে থাকে। অবশ্য ইরান, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশে একের অধিক বিয়ে করতে হলে স্বামীকে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিতে হয়।
ইতিমধ্যে ভারতেও মুসলমান সমাজের অন্দরেও বহুবিবাহ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ২০১৯-এর মার্চে দিল্লির একটি মেয়ের সুপ্রিমকোর্টে করা একটি পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট মুসলমান সমাজে ‘বহুবিবাহ’কে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে অভিহিত করেছে। (Supreme Court seeking to declare as “illegal” and “unconstitutional” the practices of polygamy and ‘nikah halala’ among the Muslim community.) এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘বহুবিবাহ’ নিয়ে নতুন করে ভাবনার সময় এসেছে বৈকি। সময় এসেছে ভেবে দেখার যে, যে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবক্ষয়ের পটভূমিতে বিশৃঙ্খলিত জাতিকে একটি নিয়মের বন্ধনে আনার জন্য ইসলামের নবী হযরত মহম্মদ (সঃ) শর্তসাপেক্ষে সর্বাধিক চারটি বিবাহের কথা বলেছিলেন, আজকের সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তার আর কোনও প্রয়োজন আছে কিনা।
সমাজ এগিয়েছে। রাজনীতি, শিক্ষা থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সর্বক্ষেত্রে মুসলিম মেয়েরাও পুরুষের সাথে সমান্তরালভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন মেয়েরা অনেক বেশি স্বাধীন, অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি স্বাবলম্বী ও স্বয়ংসম্পুর্ণ। বিশ্বজুড়ে স্কুল কলেজে অন্যান্য মেয়েদের পাশাপাশি মুসলিম মেয়েদের সংখ্যাও ক্রমশ বাড়ছে। তারা শ্রম দিয়ে অর্থও উপার্জন করছে। এমনকি তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করছে, পরিবারের সাথে থেকে পরিবারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে।
হাজার বছরের পুরনো সংস্কার ও ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে আজ মুসলিম নারীরাও সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আজকের নারীর সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক। আজকের নারী আত্মবিকাশের নেশায় সদা উন্মুখ। সকল বিষয়ে পুরুষের ওপর নারীর নির্ভরশীলতা কখনওই সুস্থ সমাজ তৈরি করতে পারে না, পারে না নারীদের মুক্তি দিতে। তাই পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে প্রাপ্ত দুর্বল মানসিকতা দুমড়েমুচড়ে গুঁড়ো করে আজকের নারী হয়ে উঠেছে অনেক বেশি স্বাধীনচেতা। পুরুষতন্ত্রের দেয়া ধিক্কারকে প্রতিহত করে ‘আজকের নারী’ আর্থ-সামাজিক মুক্তি ও অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ায় দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। আজকের নারী অনেক বেশি আত্মমর্যাদাশীল। সে আত্মমর্যাদার সাথে বাঁচতে চাই। নিজেকে সে আর কেবল পুরুষের পুতুল খেলার ‘যৌন সঙ্গী’ হিসেবে মনে করেনা। পুরুষের যোগ্য সঙ্গী হিসেবে সে পুরুষের সাথে থাকতে চাই। আর এই প্রেক্ষাপটে আজকের নারী পুরুষের বহুবিবাহ নিয়ে প্রশ্ন তো তুলবেই। সে কি পারবে তার নিজ স্বাধীন সত্তাকে পুরুষের যৌনাসক্তির কাছে জলাঞ্জলি দিয়ে মূক ও বধির হয়ে বেঁচে থাকতে! তাই, কেবল ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, সম্পূর্ণ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সর্বোপরি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আজকের নারী দিকে দিকে আওয়াজ তুলবে—‘বহুবিবাহ’ বন্ধ হোক।
পুনঃপ্রকাশ। ১৬ মে ২০২২
প্রতীকী ছবি
লেখক : স্কুল শিক্ষক , সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী
0 Comments
Post Comment