ঘেরাটোপ (পর্ব-৭)

  • 18 July, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 113 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
 রাজ্য হিসেবে তামিলনাড়ুতে সাক্ষরতার হার আশি শতাংশ। তবুও এমন আয়েঙ্গার-নায়কনের বিভেদ, অথবা উচ্চবর্ণ-দলিত সংঘাত এখনও সেই রাজ্যে রয়ে গিয়েছে সমান তীব্রতায়। সেই তীব্রতা প্রকাশ্যে উন্মোচিত হয় না সবসময়। কিন্তু পরোক্ষে, গোপনীয়তায় – কাট্টুনায়কনদের মতো একেকটি জনগোষ্ঠীর তরফে, আয়েঙ্গার অথবা আরও কোনও উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোটাও যে চূড়ান্ত স্পর্ধার বদভ্যাস বলে বিবেচিত হয়, তা রাজীব অথবা সুস্মিতাশ্রী, কারোরই অজানা নয়। (ধারাবাহিক রচনা, পর্ব ৭)

এর আগে বোম্মাই যে কখনও এভাবে স্কুটির পিছনে চাপেনি এমনটা নয়। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই যেমন সব অভিজ্ঞতা হচ্ছে, সেই প্রসঙ্গে তার ভয় বা আতঙ্ক আসাটাও মোটেও অস্বাভাবিক নয়। ওদিকে কার্থিকও আসেনি আজ। ছোট্ট সেই নীলরঙ স্কুটির পিছনে প্রাপ্তবয়স্ক তিনজন যে কোনওভাবেই চেপে বসতে পারে না (বসলে পরে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা প্রবল), কার্থিক তাই গ্রামেই থেকে গিয়েছে। বিপরীতে একলাটি বোম্মাইচরণই আজ চালাকচতুর রাজীব মুরুগানের পিছনে নীলরঙ স্কুটিতে সওয়ার। তিন সপ্তাহ হতে চলল। পূর্ণিমা বাড়ি ফেরেনি।

ছুটতে ছুটতে কোনওমতে বাস জোগাড় করে সেদিন বোম্মাই আর কার্থিক মিডওয়ের পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে পৌঁছতে পেরেছিল। পূর্ণিমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ শুনে প্রথমেই তো বোম্মাই-কার্থিকের চোখ কপালে উঠবার জোগাড়। পরে অবশ্য প্রধান অভিযোগকারিণীকে দেখতে পেতেই সন্দেহের নিরসন হয়েছিল, যদিও পূর্ণিমার ছাড়া পাওয়ার কোনও ব্যবস্থা হয়নি। সামান্য ৫০০ টাকা চুরির অভিযোগে সেদিন বোম্মাইয়ের ঘরের বউ পূর্ণিমাকে পুলিশ লকআপে রাখার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। পরদিন ছিল আদালতে তোলার দিন।

সামান্য আধারের ঠিকানার মারপ্যাঁচ নিয়ে পুলিশ যে এতটাও নিষ্ঠুর  হয়ে উঠবে তা ওরা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। বৃদ্ধ যে আইনজীবী ভদ্রলোক পূর্ণিমার হয়ে কমপয়সায় মামলা লড়তে রাজি হয়েছিলেন তিনিও সমস্ত দেখে অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও ছাপোষা লোক। পুলিশি সওয়ালের সামনে তাঁকেও কেমন যেন ম্রিয়মাণ লাগছিল। শুনানির প্রথম দিন আধার বা অন্য কোনও সচিত্র পরিচয়পত্র না থাকার কারণে পূর্ণিমার জামিন বাতিল হয়ে যায়। সাতদিন পর দ্বিতীয় শুনানিতে কাগজ জমা পড়লেও তদন্তের কারণ দেখিয়ে পুলিশ জামিন আটকিয়ে রাখে। আরও চৌদ্দদিন পর জমা পড়া আধারের প্রতিলিপি দেখিয়ে পুলিশ দাবি করে পূর্ণিমা ইচ্ছে করে পুলিশি হেফাজতে ভুল ঠিকানা বলেছে। কারণ জমা পড়া আধারের ঠিকানার সঙ্গে পূর্ণিমার বয়ানের ঠিকানা মিলছে না। তদন্তকে ভুল পথে পরিচালিত করা, নাকি এমনই কিসের যেন কারণ দেখিয়ে আবারও জামিন বাতিল হয়ে যায় পূর্ণিমার। পরবর্তী শুনানির জন্য সময় বাকি এখনও আড়াই মাস। বোম্মাই চোখে অন্ধকার দেখছিল। বিয়ের পর এদিক-সেদিক গড়িমসি করতে করতে পূর্ণিমার আধারের ঠিকানাটা আর পালটিয়ে বোম্মাইয়ের গ্রামের ঠিকানায় নিয়ে আসা হয়নি। তারই মধ্যে এসে পড়েছিল প্যাণ্ডেমিক। কাকেই বা বিশ্বাস করে বোম্মাই ধরবে অনলাইনে আধারের ঠিকানা পালটানোর জন্য? নয়তো আবার মহকুমা শহরে ছুটতে হয়। এই সব করতে করতেই আর বিষয়টা পালটানো হয়ে ওঠেনি। জিঘাংসা কি মানুষকে এতদূর নিয়ে যেতে পারে? মাথায় হাত দিয়ে কোর্ট-চত্বরেই বসে পড়ে বোম্মাই কেঁদেছিল সেদিন। তখনই রাজীব তাকে দেখতে পায়।

সেই দিনটার কথা বোম্মাইয়ের স্পষ্ট মনে আছে।

আয়েঙ্গারদের বড় মেয়ে পাঁইপাঁই জোরে গাড়ি চালিয়ে হাইওয়ে থেকে গ্রামের ভিতরের পথে ঢুকছিল। যেমনটা সে বেশিরভাগ দিনেই করে থাকে। কিন্তু সেদিনই হিসেবে ভুল হয়ে গিয়েছিল। স্টিয়ারিং অতিরিক্ত ঘুরে যাওয়ায় গাড়িটা গিয়ে সজোরে ধাক্কা মেরেছিল বাসবের মুরগির খোঁয়াড়ে। কপাল এমনই যে ঠিক সেই সময় বাসবের ছোট ছেলে নীলেশও মুরগির ঘরে কাজ করছিল। মুরগির খাঁচা ভেঙে মুরগি তো মরেই ছিল প্রচুর, আবার গাড়ির বনেটে ধাক্কা খেয়ে নীলেশও গিয়ে আছড়ে পড়েছিল খাঁচার দেওয়ালের উপর। বোম্মাই, কার্থিক, রাজাপ্পা থেকে শুরু করে গোটা নায়কন-গ্রাম আওয়াজ পেয়ে ছুটে এসেছিল। তারই সঙ্গে ছুটে এসেছিলেন মাতৃময়ী আশালতা। শিল্পপতি সন্দীপ আয়েঙ্গার ও আশালতা আয়েঙ্গারের মেয়ে পূজা আয়েঙ্গারের গায়ে হাত তুলবে কি তাদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করবে, ছোটলোক নায়কনদের মধ্যে এমন কারও বুকের পাটা ছিল নাকি সেদিন? কিন্তু রক্ত দেখে, অনেকদিনের জমানো অভব্যতার বিরুদ্ধে অবশেষে নায়কনেরাও সেদিন একযোগে ফেটে পড়েছিল। আশালতা বাধ্য হয়েছিলেন নিজের গাড়িতে তুলে নীলেশকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। নায়কনদের একযোগে বিক্ষোভের বিরুদ্ধে তাঁকে রীতিমতো অসহায় মনে হয়েছিল। বোম্মাই, কার্থিকেরা ছিল সকলের সামনে, আর সকলের চেয়ে গলার জোরও বেশি ছিল তাদের। আশালতা কি তাদের মনে রেখেছিলেন? গ্রামের অঘোষিত মালিক হিসেবে আয়েঙ্গারদের প্রায় পাঁচ পুরুষের ধারাবাহিক বসবাস। যে মহাজনের কাছ থেকে সচরাচর চড়া সুদে বোম্মাই টাকা ধার নিয়ে থাকে, অমন একশোটা মহাজনকে নাকি আয়েঙ্গার পরিবার কিনে বাড়ির গোলাম করে রাখতে পারে। এমনটাই তাদের বিষয়ে শোনা যায়। তাই অতি উৎসাহে বোম্মাইও সেদিন বোধহয় একটু বেশিই চেঁচিয়ে ফেলেছিল। তার হাত ধরে টেনে পূর্ণিমা তাকে থামানোর চেষ্টা করলেও বোম্মাইকে থামানো যায়নি। হঠাৎ করে নীচমহলের মানুষ, উপরমহলের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে শুরু করলে, তাকে আটকানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

মিডওয়ের বাসস্ট্যাণ্ডে ঢোকার সময় একেবারে গায়ে-গায়েই ধাক্কা লেগে গিয়েছিল পূর্ণিমার। সে তখনও মেয়েটাকে চিনতে পারেনি। আসলে এর আগে কখনও এমন আধুনিক শহুরে পোষাকে পূজা আয়েঙ্গারকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার। চেন্নাই শহর থেকে তাদের গ্রাম অবধি আসবার পথে মোটামুটি মাঝামাঝি জায়গায় এই একটি ছোট টাউনশিপ। তারই অন্যতম প্রধান এই বাসস্ট্যাণ্ড-চত্বর। এখানকার চালু খাবারের জায়গাগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটিই আবার ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে অল্পবিস্তর বিখ্যাত হয়ে উঠতে পেরেছে। কাজেই গরীব-বড়লোক, এমনকি বাসযাত্রী নয় এমন বিভিন্ন গোত্রের মানুষেরাও সময়ে-অসময়ে এই চত্বরে এসে ভিড় জমায়। এমনকি আসে আয়েঙ্কার-সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ মালকিন পূজার মতো মানুষেরাও। তারা আসে হাত চেটে স্ট্রিটফুড খেতে অথবা শখের ফুড-ভ্লগিং কনটেন্ট তৈরি করতে। পূর্ণিমাও কার্থিকের মোবাইল থেকে এমন বেশ কিছু মজার ভিডিও দেখেছে কয়েকবার। তবুও পূর্ণিমার সেদিন সময় ছিল না পূজাকে চিনে ফেলার। সে কেবল হাতজোড় করে ‘মন্নিকাভুম মেডাম, মন্নিকাভুম’ (দুঃখিত ম্যাডাম, দুঃখিত) বলতে বলতে তাড়াতাড়ি ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু পূর্ণিমাকে চিনে নিতে আয়েঙ্গার কন্যার দেরী হয়নি। অনেকদিন ধরে এই ছোটলোক মেয়ে আর তার ঘিনঘিনে বরটার উপর সে রাগ পুষে রেখেছে। ছোটলোকের বাচ্চারা কিনা আরেকটা ছোটলোক বাচ্চাকে আয়েঙ্গারদের ধবধবে গাড়িতে তুলতে বাধ্য করেছিল! পূজা আয়েঙ্গারকে কিনা পুলিশের ভয় দেখিয়েছিল! হাত মুঠি করে পূজা আয়েঙ্গার। কাঁধ থেকে হাতব্যাগটা চকিতে সে মাটিতে ফেলে দেয়। একবার হালকা চিৎকার করে পূর্ণিমাকে ডাকার চেষ্টা করে। কিন্তু পূর্ণিমা সে ডাক শুনতে পায় না। এমনটাই চাইছিল পূজা আয়েঙ্গার। পিছন থেকে তার ফাইফরমাশ খেটে দেওয়ার চাকর বেলা তড়িঘড়ি এগিয়ে এসে হাতব্যাগটা আবার পূজার হাতে তুলে দেয়। পূজা সরাসরি তার দিকে তাকায়। ম্যাডামের চোখ দেখে বেলার বুকটা ‘কু’ ডেকে ওঠে হঠাৎ।

বিরাট সোফার উপর হাত জড়ো করে বোম্মাই ভয়ে গুটিশুটি মেরে বসেছিল। সুস্মিতাশ্রী তার দিকে তাকান। সুস্মিতাশ্রী পন্নিরসেলভম। তামিলভূমে ইংরেজি কাগজের জগতে সুস্মিতাশ্রীর কাগজ এখনও, অতটা বিখ্যাত না হলেও, সাংবাদিকতার জগতে তাঁর পূর্ব-প্রতিপত্তি রয়েছে। যদিও সেটা সাংবাদিক হিসেবে নয়। মালিকপক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে। সে ইতিহাস পরে কখনও উলটিয়ে দেখা যাবে। আপাতত সুস্মিতাশ্রীর পরিচয়, বছর দুয়েক হল চেন্নাই থেকে চালু হওয়া ইংরেজি কাগজ ‘ভয়েসেস’এর মালিক তথা প্রধান সম্পাদক। রাজীব সেই কাগজেরই অন্যতম সংবাদদাতা, করেসপণ্ডেন্ট। চটপটে উৎসাহী ছেলেটিকে সুস্মিতাশ্রী পছন্দ করেন। মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণজ্ঞাপন ও সাংবাদিকতা বিষয়ে ডিগ্রি রয়েছে তার। মফস্বলের কোর্ট-রিপোর্টার হিসেবে এর আগেও রাজীব ‘ভয়েসেস’এর জন্য একাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্টোরি নিয়ে এসেছে। কাজেই কোনও খবরের গুরুত্ব বোঝার বিষয়ে তার উপর অগাধ ভরসা রয়েছে সুস্মিতার। সেই রাজীবই আজ বোম্মাইকে নিয়ে সটান ‘ভয়েসেস’এর অফিসে চলে এসেছে, এবং অচেনা সেই লোকটিকে এনে হাজির করেছে একেবারে সম্পাদকের চেম্বারেই। অবাক হলেও সমস্তটা শুনতে শুনতে সুস্মিতাশ্রী পুরো বিষয়টার গুরুত্ব নির্ধারণের চেষ্টা করেন। কোনও এক ভাবনায় তলিয়ে যান। তিনি রাজীবকে কার্যত হাতে করে তৈরি করতে চেয়েছেন। ‘ভয়েসেস’ গড়ে ওঠার প্রথম দিন থেকেই। রাজীবের চেয়ে বেশি সুস্মিতাশ্রীকে এই কাগজের খুব কম লোকই চেনে বোধহয়। সেই সবকিছুই তাঁর মনে ভিড় করে আসে। আসলে, বিশেষ করে আজকের এই খবরটার গুরুত্বও কেবল একদিক থেকে নয়। কেবল সামাজিক শোষণ বা অর্থের প্রবল ক্ষমতা – সেই দিকগুলি থেকেও নয়। রাজীবের চোখদুটির দিকে তাকিয়ে সুস্মিতাশ্রী ভাবতে চেষ্টা করেন। রাজীব মাথা নামিয়ে নেয়। সুস্মিতাশ্রী দোটানায় ভোগেন। এই খবরকে আলাদা একেকটি দিক থেকে দেখলেও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে এই রিপোর্ট প্রকাশ করা উচিত। আবার একই সঙ্গে এই খবর, কোথাও গিয়ে কি সুস্মিতার নৈতিক সত্ত্বাকেও ভাবিয়ে তুলতে চায়? সুস্মিতাশ্রীর তরফে এই খবর প্রকাশ করলে তা কি কোথাও গিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণেরও সমতুল হয়ে দাঁড়াবে? সুস্মিতাশ্রী ভেবে উঠতে পারেন না। তাঁর আবারও বোম্মাইয়ের উপর চোখ পড়ে। অসহায়, গভীর দুটি চোখ। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।

রাজ্য হিসেবে তামিলনাড়ুতে সাক্ষরতার হার আশি শতাংশ। তবুও এমন আয়েঙ্গার-নায়কনের বিভেদ, অথবা উচ্চবর্ণ-দলিত সংঘাত এখনও সেই রাজ্যে রয়ে গিয়েছে সমান তীব্রতায়। সেই তীব্রতা প্রকাশ্যে উন্মোচিত হয় না সবসময়। কিন্তু পরোক্ষে, গোপনীয়তায় – কাট্টুনায়কনদের মতো একেকটি জনগোষ্ঠীর তরফে, আয়েঙ্গার অথবা আরও কোনও উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোটাও যে চূড়ান্ত স্পর্ধার বদভ্যাস বলে বিবেচিত হয়, তা রাজীব অথবা সুস্মিতাশ্রী, কারোরই অজানা নয়। এদিকে বোম্মাই বাড়ি ফিরে গিয়েছে। রাজীব নিজে তাকে ফেরবার বাসে তুলে দিয়ে এসেছে। ‘ভয়েসেস’এর অফিসে এখন সুস্মিতাশ্রীর মুখোমুখি রাজীব।

-“কিছু ভাবছেন ম্যাডাম?” নীরবতা কাটাতে রাজীবই প্রথম জিজ্ঞেস করে।
-“ভাবছি এর আগে তো কখনও এমন স্টোরি সাবজেক্ট নিয়ে সরাসরি আমার ঘরে এসে উপস্থিত হওনি, হঠাৎ কি এমন হল যে একেবারে দোর ভেঙে ঢুকে এসে ঝাঁপি খুলে বসলে?” ঈষৎ হেসে কপটতার সঙ্গে সুস্মিতা পালটা প্রশ্ন করেন। রাজীব তার ম্যাডামের দিকে তাকায়।

-“সেকথা কি আর আলাদা করে আপনাকে বলে দিতে হবে ম্যাডাম?” মাথা নামিয়ে নেয় রাজীব।
সুস্মিতাশ্রী বন্ধ জানালার দিকে তাকান। ঘরে এসি চলছে। কোনও আওয়াজ নেই।

-“স্টোরিটা আমরা করব রাজীব,” খানিক পর সুস্মিতাশ্রীর জবাব পাওয়া যায়, “স্টোরিটা করা দরকার। হয়তো,” তিনি একটু থামেন, “হয়তো এর মাধ্যমেই আমরা একাধিক কালো মুখোশ টেনে ছিঁড়ে ফেলতে পারব।”

রাজীব উঠে দাঁড়ায়। মাথা নেড়ে বলে, “ঠিক এই কারণেই আমি সরাসরি আপনার কাছে ছুটে এসেছিলাম।” হাত তোলেন সুস্মিতা,

“একটা নয়। দিস উইল বি এ সিরিয়ল পিস। কয়েকটা পর্বে সাজাও। বোম্মাইয়ের ঘটনাটা একটা উদাহরণ মাত্র। এর মাধ্যমে অর্থবল এবং জাতি, দুই দিক থেকেই আমাদের রাজ্যের সামাজিক বৈষম্য যে এখনও কতখানি প্রকট, গোটাগুটি সেই বিষয়টাকে আমরা পরপর কয়েকটা পর্বে তুলে ধরতে চেষ্টা করব। দুম করে লিখতে শুরু কোরো না। ডু এ বিট অব রিসার্চ ফার্স্ট,” সুস্মিতাশ্রী পন্নিরসেলভম কৌশল সাজাতে থাকেন, “আর হ্যাঁ, বোম্মাইকে জানিয়ে দাও পূর্ণিমাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য যে লইয়ার ইত্যাদির খরচ – সেসব নিয়ে ওকে আর ভাবতে হবে না। উই উইল টেক কেয়ার অব দ্যাট।” সুস্মিতা শ্বাস ফেলেন। এই লড়াইটা তিনি ভালো ভাবে লড়তে চান।

রাজীব ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সুস্মিতাশ্রী চেম্বারের একমাত্র বন্ধ জানালাটার কাছটিতে এসে দাঁড়ান। নতুন কাগজের অফিস খোলার জন্য চেন্নাই শহরতলির বিরাট এই এ্যাপার্টমেন্টের দোতলার এই সামান্য স্পেস্টুকুই কেবল তাঁরা জোগাড় করতে পেরেছেন। ইচ্ছে আছে আরও দু’এক বছরে আরও একটু জায়গা বাড়িয়ে নেওয়ার। হয়তো আপকামিং এই স্টোরিটার মাধ্যমেই ব্রেক-ইভনে পৌঁছিয়ে যেতে পারবেন। মনে মনে হাসেন সুস্মিতা। সাংবাদিকতার সামাজিক দায়িত্বের পাশাপাশি, ব্যবসায়ের কর্ণধার হিসেবে বাণিজ্যের বিষয়টাকেও যে হারিয়ে ফেললে চলে না, উভয়সংকট এখন তাঁর। তবুও সুস্মিতা গত কয়েক বছরে অনেকখানি পরিণত হয়ে উঠেছেন। ‘ভয়েসেস’এর লক্ষ্য কি হবে, সেই বিষয়টাও সুস্মিতাশ্রীর কাছে এখন অনেকটাই পরিষ্কার। কেবল তাঁর মনের মধ্যে চেনা এক অবয়ব ভেসে ওঠে। হঠাৎ করেই মেয়েটাকে মনে পড়ছে। স্মৃতির দর্পণে সেই মুখটাও যেন ভেসে উঠছে, মুহূর্তের অন্ধকার। এইবারে নামটাও মনে পড়ে গেছে সুস্মিতার। অস্ফূটে তিনি উচ্চারণ করেন,

“সেন, সুবর্ণো সেন!” – ও’এর উপর হালকা জোর পড়ে।

কাঁচের জানালার উপর হাত রাখেন সুস্মিতাশ্রী পন্নিরসেলভম। বেশ কিছু বছর সময় পিছিয়ে যায়।
(চলবে)

আগের পর্বের ঠিকানা – https://nariswattwo.com/welcome/singlepost/the-siege-serialised-novelette-series-six-

লেখক : বিজ্ঞানী, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক 

ছবি : সংগৃহীত  

 

0 Comments

Post Comment