হে স্বপ্রকাশ!

  • 29 April, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 926 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
দর্শনের গূঢ়ত্বে যেতে চাইছি না – কেবল সেই খ্রিস্ট-পূর্বাব্দ যুগের একজন নারীকে মনে পড়াতে চাইছি, যিনি প্রশ্ন করেছিলেন তাঁর পুরুষকে। ... অথবা, আমরা ফিরে দেখতে চেষ্টা করছি ৭০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দের কোনো এক ঋষিকন্যার নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াটিকে--যেখানে রয়েছে জল থেকে বাতাসে, বাতাস থেকে আকাশে, আকাশ থেকে আদিত্যে – ধাপে ধাপে ভাঙতে ভাঙতে সত্যকে জানবার, সত্যের শেষ সীমান্তে পৌঁছোবার এক নিরন্তর প্রয়াস। নারীর বিজ্ঞানচর্চার বিষয়ে ধারাবাহিক। (পর্ব ২)

অসতো মা সদ্গময়

তমসো মা জ্যোতির্গময়

মৃত্যোর্মামৃতং গময় ...

 

আবিরাবীর্ম এধি

রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং

তেন মাং পাহি নিত্যম ...

 

অসত্য থেকে সত্যে, অন্ধকার থেকে আলোয়, মৃত্যু থেকে অমৃতে – ঋষিবাক্যে বর্ণিত যাত্রাপথ। কতজনেই বা সেই পথে হাঁটতে চেষ্টা করি ? আমাদের যে মায়াতেই মৃত্যু, মারের হাতেই অবনতি। অন্ধকারের পথে উলকাবস্তুর সহজ কটাক্ষপাত, আর সেই সহজের পথে হাঁটতে গিয়েই সত্যকে নির্বিচারে অস্বীকার। ফাঁকতালের বিশ্বকাপে মারাদোনার ‘হ্যান্ড অব গড’-এর ঝলক। সত্যই বা কি, আর অমৃতই বা কোথায় ? বিজ্ঞানের আলোচনায় এমনভাবে দর্শনতত্ত্বকে এনে ফেলতে চাইলাম কেন, শীঘ্রই তার কৈফিয়ত পাবেন। শুরুর আগে কেবল একটিবার গুরুদেবকে স্মরণ করি চলুন।

 

“মৈত্রেয়ী তখন একমুহূর্তে বলে উঠলেন – যেনাহং নামৃত স্যাম কিমহং তেন কূর্যাম। যার দ্বারা আমি অমৃতা না হবো তা নিয়ে আমি কি করবো। এ তো কঠোর জ্ঞানের কথা নয় ... উপনিষদের সমস্ত পুরুষ ঋষিদের জ্ঞানগম্ভীর বাণীর মধ্যে একটিমাত্র স্ত্রীকন্ঠের এই একটিমাত্র ব্যাকুল বাক্য ধ্বনিত হয়ে উঠেছে এবং সে ধ্বনি বিলীন হয়ে যায়নি ... মানুষের মধ্যে যে পুরুষ আছে উপনিষদে নানা দিকে নানা ভাবে আমরা তারই সাক্ষাৎ পেয়েছিলুম, এমন সময়ে হঠাৎ একপ্রান্তে দেখা গেল মানুষের মধ্যে যে নারী রয়েছেন, তিনিও সৌন্দর্য বিকীর্ণ করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ...”

 

[‘শান্তিনিকেতন প্রবন্ধমালা’, প্রথম খন্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

 

প্রশ্ন, অমৃত কী ? কীভাবে তা পেতে হয়! প্রথম প্রশ্ন। পুরুষকে প্রশ্ন, স্বামীকে প্রশ্ন। অর্থ-সম্পত্তিকে দূরে সরিয়ে রেখে প্রশ্ন। জ্ঞানের প্রশ্ন। জ্ঞান ও প্রশ্ন। পরস্পরের পরিপূরক। প্রশ্নকে বাদ দিয়ে জ্ঞানার্জন অসম্ভব। তা অসম্পূর্ণ, তা শূন্য। কাজেই মৈত্রেয়ীকে আমরা বিজ্ঞানী না বললেও, প্রথম প্রশ্নকার হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। উপনিষদের সমস্ত পুরুষ ঋষিকন্ঠের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, যিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, স্বামী যাজ্ঞবল্ক্যের সমস্ত সম্পদকে প্রত্যাখ্যান করে – প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, “যেনাহং নামৃত স্যাম কিমহং তেন কূর্যাম। যার দ্বারা আমি অমৃতা না হবো তা নিয়ে আমি কি করবো ?” যাজ্ঞবল্ক্য সে প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন।

 

বৃহদারণ্যক উপনিষদ। দ্বিতীয় অধ্যায়ের চতুর্থ ও পঞ্চম ব্রাক্ষ্মণে লিপিবদ্ধ রয়েছে ‘মৈত্রেয়ী যাজ্ঞবল্ক্যের মধ্যেকার কথোপকথন’। বলা হয় যে এই কথোপকথনের মাধ্যমেই আত্মা ও ব্রক্ষ্ম (যা কিনা আবার যাজ্ঞবল্ক্যের বচন অনুসারে পরম সত্যরূপ) তাদের প্রকৃতি ও একত্বের বিষয়টিকে স্পষ্টত নির্দেশ করা হয়, যা কিনা অনেক পরবর্তীতে প্রতিভাত হবে অদ্বৈতবাদ হিসেবে। এই বিশেষ উপনিষদটির রচনাকাল আনুমানিক ৭০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দ। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের বক্তব্যেও মূল উপনিষদগুলির রচনাকাল হিসেবে ৮০০ থেকে ৩০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দ অবধি এই সময়কালকে নির্দেশ করা হয়েছে। দর্শনের গূঢ়ত্বে যেতে চাইছি না – কেবল সেই খ্রিস্ট-পূর্বাব্দ যুগের একজন নারীকে মনে পড়াতে চাইছি, যিনি প্রশ্ন করেছিলেন তাঁর পুরুষকে। সেই ‘মৈত্রেয়ী যাজ্ঞবল্ক্যের মধ্যেকার কথোপকথন’ অনুসারে যিনি ঋষির জবাবের প্রত্যুত্তরে - নিজের মতো করে আরও যুক্তি সাজিয়েছিলেন, এবং একেকটি ক্ষেত্রে ঋষিবাক্যের বিপরীতেও বক্তব্য রেখেছিলেন। এটিকে আমরা সার্থক অর্থে ‘বিরোধিতা’ বলছি না, কারণ দেখা যাচ্ছে যে ঋষি সেই বক্তব্যকে গ্রহণ করেছিলেন। সব অর্থেই ‘মৈত্রেয়ী যাজ্ঞবল্ক্যের মধ্যেকার কথোপকথনের’ মধ্য দিয়ে একটি সার্থক প্রশ্নোত্তরের চিত্রই প্রতিভাত হতে পেরেছিল। এই কথোপকথনের মাধ্যমেই ব্রক্ষ্মরূপী সত্যকে উপলব্ধি করা গিয়েছিল, আর সেই সত্য বা জ্ঞানকে আহরণের ক্ষেত্রে - প্রশ্ন এবং আরও প্রশ্নকেই একমাত্র ভিত্তি রূপে ভাবতে পারা গিয়েছিল। যাজ্ঞবল্ক্য সহিষ্ণুতার সঙ্গে পত্নীর সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিতে চেষ্টা করেছিলেন। এ প্রশ্ন ছিল কেবল অমৃতের, ব্রক্ষ্মের, প্রেমের – কিন্তু সৃষ্টিতত্ত্বের গূঢ়তর প্রশ্নের মুখে কেমন ছিল সেই ঋষিবরের প্রস্তুতি ? জানতে হলে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে পরবর্তী অধ্যায়ে। বৃহদারণ্যকের তৃতীয় অধ্যায়ে, ষষ্ঠ ব্রাক্ষ্মণের আলোচনায় ...

 

প্রশ্নঃ জলের উপাদান বা একক কী ?

উত্তরঃ জলের একক হল বাতাস।

প্রশ্নঃ তাহলে বাতাসের উপাদান কী ?

উত্তরঃ বাতাসের উপাদান আকাশ।

প্রশ্নঃ তবে আকাশের একক কী ?

উত্তরঃ আকাশের একক আদিত্য, অথবা সূর্য।

প্রশ্নঃ তাহলে সূর্যের একক কী?

উত্তরঃ সূর্যের একক হল চন্দ্র।

প্রশ্নঃ চন্দ্রের একক ?

উত্তরঃ নক্ষত্র।

প্রশ্নঃ নক্ষত্রের একক ?

উত্তরঃ দেবতাগণই নক্ষত্রের উপাদান।

প্রশ্নঃ তাহলে দেবগণের উপাদান বা একক কী ?

উত্তরঃ তাঁদের উপাদান ইন্দ্র।

প্রশ্নঃ অতঃপর ইন্দ্রের উপাদান ?

উত্তরঃ স্বয়ং প্রজাপতি।

প্রশ্নঃ আর এই প্রজাপতির একক ?

উত্তরঃ তাঁর একক হল পরম ব্রক্ষ্ম।

প্রশ্নঃ তবে সেই ব্রক্ষ্মের একক কী ?

 

আর সহ্য হল না যাজ্ঞবল্ক্যের। প্রশ্নকারকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বলে উঠলেন, “স্তব্ধ হোন হে ভদ্রে! ব্রক্ষ্মের বিষয়ে প্রশ্নের কোনো অধিকার নেই আমাদের। আপনি আপনার প্রশ্নস্রোতকে নিবৃত্ত করুন।” ঘটনাস্থল প্রাচীন ভারতবর্ষের বিদেহ (মতান্তরে মিথিলা) রাজ্য। যেখানে রাজা জনক রাজসূয় যজ্ঞের পরবর্তীতে পণ্ডিত-বিদ্বান-দার্শনিকদের এক মহামিলনক্ষেত্র আহ্বান করেছিলেন। বলেছিলেন, ঋষিশ্রেষ্ঠকে এক হাজার গ্রাম ও এক হাজার গাভী উপহার দেওয়া হবে। কেউই নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে অগ্রসর না হলে পরে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য সেই সভায় সর্বসমক্ষে অবশেষে নিজেকেই শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করেন। এরপর, রাজা জনক আটজন বিখ্যাত পণ্ডিতকে নির্দেশ দিলেন যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রশ্ন করতে। তাঁদের বিচারেই যাজ্ঞবল্ক্যের শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপিত হবে। এই আটজনের মধ্যে, একমাত্র নারী – পণ্ডিত গর্গের বিদূষী কন্যা গার্গী, যাঁর প্রশ্নেই ঋষিবর উত্তেজিত হয়ে পড়েন। উত্তেজনার কারণ পৌরুষে আঘাত, ‘সামান্যা নারী’র প্রশ্নে উত্তর খুঁজে না পাওয়া – নাকি ব্রক্ষ্মের ব্রক্ষ্মত্ব বিষয়ে রক্ষণশীলতা, ইত্যাদির বিশ্লেষণে যাব না। কেবল ফিরে দেখতে চাইব গার্গীর প্রশ্নগুলিকে। সেগুলিকে ঋষিবরের সম্মুখে তুলে ধরার বিশেষ প্রক্রিয়াটিকে, যাকে বোধহয় আমরা স্বচ্ছন্দেই বিজ্ঞান বলে ব্যাখ্যা করতে পারি।

 

বৃহৎ বস্তুর বিষয়ে অজ্ঞানতাকে দূর করতে হলে, অজানা বৃহৎ অংশটিকে ক্ষুদ্রতর অংশে ভেঙে নেওয়ার প্রক্রিয়াটি আদতে সম্পূর্ণরূপে বৈজ্ঞানিক। এভাবেই মানুষ একদিন বস্তুকে ভাঙতে ভাঙতে বস্তু থেকে ক্রমশ অণু বা পরমাণুতে গিয়ে হাজির হতে পেরেছিল। ৭০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দের সেই ঋষিতনয়ার সেই নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াটিতেও কি আমরা সেই একই পদ্ধতির আভাস দেখতে চেষ্টা করছি ? সেই একইরকম ভাবে, জল থেকে বাতাসে, বাতাস থেকে আকাশে, আকাশ থেকে আদিত্যে – ধাপে ধাপে ভাঙতে ভাঙতে সত্যকে জানবার, সত্যের শেষ সীমান্তে পৌঁছোবার এক নিরন্তর প্রয়াস। যেনাহং নামৃত স্যাম কিমহং তেন কূর্যাম – প্রশ্নের অধিকার, প্রশ্নের সাহস। ভাঙবার অধিকার, ভাঙবার সাহস, ভাঙবার পদ্ধতি। ব্যবহারিক অর্থে গার্গীকে বৈজ্ঞানিক বলা চলে কি না জানি না, কিন্তু এই সমস্যাকে ভাঙতে ভাঙতে সত্যে পৌঁছোনোর যে প্রচেষ্টা, সেই নিদর্শনকেই আজ সম্মান জানাতে চেয়েছিলাম।

 

ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যকে একই উপনিষদের একই অধ্যায়ে, পরবর্তী আরেকটি ব্রাক্ষ্মণে বিদূষী গার্গী আরও দুটি প্রশ্ন করেছিলেন। সেগুলি চরিত্রগতভাবে আরও অধিকপ্রকারে দার্শনিক। কাজেই বর্তমান আলোচনায় সেই প্রসঙ্গকে আর নতুন করে টেনে আনতে চাইছি না। কেবল যেটা এই দুই নারীর বিষয়ে বিশেষ ভাবে বলতে চেয়েছিলাম, যে - ব্যবহারিক বিজ্ঞানেরও শুরুয়াত যেখানে – অর্থে প্রশ্ন এবং সমস্যাকে ভাঙতে চেষ্টা করা, সেই দুটি ক্ষেত্রেই কিন্তু আমাদেরকে প্রথম উদ্‌বুদ্ধ করেছেন যে মহীয়সী দুজন, আজ তাঁদেরকে সরিয়ে রেখে কি নারীর বিজ্ঞানচেতনার নান্দিমুখ করা চলে ?

 

... আমরা আজ স্বচ্ছন্দেই উচ্চারণ করতে পারি, আবিরাবীর্ম এধি! অর্থে হে স্বপ্রকাশ; রুদ্রাণী যত্তে দক্ষিণং মুখং, রুদ্রাণীর যে প্রশান্ত রূপ; তেন মাং পাহি নিত্যম – তাঁহার দ্বারা সর্বদাই আমাকে রক্ষা কর। হে স্বপ্রকাশ!

 

সূত্রঃ

 

১) ‘শান্তিনিকেতন প্রবন্ধমালা’, প্রথম খন্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী

২) ‘এই জনপদে কতিপয় কালোত্তীর্ণা নারী’, পূরবী বসু, পাললিক সৌরভ, বাংলাদেশ

৩) ‘দ্য প্রিন্সিপাল উপনিষদস’, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, হার্পার-কলিন্স

পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ২ নভেম্বর ২০২০ 

 

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক

ছবি : প্রতীকী

0 Comments

Post Comment