- 31 December, 2022
- 0 Comment(s)
- 197 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
বর্ষশেষের মরসুমে এই লেখা লিখতে বসেছি। শক্ত কথা লিখতে চাইব না। তত্ত্ব কথাও নয়। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, ক্ষোভ, বিক্ষোভ, বিরক্তি, সবকিছুই তো বাকি সারাটা বছরের জন্য, বাকি পড়ে আছে। শেষবেলায় বরং ইতিহাসের পাতায় ডুব দিয়ে আসি চলুন। ইরান, আফগানিস্তান, নারীমুক্তির আন্দোলন এই সমস্ত কিছুকে অবচেতনে মনে রেখেই খুঁজে বের করতে চেষ্টা করি দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা সম্রাজ্ঞী, মানুষের আন্দোলনে প্রথমবারের জন্য ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছনো এক অসমসাহসী বীরাঙ্গনার উপাখ্যান। ইতিহাসের গতানুগতিক সিলেবাস অনুযায়ী তিনি একসময়ে খ্যাতিমান হলেও, ক্রমশ কালের মলিনতায় হয়তো বা তিনি গণ-পরিচিতির নিরিখে ঈষৎ ধূসর হয়ে পড়েছিলেন। ঈষৎ সরে গিয়েছিলেন লোক-কৌতূহলের চেনাশোনা বৃত্তের বাইরে; যেন বা হারিয়ে গিয়েছিলেন। সচেতন ভাবে আমারও যে মনে ছিল এমনটা নয়। কেবল বর্ষশেষের এই সময়ে নানান বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎই তাঁর খোঁজ পেলাম। নতুন করে তাঁর ইতিহাসকে উপলব্ধি করলাম। মনে হলো বছর শেষে বরং জানিয়ে দিই তাঁরই জীবনবৃত্তান্ত। তাঁরই অজানা ইতিহাস। নারীমুক্তির আন্দোলন যে সহস্রাব্দ পেরিয়ে এসেছে, এমন বীরাঙ্গনাদের ইতিহাসই তো তাই নতুন উদ্যমে প্রচারিত হওয়া উচিত।
অনেকে বলবেন সুলতানা রাজিয়া ওরফে রাজিয়া সুলতানার উপাখ্যান। আমি তা বলব না, এর কারণ সুলতানা রাজিয়া ও রাজিয়া সুলতানা এই দুইটি সম্বোধনের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে।[১] সুলতানা রাজিয়া বলতে বোঝায় সম্রাজ্ঞী অথবা একচ্ছত্র ক্ষমতা যাঁর। অন্যদিকে রাজিয়া সুলতানা বলতে বোঝায় সম্রাটের স্ত্রী, বোন অথবা সঙ্গিনী, কিন্তু কখনই ক্ষমতার অধিকারী নন, এই অর্থে। কাজেই সুলতানা রাজিয়া ছিলেন সুলতানা রাজিয়াই কেবল। রাজিয়া সুলতানা কখনই তাঁর সম্বোধন হতে পারে না। কিন্তু বহুক্ষেত্রেই প্রচলিত অর্থে ইতিহাসবিদ থেকে সাধারণ মানুষ এই ভুলটিকেই উচ্চারণ করে এসেছেন। দিল্লীতে তখন মামলুক তুর্কিদের শাসন। তৃতীয় ইলতুৎমিসের কন্যা ও শামসুদ্দিন আইবকের দৌহিত্রী রাজিয়া ছোটবেলা থেকেই মুক্ত পরিসরে বড় হয়ে ওঠেন। রাজকার্য-সহ অন্যান্য নানা বিষয়ে তিনি পিতার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পোক্ত হয়ে ওঠেন। পিতা ইলতুৎমিসও কন্যার মধ্যে এই প্রতিভার স্ফূরণকে লক্ষ্য করেছিলেন। তাই ১২২৯ সালে নিজের সবচেয়ে প্রিয় পুত্র ও তাঁর চোখে ভবিষ্যৎ রাজ্যশাসনের পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি নাসিরুদ্দিন মাহমুদের মৃত্যু হলে পরে ইলতুৎমিস অন্যান্য সমস্ত পুত্রের চেয়ে রাজিয়াকেই নিজের উত্তরাধিকারী বলে চিহ্নিত করেন। এর ফলে অবশ্য সমাজের মাথাস্থানীয় ব্যবসায়ী ও অন্যান্য ক্ষমতাশালী পুরুষদের কি প্রতিক্রিয়া হবে ইলতুৎমিস তা ধর্তব্যে আনেননি। ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পর রাজ্যের ক্ষমতাবান এই পুরুষ আমলা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা একজোট হয়ে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র রুখনউদ্দিন ফিরোজকে সিংহাসনে অভিষিক্ত করেন। অকর্মণ্য রুখনউদ্দিন, তাঁর মা শাহ তুর্কানের অঙ্গুলিহেলনেই রাজ্য শাসন করতে থাকেন। এই সময়ে দিল্লির সাধারণ জনতা, যারা কিনা রাজিয়ার প্রতি অনুগত ছিল, অক্টোবর-নভেম্বর ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে তারা একজোট হয়ে ক্ষেপে উঠে সম্রাটের প্রাসাদ আক্রমণ করে। রুখনউদ্দিন ও শাহ তুর্কানকে বন্দি করা হয়। জনতার আন্দোলনে সুলতানা রাজিয়া সম্রাজ্ঞীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। দিল্লির ইতিহাসে এই প্রথমবার সাধারণ মানুষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিবাদে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে স্থলাভিষিক্ত করে।[২] ৯ই নভেম্বর ১২৩৬, রুখনউদ্দিন ও তাঁর মা শাহ তুর্কানকে হত্যা করা হয়।
সম্রাজ্ঞী হিসেবে রাজিয়া কেমন ছিলেন তার বিচার ইতিহাস করবে। কিন্তু প্রথমেই যে দুইটি উল্লেখযোগ্য বিষয়, সেই প্রাক-‘মধ্যযুগীয় সময়েও’ সম্রাটের তরফে নিজের কন্যাকে উত্তরাধিকারী হিসেবে চিহ্নিত করতে কোনও দ্বিধা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তদুপরি রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ গণবিদ্রোহের মাধ্যমে একজন নারীকে সুলতানের আসনে বসাচ্ছেন। সামাজিক দিক থেকে এ এক মনে রাখবারই মতো ঘটনা। দক্ষিণ এশিয়ায় রাজিয়া ছিলেন প্রথম মহিলা সম্রাট। রাজ্যশাসন করতে গিয়ে নিজেরই পছন্দ মতো মানুষজন, বিশেষত যারা কি না উচ্চবংশীয় নয়, তাদেরকে রাজকীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে রাজিয়া বসাতে শুরু করলে পরে অভিজাতবংশীয়দের সঙ্গে তাঁর বিবাদ শুরু হয়। ইলতুৎমিসের অধীনে কর্মরত, একজন আবিসিনিয় হাবসি ক্রীতদাস জামালুদ্দিন ইয়াকুৎকে রাজপ্রাসাদের অশ্বশালার অধিকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করার পরবর্তীতে অভিজাতবংশীয়দের ক্ষোভ ক্রমশই ফেটে পড়তে শুরু করে। ইয়াকুতের সঙ্গে রাজিয়ার সম্পর্ক নিয়েও নোংরা কানাঘুষো ও কুৎসা রটনা শুরু হয়। ঐতিহাসিক ইবন বতুতার রচনা থেকে এই বিষয়ের বিস্তারিত উল্লেখ পাওয়া যায়।[৩] ইতিহাসের গতিতে অবশ্য বিদ্রোহীদের হাতে জামালুদ্দিন নিহত হন এবং মিনহাজ-উস-সিরাজের রচনা থেকে জানা যায়, ৩ বছর ৬ মাস ৬ দিনের শাসনকালের পর[২] ভাতিণ্ডার প্রশাসক ও বিদ্রোহী নেতা মালিক আলতুনিয়ার হাতে যুদ্ধে পরাস্ত হলে পর সুলতানা রাজিয়াকে বন্দি করা হয়।
পরবর্তীতে এমন সাফল্যের পরেও, অভিজাতবংশীয়দের চক্রান্তে নিজে সম্রাট না হতে পারার দুঃখে আলতুনিয়া স্বয়ং শেষ অবধি রাজিয়ার সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেন। সুলতানা রাজিয়া ও মালিক আলতুনিয়ার বিবাহ হয়। দুইজনে একত্রে অন্যান্য বিদ্রোহীদের হঠিয়ে, অভিজাতবংশীয়দের দ্বারা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত সম্রাট বাহরাম শাহকে উৎখাত করতে লড়াই শুরু করেন। একাধিক সংঘর্ষের পর, শেষমেশ করুণ অবস্থাতেই পলায়নোন্মুখ, কর্পদকশূন্য রাজিয়া এক স্থানীয় কৃষকের কাছে আশ্রয় চান। তিনি সেই সময়ে পুরুষের ছদ্মবেশে ছিলেন। কিন্তু টাকা ও দামী পোশাকের লোভে সেই কৃষক রাজিয়াকে হত্যা করে। পরে সেই পোশাক বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে যেতেই সেটিকে বাজারের অন্যান্য মানুষ শনাক্ত করেন। রাজিয়ার মরদেহটিকে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে উদ্ধার করে নিয়ে এসে যমুনা নদীর তীরে সমাধিস্থ করা হয়। ইবন বতুতার বিবরণ[৩] থেকেই এই ঘটনারও সম্পূর্ণ আখ্যান জানা যায়। এছাড়াও ফিরোজ শাহ তুঘলকের সময়ে রচিত শামস সিরাজ আফিফের গ্রন্থ ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহি’র অন্তর্গত বিভিন্ন জমির দলিল ও দস্তাবেজ থেকেও[৪] রাজিয়ার সমাধিস্থলটির অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বর্তমানে পুরনো দিল্লির তুর্কমান ফটকের কাছে মহল্লা বুলবুলিখানায় চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা সম্রাট[১] সুলতান জালালত আল-দুনিয়া ওয়াল-দিন রাজিয়া। যাঁর বিরুদ্ধে জীবনের শেষ যুদ্ধে গিয়েছিলেন তিনি - সেই বাহরাম শাহ নিজেই রাজিয়ার সমাধির ব্যবস্থা করেছিলেন। এই সমাধিক্ষেত্রেই রাজিয়ার পাশে শুয়ে আছেন তাঁর বোন শাজিয়া। সুলতানা রাজিয়া যিনি কি না ইরান আন্দোলনের বহু শতাব্দী আগেই মাথা খুলে, পুরুষের পোশাক পরে দরবারে অধিষ্ঠিত হতেন। হাতির পিঠে চেপে দিল্লির রাস্তাতে রাজ্য পরিদর্শনে বের হতেন। মানুষের হাতেই তিনি সম্রাজ্ঞীর আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। অত্যাচারিতা নারীর আন্দোলনের ইতিহাসে তাঁর এই কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে মনে রাখার। ধর্মের নিগড় বা অন্ধকার কখনই সমাজে সত্যকার নারীর উত্থানকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। রাজিয়া থেকে মাহশা আমিনি অবধি প্রত্যেকেই খোলা মাথায়, শিরদাঁড়া সোজা রেখে পুরুষ তথা পৃথিবীর দিকে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে সাহস দেখিয়েছেন।
চিত্রেঃ সুলতানা রাজিয়ার চালু করা মুদ্রা
সূত্র:
[১] ‘এ সেন্ট, এ ফোকটেল এ্যাণ্ড আদার স্টোরিজ’, রানা সাফভি, রূপা পাবলিকেশনস ইণ্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড, ২০২১
[২] ‘এ কমপ্রিহেনসিভ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’, মহম্মদ হাবিব ও খালিক আহমদ নিজামি, পিপলস পাবলিশিং প্রেস, ১৯৯২
[৩] ‘দ্য রেহলা অব ইবন বতুতা’, অনুবাদঃ এস মেহদি হাসান, ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউট, বরোদা, ১৯৭৬
[৪] ’দ্য হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়াঃ এ্যাজ টোল্ড বাই ইটস ওন হিস্টোরিয়ানস, দ্য মহামেডান পিরিয়ড’, এইচ. এম. এলিয়ট, ট্রাবনার এ্যাণ্ড কোং, ১৮৭১
0 Comments
Post Comment