বিবাহিত নারী (২৩)

  • 22 March, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 395 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
এমন মহিলারাও আছেন--যাঁদেরকে আমরা ‘ইউরোপীয় ম্যান্টিস’-এর সঙ্গে এক করে দেখি--তাঁরা দিনের বেলার মতো রাতেও জিততে চান। পুরুষের আলিঙ্গনে তাঁরা শীতল, কথোপকথনের সময় অবমাননাকর, আচরণ-ব্যবহারে অত্যাচারী। মাবেল ডজ-এর সাক্ষ্য অনুযায়ী : লরেন্সের সঙ্গে এমনটাই ব্যবহার করেছিলেন ফ্রিডা। লরেন্সের বৌদ্ধিক শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করতে না-পেরে পৃথিবী সম্পর্কিত তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি লরেন্সের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার দাবি করেছিলেন ফ্রিডা, যে-পৃথিবীতে কেবল যৌন মূল্যবোধকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়।

হয় স্বামীর বাহুতে তিনি শক্ত হয়ে যান এবং নিজের কামোত্তেজনাহীনতার অপমান স্বামীর ওপর চাপিয়ে দেন, অথবা নিজেকে তিনি খামখেয়ালী এবং ছলাকলাপূর্ণ ব্যক্তি হিসাবে উপস্থাপিত করেন। স্বামীই মিনতি করছেন--এমন একটা মনোভাব স্বামীর ওপর তিনি চাপিয়ে দেন। তিনি ফ্লার্ট করেন, স্বামীকে ঈর্ষান্বিত করে তোলেন, স্বামীকে প্রতারণা করেন। একভাবে না-হলে অন্যভাবে চেষ্টা করেন স্বামীর পৌরুষত্বেই স্বামীকে অপমান করার। স্ত্রীর সতর্কতা যদি তাঁকে বাধা দেয় স্বামীকে চূড়ান্তভাবে ঠেলে সরিয়ে দিতে, তাহলে অন্তত গর্বের সঙ্গে নিজের হৃদয়ের মধ্যে বন্ধ করে রাখেন তাঁর উদ্ধত শীতলতার রহস্য। এই রহস্যকে কখনো-সখনো তিনি নিজের ডায়ারির মধ্যে গোপন করে রাখেন,  আরও সহর্ষে বন্ধুদের মধ্যে বিতরণ করেন : অনেক বিবাহিত মহিলাই একে-অপরের কাছে সেই ‘কৌশলগুলি’ কবুল করে আনন্দ পান, যেগুলি তাঁরা ব্যবহার করেন এমন এক আনন্দের ছলনার জন্য যা তাঁরা অনুভব করেননি বলে দাবি করেন। আর নিজেদের নির্বোধ স্বামীদের নিরর্থক সরলতায় হিংস্রভাবে হাসাহাসি করেন। এই আত্মবিশ্বাসগুলি সম্ভবত খেলার অন্য একটি রূপ : কামোত্তেজনাহীনতা এবং ইচ্ছাপূর্বক কামোত্তেজনাহীনতার মধ্যে সীমারেখা অনিশ্চিত।

এমন মহিলারাও আছেন--যাঁদেরকে আমরা ‘ইউরোপীয় ম্যান্টিস’-এর সঙ্গে এক করে দেখি--তাঁরা দিনের বেলার মতো রাতেও জিততে চান। পুরুষের আলিঙ্গনে তাঁরা শীতল, কথোপকথনের সময় অবমাননাকর, আচরণ-ব্যবহারে অত্যাচারী। মাবেল ডজ-এর সাক্ষ্য অনুযায়ী : লরেন্সের সঙ্গে এমনটাই ব্যবহার করেছিলেন ফ্রিডা। লরেন্সের বৌদ্ধিক শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করতে না-পেরে পৃথিবী সম্পর্কিত তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি লরেন্সের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার দাবি করেছিলেন ফ্রিডা, যে-পৃথিবীতে কেবল যৌন মূল্যবোধকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়।

তাঁকে (লরেন্সকে) অবশ্যই তাঁর (ফ্রিডা) মাধ্যমেই জীবনকে দেখতে হয়েছিল এবং যৌনতার দৃষ্টিকোণ থেকেই তাঁকে (ফ্রিডা) জীবনকে দেখতে হয়েছিল। এই যৌনতার দৃষ্টিকোণ থেকেই জীবনকে গ্রহণ বা নিন্দা করার জায়গায় নিজেকে স্থাপন করেছিলেন তিনি (ফ্রিডা)।

মাবেল ডজ-এর কাছে তিনি একদিন ঘোষণা করলেন :

“তাঁকে (লরেন্স) আমার কাছ থেকেই সব কিছু গ্রহণ করতে হবে। আমি (ফ্রিডা) যতক্ষণ না থাকি, ততক্ষণ তিনি কিছুই অনুভব করেন না। কিছুই না। আমার কাছ থেকেই তিনি তাঁর বইগুলি পান”, বাহ্য-অহংকারের সঙ্গে বলে চললেন ফ্রিডা। কেউ জানেন না যে, আমি তাঁর জন্য তাঁর বইয়ের পুরো পাতা তৈরি করেছি।

যাই হোক, তিনি (ফ্রিডা) অবিরাম প্রবলভাবে নিজের কাছে প্রমাণ করতে চান যে, তাঁর থেকে এই প্রয়োজনগুলি আছে লরেন্সের। তিনি চান লরেন্স নিরন্তর তাঁর যত্ন নিক। এই কাজ লরেন্স যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে না করেন, তাহলে তিনি (ফ্রিডা) তাঁকে (লরেন্স) সেই কাজ করার জন্য জোর করেন :

অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে লরেন্সের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে ফ্রিডা সেই শান্তিতে গড়ে উঠতে না-দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন--যা সাধারণত বিবাহিত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত থাকে। যে-মুহূর্তে ফ্রিডা উপলব্ধি করেন যে, অভ্যাসের মধ্যে লরেন্স ঝিমোচ্ছেন, তখনই ফ্রিডা লরেন্সের উদ্দেশে বোমা ছোঁড়েন। ফ্রিডা নিশ্চিত করেছিলেন লরেন্স যাতে কখনোই তাঁকে ভুলে না যান। আমি যখন তাঁদের দেখেছিলাম, তখন এই চিরায়ত মনোযোগের প্রয়োজন হয়ে উঠেছিল একটি অস্ত্র যা একজন তাঁর শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন। দিনের বেলা লরেন্স যদি ফ্রিডার দিকে মনোযোগ না দিতেন, সন্ধ্যায় ফ্রিডা তাহলে তাঁকে অপমান করতেন। 

বিবাহিত জীবন তাঁদের মধ্যে হয়ে উঠেছিল একই দৃশ্যের অগুণতি পুনরাবৃত্তির সিরিজ যেখানে কেউই হার মানতে চাননি। নিজেদের মধ্যে সামান্যতম বিরোধকেও তাঁরা পুরুষ এবং মহিলার মধ্যবর্তী বিপুল দ্বন্দ্বের চেহারা দান করেছিলেন।

ভীষণ অন্যরকমভাবে হলেও, জুয়ানদোর বর্ণনা অনুসারে এলিসের মধ্যেও একইভাবে খুঁজে পাওয়া যায় নিয়ন্ত্রণের বন্য আকাঙ্ক্ষা--যা তাঁকে পরিচালিত করেছিল তাঁর স্বামীকে যতটা সম্ভব নীচু করতে :

এলিস : শুরু থেকেই আমার চারপাশের সমস্ত কিছুকে আমি ছোটো করে এসেছি। তারপর থেকে আমি শান্তিতে আছি। আমাকে কেবল বনমানুষ আর কুৎসিতদের মোকাবিলা করতে হবে।

ঘুম থেকে জেগে উঠে তিনি (স্ত্রী) আমাকে ডাকলেন :

--আমার কুচ্ছিত। (এটা সম্ভাষণ)

এটা একটা কূটনীতি।

তিনি চান আমাকে অপমান করতে।

নিজের সম্পর্কে আমার সমস্ত মায়া বা বিভ্রমকে একের পর এক ত্যাগ করতে তিনি বাধ্য করেছিলেন অকপট প্রফুল্লতার সঙ্গে। বিস্মিত বন্ধুবান্ধব বা হতচকিত ভৃত্যদের সামনে আমি এইরকম বা ওইরকম দুর্ভাগা বস্তু--এরকম বলার সুযোগ তিনি কখনোই হাতছাড়া করেননি। ফলত, শেষ পর্যন্ত আমি তাঁকে বিশ্বাস করতে শুরু করি ... আমাকে অবজ্ঞা করার জন্য তিনি কখনোই এমন একটিও সুযোগ হাতছাড়া করেননি যাতে আমাকে উপলব্ধি করানো যায় যে, নিজের উন্নতির চেয়ে আমার কাজের ব্যাপারে তিনি কম আগ্রহী। 

ধৈর্য সহকারে, ধীরে ধীরে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাকে নিরুৎসাহিত করে, ক্রমশ আমাকে অপমানিত করে, একটি সুনির্দিষ্ট, দুর্ভেদ্য, অদম্য যুক্তি দিয়ে আমাকে আমার অহংকার ত্যাগ করিয়ে আমার চিন্তার উৎস তিনি শুকিয়ে দিয়েছিলেন।

  • “সংক্ষেপে বললে, একজন শ্রমিকের চেয়েও তুমি কম রোজগার করো”, ঘর মোছার লোকের সামনে একদিন তিনি আমাকে বলেছিলেন ...

... আমাকে তিনি নীচু করতে চান যাতে নিজেকে উচ্চতর বা অন্তত আমার সমান হিসাবে প্রতিভাত করতে পারেন। এই অবজ্ঞাই আমার সামনে তাঁকে তাঁর নিজস্ব উচ্চতায় বহাল রাখে ... আমার কাজকে যতটুকু তিনি তাঁর উত্তরণের সোপান বা পণ্যদ্রব্য হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন, ততটুকুই আমার প্রতি তাঁর সম্মান।

পুরুষদের সামনে নিজেদের অপরিহার্য বিষয় হিসাবে তুলে ধরার জন্য ফ্রিডা এবং এলিস এমন একটি কৌশল ব্যবহার করেন যা পুরুষরা প্রায়শই নিন্দা করেছেন : পুরুষদের শ্রেষ্ঠতা বা উৎকর্ষকে তাঁরা অস্বীকার করার চেষ্টা করেছেন। পুরুষেরা স্বেচ্ছায় অনুমান করেন যে, তাঁদের বিরুদ্ধে নারীরা কাস্ট্রেশনের স্বপ্ন উপভোগ করেন। যদিও বাস্তবে, মহিলাদের মনোভাব অস্পষ্ট। পুরুষ লিঙ্গকে দমন করার বদলে মহিলারা বরং চান অপমান করতে। আরও যা সঠিক তা হল--মহিলাটি চান পুরুষকে তাঁর নানান প্রকল্প বা উদ্যোগ, তাঁর ভবিষ্যৎ থেকে ছিন্ন করতে। স্বামী বা সন্তান যখন অসুস্থ বা ক্লান্ত হন, অথবা কেবল শারীরিক উপস্থিতিতে নেমে আসেন, তখন তিনি জিতে যান। যে-বাড়িতে স্ত্রী রাজত্ব করেন, সেই বাড়িতে তাঁরা বাকি সকল জিনিসের মধ্যে আর পাঁচটা জিনিসের অতিরিক্ত কোনো বস্তু হিসাবে আবির্ভুত হন না। গৃহস্থালীর কাজের দক্ষতার সঙ্গে স্ত্রী তখন তাঁদের পরিচালনা করেন। ভাঙা প্লেটকে আঠা দিয়ে জোড়ার মতো করে স্ত্রী তাঁদের বেঁধে রাখেন। যেমন করে পাত্র ঘষেমেজে পরিষ্কার করা হয়, তেমন করে স্ত্রী তাঁদের পরিমার্জনা করেন। কোনো কিছুই তাঁর দেবদূতসুলভ সেই হাতকে সরিয়ে রাখতে পারে না যা খোসা ছাড়ানো এবং বাসনপত্র ধোয়ার বন্ধু। ফ্রিডার কথা বলতে গিয়ে মাবেল ডজকে লরেন্স জানিয়েছিলেন : “আপনি জানেন না, আপনার অসুস্থতার সময় আপনার ওপর সেই মহিলার হাত কেমন লাগে। সেই ভারী হাত, জার্মান মাংসের হাত”। সচেতনভাবেই মহিলাটি সমস্ত ওজন সমেত নিজের হাতটি পুরুষের ওপর রাখেন যাতে পুরুষটিকে তিনি উপলব্ধি করাতে পারেন যে, সেই পুরুষটি কেবল একটি মাংসল অস্তিত্ব ভিন্ন আর কিছুই নন। জুয়ানদো বর্ণিত এলিসের এই মনোভাবকে কেউই আরও দূরে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারেন না :

উদাহরণ স্বরূপ আমার মনে আছে,আমাদের বিয়ের শুরুতে চাং সেন উকুন... এই উকুনের সৌজন্যেই আমি সত্যিই কেবল একজন মহিলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম সেইদিন যেদিন ভেড়ার লোম কাটার মতো করে আমাকে শেভ করার জন্য সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় আমাকে এলিস তাঁর হাঁটুর ওপর রাখেন। একটি মোমবাতি দিয়ে আমার শরীরকে আলোকিত করে তিনি সেই মোমবাতিটিকে আমার শরীরের চারিপাশ ঘুরিয়ে গোপন অঙ্গ পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। ওহ, আমার বগল, আমার বুক, আমার নাভি, তাঁর আঙুলের মধ্যে ড্রামের মতো প্রসারিত আমার অণ্ডকোষের চামড়া, আমার দুই পা এবং পাছার গর্তের চারপাশে রেজারের গমন-পথের মাঝখানে উরু বরাবর তাঁর দীর্ঘ বিরতি : অবশেষে ঝুড়িতে পড়ে-যাওয়া সোনালি চুলের গুচ্ছ, যেখানে উকুনটি লুকিয়ে ছিল। তারপর সেই সোনালি কেশগুচ্ছকে তিনি পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। এক ঝটকায় তিনি আমাকে মুক্ত করেছিলেন। একইসঙ্গে উকুন এবং তাদের গুহা থেকে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছিলেন একটি নতুন নগ্নতা এবং বিচ্ছিন্নতার মরুভূমিতে।

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

ছবি : সংগৃহীত

 

 

 

0 Comments

Post Comment