রো বনাম ওয়েড – কিছু ভাবনা, কিছু প্রতিবেদন

  • 17 July, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 380 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
 বিজ্ঞান ও প্রগতির বিপরীতে আজও যে মধ্যযুগীয় ভাবধারারই জিত, রো বনাম ওয়েডের ফলাফল আমাদেরকে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আমেরিকার উদাহরণকে বারেবারেই নানা প্রবন্ধে তুলে আনতে চাইছি তার কারণ, যাঁরা সবকিছুতেই পশ্চিমের বিষয়ে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করতে অভ্যস্ত তাঁদেরকে একথা মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে – স্যামচাচার দেশেও প্রদীপের তলাতেই রয়েছে অন্ধকার। গর্ভপাতের সপক্ষে আন্দোলন আদতে বিজ্ঞানসম্মত চিন্তার সপক্ষে আন্দোলন, বিজ্ঞানমুখী আন্দোলন।

এর আগের একটি প্রবন্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে সদ্য নিযুক্ত প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা বিচারপতি কেটাঞ্জি ব্রাউনকে নিয়ে লিখতে গিয়ে রো বনাম ওয়েড মামলার প্রসঙ্গ এসেছিল। মামলাটির সম্পর্কে, অথবা তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কেও, মনের মধ্যে ভাসাভাসা একটা ধারণা ছিল বটে, কিন্তু প্রবন্ধ লেখার পক্ষে তা যথেষ্ট ছিল না। সম্প্রতি বিশ্বখ্যাত নেচার পত্রিকাগোষ্ঠীর একাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত বেশ কিছু প্রবন্ধের দিকেই এই সূত্রে নজর গিয়ে পড়ল। রো বনাম ওয়েডের ফলাফল নিয়ে কেবল যে মার্কিনি জনতাই আড়াআড়ি ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে তাই নয়, সেদেশের বিজ্ঞানী, গবেষক, স্বাস্থ্যকর্মী, অথবা চিকিৎসক-সমাজের মধ্যেও কার্যত এক আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সেদেশের সুপ্রিম কোর্টের সম্মুখে লাগাতার বিক্ষোভ আন্দোলনে মহিলারা শামিল হয়েছেন। আরও দীর্ঘ লড়াইয়েরই সলতে পাকানোর কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু এমন আতঙ্কেরই বা কারণ কি? ঠিক কোন যুক্তিতেই বা মার্কিনি প্রগতিশীল মহিলা-সমাজ, বিজ্ঞানী, গবেষক, চিকিৎসকেরা সবাই এমন ভাবে পথে নেমে এলেন? সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজতে চেয়ে এই প্রতিবেদন।

 

১৯৭৩ সালে রো বনাম ওয়েড মামলার রায় দিতে গিয়ে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট মায়ের শরীরে গর্ভধারণের পর ২২ থেকে ২৪ সপ্তাহ সময় অবধি (অর্থাৎ কি না যে সময়ের পর থেকে মানবভ্রূণ বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মাতৃগর্ভের বাইরেও প্রাণধারণ করতে পারে) গর্ভপাতের অধিকারকে যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সম্প্রতি, জুন ২০২২এ এসে, পাঁচ দশক পর অন্য একটি মামলার রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট রো বনাম ওয়েডের সিদ্ধান্তকে পরিবর্তন করেছে। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে গর্ভপাতের অধিকার আর যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পাবে না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি নির্দিষ্ট রাজ্য তাদের নিজস্ব গর্ভপাত-বিষয়ক আইন প্রণয়ন করতে পারবে। এই রায় ঘোষিত হওয়ার অনেক আগে থেকেই মিসিসিপি প্রদেশের আইনপ্রণেতারা গর্ভধারণের পর ১৫ সপ্তাহের চেয়ে বেশি সময় কেটে গেলে পরে আর গর্ভপাত করা যাবে না, এমনই একটি আইন জারি করেন। সেই আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করা হয়। স্বেচ্ছায় গর্ভপাতের পক্ষে ১৫০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান এই মামলায় ‘এ্যামিকাস’ বা ‘আদালত-বন্ধু’ হিসেবে নিজেদের বক্তব্য পেশ করার ইচ্ছে প্রকাশ করে। এছাড়াও সারা দেশেই বহু সংখ্যক বিজ্ঞানী, গবেষক, স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক, বা তাঁদের প্রতিষ্ঠানগুলি নিজেদের মতো করে, নিজেদের নানাবিধ উদ্যোগেই এই প্রসঙ্গে তাদের বক্তব্য প্রকাশ করে। সেই বক্তব্যগুলি থেকেই যে সমস্ত তথ্য উঠে এসেছে, সেগুলিকেই এখানে পেশ করতে চাইব।

 

এখন রো বনাম ওয়েড মামলার রায় পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াকিবহাল মহলের মানুষেরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অন্ততপক্ষে ১২টি রাজ্য বৈজ্ঞানিক উপায়ে, চিকিৎসাগত অথবা ব্যক্তিগত কারণে গর্ভপাত নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে, নয়তো বা হাজারো নিয়মের গণ্ডিতে সমগ্র প্রক্রিয়াটিকে এতটাই জটিল করে তুলবে যে, সাধারণ মানুষ আর সেই সুবিধে ভোগ করতে পারবে না। এর বাইরেও, আরও অন্তত ৮ থেকে ১০টি রাজ্য এগুলিরই পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। অর্থাৎ কি না নরমে-গরমে গর্ভপাত বিরোধী আইন প্রণয়নের পথে হাঁটবে। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি এমনটাই হয়ে দাঁড়াবে, এই সমস্ত রাজ্যে যেখানে গর্ভপাত বন্ধ করে দেওয়া হবে, সেই সমস্ত রাজ্যের মহিলাদের একান্তই গর্ভপাত করাতে গেলে পরে – গড়ে ৪৫০কিলোমিটার দূরবর্তী কোনও অন্য রাজ্যের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে সেই পরিষেবার সুযোগ নিতে হবে, এমন রাজ্যে যেখানে কি না গর্ভপাত নিষিদ্ধ নয়। এর ফলে গড়ে প্রতি বছরে অন্ততপক্ষে এক লক্ষ মহিলা আর্থিক অথবা আইনগত কারণে গর্ভপাতের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। গর্ভপাতের বিরোধীরা সেদেশে বলে থাকেন গর্ভপাত করাতে গেলে নাকি মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভপাতের সময় মৃত্যুর চেয়ে কোলনোস্কোপি করাতে গিয়ে মৃত্যুর হার অন্ততপক্ষে ৪গুণ ও জন্মের সময়ে শিশুমৃত্যুর হার অন্ততপক্ষে ১৪গুণ বেশি। হ্যাঁ সঠিকই পড়েছেন, ভারতবর্ষ নয় – এই তথ্য আমেরিকার। স্যাম চাচার গরীয়ান অর্থনীতির খতিয়ান! গর্ভপাত বিরোধীরা বলে চলেছেন, গর্ভপাত করালে পরে মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। অন্তত ৪০টি গবেষণাপত্রকে উল্লেখ করে গবেষকেরা দেখিয়েছেন গর্ভপাতের কারণে শারীরিক অথবা মানসিক কোনও ক্ষতির ঘটনা ঘটেনি। পক্ষান্তরে ২০১৯এ প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে, গর্ভপাত করাতে চেয়েও করাতে পারেননি – এমন ৯০০জন মহিলা দীর্ঘমেয়াদী মাথা যন্ত্রণা ও হাড়ের ব্যথায় কষ্ট পেয়েছেন।

 

গর্ভপাতের বিরোধীরা বলতে চেয়েছেন গর্ভ-নিরোধক ওষুধ ইত্যাদি থাকার পরেও কেনই বা অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ ঘটবে? এমন বিজ্ঞানের যুগেও কিই বা প্রয়োজন গর্ভপাতের মতো এমন একেকটি পরিষেবার? অর্থনীতিবিদেরা এই সূত্রে এগিয়ে এসেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন ৪৫বছরের চেয়ে কমবয়স্ক মার্কিনি মহিলাদের মধ্যে অন্ততপক্ষে ৪জনে ১জন এই বয়সকালের মধ্যে অন্তত একবার হলেও গর্ভপাত করিয়েছেন। গরিব আমেরিকানদের মধ্যে গর্ভ-নিরোধক ওষুধ বা ইত্যাদির প্রসঙ্গকে এখনও অলীক কল্পনাই বলা যেতে পারে। ২০১১ সালের তথ্য বলছে ফেডেরাল দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মহিলারা, অন্য মহিলাদের তুলনায় ৫গুণ বেশি অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের সমস্যায় ভোগেন। দারিদ্রসীমার নীচে থাকা এই সব মহিলাদের মধ্যেও আবার এক-চতুর্থাংশই হলো কৃষ্ণবর্ণের। তথ্য বলছে, ‘সব-পেয়েছি’র এই দেশে – স্যামচাচার এই ভরভরন্ত সোনার সংসারে – কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের মধ্যে মাতৃত্বজনিত মৃত্যুর হার উচ্চ-আয় সম্পন্ন দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি – প্রতি এক লক্ষ কালো মায়েদের মধ্যে আমেরিকায় মাতৃত্বজনিত মৃত্যুর হার ৪৪। গর্ভপাত করাতে চেয়ে ব্যর্থ হওয়া এমন ৫৬০জন মায়েদের মধ্যে চালানো একটি সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, তাঁদের মধ্যে ৭৮%ই গর্ভপাত করাতে না পেরে নানা কারণবশত আরোই ঋণের জালে জড়িয়ে গিয়েছেন। ৮১% মানুষ ঋণ শোধ করতে না পারার কারণে উচ্ছেদ হয়েছেন। আলোর নীচেই রয়েছে গভীরতম অন্ধকার। খাস আলোর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাঁড়িয়েও, এমনই শুনতে হয়েছে আজ – আর্থিক কারণে, সন্তানকে মানুষ করতে পারবেন না বলেই – অনেক মানুষ, অনেক মায়েরা গর্ভপাতের পথ বেছে নেন। কিন্তু রাষ্ট্রের উচিত তাঁদের সেই মনোভাবকে স্বীকৃতি দেওয়া। এই সময়ের আমেরিকায় একটি শিশুকে ঠিক ভাবে বড় করে তুলতে গেলে পরে বার্ষিক অন্তত ১০,৪০০ ডলারের খরচ বহন করতে হয়। এই বৈষম্যকে পালটানোর দায় কার? এও দেখা গিয়েছে গর্ভপাত করাতে চাওয়া মায়েদের ৭৫%ই নিম্নবিত্ত ঘর থেকে এসেছেন। তাঁদের পাশে না দাঁড়িয়ে, সমাধান না বাতলিয়ে কেবল ঈশ্বরপ্রদত্ত উপহারের গল্প শুনিয়ে তাদের উপরে মাতৃত্ব বোঝাটিকে চাপিয়ে দিলে পরেই যেন বা সমস্ত সমস্যারই একটা সমাধান মিলবে – এই মানসিকতাকে পালটানো প্রয়োজন এখন।

 

বিজ্ঞানী-গবেষকেরা আরোই চিন্তাগ্রস্ত, একে তো সেদেশেও উচ্চশিক্ষিত জনগণের সুস্থিত চাকরি পাওয়ার বিষয়টি যথেষ্ট রকমেই অনিশ্চিত। এরই সঙ্গে যদি ২০ থেকে ২২টি রাজ্যে গর্ভপাত নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে যদি চাকরির দরখাস্তই না করতে পারা যায়, তাহলে আর ভবিষ্যতের ভাবনার জন্য কিই বা পড়ে থাকছে!

 

এমন আধুনিক, এমন প্রগতিশীল একটি দেশেও এমনতরো অবৈজ্ঞানিক-মানসিকতারই প্রভাব, এমনতরো অবৈজ্ঞানিক-মানসিকতারই রাজত্ব। টেক্সাস রাজ্য থেকে শোনা যাচ্ছে সেখানে নাকি গর্ভধারণের ৬ সপ্তাহ সময় পর থেকেই গর্ভপাত নিষিদ্ধ ঘোষণা হতে চলেছে। হয়তো বা ইতিমধ্যে তা হয়েও গিয়েছে। যে সময়ের ভিতরে অনেক ক্ষেত্রে মায়েরাই খবরটিকে ভালো ভাবে, নিশ্চিত করে জানতে পারেন না। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত পরিকল্পনা সফল হয়েছে। তিন-তিনজন রক্ষণশীল বিচারপতিকে সুপ্রিম কোর্টে জায়গা করে দেওয়ার পরবর্তীতে, বিজ্ঞান ও প্রগতির পথটিকে তিনি কার্যত রুদ্ধ করে দিয়েছেন। বিজ্ঞান ও প্রগতির বিপরীতে আজও যে মধ্যযুগীয় ভাবধারারই জিত, রো বনাম ওয়েডের ফলাফল আমাদেরকে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আমেরিকার উদাহরণকে বারেবারেই নানা প্রবন্ধে তুলে আনতে চাইছি তার কারণ, যাঁরা সবকিছুতেই পশ্চিমের বিষয়ে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করতে অভ্যস্ত তাঁদেরকে একথা মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে – স্যামচাচার দেশেও প্রদীপের তলাতেই রয়েছে অন্ধকার; আর এর বিপরীতে এই দেশ বা মহাদেশেরও নিপীড়িত, শোষিত নারীসমাজকে এই বলেই উদ্বুদ্ধ করা উচিত যে – তোমরা একা নও কোথাও। সবদেশে, সবকালে, সবক্ষেত্রেই তোমাদেরকে লড়াই করে বাঁচতে হয়। সেই লড়াইয়ের মধ্যেই তোমাদের স্বীকৃতি। গর্ভপাতের সপক্ষে আন্দোলন আদতে বিজ্ঞানসম্মত চিন্তার সপক্ষে আন্দোলন, বিজ্ঞানমুখী আন্দোলন। বিজ্ঞানবিরোধী এই রায় আদতে সারা পৃথিবীর কাছেই নারীর অধিকার আন্দোলনের গুরুত্ব আবারও নতুন করে প্রতিষ্ঠা করল। সামাজিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, মুক্ত চিন্তার অধিকার ও নিজস্ব সিদ্ধান্তের অধিকার – এই সমস্ত’কটি অধিকারেরই বিষয়ে সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তাই, আন্দোলনের কোনও বিরাম নেই। মেয়েরা এখনও মানুষ হওয়ার জন্য লড়ে যাচ্ছে।

 

সূত্রঃ https://www.nature.com/articles/d41586-021-02834-7

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment