হালিমার একটি বিকেল

  • 10 July, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 471 view(s)
  • লিখেছেন : খালিদা খানুম
স্কুল থেকে আসার পথটা খুব ভয়ে ভয়ে কেটেছে হালিমার। কি হলো কে জানে! কাজলির সাথে নদীর ধারে গিয়েছিল দেখে নেয়নি তো কেউ। মনে মনে আল্লাকে ডাকে — কানা ফকিরকে দুই টাকা দিব আল্লা, আব্বার কানে যাতে না পৌঁছায়। মারি পিঠিয়ের চামড়া তুলি লিবে বুধ হয় আজ। কাজলির এতো সাহস হয় ক্যমুনে কে জানে! রোজ রোজ আসগরের সাথে গিয়া বসে থাকে, ভয় ডর নাই।

টিফিনের ঘন্টা বাজলে স্কুলের গেটের বাইরে এসে হালিমা দেখে, তার ভাই দাঁড়িয়ে আছে। হালিমাকে দেখে হাঁক দেয় — বুবু তাড়াতাড়ি চল, আব্বা তকে এক্ষুনি বাড়ি যেতে বুলছে।

হালিমার ভাই হাসেন তার থেকে ছোট, সে হাঁপাচ্ছে। উত্তেজনায় হোক বা সাইকেল চালানোর ক্লান্তিতে। সে এখনো অনেকটায় ছোট, সাইকেলের সিটে বসে সাইকেলের প্যাডেল করতে পারে না। সিটে না বসেই প্যাডেল করে চালালে হাঁটার চেয়ে দ্রুত যাওয়া যায়, তাই হয়তো এই ব্যবস্থা নিয়েছে। স্কুল থেকে তাদের বাড়ি বেশি দুরে না। স্কুলের বড় বড় মাঠটা পেরোলেই তাদের গাঁ। আলরাস্তা দিয়ে গেলে পাঁচ মিনিটেই যাওয়া যায়। হাসেন সাইকেলটার মুখটা ঘুরিয়ে বললো — আমাকে বাজারে যেতে বুলেছে আব্বা, তুকে খবরটা দিয়ে। দেরি করিলি কিন্তু আব্বা ছাড়বে না। আমি চলনু।

হালিমা বাড়ি এসে শুনে, তাকে আজ তার বিয়ের জন্য পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। বাড়িঘর গোবর দিয়ে নিকানো হয়েছে সদ্য। তাদের দুইখানি মাটির ঘর। একটিতে বাঁশের মাচা করা, জামাকাপড়, বইপত্র আরো সংসারের টুকিটাকি জিনিস ঢাই করা মাচার উপরে। তারা মা বোন ভাই সবাই মিলে এই ঘরটিতেই শোয় মাটিতে পাটি পেড়ে। অন্য ঘরটিতে কুটুম এলে বসতে দেওয়া হয়। চৌকি পাতা। চৌকিতে তালের পাটিখান সরিয়ে একখানা হাতে সেলাই করা নকসীকাঁথা পাতা হয়েছে। দুইখান লাল রংয়ের প্লাস্টিকের চেয়ার। মনে হয় হাজিদের বাড়ি থেকে আনা। হাজিদের বাড়ি ছাড়া এই চেয়ার দেখেনি সে।

তার মা রান্নাঘরে তাকে এলুমিনিয়েমের থালায় ভাত দিয়ে বলল, খেয়ে নে। খেয়ে নিয়ে গা ধুয়ে নিস জলদি। দেরি করিস না।

তার দিকে তাকানোর সময় এখন নেই।

তার মায়ের হাতে এখন অনেক কাজ। দম ফেলার সময় নেই। অনেককাল আগে গ্রামে ফেরিওয়ালার কাছে থেকে চারটা কাপ প্লেট কেনা হয়েছিল, সেগুলো তাদের ঘরের বাঁশের মাচার নিচ থেকে বের করে কলপাড়ের দিকে নিয়ে যায়। সেখানে আরো অনেক রকমের বাসন রাখা। কাঁসার জগ একটা, এটা হালিমার মা তার বিয়েতে পেয়েছিল। কটা স্টিলের থালা বাটি গেলাস, যেগুলো সম্ভবত কারো কাছ থেকে ধার করে আনা, সবগুলো নিয়ে মাজতে বসে কলতলায়, তেঁতুল দিয়ে কাঁসার জগটা পরিষ্কার করতে করতে গজগজ করে — বলছিনু থালা বাটি বাসন সংসারে লাগে। আমি কডা পয়সা নিলেই বাবুর রাগ। আমি কি পয়সা গিলি খাই না কি! লোকের বাড়ি থেকি ধার করি আনতি হতক না। এইবার আল্লা মেয়েডারে পার করি দাও, বাসন কোসন নিজেই করবু। আরো দুইডা আছে। নতুন কুটুম আছে। ছেলাপিলার সংসারে লাগে এসব, তা ব্যাটাছেলেরে কে বুঝাবে।

স্কুল থেকে আসার পথটা খুব ভয়ে ভয়ে কেটেছে হালিমার। কি হলো কে জানে! কাজলির সাথে নদীর ধারে গিয়েছিল দেখে নেয়নি তো কেউ। মনে মনে আল্লাকে ডাকে — কানা ফকিরকে দুই টাকা দিব আল্লা, আব্বার কানে যাতে না পৌঁছায়। মারি পিঠিয়ের চামড়া তুলি লিবে বুধ হয় আজ। কাজলির এতো সাহস হয় ক্যমুনে কে জানে! রোজ রোজ আসগরের সাথে গিয়া বসে থাকে, ভয় ডর নাই।

কাজলিই তাকে বলেছিল — সেলিমকে চিনিস, ও তুকে ভালোবাসে। পায়ে পড়ে বলেছে একবার নদীর পাড়ে যাতে। একবার যাবার পর আর সাহস হয়নি হালিমার। কিন্তু কাজলি যায় প্রায়। আরো অনেকেই যায়।

হালিমা আল্লাকে ডাকতে থাকে, নবিকে ডাকতে থাকে, বাড়ির দিকে পা আর চলে না।

ভাতের থালা নিয়ে বসে আছে হালিমা। স্কুল থেকে ফেরার পথের ঘটনা মনে পড়ে হাসি পাই তার। নিজেকে কেমন বোকা বোকা মনে হয়, আব্বা জানবে ক্যাম্নে, আব্বা তো থাকেই না। ছয়মাস অন্তর অন্তর বাড়ি আসে।

বিয়ের সমন্ধ এসেছে। ঘটক না লাগিয়ে, দশবার ছেলের বাড়ির সামনে না বসে, একেবারেই পাকা দেখা। দাদিকে কতবার বলতে শুনেছে, বিটি হলো পরগাছা। এক জমিনে বড় হয় অন্য জমিনে ফল দেবার জন্য। এ দায় কম দায় না।

হালিমা দাদির গলা জড়িয়ে ধরে বলে, আমি তোমাকেও নিয়ে যাবু। একলা যাবুনা।

দাদি আলতো করে ঠেসা দিয়ে বলে, তর সোয়ামির সাথে তুই শুবি, আমি কি পাহারা দিবু?

হালিমা বলে, আমি তুমার সাথেই শুবো।

—ধুর পাগলি। সোয়ামি হল বড় স্বাদের জিনিস। এ স্বাদ আর কিছুতে নাই রে পাগলি। আগলে রাখতে হয়, যত্ন করতে হয়। সোয়ামির বাড়ি তো তর আসল বাড়ি।

তাহলে যারা আসছে আজ, তারাই কি তার আসল আপন লোক। তারা তো আর স্কুলে যেতে দেবে না হয়তো।

একবার সেলিমের কথা মনে পড়ে।

তার বুকের মধ্যে কেমন যেন ঢেউ ভাঙ্গছে। এটা দুঃখের না আনন্দের, তা বুঝতে পারছে না। ভাত নাড়াচাড়া করছে কিন্তু মুখে দিতে মন চাইছে না। কারা আসবে? কুন গাঁয়ের? সকালেও তো কিছু শুনেনি, তাহলে? সত্যি তারা যদি তাকে পছন্দ করে তার বিয়ে হয়ে যাবে? নতুন ঘর নতুন সংসার? অনেকগুলো প্রশ্নের সাথে এই চিন্তা মাথায় আসতে তার কেমন একটু খুশি বোধও হল তার। নিজের সংসার!

একখান পুরা ডিম ভাজি করে মা দিয়েছে তাকে। অন্যদিন হলে এই ডিমটা দিয়ে দুই থালা ভাত খেয়ে নিতে পারতো হালিমা, কিন্তু আজ ইচ্ছা করছে না। খুব জানতে ইচ্ছা করছে যারা আসছে তাদের সম্পর্কে।

হালিমার পিঠাপিঠি বোন সাবিনা। সাবিনা হালিমাকে দেখে ফিচ করে হেসে দিল।

— এই হাসছিস ক্যানরে? হালিমা রাগ দেখায়।

— বুবু তোর বিয়ে হয়ে যাবে। ছেলারা আজ আসি পাকা কথা করবে। সাবিনা হালিমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে।

— তুকে কে বুলল?

— আমাকে বুলবে ক্যান? সবাই বুলাবুলি করছিল, আমি শুনিছি।

— আর কি শুনিছিস?

— ছেলার বাপ আর আরেকখানে জানি আসবে। ছেলার বাপ আব্বার সাথে কাজ করে চেন্নায় না গুজরাটে। আব্বা তোর ছবি দেখায়ছিলো মুবাইলে। পছন্দ হয়ে গ্যেলছে। কথাবার্তাও। তারা পাশের গাঁয়ে আসিছিলো কুন কামে তার বাপ, আব্বারে ফোন করি বলিছে, হালিমারে দেখি যাই। এক কামে দুই কাম।

হালিমা এক দলা ভাত মুখে দেয়। মুখের ভিতর নাড়াচাড়া করে। ভাত চিবাতে চিবাতে মণ্ড পেকে যায়, তবু গলা দিয়ে নামে না। সাবিনাকে ডিম দিয়ে এক লোকমা ভাত খাইয়ে দেয়।

— বুবু তুই খাবিনা? সাবিনা মুখের ভিতর ভাতের দলা গিলতে গিলতে বলে।

— খাবু, তুইও খা। তুই ডিম ভাজি খেতে ভালোবাসিস না?

হালিমার বাপ ভিন রাজ্যে রাজমিস্ত্রির কাজ করে। তার বাপের বিঘা পাঁচেক জমি ছিল। সাত ভাইবোনে ভাগ করে যে কয়েক কাঠা জমি নিজের ভাগে পেয়েছিল, তাতে সবজি চাষ করে হাটে বিক্রি করতো। অবসরে পরের জমিতে জনমজুরি। এই করেই বিয়ে হল, হালিমা হল, সাবিনা হল। বাধ সাধলো ভাগ্য হাসেম যখন পেটে। ডাক্তার বললো, অপারেশন করা লাগবে। দুই কাঠা জমি বন্ধক দিয়ে, এ দুয়ার ও দুয়ারে ধার, সাহায্য ভিক্ষা করে অপারেশন হল। কিন্তু তিনখানি বুভুক্ষু পেট নিয়ে সে পড়লো অথৈ পানিতে। বড় পেট অভাব বোঝে, পানি খেয়ে শান্ত হয়। কিন্তু ছোট পেট বোঝে না। কেবল কাঁদে।

অন্যপায় হয়ে আবার হাত পাততে হয়। কয়েকদিন চলে, আবার কান্না। ঋণের বোঝা বাড়ে কেবল। শেষে তার বৌ-ই বলে, তুমিও যাও না রাজমিস্ত্রির কাজে। গাঁয়ের সবাই যাচ্ছে। জমিজমা করছে। জমিজমা না হোক, ছেলাপিলাগুলা খেয়ে বাঁচুক।

তার বৌ যখন তাকে এই কথা বলে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল সে। তাকে একরাত্তির বাড়ির বাইরে থাকতে দেয় না যে বৌ, সে তাকে কি বলছে!

কিছুদিন বাদে চোখের পানি লুকাতে লুকাতে নাড়ু মুড়ি মুড়কি পোঁটলায় বেঁধে দিয়েছিল তার বৌ।  গাঁয়ের আর সব জোয়ান পুরুষের সাথে হালিমার বাপও বেরিয়ে ছিল টাকার খোঁজে। গাঁয়ের লোকমুখে শুনেছে, বাইরে নাকি পয়সা উড়ে।

এবার বাড়ি ফিরে রাতের বেলা চৌকি পাতা ঘরে ডেকে নিয়েছিল হালিমার বাপ তার হালিমার মাকে। চিরাচরিত অভ্যাস বশে হালিমার মা আঁচল নামিয়ে ছিল।

হালিমার বাপ অন্য দিকে তাকিয়ে বলে— ওই কথা নাগো। অন্য কথা জানার জন্য ডাকছিনু।

হালিমার মা অবাক হয়ে আঁচল ঠিক করে — কি কথা?

— বুলতে কেমন জানি লাগে কিন্তু জানা দরকার।

— বুলই না।

হালিমার বাপ অন্য দিকে মাথা ঘুরিয়ে বলে— হালিমার কি মাসিক হয়েছে?

হালিমার মা কিছু বলার আগেই আবার বলে, বুলতিছি, কারণ হালিমার ভালো সমন্ধ পায়ছিনু। আমাদের সাথে রাজমিস্ত্রির কাজ করে, তার ব্যাটা। এই বছর ব্যাটার বিয়ে দিয়ে থুয়ে যাবে। চিন্তা করো না, জমিজিরাত আছে। একটায় ব্যাটা, তিন বিটির একটা বিয়ে দিতে বাকি কেবল। ভাত কাপড়ের অভাব নাই। কুনু দাবি দাওয়া নাই, মেয়েখান ভালো হলি হবে। মুবাইলে দেখাইছি হালিমার ছবি।

ইমামকেও জিজ্ঞাসা করিছি, কইছে মাসিক হইলে বিয়া দেওয়া যাইবে। বাপ হিসাব এটাই প্রথম কর্তব্য।

হালিমার বাপ, তার বৌকে কথাগুলো বলছিল না নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল তা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু হালিমার মায়ের ভিতরে ভয়ের পাহাড় জমা হচ্ছিল। দু মাস হয়েছে মেয়েটার মাসিক হয়েছে, এখনো কাপড় ঠিক করে নিতে পারে না। বুক গজায়নি। বর্ষার কচি ঘাসের মতো তড়বড় করে বাড়ছে কেবল একপেট খিদে নিয়ে।

হালিমার মা কিছু বলতে পারে না। হালিমার আব্বাও বসে থাকে চুপ করে।

হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে হালিমার আব্বা — মেয়ে পরঘরি জিনিস, মায়া বাড়িয়ে লাভ কি। এতো ভালো সমন্ধ যেচে পড়ে এসেছি, পায়ে ঠেলা ঠিক হবে না।

হালিমার মা কথাগুলো ভাবতে ভাবতে একটা আপেল আর নাসপাতিটা দশ টুকরো করে, প্লেটে আঙুর, কলা, চেরি, কমলালেবু, মিষ্টি দিয়ে প্লেটটাকে ভরিয়ে তোলে। হবু কুটুম বলে কথা। আর এমন বিনা কথাতে কেই বা মেয়ে নিয়ে যায়। হালিমার ভাগ্য ভালো বলতে হবে।

গোসল সারা হলে দাদি তাকে চুল আঁচড়িয়ে দেয়, কয়েকটা উকুন ঝরে পড়ে, পটপট করে নখ দিয়ে চিপে মারে, ছাপা একখান সুতির শাড়ি পড়িয়ে, লাল রংয়ের একখান টিপ দিয়ে হালিমার মুখখান ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দ্যাখে। ফোকলা দাঁতে হাসে—এমন সুন্দর লাতিন আমার। পছন্দতো হবেই। সালাম দিবি বুবু গিয়েই, চুপ করে বসবি, চোখ নামিয়ে।

ফুল তোলা একখান ওড়না ঘোমটার মতো করে দিয়ে হালিমাকে ছেলের বাপের সামনে নিয়ে যায় তার দাদি। চৌকিতে বসে আছে তারা। লাল একটা চেয়ার তার বসার জন্য।

সালাম দাও মা, হালিমার আব্বা বলে।

হালিমার চোখ ঝাপসা। গলার কাছে সেই যে ভাত খাবার সময় কি যেন একটা আটকেছিল সেটা আরো বড় হয়ে গলাটা চিপে ধরেছে। হালিমা খুব চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই বলতে পারছে না — আসলামলাইকুম।

লেখক : পশুচিকিৎসক, ছোটগল্পকার

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment