শাপিতপুরুষ (সপ্তম কিস্তি)

  • 09 January, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 453 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
পূর্ববকথা- বর্তমান জীবনকে দাবড় মেরে সরিয়ে দিয়ে ঝেঁকে বসেছে সুমনের অতীতচারী মন। সেই ক্যাম্পাস, সেই রিমা, সেই ভবন, আমতলা সব যেন চলমান ছবি চোখের সামনে। যতদূর হাতড়ায় তাতে চৈতির কোন জায়গা আছে বলে মনে হয় না। এক সন্ধ্যার পাগলামি ছিল স্রেফ। তবে বুকের পাঁজরে এতটা আলোড়ন কেন! চৈতির ছেলেটার কথা মনে পড়ে। এমন একটা ডানপিটে শিশুর লোভ মনের ভেতরে ঘাপটি মেরে আছে। বড় শ্বাস ফেলে। অনুর্বর পতিত জমির মতো কেটে গেল জীবনের এতটা বছর!  

[১৩]

আমার সুখের অঙ্গে দাঁত-নখের ক্ষত : রিমা

গ্রীষ্মের প্রকৃতি। রোদে পুড়ে যাচ্ছে পথ-ঘাট-গাছপালা। ঢাকা থেকে ফিরতে বিকেল চারটে বাজে রিমার। পোষাক খুলে, হাত-মুখ ধুয়ে, সুমনের সঙ্গে স্রেফ কুশল বিনিময় করে বালিশে মুখগুঁজে শুয়ে পড়ে।

রিমা এখন বেঘোর ঘুমে, যেন লাশ কাটা ঘরে পড়ে আছে একটি তাজা লাশ। চুলগুলো খ্যাপমারা জালের মতো চতুর্দিকে ছড়ানো ছিটানো। ঘরের দরজা-জানালা দুই বন্ধ। জিরো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে রুমে।

পড়ার টেবিল ছেড়ে আসে সুমন। ধীরে ধীরে রিমার ঘুমন্ত শরীরের নিকটবর্তী হয়। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ভাবে। রিমার শরীরে ধ্বস নেমেছে। সেই চনমনে রূপ-লাবণ্য ক্ষয়ে ক্ষয়ে দিনে দিনে রোগাটে এখন। পাংশুটে বিষণ্ণ। মেজাজের আমূল পরিবর্তন। শান্ত সৌম্য বিনম্র মানুষটি দিনে দিনে কেমন তিরিক্ষি স্বভাবের হয়ে যাচ্ছে। এবার বিড়ালের শিকার ধরার মতো সুমন নিঃশব্দে উঠে গেল খাটে। হাঁটু ভাঁজ করে উপুড় হয়ে রিমার শরীর ছোঁয়। ভারি নিশ্বাসের গরম বাতাস ছাড়ে। সে বাতাস রিমার শরীরকে যেন উদোম করে ফেলবে। রিমার শরীরের গন্ধের কাছাকাছি যায়। বিদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে রিমার পেটের দিকে। কতটুকু উঁচু হলো? বাচ্চা কি পেটে আছে? নাকি খালাস করে এলো? মার্ক করতে পারে না। ধীরে ধীরে নেমে আসে খাট থেকে।

রাত্রি প্রগাঢ় হতে হতে এখন দ্বিপ্রহর। কিন্তু রিমার ওঠার কোন লক্ষণ নেই। যেভাবে শুয়েছিল, ঠিক সেভাবেই শুয়ে আছে। বেঘোর ঘুমে। চিরজনমের ঘুম একবারে ঘুমিয়ে নিচ্ছে নাকি? সুমন কিছুক্ষণ পায়চারি করে। সন্ধ্যায় ঠিক ধরে উঠতে পারিনি, পেটে বাচ্চা আছে কি নেই। সিধেল চোরের মতো সতর্ক পা ফেলে হামাগুড়ি দিয়ে খাটের উপরে উঠে গেল সুমন। ভয়ে বুক কাঁপে। টের পেলে সর্বনাশ। পেটের কাছে চোখ নিয়েও ঠাহর করতে ব্যর্থ হয়। দুই মাসের পেট।

হঠাৎ সুমনের মগজ নড়ে ওঠে। ঘুমন্ত রিমার স্ফিত বুক, সাদা উরু, এক চিলতে বস্ত্রের নিচে থেকে গোপনাঙ্গ—সবাই যেন জোটবদ্ধ হয়ে ক্ষুধার্ত সুমনকে আহবান করছে। রিমার কাপড় তোলার জন্যে হাত বাড়াতেই খপ্ করে কে বা কারা যেন ধরে ফেলল সুমনের আদিম হাত। সমস্বরে খিলখিল করে হেসে ওঠে কতিপয় শিশু। অতঃপর নীরব তারা। হাত গুটিয়ে জড়োসড়ো হয়ে সরে আসে বিব্রত সুমন। কারা যেন তার সম্ভ্রম বাঁচাল! এভাবে নিজের স্ত্রীর কাছে চোরের মতো যাওয়াটা যে বিরাট লজ্জার! রিমার ঘুম ভেঙে গেলে মুখ লুকানো কঠিন ছিল। কিন্তু এই শিশুগুলি কারা? ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছে কীভাবে? এবার ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকে সুমন, কে? কে তোমরা? আমাকে লজ্জা থেকে বাঁচিয়েছো।

ফের সেই সমস্বরে খিলখিল হাসি। পিলে কেঁপে ওঠে সুমনের। ভয় পায়।

ফ্লোরে মার্বেল ফেলার টক টক শব্দ, বাচ্চাদের ছুেটাছুটি, লুটোপুটি সবই দেখে সুমন। একটি নয়, চারটি শিশুর এক টিম। ওরাই খেলা করছে। সুমন নিজের মধ্যে এক অচেনা আনন্দ অনুভব করে। খাট থেকে নামে লাফিয়ে। এবার চারটি শিশু হাত ধরাধরি করে সুমনকে বৃত্তবন্দি করে ফেলে এবং আব্বু আব্বু বলে লাটিমের মতো চক্রাকারে নেচে ওঠে। বিব্রত সুমন জাপটে ধরে ওদেরকে। শিশুগুলো অবিকল সুমনের ফটোকপি। নাক, চোখ, সজারুর মতো খাড়া কান, মাথার চুল সবই সুমনের নকল।

তোমরা কারা? কোথা থেকে এলে? সুমন জিজ্ঞেস করে।

বাচ্চারা সমস্বরে হি হি করে হেসে ওঠে আম্মু আম্মু বলে ছুটে খাটে উঠতে গেলে ওদের জাপটে ধরে সুমন। লজ্জা পায়। বুকে জড়িয়ে স্নেহসিক্ত চুম্বন দিল প্রত্যেকের কচি গালে। ফিসফিস করে বলে, আম্মু ঘুমোচ্ছে। ঘুম ভাঙলে পিটাবে। সুমন নিজের উপর চরম বিরক্ত। নিজের সন্তানদের কেউ এমন করে প্রশ্ন করে! ওদের মধ্যে সবচেয়ে বড়টা প্রস্তাব করে, আব্বু, চলো আমরা খেলা করি।

কী খেলা? সুমন কানে কানে বলে। 

সাপ-লুডু। শিশুটি কানের কাছে মুখ নিয়ে সুমনকে নকল করে একইভাবে বলে।

হুঁ বলে সুমন সম্মতি দিতেই দৌড়াদৌড়ি-হুড়োহুড়ি বেঁধে গেল। হিস্ হিস্ করে মাথা চুলকাতে চুলকাতে সুমন বলে, এখানে না! এখানে না! তোমাদের আম্মু টের পেলে রেগে ফায়ার হবে। যা বদরাগী মহিলা। খেলতে দেবে না। বারান্দায়। বারান্দায় চলো।

আচ্ছা। বারান্দায় দৌড়াল শিশুরা।

সাপ-লুডু ঘরের চারকোণে পিতা ও পুত্রগণ বসে গেল হাঁটু ভাঁজিয়ে। শুরু হল খেলা। পুত্রগণের ছক্কা উঠছে একে একে। কোন মতেই ছক্কা ওঠে না পিতার। গুটি ছুঁড়লেই উল্টেপাল্টে একই কানাই। আর তখনি ওঠে হি হি হাসির কলরব। ওদের একজনের গুটি যখন সাপের মুখে পড়ে তখন সুমনসহ বাকিরা চেঁচিয়ে ওঠে। খেলা চলে ঘণ্টা খানেক ধরে। কেউ গুটি ঘরে তুলতে পারে না। একটু এগিয়ে গেলেই মুখ হা করা ক্ষুধার্ত সাপের মুখে গিয়ে ঢোকে। অবশেষে ছক্কা ওঠে সুমনের। একে একে এগিয়ে সুমনের গুটি গিয়ে পড়ল বড় সাপটির হা মুখে। আর অমনি বিকট জোরে সমস্বরে চেঁচিয়ে একসঙ্গে লাফিয়ে ওঠে বাচ্চারা। সাথে ইস্ করে দাঁত কামড়ে চাপা কণ্ঠে গোঙিয়ে ওঠে সুমন।

ধড়ফড়িয়ে জাগল রিমা। কাঁপতে কাঁপতে সুইচ অন করে। ঝকঝকে লালচে আলোয় লজ্জায় চকচক করছে সুমনের মুখ-চোখ। সামনে ছড়ানো সাপ-লুডুর ঘর। ঘরের উপরে ছিটানো লাল, সবুজ, কালো, সাদা রঙের গুটি। ভূতগ্রস্তের মতো প্রবল আতঙ্কে কাঁপছে রিমার শরীর। ঠোঁট কামড়ে বলে, কী প্রবলেম তোমার? রাত দুপুরে সাপ-লুডু খেলছো! তাও আবার লাইট না জ্বালিয়ে একা খেলছো! তুমি না এই খেলা ঘৃণা করতে? আর এই সব পেলে কোথায়?

সুমন নীরবে দাঁড়িয়ে নখ খোঁটে। কিছু বলার যখন থাকে না তখন নখ খোঁটা সুমনের মুদ্রাদোষ। কেন অন্ধকারে বারান্দায়? কেনই বা সাপ-লুডুর ঘর ওর সামনে? নিজের মধ্যে গুলিয়ে ওঠে ঘোর বিস্ময়।

সুমনকে বিব্রত হতে দেখে চুপসে গেল রিমা। নীরবে দাঁড়িয়ে ভাবে। মদোবাতাস শিরশির করে জানালার গ্রিল টপকে রিমাকে যেন উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়। বিশাল পদ্মার উদোম বুক হতে আসছে এ বাতাস। জার্নির ক্লান্তি কাটিয়ে রিমা বেশ ফুরফুরে মেজাজে। ধীরে ধীরে সুমনের শরীর ঘেঁষে দাঁড়ায়। উদোম বুকে মুখগোঁজে। কেমন মাতাল মাতাল বিষ বিষ লাগছে শরীর। সুমনের লোমশ বুকে মুখ কচলায়। রিমার সংকেত পেয়ে জেগে ওঠে সুমনের শরীর। চূড়ান্ত মুহূর্তে উথালিপাতালি বিপ্লব ঘটে গেল দু’জনের রক্তে। অগ্ন্যুৎপাত ঘটে।  অতঃপর তারা শান্ত হয়। এবং বেহুঁশ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকে রিমা। দরদর করে ঘাম ঝরে বিছানা ভিজে জবজবে।

প্রায় আধা ঘণ্টা পরে রিমার হুঁশ ফেরে। শরীর অবশ। টনটনে টাটানি পুরো শরীরে। উঠতে গিয়ে ব্যথায় কোঁকিয়ে উঠে ফের লুটিয়ে পড়ে। নিজের দিকে তাকাতেই আঁতকে ওঠে। সারা অঙ্গে দাঁত নখের দাগ! কালচে শুকনো রক্ত লেগে আছে দাগে। সুমনের বিষ নিতে নিতে রিমা নিজে এতটা বেসামাল আগে হয়নি। এতটা আঘাত ওকে কোনদিনই দেয়নি সুমন। রিমার মনে ভয় ঢুকে লণ্ডভণ্ড করে দিতে লাগল সব সুখানুভূতি। শাড়ি কুণ্ডলি পাকিয়ে পড়ে আছে নিচে। হাত উঁচিয়ে টেনে শরীরে পেঁচানোর শক্তিটুকুও নেই। শিশুর মতো ক্লান্ত সুমন পাশে পড়ে আছে সাপে কাটা লাশের মতো। ভালোবাসার মাত্রা কমে আসলে পুরুষরা নাকি কুকুরের মতো নারীর দেহ খাবলে খামচে জখম করে। ঘৃণা ও প্রতিশোধের নেশা মেটানোর জন্য পুরুষরা নারীর দেহকে শুধুই ভোগ করে না, ছিন্নভিন্নও করে; হিংস্রতা তখন জন্তু-জানোয়ারকেও হার মানায়। সুমনকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, তুমি এমনটা করলে কেন? আমি তো ভালোবেসে স্বেচ্ছায় তোমার কাছে গিয়েছি। আমার উপরে কোন জন্মের শোধ নিচ্ছো তুমি? কিসের ক্রোধ তোমার? যা করেছো তা ঘৃণার প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। সুমন তুমি হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের চেয়েও অধম হয়ে গেলে নাকি?

ভেবে কূল পায় না রিমা। এখন কি করা উচিত। হেসে ওঠে আপন মনেই। বন্ধন বলতে এই তো! সুখ বলতেও তো এটুকু! শরীর শরীর খেলা। পরস্পরের বিষ নিয়ে নীলকণ্ঠের জীবন। এটুকুতেও সুমন এত হিংস্র হলে কী আর রইল অবশিষ্ট? দিনে দিনে ও আর কত বদলাবে? অন্তিম বিশ্বাসটাও উচ্ছ্বিষ্ট হতে চলেছে। জোড়াতালি দিয়ে চলছে। ভেতরে বাইরে কেবল রক্তারক্তি। জীবনের এই দুর্বিপাকে রিমা অসহায়। একদিন খুব সহজেই যা অস্বীকার করেছে দম্ভ করে, এখন পায়ে পায়ে এসবেরই বেড়ি। বন্দি নিজে। বন্দি সুমন। কোথায় মুক্তি?

নেতানো শরীর সুমনের। শরীরে শক্তি ফুরিয়ে এসেছে। রিমা তাচ্ছিল্যের চোখে তাকায়। অকস্মাৎ ভয় ভেতরে ঢুকে হাত-পা শক্ত হয়ে গেল। সুমন আসলে ঘুমায়নি। ঘুমের ভান ধরে পড়েছিল। এখন কেমন ঘোলাটে হিংস্র চোখে তাকাচ্ছে রিমার দিকে। বিধ্বস্ত রিমার দেহে থরকম্পন। ওর চোখে এখনো তৃষ্ণা হা হা করছে। ওর নেশা কি মেটেনি? তবে কি ফের? এবার মেরেই ফেলবে। উদোম শরীরে বিছানার চাদর জড়াতে জড়াতে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে রিমা, ওভাবে কী দেখছো? এটা বাড়াবাড়ি কিন্তু।

সুমন হুঁ করে বত্রিশ দাঁত বের করে পাগলের মতো হেসে দিল। ঝাঁকিয়ে ওঠে রিমা। শুকনো চরে যেন এক ঝলক প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেল। গদগদ কণ্ঠে অনুরোধ জানায়, প্লিজ, তোমার এ রূপ আমি দেখতে চাই না। আর একটু হলে দম আটকে নির্ঘাত মারা যেতাম। মেয়েদের মন জাগিয়ে শরীর জাগাতে হয়। এটা একটা আদিম শিল্প। আর তা না করে শকুনের মতো খাবলে কী করেছো আমার শরীর! বুক, কপাল, পেট, হাতের ক্ষতগুলো দেখিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে রিমা। আমার মুল্য তোমার কাছে এতটা কমে গেছে! আমি কী অপরাধ করেছি তোমার কাছে? আমার উপরে এত রাগ কেন? আমাকে মেরে ফেলতে চাও নাকি?

নিষ্পাপ বালকের মতো চুপচাপ শুয়ে আছে সুমন।

ক্ষতের জ্বলুনিপুড়ানির যন্ত্রণায় গড়াগড়ি করে নির্ঘুম রাত কাটে। বিশাল অন্ধকার আর নিস্তব্ধতার মধ্যে বসে রিমা নিজের মধ্যে ডুবে থাকে। দু-হাতের মুঠোয় ভরে নেয় সে সব সুখস্মৃতি। সুমনের মায়াবী রূপ আর ভালোবাসার টানে একেক সময় পাগল হয়ে যেত। ঘাইহরিণীর ডাকে পুরুষ হরিণেরা মরণের জন্য ছুটে আসে অমাবস্যার তিথিতে। রিমা কতবার যে সুমনের কাছে মরতে গিয়েছে! সুমনের বাহু ছেড়ে বেরিয়ে আসার কথা যতবার ভেবেছে, আকর্ষণ আরও দুর্ভেদ্য ও অপ্রতিরোধ্য হয়েছে। একজন সবল সমৃদ্ধ পুরুষের কাছে নিজেকে নিঃশেষে সমর্পণ করে জীবন কাটিয়ে দেবার লোভ নেই কোন নারীর? আমি তো অপরাধ করিনি। এখনো জীবনের সর্বস্ব সমর্পণ করেই সুমনকে ভালোবাসি। আর কোথাও মাথাগোঁজার ঠাঁই নেই বলে নয়, ভালোবাসাটাকে সবার উপরে সত্য করে রেখেছি।

যত দিন এগোচ্ছে, যত বয়স বাড়ছে, শরীর নির্বল হচ্ছে, বিশ্বাসের খুঁটি নড়ে নড়ে উঠছে, ততই সুমন কেমন হিংস্র টাইপের মানুষ হয়ে উঠছে। মানুষের ভেতরে ভয় ঢুকে গেলে আর কিছুই করার থাকে না। সুমনের মনে অবিশ্বাস ও ভয়ের ঘুণপোকা শক্ত খুঁটির উপরে ঘর বেঁধেছে, এখন আর ওর মুক্তি নেই। সুখ বলি, শান্তি বলি, বন্ধন বলি, বিশ্বাস-ভালোবাসা বলি, স্মৃতির ঐশ্বর্য বলি, সর্বনাশের শেষ প্রান্তে না পৌঁছে ওকে ছাড়বে না। পরিত্যক্ত হওয়ার ভয়, নিঃসঙ্গতার ভয়, সমূলে নির্বংশ হওয়ার ভয়, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভয় সুমনের ভেতরের সুস্থ-স্বাভাবিক চিন্তার মানুষটিকে ধীরে ধীরে হিংস্র আর বর্বর করে তুলছে। প্রত্যেক মানুষকে তো জীবনে কোন এক সময় নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। সুমন এখন নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছে, তাই অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। রিমা নিজের মনকে শক্ত করে। ভয় পেলে চলবে না। পাশ কাটিয়ে গেলে বা পালিয়ে গেলে সুমন বাঁচবে না; আর সুমন না বাঁচলে আমিও বাঁচব না। আমাদের বেঁচে থাকতেই হবে। নিজের পেটের দিকে তাকায় রিমা। বেঁচে থাকার লোভ জ্বলজ্বল করে ওঠে ভয়ার্ত দুচোখে। জেদ করে, জোর করে কিছুই হবে না। বুঝিয়ে ঠিক করতে হবে।

সকালের শান্ত স্নিগ্ধ বাতাসে রিমার শরীর সিক্ত হয়। ক্ষতগুলি কিছুটা শীতল হয়েছে। বাথরুমের লুকিং গ্লাসে নিজের মুখে নখের আঁচড় দেখে পাগলের মতো কাঁদে কিছুক্ষণ। ত্রস্ত হাতে এলোপাতাড়ি পানি ছিটায় ক্ষতগুলোতে। কী বিশ্রী একটা গন্ধ সারা শরীরে! রিমার মধ্যে ভিন্ন প্রশ্ন জাগে। উত্তেজক কোন ড্রাগ নেয় না তো সুমন? কোন সুস্থ মানুষ এতটা পাশবিক হতে পারে কী করে?

সাবান-ছোবড়ার ডলন দিয়ে নোনা চামড়া তুলে ফেলার উপক্রম করে রিমা। শরীরের বিশ্রী গন্ধটা তবু রয়েই গেল। তলপেটে ভেজা হাতের পরশ বোলায়। ভেতরের অন্ধকার ঘরে সুমনের যে সত্তা ক্রমেই জমাট বাঁধছে সে কি টের পেয়েছে বাবার এই হিংস্রতা?  [চলবে...]

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক (নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ) 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment