- 14 May, 2020
- 0 Comment(s)
- 723 view(s)
- লিখেছেন : আফরোজা খাতুন
তাৎক্ষণিক তিন তালাকের বিরুদ্ধে দেশের উচ্চ আদালতে তালাকপ্রাপ্ত পাঁচজন মুসলিম মহিলা আবেদন জানান। বাইশ আগস্ট ২০১৭, তাৎক্ষণিক তিন তালাক অসাংবিধানিক ঘোষণা করে উচ্চ আদালত। এই রায়ের ভিত্তিতে সরকার মুসলিম তালাক বিলের খসড়া তৈরি করে। তিরিশ জুলাই ২০১৯, রাজ্যসভায় পাস হয় তিন তালাক বিল (Protection of Rights on Marriage)। এই বিল অনুযায়ী ভারতীয় আইনে তাৎক্ষণিক তিন তালাক ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। মৌখিক, বৈদ্যুতিন বা লিখিত মাধ্যমে তাৎক্ষণিক তিন তালাক দিলে অপরাধীর তিন বছর পর্যন্ত কারাবাস ও জরিমানা হতে পারে। ম্যাজিস্ট্রেট একটা খোরপোশ নির্ধারিত করবেন সেই স্ত্রীর জন্য। অপরাধী স্বামী সেই নির্ধারিত খোরপোশ তালাক দেওয়া স্ত্রীকে দিতে বাধ্য হবেন। তাৎক্ষণিক তিন তালাক রদ আইন তৈরির দৃঢ পদক্ষেপের প্রশংসা করছেন অনেকেই। স্বয়ং প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টুইট করে লেখেন, ‘এটা লিঙ্গ বৈষ্যমের বিরুদ্ধে জয়। এর ফলে সমাজে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার পথ আরও প্রশস্ত হলো’।
তাৎক্ষণিক তিন তালাক শুধু নয়, মৌখিক তালাকের বিরুদ্ধেই এদেশের অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা দীর্ঘ দিন সরব হয়েছেন। লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধেই এই আন্দোলন। তাহলে তিন তালাক বিলে কি লিঙ্গ বৈষম্য দূর হলো? যেমনটা দাবি করছেন মাননীয় প্রধান মন্ত্রী। তালাক বিল ব্যাখ্যা করে দেখতে পারি সত্যিই লিঙ্গ সাম্য এলো কিনা। মুসলিম পুরুষরা জন্মসূত্রেই তালাক দেওয়ার অধিকার অর্জন করে। তালাক দেওয়ার ধর্মীয় বিধানে যতই কঠোর নিয়ম থাকুক না কেন, ক্ষমতা ভোগ করে পুরুষরাই। মুসলিম মেয়েদের সেই অধিকার নেই। ক্ষমতা অর্জন করতে হয় বিয়ের সময় কাবিলনামায় লেখাপড়া করে। কিন্তু সেটাও স্বামীর কাছ থেকে তালাক চাইবার অধিকার অর্জন, নিজের মুখে তালাক প্রয়োগ করার নয়। তাই তাৎক্ষণিক তিন তালাককে দেশের উচ্চ-আদালত অবৈধ ঘোষণা করার পর অপেক্ষা ছিল সম-অধিকারের আইন। যদি দুটি মানুষ একসঙ্গে থাকতে না পারে তাহলে আলাদা হবে, বিচ্ছেদ নেবে এটা যুক্তিসঙ্গত এবং মানবিক। মুসলিমদের বিয়ে হবে ছেলে-মেয়ের মত নিয়ে, চুক্তিভিত্তিক। বিয়ের বেলায় সম-অধিকার কিন্তু বিবাহ-বিচ্ছেদে যেন প্রভুর হুঙ্কার, পিতৃতন্ত্রের দাপট। দাপট মুক্তির আইন, লিঙ্গ সাম্যের আইনের আবেদন ছিল সরকারের কাছে। স্বামী অধিক ক্ষমতাবলে কোন ইচ্ছে পূরণের কারণে তালাক দিয়ে বিদায় করবে অথবা অত্যাচার থেকে মুক্ত হতে চাইলেও স্ত্রীকে তালাক না দিয়ে আটকে রাখবে, এই বৈষম্য দূর করার দাবিতেই আন্দোলন। কিন্তু কী পেলাম? রাষ্ট্রশক্তি মুসলিম মেয়েদের নিয়ন্ত্রণে রেখে, মুসলিম পুরুষদের ক্রিমিন্যাল তকমা আটার প্যাঁচ কষা আইন ঘোষণা করল। বিভাজন আর পিতৃতান্ত্রিকতার আধিপত্যে রচিত হল তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিল। ভারতের উচ্চ আদালত যে তালাককে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে, সরকারের ক্যারিসিমায়, আইনের ফেরে, তিন তালাক বিলের জোরে মুসলিম পরিবার ভাঙনের কাজ সুবিধা হলো।
মুসলিম বিবাহ-বিচ্ছেদে (তালাক) লিঙ্গ বৈষম্য কত প্রকট তা কিছুটা স্পষ্ট করা যেতে পারে বাস্তব অভিজ্ঞতার দৃষ্টান্তে। ২০১১ সাল, ডায়মন্ড হারবারের এক উচ্চ শিক্ষিত মেয়ে মেসেজ করলেন। তাঁকে সাহায্য করতে হবে। স্বামীর কাছ থেকে তালাক নিয়ে বেরিয়ে আসতে চান। অত্যাচারী স্বামীর সঙ্গে জীবন কাটানোর রুচি তাঁর নেই। কিন্তু স্বামী তালাক দেবেন না। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যে স্বামীর বাড়ি তাঁর বাড়ির থেকে অনেকটাই উপরে। তাই বাবা-মাও তালাক নিতে দেবেন না। মেয়েদের নাকি সব মুখ বুজে সয়ে নিতে হয়। উপদেশ দিলেন অভিভাবকগণ। কোন মৌলবির কাছে আবেদন জানিয়ে স্বামীর মুখ থেকে তালাক বলিয়ে নিতে চাইছিলেন তিনি। তাও সম্ভব হয়নি। তালাক চাওয়ার অনেক কারণ মেয়েদের দর্শাতে হয়। তিনি নজরবন্দী অবস্থান থেকে বেরিয়ে এলেন প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কমিশনের সহযোগিতা কিছুটা রক্ষাকবচ হলো তাঁর। ২০১৮- সাল। ততদিনে তাৎক্ষণিক তিন তালাককে অবৈধ রায় ঘোষণা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। ঝাড়খণ্ড থেকে ফোন এল। ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস এক মেয়ে। স্বামী চিঠিতে তালাক দিয়েছে। তাঁদের বনিবনাত হচ্ছিল না। ফলে তালাক নিতে তাঁর আপত্তি নেই। কিন্তু গণ্ডগোলটা অন্য জায়গায়। তাই পরামর্শ দরকার। তাঁর গ্রাম ফতোয়া দিয়েছে, এই তালাক হয়নি। অন্য কোথাও আবার বিয়ে করতে চাইলে নিয়ম মেনে আগে তালাক নিতে হবে। স্বামী বলেছেন আর নিয়ম মানতে পারবেন না। যেভাবে তালাক দিয়েছেন সেটাই বিবাহ বিচ্ছেদ বলে মানতে হবে। স্বামী জানিয়েছেন তিনি আবার বিয়ে করছেন। তালাক হওয়া না হওয়ার ওপর মুসলিম পুরুষের বিয়ে আটকাবে না। স্বামীর গ্রামের মৌলবিও ফতোয়া দিলেন, চিঠিতে দিলেও তালাক হয়েছে। দুই গ্রামের দুরকম মত। কিন্তু নিজের গ্রামের কথা মেনেই কাজ করতে হবে। তাই মেয়ের বাড়ি টাকা খরচ করে কোন এক রাজনৈতিক দলের লোকজনের সাহায্য নিয়ে ছেলেকে বাধ্য করলেন মেয়ের গ্রামের ফতোয়া মতো তালাক দেওয়াতে। এরপর নাকি মুক্তি (বিচ্ছেদ) পেলেন সেই মেয়ে। বিবাহ-বিচ্ছেদ নেওয়ার ক্ষেত্রে মুসলিম নারী-পুরুষের যে সমান অধিকার নেই তা স্পষ্ট এই ঘটনা দুটিতে। তালাক বিল নাকি সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করল। কীভাবে ?
তাৎক্ষণিক তিন তালাক তো শুধু মেয়েদেরই সমস্যা নয়। অনেক সময় দেখা গেছে রাগের মুহূর্তে তালাক বলে ফেলা কোন স্বামী ও মানতে বাধ্য হওয়া স্ত্রী উভয়েই সমস্যায় পড়ছেন। এটা আর তখন রাগারাগি মুহূর্তের শব্দ থাকে না। ঝগড়া থেমে গেলেও তাঁদের জীবন এক ছাঁদের তলায় রাখার অনুমতি হারায়। নিকাহ হালালার মতো পাশবিক নিয়ম পালনের মধ্য দিয়ে মেয়েটিকে পূর্ব স্বামীর জন্য শুদ্ধ করা হয়। তাৎক্ষণিক তিন তালাক অবৈধ এই রায়কে তাই দেশের অধিকাংশ মানুষ স্বাগত জানিয়েছিলেন। মুসলিম তালাক বিলও তাৎক্ষণিক তিন তালাককে অকার্যকর বলছে। কিন্তু জটিল করে তুলেছে একে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। স্বামীর তিন বছর পর্যন্ত জেল, জরিমানা হলো। তারপর? তালাক তো হলো না। স্বামী জেল থেকে বেরিয়ে আর একটা বিয়ে করলে? স্ত্রী কিন্তু আর বিয়ে করতে পারবে না বৈধ তালাক না পাওয়া পর্যন্ত। সেই স্বামীকেই বলতে হবে তালাককে বৈধ করার জন্য। অথবা একসঙ্গে থাকতে চাইলে ধর্ম গুরুরা যদি ফতোয়া দেন নিকাহ হালালা পালন করার? তখন? কী অধিকার হাতে পেল মুসলিম মেয়েরা? মুসলিম পুরুষদের অবস্থানই বা কী হলো? যে তালাক বৈধ নয় তা তো মানার প্রশ্নই ছিল না। তবু ঘর ছাড়া করতে চাইলে গার্হস্থ্য হিংসা আইনের সাহায্য নেওয়া যেত। মুসলিম পুরুষকে জেলে পাঠানোর উদ্দেশ্যেই কি ফৌজদারি আইন? কারাগারে বন্দী স্বামী যদি খোরপোষ দিতে অপারগ হয়? শ্বশুর বাড়ির যদি সমর্থ না থাকে অথবা তাড়িয়ে দেয়? ম্যাজিস্ট্রেট খোরপোষ নির্ধারণ করবেন কিন্তু আদায় কার কাছ থেকে হবে? সরকার দেবে কি? স্ত্রীর যদি রোজগার না থাকে? তখন সন্তানসমেত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন? তালাক বিল স্পষ্ট করেনি পরিবারের জীবনধারণের বিষয়টি।
গেরুয়া শক্তি লাভ জিহাদের নামে মুসলিম পুরুষ নিধনের সুযোগ খোঁজে, গোরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগে মুসলিম হত্যা করে, ভারত মাতাকে ভালবাসে কিনা তা বুক চিরে দেখে, নাগরিকপঞ্জির নামে মুসলিম বিতাড়িত হবে ভেবে খুশি হয়। মুসলিম পরিবারগুলির উপার্জনের পথ বন্ধ করে পরিবার ধ্বংসের কৌশলেই কি এসব খুন? সেই সারিতেই তাহলে তালাক দেওয়ার অজুহাতে কারাবাসের ব্যবস্থা? মুসলিম পিতৃতন্ত্রের অবসান চেয়ে আন্দোলন, লিঙ্গ সাম্যের দাবিতে আন্দোলন, তারমানে কিন্তু পুরুষদের জেলে পাঠানো নয়। সন্তানদের নিয়ে পথে দাঁড়ানো নয়। পরিবার রক্ষার জন্য তালাক বন্ধের আইন করা। যেমন সই-সাবুদে বিয়ে তেমন সই-সাবুদে বিচ্ছেদ। বিজেপি সরকার মেয়েদের অধিকারের পথে একচুলও এগোয়নি। মুসলিম মেয়েদের সুরক্ষার কথা প্রচারে রেখে, প্রতিহিংসাপরায়ণ ভাবনা আর মৌলবাদী ধারণা দিয়ে তৈরি করেছে মুসলিম তালাক বিল।
কিছু মানুষ উচ্ছ্বাস করছেন, তিনশো সত্তর উঠে যাওয়ায় কাশ্মীরিরাও বাঁচল বলে। তাৎক্ষণিক তিন তালাক থেকে কাশ্মীরের মেয়েরা মুক্তি পাবে। তিন তালাকের চেয়ে বড় বিপদ নাকি মুসলিম মেয়েদের নেই। ফলে কাশ্মীরি মেয়েদেরও নেই। ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯১ কাশ্মীরের কুপওয়ারা জেলার কোনান, পোসপোরা গ্রামে ভারতীয় নিরাপত্তা রক্ষী গণ ধর্ষণ চালিয়েছিল। সেটা বুঝি মেয়েদের বিপদ নয়? হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খাট্টা বা মোজাফফরনগরের বিজেপি বিধায়ক বিক্রম সাইনির, বিয়ের জন্য কাশ্মীরি মেয়ে নিয়ে আসতে পারবেন বলা এবং তারপরই গুগলে ‘কাশ্মীরি গার্ল’ ও ‘ম্যারি কাশ্মীরি গার্ল’ সার্চ করা মেয়েদের অসম্মান বা সমস্যা নয়?
এরপরেও তিন তালাক রদ মুসলিম মেয়েদের মুক্তির স্বাধীনতা বলবো না তলিয়ে ভাববো? মুসলিম মেয়েদের মূল দাবি, সম-অধিকারের দাবি কিন্তু আড়াল হয়ে যাচ্ছে গেরুয়া সরকারের কৌশলে। সজাগ আন্দোলন তাই জরুরি।
সৌজন্য অনীক।
কভার ইমেজ : সাউথ কলকাতা সোসাইটি ফর এমপাওয়ারমেন্ট অফ উইমেন-এর পদযাত্রা।
0 Comments
Post Comment