- 29 July, 2023
- 0 Comment(s)
- 669 view(s)
- লিখেছেন : রুমেলিকা কুমার
আবার ফিরে এসেছে ঢেউ। মারীর দেশে তৃতীয় ঢেউ। আবার ক্লিনিকে বাড়ছে জ্বর সর্দি কাশির উপসর্গ। অবশ্য ভুলেও জ্বর নৈব নৈব চ। সর্দি কাশি, নাক দিয়ে জল বেরোনো। ব্যাস ওইটুকুই। জ্বর কিছুতেই মুখ দিয়ে বেরোবে না। দুনিয়া রসাতলে যাক ৯৮.৬ ছেড়ে তাপমাত্রা এক বিন্দু ডানদিক সরবে না।
-জ্বর এসেছিল?? – না না না জ্বর একদম আসেনি দিদি …
-কোভিড টেস্ট করিয়েছ?
– নাহ নাহ কোভিড হয়নি আমার
খুব গম্ভীর ভাবে বলতে হল - স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে করিয়ে নাও কোভিডের পরীক্ষা
– করাতে হবে? কোভিড?
আরো স্বরের তীব্রতা বাড়িয়ে জোর দিয়ে বলতে হলো – হ্যাঁ
আবার সে এসেছে ফিরিয়া। নতুন রূপে নতুন সাজে। ওমিক্রণ। আবার কানে ভেসে আসছে আধাপুরাতন নতুন শব্দর ঢেউ। লকডাউন, কন্টেনমেন্ট, মাইক্রোকন্টেনমেন্ট, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং ----
কত নম্বর হল? তৃতীয় না? সমুদ্রের পারে বসে ঢেউ গোনা সোজা। ঢেউয়ের পর ঢেউ আসে। পায়ের কাছে মিলিয়ে যায় জলের স্তর। কিছু জিনিস ফিরিয়ে দেয় পার ধরে। স্নান করতে নেমে হারিয়ে ফেলা চপ্পল। অথবা পরিধানের স্নানবস্ত্রর আকস্মিক স্থানচ্যুতি ঘটলে। সুরাধার। প্লাস্টিকের বোতল। সবকিছু ফিরে আসে না অবশ্য। সবাই ফিরে আসে না তো। কেউ কেউ কোনকিছু মিলিয়ে যায় অতল জলের গভীরতায়। মানুষের মতো।
৩০ বছরের মহিলা এলেন। ঘর পুরুষবর্জিত হলে কুণ্ঠিত স্বরে বললেন
- দিদি দুমাস মাহিনা হয়নি
- টেস্ট করেছ?
- নাহ দিদি করিনি
- কেন? দুমাস হয়নি যখন করবে তো
- দিদি স্বামী আমার সঙ্গে থাকে না। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তাই টেস্ট করিনি …
একথা সেকথা বলার পর বোঝানো গেল স্বামীর সঙ্গে সহবাস না করলেও প্রেগন্যান্সি টেস্টটা একবার করানো উচিত। অন্যান্য টিউমার জাতীয় সমস্যা হলেও ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে। রাজিও করানো গেল। অন্তত মুখে রাজি হল। করাবে কি না সে একমাত্র চারদেওয়ালই বলতে পারবে।
পারে বসে ঢেউ গুনছি। প্রথম ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে জীবনের নিশ্চয়তা। প্রথমবার নিউ নর্মালে বাঁচতে শুরু করে হারিয়ে গেল আর্থিক সম্বল। ব্যবসা বন্ধ হল। কাজ চলে গেল। লকডাউন শেষে দেখলাম চেনা পেন খাতার স্টলটা আর খুলল না। খুলবেও না। বদলে তৈরি হল নতুন দোকান। দোকানদার কাকু হারিয়ে গেল। খোঁজ রাখেনি কেউ। ঢেউ ফেরত দিয়ে গেল পরিযায়ী শ্রমিকদের হেঁটে ফেরার মাইলের পর মাইল রাস্তা। হাইরাইজ সোস্যাইটি যখন কমপ্লেক্সের দরজা আটকে ঢেউ সামলালো, ছাদে বসে দেখতে পেলাম স্টেশনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে বোঁচকা কাধে কিছু মানুষ। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি পৌছোল তাঁরা। কেউ বা পৌঁছোল না। হাইওয়ের ধারেই শেষবার নিশ্বাস পড়ল তাদের। অথচ সরকারি মতে মৃত পরিযায়ী শ্রমিকদের তো কোন তথ্যই নেই। ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সেইসব তথ্যকে। সরকারের চোখে, সমাজের চোখে ওরা চিরকাল অনামীই থেকে গেল। অনামীই থেকে যায়।
ভদ্রমহিলা এখনো বসে আছেন। লিখে যাচ্ছি পেস্ক্রিপশন। হাতের লেখার যারপরনাই উন্নতি হয়েছে। কিছুদিন পরেই দেখব কেউ ফেসবুকে ছবি তুলে জিগ্যেস করছে এটা কি লেখা আছে আবিষ্কার করলে ২০ টাকা দেওয়া হবে।
-ছাড়াছাড়ি কেন হল?
-অশান্তি হত খুব।
-কি নিয়ে?
- খুব রাগ। ছোট খাটো সমস্যা নিয়ে রেগে যেত। গেল বছর লকডাউনে কাজটাও চলে গেল। তারপর অশান্তি খুব বেড়ে গেল।
- কি করত? মারত?
- হ্যাঁ ওই আর কী …
এরপরের কথা গুলো না বলাই থাকে। ঘরে লোক চলে আসে। কে বলেছে নীরবতা শান্তি। তার থেকে হঠাৎ করে কেউ এসে কথার রেশে টান মারলে হয়তো বেঁচে যাওয়া যায়। বেঁচে না গেলেও পালিয়ে যাওয়া যায়।
তবু মানুষ বেঁচে গেল। আবার এল পরের ঢেউ। টেনে নিয়ে গেল অনেককে, অনেক মানুষকে। প্রাণে না মারলেও পাকস্থলীতে। অক্সিজেন না পেয়েও যে মানুষ মরতে পারে প্রথমবার অনুধাবন করলাম। আবার ঢেউয়ে ফিরে এল সেই মানুষই। ফিরিয়ে দিল সেই মানুষকেই। পাশে দাঁড়ানোর মনুষত্ব্য নৈতিকতা যে এখনো বেঁচে আছে – সেই চেতনাকে ফিরিয়ে দিল। ফিরিয়ে দিল একসাথে বেঁচে থাকার, বাঁচতে শেখার সেই পাঠ। আদি ও অকৃত্রিম সেই শিক্ষা – মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ জীব ।
২৫-২৬ বছরের মেয়ে। সদ্য এক বাচ্চার জন্ম। বাচ্চা সামলাতে গিয়ে হিমসিমে অবস্থা। তারই মাঝে বাড়িতে সেই এক অশান্তি। মুখ ফুটে কেউ বলে না মারধোরের কথা। তবু বেরিয়ে আসে হালকা কিছু তিক্তরস। পেকে যাওয়া পুঁজে ভরা অ্যাবসেস থেকে যেমন চলকে পড়ে।
লকডাউনে কাজকর্ম কিছুই তো পাচ্ছে না। সেলাইয়ের কাজ করত। গেল বারের লকডাউনে সব শেষ। মাঝে যাও বা পেত এখন তো আবার সব বন্ধ
- চলছে কী করে?
- এতদিন তো ব্যাঙ্কে যেটুকু ছিল তুলে চলছিল। জানিনা এরপর কি করব। ঐজন্যই তো আরো রেগে আছে। মন মেজাজ ভাল নেই কি না।
ভালোবাসা? অধিকার? নির্যাতন? মেনে নেওয়া? মানিয়ে নেওয়া? ডিফেন্স? নির্যাতনকারী স্বামী? দায়মুক্ত সমাজ? পিতৃতন্ত্র? গার্হস্থ্য হিংসা? সংসারের রোজকারের ঝামেলা?
মারীর দেশে কী শুধুই ওমিক্রণ আসে? ঢেউ কি শুধু পা ভিজিয়ে দেয়? ফিরিয়ে দেয় আমাদেরই ফেলা আবর্জনা, বর্জ্য। সবকিছুই ফিরে আসে। নিজেদের তৈরি করা প্রত্যেকটা আবর্জনার শেষ টুকরোটাও।
আবারও পেশেন্ট দেখা চলল। এর মাঝেই বর্ষা। আগেরদিনই এক বন্ধু ফোনে বলছিল জলবায়ু আবহাওয়া এসব এখন অতীত। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা বৃষ্টিই শেষ কথা।
ফেরত পথে মনে হল। মারীর ঢেউ আবার ফিরিয়ে দিচ্ছে। ফিরিয়ে দিচ্ছে না শোনা চড় থাপ্পড়, রাতের বেলার চিৎকার কান্না। ঢেউয়ের গর্জনে শোনা যায় না কিছুই। অথচ ফিরে ফিরে আসে সবকিছুই ।
ঠিক পায়ের তলায় ।
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ১৮ জানুয়ারি ২০২২
লেখক : সমাজকর্মী, চিকিৎসক
0 Comments
Post Comment