শাপিতপুরুষ (ত্রয়োবিংশ এবং শেষ কিস্তি)

  • 01 May, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 370 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
পূর্বকথা--শ্যামল কানাডা বেরোবার মুহূর্তে চাপা কর্কশ কণ্ঠে চৈতিকে বলে, চিরজনমের মতো দেশ ছাড়ছি। আমার সাথে তো নয়-ই, ছেলের সাথেও, কোন দুর্বল মুহূর্তে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো না। সত্যিটা জানতে পারলে ছেলে থুতু দেবে তোমার আর তোমার সন্তানের মুখে। বেহুঁশ চৈতির ভেতর থেকে উগলে আসা বমির কিছু পরিমাণ ছিটকে পড়েছে শ্যামলের শার্ট-প্যান্টে। বমির এই গন্ধ কানাডায় পৌঁছুবে। যুবতী বউ ঘরে রেখে যারা কানাড়ায় এখন, তারাও যেন বমির গন্ধ পেতে পারে শ্যামলের শরীর হতে, এ ব্যবস্থা-ই যেন করে দিল চৈতি।

[৩২]

ফিরবো কি ফিরবো না : রিমা 

অয়ন বরং নিষেধ করেছিল রিমাকে। এ বাস্তবতায় এখন মোটেই উচিত হবে না সুমনের মুখোমুখি হওয়া। সমূহ বিপদ সংকেত। আটমাস চলছে। সুতরাং রিস্ক নেওয়ার খেসারত মারাত্মক হতে পারে। কমলিকা ব্যানার্জি সুমনকে চোখে চোখে রাখবে বলে কথা দিয়েছে। বরং রিমাকে কাছে পেয়ে রিঅ্যাক্ট করতে পারে সুমন। বড় কোন দুর্ঘটনাও ঘটে যেতে পারে। রুমে পিস্তল রাখার কথাটিও ভাববার বিষয়।

টানা তিনদিন কেঁদে, উতালিপাথালি করে, নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, নিজেকে ধিক্কার জানিয়ে; বিশাল অন্ধকার ও নিঃশব্দতার মধ্যে জেগে উঠে রিমা শেষমেষ সিদ্ধান্ত নিল—না, যেতেই হবে। আমাকে-ই যেতে হবে। আমি সুমনের হাতে হাত রেখে কথা দিয়েছি—আমরা একসাথে বাঁচব, আমরা এক সাথে মরব। ও এখন মরণপথের যাত্রী। আমি এভাবে স্বার্থপরের মতো দূরে সরে থাকতে পারি না। আমি অবশ্যই যাবো। কারও বাধা শুনছি না। ভেতরে যুক্তিহীনভাবে জেঁকে থাকা সুমনের প্রতি অন্ধ ভালোবাসাই শেষ সম্বল রিমার। চোখের সামনে এভাবে বিশ্বাস হারিয়ে মানুষটা মরতে বসেছে, আমার কি কোন দায় নেই? সন্তান না নেবার প্রবল জেদের কাছে হেরেই না এ নিরাময়হীন রোগে পড়ল সুমন।

যাত্রা পথ জুড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে রিমা। কত বিচিত্র সুখ-স্মৃতিই না মনছবি হয়ে চোখে ভাসে। ক্লান্তি আর বিষাদের ভারে চিড় খেয়ে ওঠে শরীর। সামান্য এদিক সেদিক হলেই লুটিয়ে পড়বে হয়ত পথেই।

টার্মিনালে বাস থেকে নেমে রিকশা নিল রিমা। রিক্সার হুক ধরে এপাশ-ওপাশ করতে করতে শেষপর্যন্ত নামল বাসার গেটে। পদ্মার এক পসলা দমকা মাতাল বাতাস সাঁই সাঁই করে ছুঁয়ে গেল রিমার শরীর। সেই সাথে মনের ভেতরে জমে থাকা মেঘও কিছুটা বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে গেল। 

পাথরের পা দুটো যেন পাহাড় ডিঙাচ্ছে এমন করে শরীর টেনে টেনে নিজেকে দরজার সামনে দাঁড় করায় রিমা। একটা উৎকট গন্ধ নাক জাপ্টে ধরে। ভেতর  যেন শবদাহ চলছে। অস্পষ্ট চিহ্নের মতো কোন চেনা মানুষের মৃত্যু দৃশ্য কল্পনা করে রিমা। বুক দাবড়িয়ে কান্না বেরিয়ে আসে।

বিকেল গড়িয়ে এখন প্রায় সন্ধ্যা। আলো-আঁধারির লড়াই এখন সন্ধ্যার আকাশে। টক্ টক্। দরজা টোকা দেয় রিমা। ভেতর থেকে কোন সাড়া না পেয়ে ফের টোকায়। সুমন, দরজা খোলো, আমি রিমা ।                   

রিমা! রিমা! শব্দ করে আতঙ্কে উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ে বেড়াচ্ছে সুমন এবং বিছনা-পত্তর উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে তোলপাড় করে একটা কিছু  খুঁজছে। রিমার কানে আসছে। কী খুঁজছে সুমন! পিস্তল! ভয়ে পাক খেয়ে ওঠে রিমার ক্লান্ত দেহ। হুঁ করে মুচকি হাসি দিয়ে দরজা ঘেঁষে দাড়ায়। রিমার বুকে গুলি ছুঁড়বে তুমি সুমন! হায় রে সুমন! রিমার বুকে গুলি ছুঁড়বে তুমি! পারবে? পারবে কি? পারলে তো আমার মতো কে আর খুশি হবে বলো দেখি? কত প্রহর পার করে দিয়েছো সুমন? কত দিন? কত বছর? এই রিমার বুকে মাথা ফেলে। এই বুকে মুখগুঁজে। এই বুক ঝাঁঝরা করে দিতে পারো তুমি সুমন! অবিশ্বাস্য। না সুমন, তুমি পারো না। মাথা ঝাঁকিয়ে ওঠে রিমা। এবার দরজা খটখটানির সাথে আস্থার কণ্ঠে ডাকে, সুমন, প্লিজ, খোলো দরজা। দেখো কে আমি? বড্ড টায়ার্ড লাগছে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না সোনা আমার।

খট করে দরজা খুলে গেল। পরনে গামছা, পুরো উদোম হারগিল চেহারার সুমন ভাবলেশহীন নিষ্করুণ চোখে তাকিয়ে দেখছে রিমাকে। ঢেকুর গিলে হাসি দিয়ে রিমা বলে, অবাক করলাম? সারপ্রাইজ দিলাম কেমন? সুমনের মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই। রিমার স্ফিত পেটের দিকে তাকায় তীর্যক চোখে।

অপ্রস্তুত রিমার টাল খাওয়া শরীর রুমে ঢুকেই দরাম করে লুটিয়ে পড়ে বিছানায়। কী বিশ্রী গন্ধ! ইঁদুর পঁচা গন্ধ বিছানায়। দুর্গন্ধে ঘরময় ভুরভুর। ব্যস্ত ফুটপাতের মতো ঘরময় ময়লা-আবর্জনা ছড়ানো-ছিটানো। কালচে চাকা চাকা মাটির ঢিলার মতো কী সব দেখে রিমার ভেতরে রি রি করে ওঠে। এসব হয়ত শুকনো মল হতে পারে। ভাসা ভাসা চোখ ফেলে দেখে নেয় রিমা তার সংসার। বুকটা খাঁ খাঁ করে ওঠে। হায় রে সাধের সংসার! সংসারের মোহ বুঝি আর ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই রিমার মধ্যে। নচেৎ এক প্রহরের জন্য কোথাও গিয়ে দাঁড়াতেই মন উচাটন হয়ে উঠত যে রিমার, দিব্যি দুই মাস কাটিয়ে ফিরল কী করে সেই রিমা? স্বামী হন্তার আগাম অভিযোগের খড়্গ যে নারীর উপর, তার জন্য ঘর-বর-সোনার সংসারের কল্পনা করাও যে পাপ।

রাতের প্রথম প্রহরের সবটাই মরার মতো পড়ে রইল রিমা। দেহ-মনের অবিরাম ধকল তাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে সায় দেয় না। তথাপি কুঁকাতে কুঁকাতে ওঠে। উঠতে উঠতে ক্ষীণকণ্ঠে সুমন সুমন বলে ডাকে। সাড়া শব্দ পায় না সুমনের। নিজেই ঢুলতে ঢুলতে গেল ড্রইংরুমে। রিমাকে দেখেই ত্রস্ত-ব্যস্ত হয়ে কিছু একটা লুকাল সুমন।

কী লুকালে? পিস্তল? রিমার ঠোঁটে বিদ্রুপের বাঁকা হাসি। 

ঘুর্ণনরত ফ্যানের দিকে নিবিষ্ট চোখে তাকিয়ে আছে সুমন। রিমা যা বলে তা সুমনের কানে পৌঁছাল কিনা নিজেই সন্দেহমুক্ত হতে পারে না। সুমনের কোল ঘেঁষে বসে রিমা। কিন্তু বসে মিনিটও পার করতে পারে না। মরাপোড়ার গন্ধ সুমনের শরীরে। সুমন কি আমাকে চিনতে পারেনি? হাবেভাবে মনে হচ্ছে জীবনে এই প্রথম দেখছে আমাকে। যদি না চিনে থাকবে তবে পিস্তল নিয়ে নাড়াচাড়া করবে কেন? রিমা দ্বিধায় পড়ে গেল। তুমি কি আমার সাথে কথা বলবে না, সুমন? মাথা নামিয়ে ক্ষুণ্ন কণ্ঠে বলে রিমা।

সুমনের অবিশ্বাস্য রকমের নীরবতা অনিশ্চিত আশঙ্কায় ফেলে দেয় রিমাকে। একটা ভয় বুকের মধ্যে হন্যে হয়ে তাড়া করছে। তবে কি এই রাত-ই জীবনের শেষ রাত? হঠাৎ বুকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে রিমার। কাছেপিঠে আর কাউকে খুঁজে পায় না, যাকে খুুঁটি করে বাঁচবে। তখনি পেটের দিকে চোখ যায়। ওর পেটের ভেতরে গভীর অন্ধকারে ছোট্ট সুমন ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটছে।

তুমি কি আমাকে চিনতেও পারোনি, সুমন? মাথা নোয়ায়ে দু’হাতে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ওঠে রিমা।

কুৎসিত মুখভঙ্গি করে ক্রোধের সাথে এমন বীভৎস চোখে তাকায় সুমন, সাদা চুনের মতো রক্তশূন্য হয়ে গেল রিমার মুখ। ওকে যে চিনতে পেরেছে এবং খুব ভালো করেই চিনতে পেরেছে সুমনের বিদঘুটে বীভৎস চাহনিই তার জ্যান্ত প্রমাণ।

কী খাও রাতে? আঁচলে মুখ মোছে রিমা।

খাওয়ার কথায় চমকাল সুমন। কেন চমকাল? রিমা ধরতে পারে সহজেই। রিমা তোমাকে খুন করবে সুমন! এই বিশ্বাস নিয়ে তুমি হয়ত বা চলেই যাবে। কিন্তু আমি কি চাই তুমি ছাড়া এক মুহূর্ত বাঁচি। কী পেলাম আর কী পেতে পারি সে হিসেব কি আর বাকি আছে? তোমাকে দেওয়া একটি কথা রাখতে পারলাম না আমি, আমরা একসাথে মরব, আমরা একসাথে বাঁচব। অবশ্য সে তোমারই জন্যে। তোমার চাওয়াটাকে মূল্য দিতে গিয়ে, তোমার বিশ্বাসটাকে বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে, তোমার সংগ্রাম, তোমার অস্তিত্বকে পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে আজ আমি নিজের কাছে নিজেই প্রতারক! শপথ ভাঙছি! জোরে শ্বাস ফেলে রিমা। এবার ডাক্তারের কাছে যেতে-ই হবে তোমাকে সুমন। তোমার বাবু দেখবে না?

সাঁই করে উঠে দাঁড়িয়ে লম্বা পা ফেলে হনহন করে চলে গেল সুমন। বগল চাপা কালো পিস্তলের নলটা পেছন হতে দেখা যাচ্ছে। হুঁ করে হেসে ওঠে রিমা। মরণের এত কাছে জীবন! তবু এক চিলতে মরণের ভয় ঢুকছে না মনে! সুমনের প্রতি বিশ্বাসের বরফ গলে এক ফোঁটা জলও হয়নি এখনো দেখছি!

সুমনের পিছু পিছু গেল রিমা। বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে কিছু একটা চিবোচ্ছে সুমন। কী চিবাচ্ছো? দাও তো আমাকে। ক্ষিধেয় পেটের মধ্যে নাড়িভুঁড়ির মিছিল চলছে। সুমনের পাশে শুয়ে গলার ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে খাবলে ধরে রিমা। হাত টেনে বের করে দেখে, কাঠের মতো শক্ত শুকনো পাউরুটি। রুটির দিকে তাকিয়ে রিমার চোখ ছলছল করে ওঠে। হায় সুমন! ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে রিমা। লাশের মতো চিৎ হয়ে লুটিয়ে পড়ে বিছানায়। আচমকা সুমন দাঁত খিঁচিয়ে দুই হাতে রিমার দুই স্তন খাবলে ধরে। লাফিয়ে উঠে আসে রিমার উপরে। ভয়ানক শব্দে চিৎকার  করে ওঠে রিমা, বাবু মারা যাবে সুমন! তোমার সন্তান মারা যাবে! আমি মারা যাবো। কিছুতেই ছাড়ছে না সুমন। রিমার চিৎকারে সুমনের হিংস্রতার উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। আর উপায় নেই। সুমনের বুক বরাবর সজোরে লাথি মারে রিমা। নির্বল কঙ্কালসার সুমন উল্টে পড়ে। বিছানা ছেড়ে চলে যায়।

বালিশ কামড়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে রিমা। বুকে প্রচণ্ড টাটানি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ড্রইংরুম হতে সুমনের ফিসফিসানি কানে আসে। রিমা উঠে গেল।

পিতার কোলে মুখ লুকিয়ে অভিমানী শিশু যেভাবে ফুঁপিয়ে কাঁদে আর বিলাপ করে, ঠিক একইভাবে, কল্পনায় বাবার কোলে মুখ লুকিয়ে সোফায় দুই পা তুলে গুটিসুটি মেরে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সুমন! আর নিবিষ্টমনে বিলাপ করছে, বাবা, আমি আজ রাতে-ই খুন হচ্ছি। বাবা, আজ রাতেই আমি খুন হচ্ছি। বাবা! আজ রাতে আমি খুন হচ্ছি। 

সোফার বালিশ উল্টিয়ে পিস্তল খোঁজে রিমা। ধারেকাছের সব সম্ভাব্য জায়গায় হাতড়িয়ে পায় না। পরে আবিষ্কার করে, দুই হাঁটুর সামান্য উপরে চাপ দিয়ে ধরে রেখেছে পিস্তল। টানবে নাকি ভাবে। টানলে যদি অন্য কাণ্ড ঘটায়? যে রকম ভয়ানক খাপছাড়া ব্যবহার করে এলো কিছুক্ষণ আগে। পিস্তল টানতে সাহস হয় না রিমার। 

রাতের প্রহর ক্রমে বেড়েই চলছে। রিমা আর নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারছে না। বিছানায় শুয়ে বিড়ালের মতো কুণ্ডুলি পাকিয়ে বালিশে মুখ চেপে পড়ে থাকে। একটা রাত কাটাতেই এত ধকল! চোখ বুঁজে একটা প্রার্থনা রিমার বুক ফেঁড়ে আসতে চায়। কিন্তু কী প্রার্থনা করবে? কার কাছে প্রার্থনা করবে? রিমা বুঝে উঠতে পারে না। কূলহারা রিমাকে স্বামীহারা করে অকূলে ফেলো না; সুস্থ সবল করে দাও স্বামীকে; অনাগত সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে; ঘর-বর-সোনার সংসার দাও ফিরিয়ে—এসব প্রার্থনা করবে রিমা? না, এসব প্রার্থনা রিমা করতে পারে না। মানুষ এসব প্রার্থনা করে যে শক্তিমানের কাছে তার ক্ষমতাকে বিদ্রুপ করেছে রিমা। তার নিয়মনীতিকে দম্ভ করে অস্বীকার করেছে। শরীর কেঁপে ওঠে রিমার! না, কিছুতেই প্রার্থনা করব না আমি। আমি কিছুতেই সুমনের বিশ্বাসের সাথে প্রতারণা করব না। আমার বিশ্বাস আমার অস্তিত্ব। নিক্, কেড়ে নিক্! সেই শক্তিমান কেড়ে নিক আমার ঘর-বর-সংসার সব।

ধূপপোড়ার উৎকট ঝাঁঝালো গন্ধে তন্দ্রাচ্ছন্ন রিমার ঘোর কাটে। দিনের আলো ততক্ষণে  প্রবেশ করেছে রুমে। বিছানায় পড়ে থাকতেই ভালো লাগছে। যদিও ক্ষিধেয় পেট মোচড় দিয়ে উঠছে। ধূপপোড়ার গন্ধে শুয়ে থাকতে না পেরে উঠে পড়ে। মাতালের মতো হেলেদুলে ড্রইংরুমে গেল সুমনকে দেখতে। ড্রয়িং রুমে পা ফেলেই ভয়ঙ্কর চিৎকার দিয়ে ওঠে রিমা।

যোগাসন করে বসে আছে সুমন। ধূপ জ্বলছে পিয়ালায়। ডান হাতের বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে রেখেছে পিয়ালার উপরে। আঙুল থেকে বৃষ্টির ফোঁটার মতো টপটপ করে রক্ত পড়ছে পিয়ালায়। কেক কাটার চাকু দাঁত দিয়ে মুখে কামড়ে ধরে আছে। বাম হাত দিয়ে ভয়ানকভাবে টিপে ধরে আছে ডান হাতে কাটা আঙুল। পিস্তল বগলেই চাপা। পরনের গামছাটা খুলে পড়েছে, না হয় খুলে রেখেছে। প্রাগৈতিহাসিক কালের এক কাপালিক যেন তন্ত্র সাধনায় ব্যস্ত।

রিমাকে দেখেই লাফিয়ে উঠে সুমন। অন্ধ অজগরের মতো মুখ হা করে ধেয়ে আসে। বেহুঁশ হয়ে দৌড়াতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় রিমা। হনুমানের মতো এক লাফে চড়ে বসে রিমার উঁচু পেটের উপরে। কঙ্কাল হাত দিয়ে খাবলে ধরেছে স্ফিত স্তন। আততায়ীর এলোমেলো ছুরি চালানোর মতো সুমনের উত্থিত শিশ্ন এলোপাতাড়িভাবে আঘাত করে চলেছে রিমার পোয়াতি পেটের নরম মাংসে। সুমনের মুখ থেকে পিচ্ছিল লালা চুঁইয়ে পড়ছে রিমার বুকের উপরে। ভয়ানক শক্তি  প্রয়োগ করে বুক মোচড়াতে শুরু করলে মরণ চিৎকার দিয়ে ওঠে রিমা, আমাকে বাঁচাও সুমন, আমি মরে গেলে তোমার সন্তান বাঁচবে না। আমার পেটে তোমার সন্তান। ওকে তুমি বাবা হয়ে আঘাত দিও না। ও তোমাকে কোনদিনও ক্ষমা করবে না। মরণযন্ত্রণায় ছটফট করে রিমা।

আক্রমণ আরও তীব্র হয়ে ওঠে।

রিমা কঠিন সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। নিজের ডান হাতের দুই আঙুল বেহুঁশ সুমনের বাম চোখে খেজুরের কাঁটার মতো ঢুকিয়ে দিল। তেল ফুরিয়ে আসা বাতির মতো দপ করে নিভে গেল সুমনের চোখের আলো। চোখে অন্ধকার নেমে আসে।

আর দেরি নয়। গোছানো ব্যাগ হাতে নিয়ে রুম থেকে দৌড়ে বের হয় রিমা। সিঁড়ির দুই ধাপ নামার পরে তৃতীয় ধাপে পা হড়কে গেল। হাতের ব্যাগ ছুটে বেরিয়ে গড়িয়ে পড়ছে নিচে। সিঁড়ির রেলিং ধরে মুহূর্তের জন্য দাঁড়াল রিমা।

[শেষ পর্ব]

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক (নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ) 

0 Comments

Post Comment