- 15 March, 2023
- 0 Comment(s)
- 423 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে মায়ানমারের রাখিন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার শুরু হয়। যদিও তাঁদের অস্তিত্ব নিয়ে সামরিক ও রাজনৈতিক টানাটানি বহুদিন ধরেই চলে আসতে পেরেছে, তবুও বিশেষ করে বলতে গেলে সাম্প্রতিক অতীতে নভেম্বর ২০১৬’র ঘটনাই সবচেয়ে বেশি করে প্রচারমাধ্যমে উঠে এসেছিল। সেই সময় রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রাক্তন মহাসচিব কোফি আন্নানের নেতৃত্বাধীন কমিটি মায়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধ ও শান্তি ফেরানোর প্রশ্নে সক্রিয় ভূমিকা নিতে চাইলেও, শেষমেশ তা কাজে আসেনি। সমসাময়িক রাষ্ট্রীয় ভোট রাজনীতির হিসেবে, ‘বিশ্বের বিবেক’ হিসেবে বন্দিত নেত্রী নোবেলজয়ী আং সান সূ চি অবধি সেই সময় রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে অনীহা প্রকাশ করেন। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতার একটি ছোট পত্রিকায় রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আমি প্রথম একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। সেখানে অন্য সব কিছুর সঙ্গে আং সান সূ চি’র অবস্থান প্রসঙ্গেও কড়া নিন্দাবাক্য প্রয়োগে পিছপা হইনি। আজ সেখান থেকেও আমরা প্রায় আরও সাত বছর পেরিয়ে এসেছি। সামরিক অভ্যুত্থানের পরবর্তীতে এখন আং সান সূ চি’ও জেলবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। কেবল বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খবর। বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে যে অবর্ণনীয় অবস্থায় তাঁরা থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, সেই খবর বিভিন্ন সময়েই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তরফে তাদের প্রতিবেদনে উঠে আসতে পেরেছে। শরণার্থী, উদ্বাস্তু, অনুপ্রবেশকারী – এই শব্দগুলি এখন রাজনৈতিক মন্ত্রের মতোই একত্রে উচ্চারিত হয়ে থাকে। গড়ে উঠতে শুরু করে অসহায়ের বিরুদ্ধে অল্পশিক্ষিত, অকর্মণ্য অথচ বিপুল সংখ্যাতে যাদের উপস্থিতি, তেমন একেকটি জনতার সেনাদল। ইংরেজিতে আমরা যাদেরকে ‘মব’ বলে চিহ্নিত করে থাকি। আমাদের তখন মনে পড়ে ১৯৩৮শের আরেক নভেম্বর। অথবা মনে পড়ে পেহলু খান, মহম্মদ আখলাখদের খবর। নভেম্বর ১৯৩৮শে, নাইট অব দ্য ব্রোকেন গ্লাস অথবা ক্রিস্ট্যালনাখটের সেই রাতে, যেই রাত্তিরে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর কর্মীরা, সরকারি সমস্ত সুবিধাকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করেছিল দেশজুড়ে ইহুদী বিতাড়নের উদযাপন। এক রাত্তিরেই শেষ হয়ে গিয়েছিল অসংখ্য পরিবার। পরের পর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁদের বাসস্থান, উপাসনাগৃহ, ব্যবসার জায়গা ইত্যাদি সবকিছুই। বিভাজনের রাজনীতির চরমতম অবস্থায় পৌঁছনোর সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমাদের দেশেও যে ইঙ্গিত কেবল সেই দিকেই যেতে শুরু করেছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে প্রয়োজন ছিল রোহিঙ্গাদের নিয়ে, বিশেষত এক রোহিঙ্গা নারীকে নিয়েই আরও বেশি করে লেখার। তার সাফল্যকেই আরও বেশি করে আনন্দের সঙ্গে উদযাপন করার।
তাসমিদা জোহরের কথা বলব। ২০০৫ সালে গণহত্যার হাত থেকে বাঁচতে মায়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছিল তাসমিদা। মায়ানমারের মাটিতে রোহিঙ্গা হিসেবে বেঁচে থাকা এক অবর্ণনীয় ঘটনা। সামাজিক বা রাজনৈতিক কোনও ক্ষেত্রেই তাদের অস্তিত্ব জাহির করতে দেওয়া হয়না। চাকরি জোটে না কোনওখানেই। ভোটাধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত। এহেন অবস্থা থেকে পালিয়ে এসে তাসমিদার পরিবার কক্সবাজারে, পৃথিবীর বৃহত্তম উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নেয়। মায়ানমারের শিক্ষা সংক্রান্ত নথিপত্র বাংলাদেশে স্বীকৃত না হওয়ায় তাসমিদাকে আবার প্রথম শ্রেণী থেকেই পড়াশোনা শুরু করতে হয়। ২০১২ সালে ভারতে চলে আসে তাসমিদার পরিবার। প্রথমে হরিয়ানার শরণার্থী শিবির, পরে দিল্লীর এক আত্মীয়ের বাড়িতে তারা থাকতে শুরু করে। এরই মধ্যে তাসমিদা পড়াশোনা চালিয়ে যায়। দূরশিক্ষার মাধ্যমে হলেও, তার অদম্য জেদ ও পরিশ্রমের ফলস্বরূপ, গত বছর, ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশের মধ্যে প্রথম মহিলা রোহিঙ্গা গ্র্যাজুয়েট হিসেবে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে স্নাতক শংসাপত্র পেয়েছে। এখানেই শেষ নয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের বিভিন্ন কর্মসূচীর সহায়তায়, সে এই মুহূর্তে কানাডার উইলফ্রিড লরিয়ের ইউনিভার্সিটির তরফে বিশেষ এক মনোনয়ন পত্রের অপেক্ষা করে রয়েছে। সেই মনোনয়ন প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হলে পরেই, সব কিছু পরিকল্পনা মাফিক এগোলে আগামী আগস্টেই তৃতীয়বারের জন্য আবারও ‘দেশ’ত্যাগী হয়ে, এবারে সুদূর কানাডায় পাড়ি জমাবে তাসমিদা। তবে এই যাত্রা আর আগেকার সমস্ত ঘটনার মতো আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা বুকে নিয়ে হবে না। এবারের উড়ান হবে আশার অভিমুখে, আত্মবিশ্বাসের অভিমুখেই।
তাসমিদার দাদাও এই দেশের মধ্যে প্রথম রোহিঙ্গা যুবক, যে কিনা স্নাতকোত্তরের গণ্ডি পেরিয়েছে। রোহিঙ্গা শব্দটা আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে অনেক সভ্যবৃত্তেও উচ্চারিত হলে পরে কেমন যেন একটা নিস্তব্ধতা নেমে আসে। দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে কারও বা কোনও সম্প্রদায়ের বেঁচে থাকা আজ আর নতুন ঘটনা নয় আমাদের দেশ বা পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই। বারংবার সেই কারণেই বোধহয় আমাদের ক্রিস্ট্যালনাখটের রাত মনে পড়ে। এক গোষ্ঠীর উপরে আরেক গোষ্ঠীর প্রভুত্ব, এক জাতির বিপরীতে আরেক জাতির শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের নীচতম উদাহরণ। সেই খেলা কিন্তু অন্য অনেক দেশের পাশাপাশিই আমাদের দেশেও শুরু হয়ে গিয়েছে। এখানে তাই রোহিঙ্গা মানুষদের নিয়ে আলোচনা করাও, কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্ম দেয়। সেই কারণেই রোহিঙ্গা নিয়ে আলোচনা করা উচিত। সেই কারণেই তাসমিদার সাফল্যকে উদযাপন করা উচিত।
বহু দশক ধরে এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পরিচয় ‘স্টেটলেস এনটিটিস’ হিসেবে, ‘রাষ্ট্রহীন বস্তুসমূহ’ হিসেবে। নাগরিক তো দূরস্ত, সরকারি পরিভাষাতেই তারা ‘এনটিটিস’ বা ‘দ্রব্যাদি’, ‘বস্তুসমূহ’ হিসেবে পরিগণিত হয়। এমন বিশেষণেরই আমরা স্বাভাবিকীকরণ করেছি। আজ নতুন করে নয়, অনেক বছর আগে থেকেই এই স্বাভাবিকীকরণের সূত্রপাত। আমরা কক্সবাজারের দুর্গন্ধময় শরণার্থী শিবিরকে মনে রাখি। সেই দুর্গন্ধের দায়টুকুকেও উদ্বাস্তু মানুষগুলোরই উপরে চাপিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করি না। তাসমিদাদের জন্য রাখা থাকে কেবল নারীদিবসের সংবাদপত্রে শেষের এক কলম।
এই কারণেই তাসমিদার কথা বলতে চেয়েছিলাম। রোহিঙ্গাদের দেখা হোক মানুষ হিসেবে, শরণার্থী হিসেবে, উদ্বাস্তু হিসেবে। কোনও ধর্মীয় পরিচিতিতে নয়, কোনও পূর্বনির্ধারিত অন্ধবিশ্বাসের চশমা দিয়ে নয়, কোনও বিদ্বেষের ভ্রু-ভঙ্গি থেকে নয়। সবাইকে মানুষ হিসেবে সাদা চোখে দেখতে গেলে পরে, একেকজনের তরফে কিসেরই বা যে এত অসুবিধা, এত বিদ্বেষের জন্ম হয়, বুঝে উঠতে পারি না। সেই সময়গুলোতে ‘আগন্তুক’ সিনেমার মনোমোহন মিত্রকেই আবারও করে মনে পড়াতে ইচ্ছে হয়। ধর্ম মানেন কিনা এই প্রশ্নে যে মানুষ স্বচ্ছন্দে উত্তর দিয়েছিলেন, “যে জিনিস মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে, আমি তাকে মানি না। এই একই কারণে আমি জাতও মানি না।”
আজ কেবল তাসমিদারাই আরও এগিয়ে যাক।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment