এক টুকরো আকাশ (পর্ব- ৫)

  • 24 January, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 46 view(s)
  • লিখেছেন : মীরা কাজী
একটু দেরি না করে বোরখাটা  খুলে ফেলে লাফিয়ে জানালার একটা শিক ধরার চেষ্টা করলাম। কিন্তু  নাগাল পেলাম না। বুঝলাম যতটা সহজ ভেবেছিলাম ততটা সহজ নয়।  এবার জলের বালতিটা উপুড় করে তার উপর উঠে দাঁড়াতেই  প্লাস্টিকের  বালতিটা  মড়াৎ শব্দ করে ভেঙ্গে গেল। সাথে সাথেই টিনের দরজায়  টোকা  পড়তে শুরু করল। একটু ঠেলা  দিলেই লড়ঝড়ে  টিনের দরজাটা খুলে যাবে।

    শুভলক্ষ্মী

 

 বাড়ি বদল করে নতুন পাড়ায় আসার পর আমার একজন  সাহায্যকারিণীর দরকার হয়ে পড়ল। আগের  মহিলাটি এ পর্যন্ত চালিয়ে দিল। কিন্তু তার বাড়ি থেকে আমার এখনকার ঠিকানা দূর হওয়ার কারণে  তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। আমি একে ওকে বলে রেখেছি। তবে  তেমন কাউকে  পাওয়া যাচ্ছে না।

   একদিন সকালে বিশ্বনাথ, যার ডাকনাম-নীলেশ, নীল। “ বৈশাখী” পর্বে তার কথা  বলেছি, সে উঠতি বয়সের একটি মেয়েকে নিয়ে হাজির হল।

   “ দিদিমনি, এ হল লক্ষ্মী। চব্বিশ ঘণ্টাই থাকবে। এর হাতে সংসারের ভার  দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন, এ বিষয়ে আপনাকে গ্যারান্টি দিতে পারি”। মেয়েটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বিশ্বনাথ বলল।

“ চব্বিশ ঘণ্টার লোকের  তো আমার দরকার নেই। আমি বেরিয়ে গেলে ও একা  কী করবে?”  আমি বললাম।  বলতে পারলাম না, এই বয়সের একটা মেয়েকে  সর্বক্ষণের জন্য রাখা অনেক ঝুঁকির হয়ে যাবে।

 

        বিশ্বনাথ  শেষমেশ আমাকে রাজি করিয়েই  ছাড়ল। বলল, লক্ষ্মীর  থাকার জায়গা নেই। বেশ কিছুদিন সে বিশ্বনাথের কাছেই আছে। বিশেষ কারণে  তার পক্ষে ওকে রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না। এখন আমি  আশ্রয় না দিলে মেয়েটি ভেসে যাবে।

আমাকে ইতস্তত করতে দেখে বিশ্বনাথ বলল, "ঠিক আছে,  বরাবরের জন্য না হোক কয়েকটা দিন  ওকে আপনার কাছে রাখুন, তার মধ্যে একটা ব্যবস্থা করে ফেলব”।

ইচ্ছে না থাকলেও বিশ্বনাথের কথাটা ফেলতে পারলাম না। ও আমার অনেক দিনের পরিচিত।  যে কোনও দরকারে ডাকলেই ছুটে আসে। শুকনো গলায় বললাম,” তাহলে কয়েকটা দিন থাকুক”।

         বিশ্বনাথ লক্ষ্মীকে রেখে  চলে গেল। আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে চুপচাপ বসে আছি । “দিদি,  চাটা খেয়ে নিন”। তাকিয়ে দখি। এক কাপ চা ,প্লেটে দুটো বিস্কুট  নিয়ে লক্ষ্মী আমার সামনে দাঁড়িয়ে।   

  “ আমাকে রান্না চড়াতে হবে। নটা বাজতে চলল!” ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমি  ছটফটিয়ে উঠলাম।

“ ভাত বসিয়ে  দিয়েছি। এবেলা ফুলকপি  দিয়ে মাছের ঝোল আর বেগুন ভাজা করে দিচ্ছি। ও বেলা যা বলবেন করে দোবো”।

আমি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম। এরমধ্যে রান্নাঘরে, ফ্রীজে  কোথায় কী আছে দেখে রান্না বসিয়ে দিয়েছে! একে কী বলব? তোষামোদ? নাকি অন্য কিছু? কিন্তু ওর মুখ দেখে  কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

    খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে কলেজে গেলাম। অচেনা একজনকে বাড়িতে রেখে এসেছি। সব চেয়ে অস্বস্তির কারণ ওর বয়স। মেয়েটির জীবনে একটা কিছু গোলমেলে ব্যাপার আছে, বিশ্বনাথ আমার কাছে না ভাঙলেও  বুঝতে অসুবিধে হয়নি।

    কলেজ থেকে একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়েছি। বাড়ির সামনে এসে দেখি বিরাট জটলা, একজন মহিলা ও একজন পুরুষ মানুষ খুব তড়পাচ্ছে।  নিশ্চয় লক্ষ্মীজনিত ব্যাপার।  বিশ্বনাথ আমাকে ভালো ফ্যাসাদে ফেলেছে! কাছে যেতেই  ভিড়টা  সরে  গিয়ে আমাকে জায়গা করে দিল।

“কি হয়েছে? এখনে এত হল্লা কিসের?”

“ আমার মেয়েকে আটকে রেখেছেন কেন? জানেন আমি পুলিশে খবর দিতে পারি?” মহিলটি আমার দিকে তেড়ে এল।

“কে আপনার মেয়ে?”

“ন্যাকা সাজছেন? লক্ষ্মী! তাকে আপনি  আটকে রেখেছেন, আমাদের কাছে খবর আছে”।

“ আমি কাউকে আটকে রাখিনি। খামোখা হুজ্জোত করবেন না”।

“ডাকুন তাকে? প্রমাণ হয়ে যাক আটকে রেখেছেন কি রাখেননি?”

 

    আমি দরজা খুলে ডাকবার আগেই লক্ষ্মী বেরিয়ে এসে ওদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,  “কেউ আমাকে আটকে রাখেনি। আমি নিজের ইচ্ছায় এখানে আছি।”

“ বেশ করেছিস। এবার চল হারামজাদী!”  মহিলাটি লক্ষ্মীর দিকে তেড়ে এল।

  “ কতবার বলব, আমি তোমাদের সাথে  থাকব না। এটা ভদ্রলোকের বাড়ি। বেশি ঝামেলা করলে আমি পুলিশের কাছে গিয়ে তোমাদের নামে কমপ্লেন করব”।

“ হিল্লি-দিল্লি ঘুরে এসে  খুব বাড় বেড়েছে না? একবার হাতে পাই, তারপর দ্যাখ কী করি তোর?”

“সে যা হয় কোরো। এখন এখান থেকে যাও”। লক্ষ্মী ওদের মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দিল।

 

     দরজার ওপিঠে মহিলা আর পুরুষ কণ্ঠের চিৎকার শোনা যাচ্ছে,” কদিন লুকিয়ে থাকবি?  পেলে হাত-পা ভেঙে ফেলে রেখে দোব, মনে থাকে যেন”।

লোকজন আরও কৌতূহলী  হয়ে উঠেছে। আমি এ পাড়ায় নতুন এসেছি। সবার সাথে  এখনও ভালো করে পরিচয় হয়নি। তাই আমাকে জিজ্ঞেস না করে সবাই  উল্টোদিক থেকে ব্যাপারটা সবিস্তারে জেনে  নেবার চেষ্টা করছে । এ রকম পরিস্থিতিতে কখনও পড়িনি। কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারছি না।  বিশ্বনাথের সাথে কথা বলা দরকার।

 

“দিদিমনি?” লক্ষ্মীর ডাকে  আমার সম্বিত ফিরল।   

“ আমার জন্য খামোকা আপনাকে ঝামেলায় পড়তে হল। আজকের রাতটা  থাকতে  দিন। ভোরের আগেই আমি চলে যাব”। শুকনো মুখে  লক্ষ্মী বলল।

“কোথায় যাবি”?

“ যেখানে হোক। নাহলে প্রতিদিন ওরা এখানে  এসে ঝামেলা করবে”।

আমি কোনও কথা বললাম না। কীই বা বলব।

রাতে লক্ষ্মী কিছু খেলনা। আমিও সামান্য কিছু মুখে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কী মনে করে মেন দরজার চাবিটা নিজের কাছে রাখলাম। ভোর হবার কিছু আগে শোবার দরজায়  ঠুক ঠুক আওয়াজে আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি লক্ষ্মী।

“ কি হল?” ধড়মড় করে উঠে বসলাম।

“ দরজাটা খুলে দিন। আমি যাব”। মুখ নামিয়ে লক্ষ্মী বলল।

ততক্ষণে আমি মনস্থির করে ফেলেছি, মেয়েটিকে এভাবে বিপদের মুখে ছেড়ে দেওয়া যাবে না।

বললাম, “কয়েকটা দিন এখানেই থাক। দেখি তোর জন্য কিছু করতে পারি কি না। তার আগে বলতো, তোর সাথে কী  হয়েছে যার জন্য তোকে  এমন পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে?”  

 লক্ষ্মী বোধ হয় এতটা আশা করেনি। সে  দুই হাঁটুর ফাকে মুখ গুঁজে দিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকল। তারপর যা বলল, তা  কোনও রহস্য গল্পের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।

 

          লক্ষ্মীর জীবনের গল্পটা তার  জবানীতেই বলছি-   আমার মা যখন মারা যায়, আমি আর আমার দিদি তখন নেহাতই ছোট। আমাদের দেখাশোনার জন্য বাবা আবার বিয়ে করে। আজ যে আমাকে তার মেয়ে বলে দাবি করছিল, সে আমার সৎমা। আমরা তাকে নতুন মা বলি।

নতুনমা প্রথম থেকেই আমাদের দুই বোনকে দিয়ে সংসারের সব কাজ করাত। না পারলে জুতো, লাঠি হাতের কাছে যা পেত তাই দিয়ে পেটাত।  নিজে  সারাদিন পাড়া বেরিয়ে, ঘুমিয়ে কাটাত। বাবাকে বলতে সাহস হত না। জানতে পারলে নতুনমা মারবে। বাবা একটা জুতোর দোকানে  সামান্য মাইনের কাজ করত। সন্ধ্যে বেলায় বাবা কাজ থেকে ফিরলে আমাদের ধড়ে প্রাণ আসত। রাতে বাবার পাশে বসে খেতাম। তারপর  তার গা ঘেঁষে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম।

সেই সুখটুকুও বেশিদিন  আমাদের সইলনা। হঠাৎ করে বাবার কী যে হল, কাজে যায় না, ভালো করে খায় না, স্নান করে না, কেবল আবোল তাবোল বকে। আমরা কিছু বলতে গেলে তেড়ে মারতে আসে।

       আমাদের দুঃখের শেষ নেই। নতুন মা আমাদের  উপর যারপরনাই অত্যাচার করে। শেষে আমাদের দুই বোনকে অন্যের বাড়িতে বাসন মাজার কাজে লাগিয়ে দিল।

      দিনের শেষে আমরা বাবাকে এখান ওখান থেকে খুঁজে বাড়ি নিয়ে আসতাম। একদিন আমরা হন্যে হয়ে খুঁজেও বাবাকে পেলাম না। আমি তখনও বেশ ছোট। রাতে বাবাকে ছাড়া ঘুমোতে পারি না। আমি খুব কান্না কাটি করতে থাকলাম। নতুন মা আমাদের দুজনাকে  ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ল। দু-দিন পরে বাবার লাশটা একটা পুকুরে ভেসে উঠতে দেখা গেল। কেউ তাকে শ্বাসরোধ করে মেরে পুকুরে ফেলে দিয়েছে।

    কিছুদিন যেতে না যেতেই নতুনমা বাবার বন্ধু  ভোম্বোল কাকাকে বিয়ে করে আমাদের বাড়িতে এনে তুলল। বাবার মাথার গোলমাল হওয়ার  পর থেকেই ভোম্বোল কাকা আমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া করছিল।

 

       আমি আর দিদি সারাদিন পরের বাড়িতে খেটে বাড়ি ফিরে দেখি, নতুন মা আর ভোম্বোল কাকা ঘন হয়ে বসে আছে, হাসি- মশকরা করছে।  বাবার জন্য  প্রাণটা হুহু করে ওঠে। পাগল- ছাগল হয়েও যদি বেঁচে থাকত তাহলে এই দৃশ্য দেখতে হত না। বাবার মৃত্যুর পিছনে কাদের হাত ছিল বুঝে নিতে অসুবিধে হয়না। কিন্তু বুঝেই বা কি করব।     

    কয়েক বছর পর দিদি পাড়ারই একজনের সাথে পালিয়ে বিয়ে করে  প্রাণ জুড়োলো। আমি একেবারে একা হয়ে গেলাম। একদিন কাজ থেকে ফিরতেই নতুনমা আমাকে  বলল, “ হাত –মুখ ধুয়ে একটা পরিষ্কার জামা পরে তৈরি হয়ে থাকিস”।

অবাক হয়ে তার মুখে দিকে তাকাতে, সে বলল,”  পাত্রপক্ষ  তোকে দেখতে আসবে”।

“ আমি এখন বিয়ে করব না”।

“ তা করবে কেন? দিদির মত কারও সাথে পালাবে? তবে সেটি হবে না। যা বলছি  শোন। নাহলে কপালে দুঃখ আছে”।

মনে যাই থাক, একটা পরিষ্কার জামা পরে বসে থাকলাম। সন্ধ্যের কিছু পরে ভোম্বল কাকা কয়েকজন লোক সাথে করে বাড়ি ঢুকল। বাবার বয়সী  এই লোকগুলোকে আমি একটু আধটু চিনি। এরা আমার সামনে বসে মদ খেতে খেতে খিস্তি-খেউর, অশ্লীল আলোচনা  করতে শুরু করল। বাজারে গোরু, ছাগল কেনা-বেচার সময় যেমন দর-দাম হয়, তেমন করে আমার দরদাম শুরু করল। আমি উঠে পালাতে গেলে ভোম্বল কাকা লাল চোখ ইশারা করে  নিষেধ করল।  উঠে পালাবার সাহস হল না।

   পরদিন  সন্ধ্যের আগে  নতুনমা যখন আমাকে তৈরি হতে বলল,

আমি বললাম, “ কাল তুমি মিথ্যা বলেছ। ওরা বিয়ের জন্য আসেনি। খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিল।”

“সব যখন বুঝেই গেছিস তখন চুপচাপ যেমন বলছি শোন। নাহলে তোর ভোম্বল কাকার রাগ জানিস তো? মেরে হাড়-মাস আলাদা করে দেবে”।

“ জানি,  তবুও  যাব না। তোমার নিজের মেয়ে হলে ওই বাজে লোকগুলোর  সামনে যেতে  বলতে পারতে?”

“ নখরা করিসনা লক্ষ্মী!  আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। এবার একটা কাণ্ড ঘটে যাবে।”

“বেশ শুনব,  তোমার কাণ্ড ঘটানো কিম্বা ভোম্বল কাকার মারের ভয়ে নয়”।

  “তাহলে?”

  “ রোজ আমাকে  বখরা দিতে হবে”।

  “কিসের বখরা?” নতুনমা খেঁকিয়ে উঠল।

  “ আমকে মূলধন করে যে ব্যবসাটা শুরু করেছ তার”।

  “কী যা তা বলছিস? মুখ ভেঙে দোবো”।

“সে দিতেই পারো, তবে  লোক জানাজানি হয়ে গেলে পুলিশের খপ্পরে পড়ে যাবে।বখরা পেলে কাকপক্ষীতেও জানবেনা। কথা দিলাম”।

“  তোর ভোম্বল কাকাকে বলে দেখব”।

“  আজ আমাকে  হাজার খানেক টাকা  দিতেই  হবে। নাহলে আমি  ওদের সামনে যাব না“।

“ হাজার খানেক টাকা? কী করবি?”  টাকার অংক  শুনে আঁতকে উঠল নতুন মা।

“দুটো শাড়ি, সঙ্গে সায়া ব্লাউজ, কিছু সাজ গোজের জিনিস কিনতে হবে। রোজ রোজ  এই  রঙচটা জামা পরে গেলে ভোম্বল কাকার বন্ধুরা ছাড়া আর কেউ পুঁছবে না। তোমাদের ব্যবসার দফা রফা”।

নতুন মা কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর আমার হাতে পাঁচশ টাকার দুটো নোট ধরিয়ে দিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি ফিরিস।  ওরা এসে পড়লে তখন---?”

বাকি কথাগুলো শুনতে পেলাম না, নিজের কিছু জমানো টাকা ছিল সেগুলোকেও  নিয়ে  আমি ততক্ষণে  বাড়ি  থেকে বেরিয়ে পড়েছি।

           প্রথমে ভাবলাম দিদির কাছে যাই। পরক্ষণেই  মত বদলালাম। এরা  আগে দিদির কাছে  আমার খোঁজ করতে যাবে। সেখানে আমাকে পেলে দিদিকেও  হেনস্থা করবে। অনেক দুঃখের পর দিদি একটু সুখের মুখ দেখেছে। তার সুখের সংসারে  অশান্তি হোক আমি তা চাই না।

স্টেশনে এসে সোজা ট্রেনে চেপে কোলকাতা, তারপর  পুনে।

 

     নতুন  জায়গা। ভাষা জানা নেই। থাকার জায়গা নেই। স্টেশনে একটা বুড়ি  ভিখারিনির রান্না করে দিই, কাপড় কেচে দিই। তার পরিবর্তে সে  তার  পাশে হাত খানেক জায়গা আমাকে ছেড়ে  দিয়েছে রাতে ঘুমোনোর জন্য। যেকটি টাকা এনেছিলাম, তাই দিয়ে একবেলা খাই। কাজ খুঁজে চলেছি। যে কোনও কাজ। কিন্তু একটা অচেনা মেয়েকে কে কাজ দেবে? টাকা কটা শেষ হলে কী হবে, ভাবতে গিয়ে ভয়ে বুক কাঁপছে।

 

         সেদিন, তখন কত রাত হবে কে জানে? আমার মনে হল কয়েকজন লোক মিলে  আমাকে  টেনে হিঁচড়ে কোথাও একটা নিয়ে চলেছে। আমি বাধা দেবার চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছিনা। ঘুমে শরীর অসাড়। দু চোখের পাতা ভারী। বুড়িমার গলা পাচ্ছি। সে লোকগুলোর সাথে  কথা বলছে। আবছা মনে পড়ল, বুড়িমা রাতে সরবতের মত কিছু একটা  আমাকে খেতে দিয়েছিল। বলেছিল,” রাতে না ঘুমিয়ে কেবল এপাশ ওপাশ করিস। এটা খা। ভালো ঘুম হবে”।

  ঘুমটা পাতলা হয়ে এলে দেখলাম, আমি  হাত-পা বাঁধা অবস্থায়  একটা অন্ধকার ঘরের মেঝেয় পড়ে আছি। শরীরটাকে  ঘষটাতে ঘষটাতে ঘরটার দরজার কাছে নিয়ে এসে পা দিয়ে ঠেলে বুঝলাম, সেটা বাইরে থেকে বন্ধ। ভয়ে বুক হিম হয়ে গেল। প্রতিটা মুহুর্ত এক যুগ মনে হচ্ছে।

    সকাল হতেই একটা ছেলে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল। তার হাতের থালায় দুটো রুটি একটা বাটিতে  ডালের মত কিছু একটা। থালাটা  আমার কাছে নামিয়ে রাখার সময়, ছেলেটি আমার দিকে কয়েক মুহুর্ত চেয়ে থাকল। তারপর চলে যেতে গিয়ে কী মনে করে ফিরে এসে চুপি চুপি পরিষ্কার বাংলায় বলল,” এরা তোমাকে দুবাই চালন করে দেবে। এই খাবারে ঘুমের ওষুধ মেশানো আছে। বাঁচতে চাইলে আমি যা বলছি শোনো”।

   আমি তার কথা শুনে কাঁদতে শুরু করলে সে বলল, “এখন সময় নষ্ট না করে আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনো। একটু পরেই দুজন লোক আসবে।  তুমি ঘুমের ভান করে পড়ে থাকবে। তোমাকে ওদের সাথে যেতে বললে তুমি  বাথরুম যেতে চাইবে।  ওরা পারমিশন দেবে। আমি বাথরুমের জানালার একটা শিক ভেঙ্গে রাখব। তুমি সেদিক দিয়ে লাফিয়ে পড়বে।  বাকিটা তোমার ভাগ্য। তবে এসময় ওদিকটায়  পাহারা থাকে না”।

   ছেলেটি  তাড়াতাড়ি থালার খাবারটা  একটা পলিথিনে মুড়ে  নিজের পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে চলে গেল।

  আমাকে অভিনয় করতে হবে। ঠিকমত করতে না পারলে  ভাগ্যে কী ঘটবে সেটা  বুঝতে না পারার কথা নয়। এসব ভাবনা  ছাপিয়ে একটা কথা বার বার মনে হতে লাগল, ছেলেটি  উপযাচক হয়ে কেন আমাকে  সাহায্য করতে এগিয়ে এল, এটা কোনও দিন জানা হবেনা। আমি অসফল হলে ওরও  ক্ষতি হতে পারে।

বেশিক্ষণ  অপেক্ষা করতে হলনা। একজন ষণ্ডা মতন লোক, পিছনে  একজন মহিলা ঘরে এসে ঢুকল। মহিলাটি  আমার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিল। তারপর একটা বোরখা আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সেটা আমাকে পরে নিতে বলল। আমি সেটা গায়ে চাপিয়ে নিলে ওরা আমাকে তাদের সাথে যেতে বলল। আমি এবার ইশারায় বাথরুম যাবার কথা জানালাম। আমি যা কিছু করছি চোখ বন্ধ করে, টলতে টলতে। আমার  বাথরুম যাবার কথায় ওরাএকটু যেন বিরক্ত হল। আমি ভাবলাম বুঝি শেষ রক্ষা হলনা।  ষণ্ডামতন লোকটা মহিলাটিকে কিছু একটা বলল। মহিলাটি  আমাকে টানতে টানতে ঘর থেকে বের করে, সামান্য তফাতে  একটা ঘুপচি মত ঘরের  ভিতর ঠেলে দিয়ে টিনের দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল।

 

    ঘরটার ভিতর এত দুর্গন্ধ , ঢোকা মাত্র বমি চলে এল।  আমি প্রথমেই   দরজাটার ছিটকিনিটা আটকে দিলাম।  ঘরটার  মেঝে থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে একটা ছোট জানালা আছে। সেখানে তিনটে শিকের একটা আগে থেকেই ভেঙে এমন ভাবে বসানো আছে হঠাৎ দেখলে  কেউ বুঝতে পারবে না। আমি জানি বলে বুঝতে  অসুবিধে হল না। বেঁটে মানুষের পক্ষে  জানালাটার নাগাল পাওয়া মুশকিল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে  সাধারনের  চেয়ে আমার হাইট একটু বেশি। একটু দেরি না করে বোরখাটা  খুলে ফেলে লাফিয়ে জানালার একটা শিক ধরার চেষ্টা করলাম। কিন্তু  নাগাল পেলাম না। বুঝলাম যতটা সহজ ভেবেছিলাম ততটা সহজ নয়।  এবার জলের বালতিটা উপুড় করে তার উপর উঠে দাঁড়াতেই  প্লাস্টিকের  বালতিটা  মড়াৎ শব্দ করে ভেঙ্গে গেল।

   সাথে সাথেই টিনের দরজায়  টোকা  পড়তে শুরু করল। একটু ঠেলা  দিলেই লড়ঝড়ে  টিনের দরজাটা খুলে যাবে। তারপর! ভয়ে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। কিন্তু অত সব  ভাবার সময় নেই। আমি নিজেকে সামলে  নিয়ে  বললাম,  "পা পিছলে পড়ে গেছি। একটু পরেই বেরোচ্ছি”।

    কী বুঝল কে জানে, দরজায় টোকা  বন্ধ হল। আমি মরিয়া হয়ে  ফের লাফ দিলাম। একবার, দুবার,  তিনবারের  বার  সফল হলাম। ভাঙা শিকটাকে  সরিয়ে  তার ফাঁক দিয়ে শরীরটাকে কোনও রকমে গলিয়ে পিছন দিকে  ঝুলে পড়লাম। পিছনের দিকটায় কিছুটা  ঝোপ-ঝাড় ছিল,তার ভিতর গিয়ে পড়লাম। একটু আধটু কেটে ছড়ে যাওয়া ছাড়া  তেমন  কিছুই হল না। ঝোপের  ভিতর দিয়ে গুঁড়ি মেরে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে  রাস্তায় উঠে  হাঁটতে শুরু করলাম। দৌড়ালে  অন্য বিপদ হতে পারে।

 

        বুকের ভিতর হাতুড়ি পিটছে। ওরা  নিশ্চয় এতক্ষণে আমাকে খুঁজতে লেগেছে। যে কোনও সময়  ধরা পড়ে যেতে পারি। আর ঝুঁকি নেবার সাহস হলনা।  রাস্তায়  কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ দেখতে পেয়ে তার শরণাপন্ন  হলাম। ছোট থেকে পুলিশের নাম শুনলে আমার হৃদকম্প শুরু হয়ে যায়। আজ  ট্রাফিক পুলিশটাকেই আমার ত্রাণকর্তা  বলে মনে হল।  আকারে ইঙ্গিতে, বোঝাবার চেষ্টা করলাম, আমি বিপদে পড়েছি, আশ্রয় চাই। পুলিশটা  আমাকে ইশারায় আশ্বস্ত করল। নিজের বোতল থেকে জল খেতে দিল। সঙ্গে সঙ্গে আশ-পাশ থেকে কিছুজন সেখানে  জড়ো হয়ে গেল।

 

       বেশ কয়েকদিন  কাছাকাছি একটা  থানার লক-আপে ছিলাম। ওই থানার বড় বাবু খুব ভাল মানুষ। তিনি  একজন বাংলা ভাষা জানা লোকের সাহায্যে আমার সাথে কথা বলে, আমাকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। অভিভাবক হিসেবে আমি বিশ্বনাথদার নামটা বলেছিলাম। বিশ্বনাথদার ফোন নম্বরটা আমার মনে ছিল।

  সেদিন থেকে আজ প্রায়  তিনমাস বিশ্বনাথদার বাড়িতেই আছি। বিশ্বনাথদার বাড়ি আমাদের বাড়ির কাছেই। নতুনমা, ভোম্বলকাকা আমকে নিতে এসেছিল। আমি না করে দিয়েছি। সেই থেকে রাস্তা-ঘাটে  বিশ্বনাথদার  সঙ্গে আমার নাম জুড়ে অকথা- কুকথা  বলে বেড়াচ্ছে। বৈশখীদিকেও রেহাই দিচ্ছেনা। নিরুপায় হয়ে বিশ্বনাথদা আপনার কাছে  আমাকে রেখে গেল। কিন্তু এখানেও এরা আমাকে থাকতে দেবেনা। এখন আমার মরা ছাড়া গতি নেই।

   কথা শেষ করে লক্ষ্মী কাঁদতে শুরু করল।

             “তোকে কোথাও যেতে হবেনা। দেখছি কী করা যায়। এখন যা মুখ-টুক ধুয়ে  ভালো করে চা কর”।

           আমি  বিশ্বনাথকে সঙ্গে নিয়ে থানায় গিয়ে লক্ষ্মীর ব্যাপারে সমস্ত খুলে বললাম। থানার বড় বাবু লক্ষ্মীর বিষয়ে অবগত ছিলেন। কিছুদিন আগে এই থানার মাধ্যমেই লক্ষ্মী পুণে থেকে এখানে ফিরেছে। তিনি পুলিশ পাঠিয়ে  ভোম্বল ও তার স্ত্রীকে  ডেকে পাঠালেন।  তারা এলে, লক্ষ্মীকে ফের হেনস্থা করার জন্য দশ  হাজার টাকা জরিমানা করলেন। ভোম্বলও তার স্ত্রী বড় বাবুর পায়ে ধরে কাঁদা কাটা করায়  জরিমানার টকাটা  মকুব হল।  বড়বাবু  কড়া ভাষায় বললেন,  এরপর কোনও রকম  ঝামেলা করলে মেয়ে পাচারের কেস দিয়ে  দুজনাকে জেলের ঘানি টানিয়ে ছড়বেন। ভোম্বল আর তার স্ত্রী  মুখ চুন করে পালিয়ে গেল।

       সেই থেকে লক্ষ্মী  আমার কাছেই থাকে। আমাকে “দিদি” ডাকে। এখন সে লক্ষ্মী নয়, শুভলক্ষ্মী। মাধ্যমিক অবধি পড়ার পর পড়া ছেড়ে দিতে হয়েছিল তাকে। এখন  ওপেন ইউনিভার্সিটির হায়ার সেকেন্ডারি (  B.P,P) কোর্সে ভর্তি হয়ে ফের পড়াশোনা শুরু করেছে। শনি, রবিবার কলেজে যায়, বাকি দিন গুলোয় জয়িতার কাছে সেলাই শেখে। সেখানে অনেকগুলো বন্ধুও হয়েছে তার। আমার সংসারটার  সাথে সাথে  শুভলক্ষ্মী এখন আমারও  অভিভাবক। 

লেখক : ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক 

ছবি : সংগৃহীত  

 

0 Comments

Post Comment