- 15 February, 2024
- 0 Comment(s)
- 162 view(s)
- লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
ঠিক এই কিছুক্ষণ আগে আমার সামনে যে জিনিসটা দাঁড়িয়ে ছিল সেটা আদৌ কোন ছায়া না কায়া তা আমি বলতে পারব না। কিন্তু এই ছায়ামূর্তিটা যে কার তা আমি জানি। আমার সদ্যমৃতা পত্নী নয়নাকে আমি এতটাই ভালোবাসতাম যে তার ছায়ারও আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়ার কোন উপায় ছিল না। কিন্তু এ কী করে সম্ভব! আমার স্ত্রী মারা গেছে ঘণ্টা দুই আগে। আমার মত সাধারণ ছাপোষা মানুষের জীবনেও কি এমন অলৌকিক ঘটনা ঘটতে পারে? আমি প্রকাশ মিত্র, ছোট একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে অতি সাধারণ মানের চাকরি করি। বিয়ের আগে আমি নয়নাকে চিনতাম না। মা আমার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্যে ওকে পছন্দ করেছিলেন। নয়না ছিল ইঞ্জিনিয়ার। এমনই সুন্দরী, চাকুরিজীবি, শিক্ষিতা মেয়েকে মা ঘরের বউ করে আনতে চেয়েছিলেন। বিয়ের পর আমি আর নয়না পরস্পরকে খুবই ভালবাসতে শুরু করলাম। আমার বিয়ের এক বছরের মধ্যেই মা মারা গেলেন। মায়ের বিয়োগে আমার বাবা সারাক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে থাকতেন। সংসারের থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নিয়ে শোবার ঘরের জানালার পাশে বসে থেকেই সারাদিন কাটিয়ে দিতেন। এর আরও দুবছর পর আমি বাবা হলাম। আমাদের মেয়ে রিমি হওয়ার পাঁচ মাস পর নয়না একটা বড় বিদেশি কোম্পানিতে কাজের সুযোগ পেল। আমার এতে আনন্দ হওয়ার কথা কিন্তু তা না হয়ে নয়নার উন্নতির প্রতি মনে একটা তখন ঈর্ষা জেগে উঠেছিল। চাকরি পাওয়ার বিষয়ে নয়নার উৎসাহের অন্ত ছিল না। বিদেশি কোম্পানিটাতে কাজ করলে বছরে অন্তত দুবার তাকে ইউরোপ কিংবা আমেরিকার কোথাও না কোথাও কাজের জন্য গিয়ে বেশ কিছুদিন থাকতে হবে। আমার ওকে দেখে ঈর্ষা হত। আমি পুরুষমানুষ হয়ে জীবনে কোনোদিন কলকাতা শহরের বাইরে পা রাখার সুযোগ পেলাম না আর আমার স্ত্রী কি না যাবে ইউরোপ- আমেরিকা! আমার মনে ধারণা তৈরি হয় যে এই কাজটা পেলে নয়না অনেক বেশি অহংকারী হয়ে যাবে। ওর সেই চাকচিক্য আর আধিপত্য আমার সহ্য হবে না। তাই আমি নানা ছুতোয় তাকে এই কাজে যোগ দেওয়ার থেকে বিরত করতে চেয়েছিলাম। প্রথমে আমার ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে অজুহাত দেখালাম। তারপর আমার বৃদ্ধ অসুস্থ বাবা এবং অবশেষে কিছু না পেয়ে নিজের প্রেমের দোহাই দিলাম। নয়নাকে অনেক প্রকারে বুঝিয়ে দিলাম যে তাকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে একদিনও সম্ভব নয়। বুঝলাম এই শেষবার আমি ওর হৃদয়ের মোক্ষম স্থানে আঘাতটা করতে পেরেছি। অবশেষে আমিই জিতে গেলাম। চাকরিটা করতে যাওয়া হল না বলে নয়না বেশ কিছুদিন মনমরা হয়ে রইল। নয়না এতে এতটাই হতাশ হয়েছিল যে সেই দুঃখে আর অন্যত্র কাজের চেষ্টাই করল না। প্রথমে এতে আমার খুব আনন্দ হয়েছিল। এবার থেকে নয়না সারাদিন ঘরে থাকবে বাবা ও রিমিকে দেখভাল করবে আর সর্বোপরি আমার চোখের আড়াল হবে না। আমার ঈর্ষার কারণ তখনকার মত শান্ত হল। কিন্তু এভাবে একটা বছর পার হতে না হতেই আমার মনে নয়নার প্রতি আবার ঈর্ষা জেগে উঠল এবং তারই সঙ্গে মিশে গেল কেমন একটা তাচ্ছিল্যের বোধ। সারাদিন অফিসের ধকল সহ্য করে এসে আমার কেবলই মনে হত নয়না বেশ আরামেই আছে। আমার রোজগারে বিনা পরিশ্রমে খাচ্ছে পরছে আর সারাদিন বাড়িতে বসে রান্নাবাটি খেলছে। বাইরের জগতের সমস্ত অপ্রাপ্তির ক্ষোভের ভার আমি নির্দ্বিধায় নয়নার ওপর চেচামেচি করে হালকা করতাম। নয়নার এতে কতটা কষ্ট ও অপমান বোধ হত তা নিয়ে চিন্তা করতাম না। নয়না রুখে দাঁড়ালে অত্যন্ত অনায়াসে ওকে ওর বেকারত্ব নিয়ে আর আমার উপার্জনে বসে খাওয়ার জন্যে খোঁটা দিতাম। একবারের জন্যেও তখন আমার মনে হত না যে নয়নার বেকারত্বের মূল কারণ আমিই। নয়নার ওপর রিমির সমস্ত ভার চাপিয়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্তে ছিলাম। মাঝেমাঝেই আমাদের মধ্যে ছোটখাটো ঝগড়া হতেই থাকল। এই কালই তো আমাদের সেই ছোটখাটো ঝগড়া চরম আকার ধারণ করেছিল। এখন ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলে বুঝতে পারি কত তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে একজন মানুষ কতটা নিচে নেমে যেতে পারে। নয়না অনলাইনে নিজের জন্যে একটা দামি ব্যাগ আর আমাকে উপহার দেবে বলে একটা দামি ঘড়ি কিনেছিল। অফিস থেকে ফিরে জিনিসগুলোর দাম দেখেই আমার মেজাজ চরমে উঠে গেল। আমি ওর ওপর তর্জন গর্জন শুরু করলে নয়না বলেছিল যে সে তার জমানো টাকা থেকে খরচ করেছে তাই এই নিয়ে কথা শোনানোর কোন অধিকার নাকি আমার নেই। আমার তখন বিশ্বাসই হয়নি যে নয়নার নিজস্ব কোন জমানো টাকা থাকতে পারে। নয়না আমাকে বলেছিল, ‘তোমার মত হাড়কিপটে লোকের সঙ্গে বিয়ে করাটাই আমার অপরাধ হয়েছে।’
আর এই সামান্য অপমানে আমি আমার সকল শিক্ষা আর ভালোবাসাকে ভুলে সমস্ত সীমা লঙ্ঘন করে নয়নাকে সজোরে একটা চড় মারতে গিয়েছিলাম। কিন্তু চড়টা তার গালে না লেগে পড়েছিল কানের ওপর। বুঝতে পারছিলাম নয়নার মাথা ঝিমঝিম করছে। ওর চারদিক অন্ধকার হয়ে যেতেই মাথা ঘুরে পড়ে গেল মেঝেতে। আমি সেই রাত্রে অত্যন্ত ভয় পেয়ে ছুটে বাড়ির বাইরে চলে আসি। তারপর রাস্তাতেই কিভাবে যে খোলা আকাশের নিচে সারারাত কাটিয়ে দিলাম তা নিজেও জানিনা। পরের দিন একেবারে অফিস করে সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরলাম। আমি এসে নক করতে বাবাকে দরজা খুলতে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। বাবা আমাকে দেখে কান্না জড়ানো গলায় বললেন, ‘দেখ না বাবা, বউমা সেই কোন সকালে রান্নাঘরে ঢুকে দরজা দিয়েছে তারপর আর কিছুতেই খুলছে না। নাতনিটা কেঁদে কেঁদে শরীর খারাপ করে ফেলছে।’
আমার মাথাটা ঠিক সেই মুহূর্তেই যেন একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল। দরজা খোলার অনেক চেষ্টা করেও যখন কিছু হল না তখন অবশেষে দরজা ভাঙতে হল। দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে যে দৃশ্যটা আমার চোখে পড়ল সেটা দেখে আমার রক্ত জল হয়ে গেল। আমার সামনে নয়নার নিথর দেহ মাটিতে পড়ে রয়েছে। বাঁ হাতের ঠিক যে শিরাটা কাটলে মানুষের সামনে অনায়াসে স্বর্গের দরজা খুলে যায় ঠিক সেই শিরাটা সুনিপুণ ভাবে কাটা। নয়নার অপূর্ব শিল্পকর্ম দেখে আমার সারা শরীর শিউরে উঠলো। গোটা ঘর তখনও টাটকা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। যে বড় ছুরিটা দিয়ে নয়না হাত কেটেছে সেটা তখনও নিজের সমস্ত শরীরে নয়নার রক্ত মেখে মেঝেতেই পড়ে রয়েছে। নয়না নিজের মুখটা একটা কাপড় দিয়ে শক্ত করে এমনভাবে বেঁধেছে যাতে তার আর্তনাদ বাইরে থেকে কেউ শুনতে না পায়। প্রবল যন্ত্রণায় নয়নার ফর্সা সুন্দর মুখটা বিভৎস ভাবে বিকৃত হয়ে গেছে। বাবার ডাকাডাকিতে আমার সম্বিৎ ফিরল। বাবা কাঁপা গলায় বললেন, ‘বউমাকে এক্ষুণি হাসপাতালে ভর্তি কর।’
হাসপাতালে ভর্তি করার পর ডাক্তার জানালেন যে নয়নার শরীর থেকে অনেকটা রক্ত বেরিয়ে গেছে তাই রক্তের প্রয়োজন। ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে অনেক রক্ত দেওয়ার পরেও কোন চিকিৎসা নয়নাকে ফিরিয়ে আনতে পারল না। বলা ভাল নয়না হয়ত আর ফিরে আসতে চাইল না। ডাক্তার জবাব দেওয়ার পর আমাকে নয়নার ডেথ সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্যে চার ঘণ্টা অপেক্ষা করতে বললেন। কিন্তু নয়নার প্রেতচ্ছায়া আবার কি করে ফিরে এল তা জানি না। হতে পারে সবটাই আমার কল্পনা কিন্তু এই প্রেতটা আমার সামনে একটা দর্পনের মত দাঁড়িয়ে থেকে যেন বলছিল, ‘আমি তখনই মরে গিয়েছিলাম যখন তুমি আমার গায়ে হাত তুলেছিলে। আমার গল্পটা ফুরানোর আগেই আমাকে মেরে ফেললে?’
আমার চরিত্রের একটা অন্ধকার দিকের সাক্ষী এই প্রেতটা যেন আমার অন্তঃসারশূন্যতাকে নিজের অস্তিত্বের মধ্যে দিয়ে ক্রমাগত ব্যঙ্গ করে চলেছে। জানি ওর কাছে যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি ক্ষমা না চাইব ওর মুক্তি নেই। আমার মনে হল মুক্তি তো আমারও নেই। নয়না যদি আমার কাছে আর কখনো ফিরে না আসে তবে আমার জীবনটাও নরক হয়ে যাবে। আমার ছোট্ট নির্দোষ মেয়েটা মায়ের কোলের উষ্ণতার জন্য একনাগাড়ে কেঁদে চলেছে। আমি নয়নাকে সত্যিই ভালোবাসতাম তাই কোনোদিনও তার মৃত্যুর কল্পনা করতে পারিনি। নয়না যে সত্যিই আর নেই একথা বিশ্বাস হচ্ছিল না। সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে হাসপাতালের একটা অপেক্ষাকৃত নির্জন জায়গায় সরে এলাম। আমার মাথা কাজ করছিল না। এবার তো থানা-পুলিশ অনেক কিছু হবে। আমিই কেবল জানি যে এটা আত্মহত্যা নয়, এটা একটা খুন। আর এই খুনটা করেছি আমি। আমি মধ্যবিত্ত এক অতি সাধারণ মানুষ প্রকাশ মিত্র, যে একটা মশাকেও ঠিকমত কখনও মারতে পারিনি সেই আমি নিজের জলজ্যান্ত স্ত্রীকে খুন করে ফেললাম? আমার স্ত্রীর ওপর আমার অধিকার থাকলেও রিমির থেকে তার মাকে কেড়ে নেওয়ার কোন অধিকার আমার নেই। হাসপাতালের ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেছে। মানুষের ভিড়ের সেই হট্টগোল এখন আর নেই। হাসপাতালের পিছনদিকের এই স্থানটা বড় নির্জন। বসার জন্য সারি দিয়ে চেয়ার রাখা আছে তারই একটাতে আমি হেলান দিয়ে বসলাম। আমার ঠিক সামনে একটা স্লাইডিং দরজা। পায়ের দিক থেকে কোমর পর্যন্ত অর্ধেকটা কাঠের আর বাকিটা ঘষা কাঁচ দিয়ে তৈরি। ঐ কাঁচের ওপরেই আঁকা রয়েছে নয়নার ছায়ামূর্তিটা। ছায়ার প্রতিটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আমার কাছে স্পষ্ট। আমি পুরুষমানুষ হয়েও নয়নার প্রেতের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আমি ওর কাছে ক্ষমা চাইলাম বটে কিন্তু জানি আমাকে ক্ষমা করা ওর পক্ষে অত সহজ হবে না। আমি নয়নাকে বললাম, ‘নয়না, প্লিজ তুমি ফিরে এসো। রিমির কথাটা অন্তত একবার ভেবে…’
কথাটা বলে ফেললেও মনে হল আবার কোন অজুহাত দিয়ে নয়নার প্রেতমূর্তির স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকার আমার নেই। আমার গলা থেকে আর স্বর বেরোলো না। চোখের বাঁধ ভাঙা জল সামনের সব কিছুকে ঝাপসা করে দিল।
কতক্ষণ যে এভাবে অন্যমনষ্ক হয়ে কেঁদে গেছি জানিনা। কিন্তু একজন নার্সের গলা পেয়ে আমি চমকে উঠলাম, ‘স্যর আপনি এখনও এখানে বসে আছেন? ওদিকে ডক্টর আপনাকে খুঁজছেন, আপনার স্ত্রী রেসপন্স করছেন।’
আমার বুঝতে বাকি রইল না যে এবারেও আমি আমার স্ত্রীর হৃদয়ের মোক্ষম স্থানে আঘাত করতে পেরেছি। নয়না আমার ওপর অভিমান করে চলে গেলেও নিজের মেয়ের উপর মায়া কাটাতে পারেনি। আমি জানি নয়না এবার ফিরে এসে আর আমার মত লোকের সঙ্গে থাকতে চাইবে না। নয়নার পৈতৃক ভিটেটা অনেকদিন হল ফাঁকাই পড়ে রয়েছে। সেখানে উঠে নয়না আবার সেই বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে নিশ্চয় যোগাযোগ করে ঐ কাজটা আবার নেওয়ার চেষ্টা করবে আর আকাশপথে আমারই চোখের সামনে দিয়ে উড়ে চলে যাবে আমেরিকা। এবার শুধু আমি কেন আমার চোদ্দ পুরুষও ওকে আটকাতে পারবে না।
লেখক : শিক্ষার্থী, ছোটগল্পকার
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment