- 14 April, 2023
- 0 Comment(s)
- 242 view(s)
- লিখেছেন : শাম্মা বিশ্বাস
সিমন দ্য বোভোয়ার ছিলেন একজন ফরাসি লেখিকা, বুদ্ধিজীবী,অস্তিত্ববাদী দার্শনিক, নারীবাদী ও সমাজতত্ত্ববিদ। সিমন ১৯০৮ সালের ৯ জানুয়ারি প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জর্জ ব্যারত্রঁ দ্য বোভোয়ার ছিলেন আইনজীবী, মা ফ্রঁসোয়া ব্রাসোর ছিলেন গৃহকর্ত্রী। তিনি খুব ধার্মিক মহিলা ছিলেন। সিমনের একটা বোন ছিল যার নাম হেলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তাঁদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে এই সময় তাঁদের মা দুই বোনকে ধর্মবাদী বিদ্যালয়ে পাঠাতে চেয়েছিলেন। সিমন ছোটবেলায় খুব ধর্মবাদী ছিলেন,কিন্তু ১৪ বছর বয়সে তিনি ধর্মের উপর বিশ্বাস হারান এবং সারা জীবন নাস্তিক থাকেন।
সিমন ১৯২৫ সালে গণিত ও দর্শনে ব্যাকালরেট পরীক্ষায় পাশ করেন। এরপর তিনি ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয় সোরবোর্নে দর্শন নিয়ে পড়েন। সেখানে তাঁর পরিচয় হয় বিখ্যাত লেখক দার্শনিক জঁ-পোল সার্ত্রের সঙ্গে। ১৯২৯ সালে ২১ বছর বয়সে তিনি দর্শনে এগ্রিগেশন পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান পেয়ে উত্তীর্ণ হন। সেখানে থিসিস করেছিলেন দার্শনিক লাইবনিজের ওপর। একই পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন জঁ- পোল সার্ত্র। সে সময় তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব, প্রেম ও গুরু-শিষ্যের জটিল সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
সিমন মনে করতেন সমাজে দুই শ্রেণির প্রাণী আছে। প্রথম সারিতে থাকেন পুরুষ আর দ্বিতীয় সারিতে অন্যান্য গোত্রভুক্ত প্রাণী। পুরুষ শাসিত এই সমাজ নারীদের প্রতিনিয়ত ‘অন্যান্য’ গোত্রের মধ্যে বসবাসরত এক কাল্পনিক জীব হিসেবে ভাবতেই বেশি আনন্দ পায়। এর অন্যতম কারণ হিসেবে পুরুষরা সবসময় যে সাফাইটি দেন তা হলো নারীকে বোঝা কঠিন আর এরা সবসময়ই রহস্যাবৃত। সে কারণেই নারী ও পুরুষকে একই পাল্লায় মাপা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। নারীদের প্রতি সমাজের এই বৈষম্যের কথা জানা ছিল বলেই সিমনের মতো একজন নারীবাদীই হয়তো বলতে পেরেছিলেন ‘নারী হয়ে কেউ জন্মায় না, বরং কেউ নারী হয়ে ওঠে’। ১৯৪৩ সালে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের পটভূমিতে তাঁর এবং সার্ত্রের জটিল সম্পর্ককে কেন্দ্র করে লেখেন প্রথম উপন্যাস ‘সি কেম টু স্টে’। ১৯৪৫ সালে সিমনের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘লা সেং ডেস অট্রিস’ প্রকাশিত হয়। ১৯৫৪ সালে সিমন প্রকাশ করেন আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘লেস মেন্ডারিন’ বা দি ম্যান্ডারিন। এর পটভূমি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষকাল। ১৯৪৯ সালে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় তার সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক গ্রন্থ ‘দি সেকেণ্ড সেক্স’। বইটিতে তিনি লিঙ্গ বৈষম্যের ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিগুলো ব্যাখ্যা করেছেন। ইতিহাসের আলোকে নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন এ বইতে। বইটি তিনি দুই খণ্ডে প্রকাশ করেন। প্রথমটি ‘ফ্যাক্টস অ্যান্ড মিথস’, দ্বিতীয়টি ‘লিভড এক্সপেরিয়েন্স’। এটিকে নারীবাদী দার্শনিক গ্রন্থেরও সেরা বই হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ তাঁর এ বইয়ের প্রভাবেই তৈরি হয় নারীবাদী প্রচার-প্রসারের দ্বিতীয় ঢেউ। ‘নারী হয়ে জন্মায় না কেউ, বড় হতে হতে নারী হয়ে যায়’—এ কথাগুলো উচ্চারণ করার মাধ্যমে তিনি প্রথমবারের মতো শারীরিক লিঙ্গপরিচয় এবং সামাজিক ও ঐতিহাসিক লিঙ্গপরিচয়ের মধ্যে পার্থক্য দেখানোর চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ‘নারীরা দ্বিতীয় লিঙ্গ—তার কারণ হলো, তাদের পুরুষের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা হয় '। উদাহরণ হিসেবে দেখান—অ্যারিস্টটল বলেন, ‘তাদের মধ্যে কিছু গুণের অভাব আছে বলেই নারীরা নারীসুলভ।’ সেইন্ট টমাস বলেন, ‘পুরুষের ত্রুটিপূর্ণ অবস্থা বা ঘাটতির নাম হলো নারী।’ তবে সিমন নিজে মনে করতেন, নারীরা পুরুষের মতই নিজের পছন্দের বিষয় ও পথ বেছে নিতে পারে। নিজেদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম তারা। এছাড়াও ১৯৫৮ সালে সিমন চার খণ্ডে তার আত্মজীবনী শেষ করেন- মেমোয়ার্স অব এ ডিউটিফুল ডটার, দি প্রাইম টাইম, ফোর্স অব সারকামস্টেন্স এবং অল সেইড অল ডান। ১৯৭৯ সালে প্রগতিশীল নারীদের জীবন অবলম্বনে লেখেন ছোটগল্প ‘দ্য থিংস অব দি স্পিরিট কাম ফার্স্ট’, দ্য প্রাইম অফ লাইফ, দ্য লং মার্চ, দি ওমেন ডেস্ট্রেয়েড ইত্যাদি।
নিজের পছন্দমতো জীবনযাপনে অভ্যস্থ এবং বিশ্বাসী ছিলেন সিমন। নারীর অধিকার নিয়ে সবসময় সচেতন থাকার কারণেই পুরুষকেন্দ্রিক আচার আনুষ্ঠানেও তার উপস্থিতি ছিল অনেক কম। এই নারীবাদী নারী ১৯৮৬ সালের ১৪ এপ্রিল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃত্যুর পর সিমন দ্য বোভোয়ারকে সমাধিস্থ করা হয় প্যারিসে, তাঁর বন্ধু জঁ-পোল সার্ত্রের সমাধির ঠিক পাশেই।
0 Comments
Post Comment