- 28 December, 2021
- 0 Comment(s)
- 561 view(s)
- লিখেছেন : আফরোজা খাতুন
রোকেয়ার ‘পদ্মরাগ’ (১৯০২ সালে লেখেন, প্রকাশ হয় ১৯২৪ সালে) উপন্যাসের নায়ক লতীফ, লতীফের মা এবং বোনেরা সমস্যায় পড়েছিল বাবার মৃত্যুতে। দাদু বেঁচে থাকাকালীন বাবার মৃত্যু হওয়ায় লতীফরা তার চাচা হবীব আলমের দাক্ষিণ্যে জীবনধারণ করে। লতীফ উচ্চশিক্ষা পেয়েছে চাচার অর্থ সাহায্যে। তাই কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে চাচার কথা অমান্য করার অধিকার সে অর্জন করতে পারেনি। কন্যার বাড়ি থেকে অর্থ প্রাপ্তির লোভে চাচা হবীব আলম লতীফের আর একটি বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে যা লতীফের নীতিতে গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু পরিবার-পরিজন, আত্মীয়রা লতীফকে মনে করিয়ে দিয়েছে, তার বেঁচে থাকার উপাদানগুলো চাচার দয়ার দান। আজীবন চাচার সিদ্ধান্তকেই লতীফের মেনে চলা উচিত। ফলে লতীফ ‘বলিদানের ছাগলের মত বিবাহের জন্য প্রস্তুত হইলেন।’ (পদ্মরাগ, পৃ ২২৬, রোকেয়া রচনাসংগ্রহ, বিশ্বকোষ পরিষদ, ২য় সংস্করণ)। লতীফরা আজও ভারতের মুসলিম পারিবারিক আইনে ছড়িয়ে রয়েছেন, খুঁজলেই পাওয়া যায়। ১৯০২ থেকে ২০২১ একই পথে আমাদের পরিক্রমা। অজুহাত ধর্মের। আত্মতৃপ্তি দয়ার দানে।
বাঁকুড়ার অন্ডাল থানার চাবড়া গ্রামের সেখ মোসলেম জানালেন তাঁদের নিয়ে তাঁর মায়ের লড়াইয়ের জীবনকথা। হাসিনা বিবি চার মেয়ে, দুই ছেলেকে নিয়ে বিধবা হলেন। বাচ্চাদের তখনও শৈশব-কৈশোর পেরোয়নি। হাসিনা বিবির বৃদ্ধ শ্বশুর ও দুই দেওর বাড়িতেই ঠাঁই দিয়েছিলেন। তবে সন্তানদের খাবার যোগাড়ের দায়িত্ব ছিল হাসিনা বিবির। মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে কাজে নামলেন তিনি। কখনও রুটি কারখানায়, কখনও বেলের মালা তৈরি, কখনও লোকের বাড়ি কাজ করে তাঁরা কোনরকমে সাতটা মানুষের খাবার সংগ্রহ করতেন। হাসিনা বিবির ইচ্ছা ছিল ছেলে দুটোকে পড়ানোর। কিন্তু অর্থাভাবে আর সে ইচ্ছে পূরণ হয়নি। ছেলেদেরও স্কুলের পাট চুকিয়ে কাজে লাগিয়ে দেন। সেখ মোসলেমের বয়স এখন তিপান্ন বছর। তাঁর বছর দশেক বয়সে বাবা মারা যান। এতগুলো বছর মায়ের জীবনের অসহায়তা দেখে এখন তিনি এই আইনের প্রতি চরম ক্ষুব্ধ। কারণ দাদু মারা যাওয়ার পর তাঁদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। চারটে ঘরের মালিক দুই চাচা। তাঁদের ভাগে শূন্য। পড়ার সুযোগ হারিয়েছেন। সামান্য রোজগারে মাথা গোঁজার এক চিলতে ঠাঁই করেছেন। আশ্রয়ের প্রয়োজনেই বোনেদের কোনপ্রকারে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর ভাই সেখ জলিল শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। আর হাসিনা বিবি ছেলে-মেয়েদের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে দিন কাটাচ্ছেন। নিজস্ব ঠাঁই বলতে কিছু নেই।
বাঁকুড়ার ইদ মহম্মদ এই মুসলিম পৈতৃক আইন সংস্কারের প্রয়োজনে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। তাঁর আট বছর বয়সেই জীবনটা যে পালটে গেছে এই আইনের ফাঁদে। বিধবা মা শ্বশুরবাড়িতে একটা ঘর পেয়েছিলেন থাকার। শ্বশুরের মৃত্যুর পরও ইদ মহম্মদের চাচা তাঁদের ঘরের মালিকানা কেড়ে নেননি। লেখাপড়া নাই বা হলো। আশ্রয়টুকু তো আছে। ইদ মহম্মদ মুরগীর দোকানে মাংস কাটার কাজ করেন। একই বাড়িতে চাচার ছেলেমেয়েকে দেখেছেন লেখাপড়া শিখতে। মাঠের ফসল, বাঁশের বাগান বিক্রি হয়ে সব টাকা চাচার হাতে যাচ্ছে। তাঁর বাবার অংশও। এত বঞ্চনা, অপমান মুখ বুজে সয়েছিলেন চাচা আশ্রয়হীন করেননি বলে। নিজের জীবনে পড়াশোনা না শেখার অপূর্ণতা সন্তানদের মধ্যে দিয়ে পূরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন। চরম এই লড়াইয়ের মধ্যে তাঁর জীবনে জারি হলো চাচার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার ফরমান। কারণ ইদ মহম্মদের মা বেঁচে থাকা পর্যন্ত চাচার ইমান কাজ করেছে। মায়ের মৃত্যুর পর শরিয়তি আইন মোতাবেক প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বাস করা ঘরের অধিকার হারাচ্ছেন ইদ মহম্মদ। এখন গ্রামের মানুষদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন এই অন্যায়ের প্রতিবিধান চেয়ে। কারণ দেশের আইন তাঁকে ওই আশ্রয়টুকুও ফিরিয়ে দিতে পারবে না। মুসলিম পারিবারিক আইনের বিচারে তিনি যে বাস্তুজমি, বসতভিটের অধিকার হারিয়েছেন। ছেলেমেয়েরা কলেজে পড়ে। তাঁদের নিয়ে কোথায় দাঁড়াবেন? তাঁর জীবন কাটে দৈনিক রোজগারে। আর ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ কিছুটা হিতাকাঙ্ক্ষীদের অর্থ সাহায্যে। প্রকট দুঃখে তিনি বললেন, ‘দাদুর আগে যে বাবারা মারা যান, তাঁরা কি অপরাধী? কেন তাঁদের স্ত্রী সন্তানদের পথে ঠাঁই হয়? এই পরিবারগুলোর জীবনে যে অন্যায় হচ্ছে তার প্রতিকার কবে হবে? এমন আইনের পরিবর্তনের জন্য গ্রামে গ্রামে ঘুরে অধিকারহারা পরিবারগুলোর সঙ্গে জোট বাঁধছি। যদি কেউ সাহায্য করেন তাহলে আদালতেও যাব।’
মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিপ্রাপ্ত সেই মানুষদের পক্ষে ইদ মহম্মদের আবেদন কি স্বস্তিকর হবে যাঁরা ইমান আর দয়া দাক্ষিণ্যের ফতোয়ায় আত্মতুষ্টি লাভ করেন? বাস্তবে ঘটা এই সমস্যাগুলির অভিজ্ঞতা থেকে ভবিষ্যতের জন্য আমরা কি এই পারিবারিক আইন সংস্কারের কথা ভাবব না? ইদ মহম্মদের প্রয়াসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব কাদের?
0 Comments
Post Comment